৫৯ বর্ষ ৪২ সংখ্যা / ৩ জুন, ২০২২ / ১৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯
আসামের বিজেপি সরকারের প্রচারের ঢক্কানিনাদ
বাস্তবে উঠে আসছে ব্যর্থতা ও মানুষের দুর্দশার ছবি
সন্দীপ দে
আসামে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সাড়ম্বরে নানা অনুষ্ঠান পালিত হয়েছে। এই অনুষ্ঠানগুলির মধ্য দিয়ে এমন একটা ধারণা তৈরির প্রয়াস চালানো হয়েছে যাতে মনে হবে যেন রাজ্যটি উন্নতির শিখরে পৌঁছে গেছে। অথচ এই সময়কালে বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা, দমনপীড়ন ইত্যাদিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। অথচ সরকারি কোষাগারের বিপুল অর্থ ঢালাও খরচ করে গুয়াহাটিতে সরকারের বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠান হয়েছে। এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তিনিও তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে সরকারি প্রচারের বাগাড়ম্বরের সাথে পাল্লা দিয়ে সুর চড়িয়েছেন। একদিকে যেমন কেন্দ্রের মোদি সরকারের দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে ‘সাফল্যে’র জয়গান গেয়েছেন, তেমনি রাজ্যের বিজেপি সরকারেরও উন্নয়নের কর্মকাণ্ডের সুখ্যাতিতে মুখর হয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাবে এই প্রচার আসলে ভাঁওতা ও মিথ্যার ঢক্কানিনাদ ছাড়া আর কিছুই নয়। লক্ষণীয় বিষয় হলো সরকারের এই নির্লজ্জ মিথ্যাচার ও প্রচারের ঢক্কানিনাদের তালে উপযুক্ত সঙ্গত করেছে রাজ্যের ‘সত্যনিষ্ঠ’ ও ‘বস্তুনিষ্ঠ’ সাংবাদিকতার প্রবক্তা একাংশ সাংবাদিক ও প্রচারমাধ্যম।
আসামে বিজেপি পরিচালিত সরকার আসলে ছয় বছর পূর্ণ করেছে। এর আগের পাঁচ বছর সর্বানন্দ সোনোয়াল নেতৃত্বাধীন জোট সরকার সমস্ত ক্ষেত্রেই ব্যর্থতার নজির রেখেছে। এখন সেই ব্যর্থতাগুলিকে ঢেকে রেখে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সরকারের ‘সাফল্য’ নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়েছে। কিন্তু বিজেপি জোট সরকারের প্রথম পাঁচ বছরের কার্যকালে তাদের আসাম বিরোধী নীতিগুলি প্রকট হয়েছে। সোনোয়াল সরকারের ব্যর্থতাকে আড়াল করতে নানা ছক কষে ডুবন্ত তরীর রক্ষা কর্তা হিমন্ত বিশ্ব শর্মাকে ‘গতিশীল’ নেতা হিসেবে তুলে ধরে ‘উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করা’র দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু বিজেপি শাসনে যদি প্রকৃত অর্থেই রাজ্যের উন্নতি হতো, তাতে কোনো আপত্তির কারণ থাকত না। রাজ্যের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দ্রুত উন্নয়ন এবং আসাম যদি প্রকৃত অর্থেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ‘মেডিক্যাল হাব’-এ পরিণত হতো, রাজ্যটি যদি বিদেশি মুক্ত-অনুপ্রবেশ মুক্ত-সন্ত্রাসবাদ মুক্ত-বন্যা-ভাঙন মুক্ত হতো তাহলে কোনো আপত্তি বা সংশয়ের পরিবর্তে উৎসাহ-উদ্দীপনার জোয়ার বইত। রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীর বাণী অনুযায়ী শিক্ষাক্ষেত্র যদি ‘দীপ্তিমান অসম’ হতো, বেকার সমস্যা নিরসনে উপযুক্ত ও বাস্তব সম্মত পদক্ষেপ নিতে সরকারকে দেখা যেত; অর্থাৎ উন্নয়ন ও বিকাশের সমস্ত দিকে আসাম যদি দেশের মধ্যে সাফল্যের অগ্রণী সারিতে থাকত তাহলে রাজ্যবাসী স্বাভাবিকভাবেই উৎফুল্লিত ও কৃতজ্ঞ থাকত।
কিন্তু সরকারের প্রতিশ্রুতির বন্যা এবং বাস্তবের মধ্যে সীমাহীন পার্থক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কেন্দ্র এবং রাজ্য - দুই সরকারের ক্ষেত্রেই এই কথা প্রযোজ্য। ২০১৬ সালে প্রথম বারের জন্য ক্ষমতায় আসার আগে বিজেপি’র প্রতিশ্রুতি এবং তাদের কাজকর্মের পার্থক্য সামান্য দৃষ্টিতেই ধরা পড়ে। ‘বিদেশি মুক্ত অসম’-এর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক দল বিজেপি সংবিধানকে পুরোপুরি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে অসম চুক্তি লঙ্ঘন করে এবং আসামের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বিপন্ন করে সিএএ আইন প্রণয়ন করে। আসামের জনগণের পাশাপাশি গোটা দেশের গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও এই আইন প্রণয়ন করতে দেখা যায়। এখন এনআরসি উন্নীতকরণের প্রক্রিয়া অর্থহীন করতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছে কেন্দ্র এবং রাজ্যের ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকার। একইভাবে নানা টালবাহানা করে ছয় জনগোষ্ঠীর জনজাতিকরণের দাবিও হিমঘরে পাঠিয়ে প্রবঞ্চনা করা হচ্ছে অর্থনৈতিক-সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীসমূহকে। উল্লেখ করা যেতে পারে, কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় এসেই আসামের ‘বিশেষ রাজ্যে’র মর্যাদা কেড়ে নেয়। জিএসটি প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে আসামের মতো পশ্চাৎপদ রাজ্যগুলিকে আর্থিকভাবে বিপন্ন করে। তৈল ক্ষেত্রগুলিকে নিলামে বিক্রি করা হয়, বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ রাজ্যটির সম্পদ বৃহৎ পুঁজিপতি ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেবার প্রক্রিয়া সুগম করা হয়। এক অর্থে আসাম হয়ে ওঠে পুঁজিপতি তথা কর্পোরেটদের মৃগয়া ক্ষেত্র। কেন্দ্রের সরকার আসামে বন্যা-ভাঙনের সমস্যাকে রাষ্ট্রীয় সমস্যা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়নি, অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আসামে এসে নানা ভিত্তিহীন আবোলতাবোল কথায় রাজ্যটিকে বন্যামুক্ত করবেন বলে সদম্ভে ঘোষণা করে যান।
কিন্তু সোনোয়াল সরকারের সময় থেকেই আসামে শুরু হয় মেরুকরণের লক্ষ্যে নির্মম কৃষক উচ্ছেদ অভিযান। উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে কলুষিত করে আসামের সমাজজীবনকে। বর্তমানের বাক্পটু মুখ্যমন্ত্রী পূর্বতন সোনোয়াল সরকারের সময়কাল থেকে হিন্দু-মুসলমানের মিলন ক্ষেত্র আসামে আবিষ্কার করে ‘সভ্যতার সংকট’। ৬৫ শতাংশ বনাম ৩৫ শতাংশের মধ্যে যুদ্ধ।
সাম্প্রদায়িকতাকে আরও তীব্রতর করতে উদগ্রীব বর্তমানের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে নানা গালভরা বুলি ও প্রতিশ্রুতির বন্যায় আসামকে আবারও ‘শ্রেষ্ঠ রাজ্যে’ পরিণত করার ঘোষণা করেছেন। সরকারি বিজ্ঞাপনগুলিতে ঢালাও প্রচার চলছে তাঁর সরকারের প্রথম বছরে পূর্বের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ১ লক্ষ বেকারের কর্মসংস্থান করেছে। এছাড়াও সরকারি বিজ্ঞাপনে তুলে ধরা হয়েছে বিগত এক বছরের শাসনকালে নাকি রাজ্যে অর্থনৈতিক সুস্থিরতা এসেছে, ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে, কৃষক এবং চা জনগোষ্ঠীর কল্যাণ সাধন হয়েছে, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিপ্লবের সূচনা হয়েছে এবং গতিশীল আসামের নির্মাণ হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এসব নিছক মিথ্যাচার, সহজ সরল আসামবাসীকে ধোঁকা দেবার এক নতুন কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়। এই প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা উচিত যে, নীতি আয়োগ সহ কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সর্বশেষ প্রকাশ করা সূচক অনুযায়ী আসামের গতি পশ্চাৎমুখী হচ্ছে কেন? উন্নয়নের নিরিখে ২৮টি রাজ্যের মধ্যে আসামের স্থান কেন ২৫ নম্বরে? ধর্ষণ, নারী নির্যাতন রাজ্যে কেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে? ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী আসামে আইন শৃঙ্খলার কেন অবনতি হচ্ছে? দারিদ্র্যের বহুমাত্রিক নিরিখে অসমের স্থান কেন নিচের দিকে যাচ্ছে? রাজ্যের স্বাস্থ্যক্ষেত্রের উন্নয়নের ঢাক পেটানো মুখ্যমন্ত্রীর উত্তর দেওয়া উচিত যে, আসামে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার কেন এত অধঃপতন হচ্ছে এবং সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রসমূহে চিকিৎসক-নার্স থেকে শুরু করে চিকিৎসা কর্মী তথা সার্বিক স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর সংকট কেন এত তীব্র হচ্ছে? সরকারি বিদ্যালয়গুলি কেন ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে? কতজন কৃষক প্রতি কুইন্টাল ধান ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ১৯৪০ টাকায় বিক্রি করার সুযোগ পাচ্ছেন? অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি কেন নিশ্চিত হয়নি? এর কোনো উত্তরই মুখ্যমন্ত্রী দিতে পারবেন না। ‘স্মার্ট সিটি’ তো দূরের কথা রাজধানী গুয়াহাটি মহানগরে পানীয় জলের সংকট বছর বছর ধরে জনসাধারণের দুর্ভোগকে বাড়িয়েই চলেছে। অন্যদিকে অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির প্রশ্নেও নির্বিকার এই সরকার।
একদিকে রাজ্য সরকার রাজ্য কোষাগারের বিপুল অর্থ খরচ করে ‘সাফল্যে’র প্রচার করছে, অন্যদিকে বাস্তবে রাজ্যের অন্য চিত্র প্রকট হয়ে উঠছে। সংবাদমাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছে অভাবের তাড়নায় মা তার তিন সন্তানকে বিক্রি করতে গিয়েছিলেন। কোকরাঝাড় জেলার এই ঘটনায় রাজ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তার আগের একটি ঘটনায় জানা যায়, খিদের যন্ত্রণায় পচা কাঠের গায়ে বেড়ে ওঠা মাশরুম খেয়ে ২৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে রাজ্যে। রাজ্যের যখন এমনই অবস্থা তখন গত ২৮ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর সভায় লোক আনার জন্য সরকারি কোষাগার থেকে খরচ করা হয়েছে ৩০ কোটি টাকা। তার দিন পনেরোর মধ্যে আবার অমিত শাহর সভার জন্যও বিপুল অর্থ খরচ করা হয়েছে।
গত ১ বছরে গরিব মানুষের উচ্ছেদ আর পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে মৃত্যুর ঘটনা অন্যান্য বিজেপি শাসিত রাজ্যকেও পিছনে ফেলে দিয়েছে। গত বছরের ১০ মে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন হিমন্ত বিশ্ব শর্মা। ওই দিনই গৌহাটি হাইকোর্ট রাজ্য সরকারকে উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু আদালতের নির্দেশকে উপেক্ষা করে সরকার সাতদিনের মাথায় গরিব মানুষদের উচ্ছেদ অভিযানে নেমে পড়ে। উচ্ছেদের মূল লক্ষ্য ছিল মুসলিম ও বাংলাভাষী মানুষ। দরং জেলার ধল গোরুখুঁটি এলাকায় উচ্ছেদ অভিযানে নেমে হিমন্ত বিশ্ব শর্মার পুলিশ দু’জন গরিব মানুষকে গুলি করে হত্যা করে, গুলিতে আহত হন ২০ জনেরও বেশি মানুষ। এই উচ্ছেদের আগে গরিব মানুষদের গায়ে ‘বাংলাদেশি’ তকমা সেঁটে দেন মুখ্যমন্ত্রী।
এমনকী সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যার মধ্যেই গুয়াহাটি মহানগরীর শিলসাঁকো জলাশয়ের পাশে প্রায় শতাধিক বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানকার বেশির ভাগ মানুষই শ্রমজীবী অংশের।
রাজ্যে সংঘর্ষে মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় খোদ আদালত আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। গুজরাটের বিধায়ক জিগনেশ মেওয়ানিকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তারির ঘটনায় বরপেটা জেলা আদালতের বিচারপতি রাজ্যের পুলিশকে যেভাবে ভর্ৎসনা করেছেন তাতে মুখ পুড়েছে রাজ্য সরকারের। উল্লেখ্য, গত ১ বছরে রাজ্যে ৬০টির বেশি সংঘর্ষে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। হতাহতের মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুর সংখ্যাই বেশি।
এতো গেল একটা দিক। যে কথা আগেই উল্লেখিত হয়েছে, বিজেপি ক্ষমতায় এসেই রাজ্যের সম্পদ ঢালাও বিক্রি শুরু করে দিয়েছে। রাজ্যের অন্যতম সম্পদ তেল থেকে কয়লা খাদান, বিমানবন্দর বিক্রি শুরু করে দিয়েছে, ইতিমধ্যেই রাজ্যের কয়েক হাজার হেক্টর জমি বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দিয়েছে। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর রাজ্যের বিজেপি সরকার গুয়াহাটি রেল স্টেশন সংলগ্ন রেলের ৫৮ বিঘা জমি বিক্রি করে দিয়েছে। এদিকে জমি কেলেঙ্কারিতে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল উঠেছে।
আবার বেকারদের সাথে প্রতারণারও নজির গড়েছে এই সরকার। সরকারি বিজ্ঞাপন দিয়ে ‘নিয়োগ মেলা’র অনুষ্ঠান করে বেকারদের কাছ থেকে কয়েক লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একাধিক বেসরকারি সংস্থা। রাজ্যের চুক্তি ভিত্তিক শিক্ষকদের চাকরি নিয়মিতকরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা কার্যকর করেনি। গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি’র অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল সরকারের প্রথম বছর পূর্ণ হবার আগে ১ লক্ষ বেকারের চাকরি দেবে। এখন মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, চাকরি না হলেও ষাট হাজারের সাক্ষাৎকার হয়েছে।
এছাড়াও নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতি ছিল রাজ্যের ৩০ লক্ষ গরিব মহিলাকে অরুণোদয় প্রকল্পের নামে মাসে তিন হাজার টাকা করে দেবে। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি পালিত হয়নি। বিজেপি বলেছিল, চা শ্রমিকদের মজুরি ৩৫০ টাকা করবে, ক্ষুদ্র দোকানদার ও ফুটপাত ব্যবসায়ীদের কল্যাণে একশো কোটি টাকা খরচ করবে, আশা ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের স্মার্ট ট্যাব দেবে, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের সাইকেল দেবে এবং শিক্ষা বিভাগের খালি পদ শীঘ্রই পূরণ করা হবে। কিন্তু একটি প্রতিশ্রুতিও পালন করেনি হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সরকার।
গত নির্বাচনের আগে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি ছিল বন্যামুক্ত আসাম গড়তে সদিয়া থেকে ধুবড়ি পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের পাশাপাশি অন্যান্য নদীর খনন করা হবে। কিন্তু এক বছর অতিবাহিত হয়ে যাবার পরও সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। উলটে সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত হয়েছে আসাম। রাজ্যের ৩১টি জেলাই প্লাবিত হয়েছে। এই প্রলয়ঙ্কর বন্যার প্রকোপে এপর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৪। বানভাসির সংখ্যা অন্তত ৭ লক্ষ ২০ হাজার। ব্রহ্মপুত্র, বরাক এবং কুশিয়ারা নদীর প্লাবনে এই বিপর্যয় নেমে এসেছে আসামে। নিউ হাফলং রেল স্টেশন একেবারে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। বন্যার জলের তোড়ে একটি ট্রেন পড়ে গেছে, ভেসে গেছে লোহার তৈরি সেতু। ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, গরিব মানুষের ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ৯৩ হাজার ৫৬২.৪০ হেক্টর কৃষি জমি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় ২ হাজার ২৪৮টি গ্রাম জলের তলায়। প্রায় ৭৫ হাজার মানুষ ঘরবাড়ি ভেসে যাওয়ায় ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। ৪ লক্ষাধিক গবাদি পশু বন্যার কবলে পড়েছে বলে সরকারি সূত্রে খবর মিলেছে।
আসামের সাম্প্রতিক বন্যায় যখন এমনই এক ভয়ঙ্কর অবস্থা তখন প্রায় প্রতিদিন মুখ্যমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমে বাণী দিয়েছেন, বন্যা দুর্গতদের জন্য তাঁর সরকার নাকি পর্যাপ্ত ত্রাণ দিচ্ছে। অথচ বাস্তব পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ উলটো। সামান্য ত্রাণের জন্য হাহাকার করেছেন বন্যাদুর্গত মানুষরা। অনেক জায়গায় খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাতে বাধ্য হয়েছেন বন্যার্ত মানুষ। তাঁরা নিরুপায় হয়ে ত্রাণের দাবিতে বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। অনেক জায়গায় স্থানীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকরা বন্যা দুর্গতদের জানিয়েছেন, পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা নেই। এই অবস্থায় কিছু জায়গায় হেলিকপ্টারে ত্রাণ, খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেবার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে সরকার দাবি করেছে কোথাও নাকি ত্রাণের অভাব নেই। মানুষের বিপন্ন অবস্থা নিয়ে এভাবেই প্রতারণা করছে বিজেপি সরকার।
বিগত এক বছরের মধ্যে রাজ্যের ‘উন্নয়ন’ কতটা করেছে বিজেপি সরকার তা রাজ্যবাসী ভালোভাবেই জানেন। তবে তারা এটাও প্রত্যক্ষ করেছেন, উন্নয়নের নামে দুর্নীতি-কেলেঙ্কারিতে অনেক ‘সাফল্য’র নজির রেখেছে এই সরকার। রাজ্যে পুলিশে নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির ঘটনায় গোটা আসাম উত্তাল হয়েছে বেশ কয়েক মাস আগে। এই ঘটনায় পুলিশ প্রশাসনের শীর্ষ আধিকারিকদের সরাসরি যুক্ত থাকার অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। প্রমাণ হয়েছে সরকারের মদত ছাড়া এতবড়ো দুর্নীতি সম্ভব নয়।
সম্প্রতি পিপিই কিট কেনা নিয়ে খোদ মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার বিরুদ্ধে কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে। মহামারীর সময়ে বাইরে থেকে পিপিই কিট কিনে আনার নামে রাজ্যে কেলেঙ্কারি হয়েছে বলে স্বাস্থ্য বিভাগের দেওয়া আরটিআই’র জবাবে সামনে এসেছে। অথচ সরকারের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ করোনা মোকাবিলার জন্য হিমন্ত বিশ্ব শর্মার পিঠ চাপড়ে দিয়েছিলেন।
সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ, দেশে করোনার ভয়াবহ সংক্রমণ শুরু হবার পর ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল গুয়াহাটি বিমান বন্দরে একটি বেসরকারি কার্গো বিমানের সামনে ছবি তুলে তা সোশ্যাল মিডিয়ায় টুইট করে রাজ্যের তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা দাবি করেছিলেন, কোভিড মোকাবিলায় চীন থেকে নাকি ৫০ হাজার পিপিই কিট এনেছে রাজ্য সরকার। তখন শাসকদল ঘনিষ্ঠ সংবাদ মাধ্যমগুলি হিমন্ত বিশ্ব শর্মার ব্যাপক প্রশংসামূলক প্রচারে মত্ত হয়। অবশ্য তখনই জাতীয়স্তরের কয়েকটি সংবাদমাধ্যম প্রশ্ন তোলে যে, করোনা মোকাবিলার দায়িত্ব কেন্দ্রের। কিন্তু একটি রাজ্য সরকার কী করে বিদেশ থেকে পিপিই কিট কিনে আনে?
এই ঘটনার সত্যতা জানতে চেয়ে রাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন সঞ্চালকালয়ের কাছে গত মার্চ মাসে আরটিআই করে ‘দ্য ওয়ার’ ও ‘দ্য ক্রস কারেন্ট’ নামের দু’টি পোর্টাল সংবাদ সংস্থা। গত ২৬ মে তার জবাব আসে। তাতে বলা হয়, ২০২০ সালের ১৮ মার্চ থেকে ২০২২ সালের ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত পিপিই কিট কেনার কোনো তথ্য নেই। হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সোশ্যাল মিডিয়ায় চীন থেকে পিপিই কিট কেনার যে দাবি করেছেন, তা সম্পূর্ণ ভুয়ো। আরটিআই’র জবাব দুই সংবাদ সংস্থাই প্রকাশ করে। এই ঘটনা প্রকশ্যে আসায় মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা কার্যত বেকায়দায় পড়েছেন। এই ঘটনা ধামাচাপা দিতে তড়িঘড়ি মন্ত্রী পীযূষ হাজারিকাকে মাঠে নামালেও তাঁর অসংলগ্ন জবাবে এই দুর্নীতি আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। তিনি সাংবাদিকদের উপর দোষ চাপানোর চেষ্টা চালালেও কেলেঙ্কারি চাপা দিতে পারছেন না। বিরোধীরা এই ঘটনায় সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
আসামের মানুষ তাঁদের জীবনের অভিজ্ঞতায় উপলব্ধি করতে পারছেন বিজেপি সরকারের শাসনে তাঁরা কতটুকু উপকৃত হয়েছেন। এই সামগ্রিক ঘটনাবলির মধ্যদিয়ে বিজেপি শাসনের প্রকৃত স্বরূপ প্রকট হয়ে উঠছে রাজ্যবাসীর কাছে।