৫৯ বর্ষ ৪২ সংখ্যা / ৩ জুন, ২০২২ / ১৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯
ছাত্রছাত্রীদের টোপ হিসেবে নিয়ে ধ্বংস করতে চাইছে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা
সায়ন ভট্টাচার্য
‘‘যুদ্ধ ও মহামারী একে অপরের গালে চুমু খেতে খেতে আসে সভ্যতার এক একটি শতাব্দীর বুকে।’’ - বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এই অমোঘ লাইনগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। যুদ্ধ সর্বদাই লাগে মগজের ভিতর। একটা প্রজন্মের ধ্বংসের পিছনে থাকে চিন্তার দুটো যুযুধান পক্ষ তৈরি করে দেওয়ার মধ্যে। অনলাইন ও অফলাইন পরীক্ষা নিয়ে সাম্প্রতিক পশ্চিমবাংলায় সবচেয়ে বড়ো যুদ্ধ তরুণ প্রজন্মের কাছে।
২০২০ সাল থেকে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। বিষয়টা নিয়ে জনপরিসরে সবাই যে খুব চিন্তিত তেমনটা নয়। বেশ তো অনলাইনে হচ্ছে সবটাই। আরও বেশি করে অনলাইনের প্রতি আকর্ষণটা তৈরি হলো যখন স্কুল ও কলেজে দেখা গেল মুড়ি মুড়কির মতো বিনা-শ্রমে ভরে উঠছে মার্কশিট।
একটা গরিব দেশে বিকল্প ব্যবস্থা নাকি অনলাইন শিক্ষা! ভাবতেও অবাক লাগে গড়ে কুড়ি শতাংশও ঠিকভাবে এই বিকল্প ব্যবস্থার সুফলের অধিকারী নয়। তবুও আমরা মেনে নিলাম আর নিচ্ছিও - মন থেকে না হলেও এই নির্দেশ অধিকাংশই মেনে নিচ্ছি। আর সরকারকে দোষ নতুন করে দিয়ে লাভ নেই, কারণ কানকাটার কোনো কিছুর শোনার বা বোঝার দায় থাকে না। ভারতের এই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোটি যে পুঁজিপতিদের নির্মাণ করা খাঁচা সেটা আমরা সবাই জানি। আর জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ও লোভ দেখিয়ে একটা মুক্ত হিংস্র খোলাবাজারের পণ্য করে তুলবে শিক্ষাকে সে আর নতুন কোনো কথা নয়। বিভিন্ন শিক্ষার নামে শিক্ষা বিপণনের অ্যাপ হাঙরের মতো গিলে খেতে চাইছে এক একটা ক্লাসরুম, শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক।
শিক্ষার মান ও প্রয়োগ যে অত্যন্ত নিম্নগামী তার জন্য শেষ দশ বছরের দিকে ভালো করে তাকালেই বোঝা যায়। শিক্ষার জন্য বিনিয়োগ করতেই যেন নারাজ সরকার। আসলে তো লাভ দেখে সরকার! শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ নয় সম্পদ তৈরি হবে পুঁজির দিকে চলমান হয়ে। উন্নত শিক্ষার প্রয়োগ, প্রণালী, মাধ্যম কিংবা যন্ত্রাংশ কোনোটাই সর্বসাধারণের জন্য নেই।
২০২২ সালে এসে যখন দেখা যাচ্ছে সামাজিক জীবনযাপন আবার স্বাভাবিক তখন - ছাত্রছাত্রীরা কী চাইছে? সমাজের কাছে রেজাল্টের একটাই উদ্দেশ্য - চাকরি। চাকরি গুরুত্বপূর্ণ অবশ্যই, কিন্তু ক্রীতদাসের মতো রেজাল্টের প্রতি প্রলোভন দেখিয়ে, পরের পর প্রজন্মকে একটা মধ্যবিত্ত বুর্জোয়া শ্রেণির দলদাসকারীরা ভালো কোম্পানির উন্নত শোষিত শ্রমিকে পরিণত করে এক একটা তরুণ প্রজন্মকে বিকৃত করে দিল। তাই মহামারীতে যখন ঝুড়ি ঝুড়ি হরির লুটের মতো নম্বর আসতে শুরু করল, তখন সেই এলিটরাই ভাবতে শুরু করল বেশ তো মোটা নম্বরের মার্কশিট তৈরি হয়ে যাচ্ছে , ফালতু স্কুলে যাওয়ার কী দরকার। পৃথিবীজুড়ে গণতন্ত্রকে হত্যা করতে হলে, তার মূল তো শিক্ষাক্ষেত্রে আঘাত করা, তরুণ প্রজন্মকে বিকলাঙ্গ করে দাও। এই আঘাতের টের আমরা পাবো যখন ভবিষ্যতে একটা বেকার সমস্যা ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে যাবে। সেদিন কিন্তু প্রতিবাদের কণ্ঠটা থাকলেও মুহূর্তটা আর থাকবে না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে অনলাইনে পরীক্ষার জন্য ধর্না, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ঘেরাও - কেন না পরীক্ষায় বই খুলে লিখবে।
আর অপর একটি শ্রেণি কষ্ট করে মোবাইল ফোন কিনতে কুণ্ঠা বোধ করে না কিন্তু প্রতিবাদী হতে গেলে, কণ্ঠস্বর তুলতে গেলে, প্রশ্ন করতে তাদের অসুবিধা হয়ে যায়। কিংবা যে তরুণরা সমাজের জন্য লড়াই করে তাদের উদ্দেশে এই মধ্যবিত্ত সমাজই বলে - “এই অসভ্য ছেলেমেয়েগুলো কলেজ ইউনিভার্সিটিতে কী শুধু রাজনীতি করতেই আসে!” কিংবা “বাড়িতে মনে হয় কোনো শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপার নেই”। বৃহৎ পুঁজি অনায়াসে এ ধরনের মানসিকতার সাহায্যেই নিজের ব্যবসার পথকে রাজপথে পরিণত করে। আর সেখান থেকেই তাদের কাছে তৈরি করার খুব দরকার হয় শিক্ষার অ্যাপ। অ্যাপের মধ্যে দিয়ে যদি একদিন ভবিষ্যৎ বাংলা কিংবা ভারত শিক্ষিত হয় (বলে দাবি করে) তাহলে খুব অবাক হবো না। কারণ চেতনার যে স্তরে নাগরিক সমাজের স্বার্থপর মন কাজ করছে সেখানে নিজেরটা গুছিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা, একটা শ্রেণির থেকে অপর একটা শ্রেণির মধ্যে সামাজিক দূরত্ব তৈরি করেই দিচ্ছে।
শিক্ষা একটি অন্তহীন চলমান প্রক্রিয়া। শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে দুটি দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ করা যায়। প্রথমত, ব্যক্তির দেহমনের উন্নয়ন, ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যবাদের বিকাশ, কোনো না কোনো পেশায় নিয়োজিত হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ একইসঙ্গে ব্যক্তির আত্মপরিচয়ের ভিত্তি রচনা করা। দ্বিতীয়ত, ভালো নাগরিক হিসেবে ব্যক্তিকে গড়ে তোলা যাতে সে নিশ্চিতভাবে সমাজের কাজে আসে, উৎপাদনক্ষম মানুষ হিসেবে সমাজের উন্নয়নে অংশ নিতে পারে। সেজন্য তাকে পর্যাপ্ত জ্ঞান দান, সেইসাথে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধে উদ্দীপ্ত করা। দুটো দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূরক এবং দু’য়ের যোগফলের নামই প্রকৃত শিক্ষা। যার মর্মকথা শিক্ষার মূল্যবোধের বিকাশ। শিক্ষালাভের পর যদি কেউ ন্যায়-অন্যায়,ভালো-মন্দের ফারাক না বুঝে, ভালোর পক্ষে অসত্য, কদর্য ও মন্দের প্রতিরোধ করতে না পারে তাহলে সে শিক্ষা সম্পূর্ণটাই বৃথা।
বিষয় কিংবা অবস্থাটা যে সমস্যাজনক তা কিন্তু সবাই বুঝতে পারছে। অথচ ন্যূনতম কয়েকজনের বৈপ্লবিক চিন্তার কথা বাদ দিলে, কেউ কিছুতেই মুখ খুলতে চাইছেন না। সমাজের এই অবস্থাটাকেই বোধহয় সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্ব বলে। আসলে শিক্ষাই যে চেতনা আনবে - আর সে পথ ধরেই আসবে বিপ্লব, এই বৈজ্ঞানিক সূত্র সম্পর্কে অবগত শাসকশ্রেণি। তাই মধ্যবিত্তকে হাতে রেখে, অসচেতন করে রেখে শাসকের শোষণযন্ত্র সর্বদাই চাইবে শিক্ষা যেন বার বার অনলাইনেই চলে আসে। ছাত্রছাত্রীরা শুধুই টোপ মাত্র।