E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৪২ সংখ্যা / ৩ জুন, ২০২২ / ১৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯

ত্রিপুরার চিঠি-১

সিআইটিইউ’র ত্রিপুরা ১৫তম রাজ্য সম্মেলন

হার না মানা লড়াইয়ের চেতাবনি

হারাধন দেবনাথ


আগরতলার রাজপথ জুড়ে শ্রমিকদের মিছিল।

২৮ মে সকাল ১১টা। রাজধানী আগরতলায় বিশাল মিছিল লেন্সবন্দি করতে গিয়ে এক চিত্র সাংবাদিক বলছিলেন এতো মানুষ? এতো দেখছি বর্ষার গোমতীর স্রোত! সত্যিই তাই। সিআইটিইউ’র ত্রিপুরা রাজ্য সম্মেলনকে কেন্দ্র করে মিছিল-সমাবেশ-প্রতিনিধি অধিবেশনে বিজেপি’র ফ্যাসিস্তসুলভ আক্রমণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াই এগিয়ে নেয়ার চেতাবনি ঘোষিত হয়েছে।

৪৫ মাসের জোট শাসনে রক্তাক্ত গণতন্ত্র। আক্রান্ত শ্রমজীবী মানুষ। কাজ করিয়ে টাকা না দিয়ে ইটভাটার পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। মজুরি বঞ্চিত শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ায়নি শ্রম দপ্তর। চা বাগানগুলিতে ক্ষুধার আর্তনাদ। পরিবহণ শ্রমিকদের মজুরি একই জায়গায়। রিকশা শ্রমিকদের অর্জিত অধিকার খর্বিত। তাঁত শিল্পীরা পেশা ছাড়ছেন। তাঁতি পাড়ায় শ্মশানের নিস্তব্ধতা। নির্মাণ শ্রমিকদের মজুরি একই জায়গায়। অথচ বাড়ছে দ্রব্যমূল্য। শহরের চৌমুহনিতে শ্রমিকদের দিনভর অপেক্ষা করে বাড়ি ফেরার রোজনামচা নিয়ে ভাবতে নারাজ শাসক। এরকম দমবন্ধকর অবস্থায় অনুষ্ঠিত সিআইটিইউ’র রাজ্য সম্মেলনে নেতৃবৃন্দ উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেনঃ পাড়ায় পাড়ায় পরিবর্তনের জাগরণ তৈরি করুন। বিজেপি’র পোষা ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর হুমকি দু’পায়ে মাড়িয়ে রাস্তায় নামুন। নতুন আবহে লড়াই গড়ুন শাসককে পরাস্ত করতে।

২৮-২৯ মে অনুষ্ঠিত রাজ্য সম্মেলনে ৩৭৫ জন প্রতিনিধি অংশ নেন। সম্মেলনে ১০৩ জনের জেনারেল কাউন্সিল, ৬০ জনের ওয়ার্কিং কমিটি, ২২ জনের সম্পাদকমণ্ডলী গঠিত হয়েছে। সভাপতি হিসেবে মানিক দে, সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শংকর প্রসাদ দত্ত পুনঃনির্বাচিত হয়েছেন।

থামো এবার শাসক

সাবধান। সামনে আর একপাও না। শাসক এবার তোমার থামার পালা। রাজধানী শহর দখল নিয়ে শ্রমজীবী মানুষ শোনাল এই বার্তা। পথচলতি সাধারণ মানুষ থেকে দোকানদার, ব্যবসায়ী সকলেই অপলক চোখে দেখল লাল ঢেউ খেলানো সুনামি। হাতে হাতে উঁচু করে ধরা লালঝান্ডা, ব্যানার, ফেস্টুন। শ্রমজীবী মানুষের বাঁধভাঙা এক একটা স্রোত রাজপথের এক একটি অংশকে ভাসিয়ে দিচ্ছিল মুহূর্তে। মিছিলের অগ্রভাগের দেখা মিলছে। দূর থেকেই সমুদ্র গর্জনের মতো শোনা যাচ্ছে স্লোগান - ত্রিপুরায় বলছে সবাই/ ২৩-এ বামফ্রন্টকে চাই/ এই বিজেপি আর না/। কিন্তু মিছিলের শেষ কোথায়?

পূর্বাভাস মিলছিল। রাজ্যের নানা প্রান্তে লড়াকু মানুষের প্রস্তুতি দেখে। দুপুরে লালঝড় আছড়ে পড়বে শহরের বুকে। সিআইটিইউ’র ১৫ তম রাজ্য সম্মেলনের প্রকাশ্য সমাবেশ স্থল রবীন্দ্র শতবার্ষিকী ভবনের সামনের রাস্তা মিছিলে মিছিলে ভরিয়ে তুলবেন শ্রমজীবী অংশের মানুষ। কার্যত ছাপিয়ে যায় লালঝড়ের সম্ভাব্য সমস্ত অনুমান। মানুষের ভিড় সমাবেশস্থলকে ছোটো করে দেয়। বিজেপি-আইপিএফটি জোট সরকারের ৫০ মাসের শাসনে মনে পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে হাজার হাজার মানুষ পা মেলান মিছিলে। এদিন সকালে রাজ্যের বিভিন্ন রেল স্টেশন থেকেই রচিত হতে থাকে শাসকের হিংস্র আক্রমণ রুখে এগিয়ে চলার স্পর্ধা দেখানো মানুষের ইতিহাস। মানুষের ঐক্যবদ্ধ লড়াই সংগ্রামে আতঙ্কিত বিজেপি নানাপ্রান্তে সমাজবিরোধী লেলিয়ে দিয়েও চিড় ধরাতে পারেনি লড়াকু মানুষের চেতনায়। হাওড়া নদীর দক্ষিণ-প্রান্ত উথাল-পাতাল করে শহরে ঢুকতে থাকেন মানুষ।

সংগঠনের রাজ্য দপ্তরের সামনে সমবেত হয়ে কেন্দ্রীয় মিছিলে পা মেলান শ্রমজীবী মানুষ। মা-বোনেদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। ভুখা পেটের দাবড়ানিই তাদের নামিয়েছে পথের মিছিলে। শ্রমিকদের গ্রস্থিল পেশী সংবলিত হাতগুলি ছিল মুষ্টিবদ্ধভাবে শূন্যে। মিছিলের অগ্রভাগে চিরাচরিত পোশাকে চা শ্রমিক পরিবারের ছোটো ছোটো মেয়েদের নৃত্য সংগ্রামী উদ্দীপনা ছড়িয়ে দেয়। দূর-দূরান্ত থেকে আসা শ্রমজীবী নারীদের কাঁধে ঝুলানো ব্যাগেই ছিল দুপুরের খাবার। চা বাগান শ্রমিক, রেগা শ্রমিক, চালকলে কাজ করা শ্রমিক, রিকশা শ্রমিক, দিনমজুর, পরিবহণ শ্রমিক, কলকারখানার শ্রমিক, দোকান কর্মচারী, পরিচারিকার কাজ করা মা-বোন - কে ছিলেন না মিছিলে। বটতলা ঘুরে প্যারাডাইস চৌমুহনি হয়ে সোজা এগোতে থাকে মিছিল! হাজারো কণ্ঠে স্লোগানে আলোড়িত হয় রাজপথের দু’ধার। মানুষের পদভারে শহরের কম্পন অনুভূত হচ্ছিল দূর থেকেই। লালঝান্ডা হাতে এতো এতো মানুষ গত ৫০ মাসে শেষ কবে পথে নেমেছিলেন,তা নিয়ে আলোচনা ছিল পথচলতি মানুষের মধ্যে। সংগ্রামী আবেগ ছড়ানো রাজধানীর রাজপথের স্লোগান মুখর লালস্রোতকে সংহতি জানান রাস্তার দু’পাশের মানুষ। তাদের চোখে মুখে স্বস্তির ছাপ। দমবন্ধকর পরিস্থিতি থেকে সম্ভাব্য মুক্তির স্বস্তি। বিজেপি’র অপশাসনের বিরুদ্ধে তোলা শ্রমজীবী মা-বোনেদের এক একটি স্লোগান চারপাশে আছড়ে পড়ছিল গোলা থেকে বেরোনো শেলের মতো হয়ে।

জ্বলন্ত ইস্যুতে লড়াইয়ের বার্তা

শ্রমিকদের খুবই জ্বলন্ত ইস্যুতে ইউনিয়নভিত্তিক আন্দোলনে নামুন। ধীরে ধীরে এলাকায় এলাকায় আন্দোলনের বিস্তার ঘটান। নতুন মানুষকে কাছে আনুন। শক্তপোক্ত করুন মতাদর্শগত ভিত্তি। এই আহ্বান সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য, বিধানসভার বিরোধী দলনেতা মানিক সরকারের। সিআইটিইউ’র রাজ্য সম্মেলনের প্রতিনিধি অধিবেশনে। প্রতিনিধিরা এই আহ্বানের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন আলোচনায়।

প্রতিনিধি অধিবেশনে মানিক সরকার ছাড়াও বক্তব্য রাখেন সিআইটিইউ’র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তপন সেন, সভাপতিমণ্ডলীর পক্ষে মানিক দে। সম্মেলনকে অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন জিএমপি’র কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক রাধাচরণ দেববর্মা, টিইসিসি (এইচ বি রোড)-র সাধারণ সম্পাদক স্বপন বল এবং নারীনেত্রী চিনু চৌধুরী। সভাপতিমণ্ডলীতে মানিক দে ছাড়াও ছিলেন তপন চক্রবর্তী, পাঞ্চালী ভট্টাচার্য, হুমায়ুন কবির, পরেশ পাইক ও রবি দেববর্মা। সম্মেলন থেকে ২টি প্রস্তাব ও আগামীদিনে রাজ্যব্যাপী তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে ১০ দফা দাবিসনদ গৃহীত হয়েছে।

যন্ত্রণাকে ক্রোধে পরিণত করুন

সাধারণ মানুষের যন্ত্রণাকে ক্রোধের আকারে প্রতিফলিত করার ক্ষেত্রে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা পালনের প্রয়োজনীয়তার কথা উচ্চারিত হয় সিআইটিইউ’র ১৫ তম রাজ্য সম্মেলনে। প্রতিনিধি অধিবেশনে আলোচনায় অংশ নিয়ে সংগঠনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তপন সেন বলেন, পুঁজিবাদ ও জমিদারতন্ত্র পরিচালিত রাষ্ট্রের চেহারা কী হতে পারে,তা এখন আমাদের সামনে স্পষ্ট। এই ব্যবস্থার পরিবর্তনের তাগিদ জাগাতে হবে মানুষের মধ্যে। এটা শ্রমিকশ্রেণিই করতে পারে।

আগরতলা টাউন হলে অনুষ্ঠিত দু’দিনব্যাপী সম্মেলনে প্রতিনিধিদের আলোচনাতেও উঠে আসে বিজেপি’র শাসনে জীবন-জীবিকায় নেমে আসা বিপর্যয়ের কথা। একদিকে কেন্দ্রীয় নীতিতে জীবন যন্ত্রণা যেমন বাড়ছে, তেমনি রাজ্যেও বিজেপি জোট সরকারের অপশাসন কেড়ে নিচ্ছে শ্রমজীবী অংশের মানুষের সমস্ত সহায় সম্বল। সিআইটিইউ রাজ্য কমিটির সাধারণ সম্পাদক শংকর প্রসাদ দত্তের পেশ করা রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক খসড়া প্রতিবেদনের ওপর আলোচনায় অংশ নেন মোট ২৮ জন প্রতিনিধি।

বিজেপি’র শাসনে দেশের ওষুধ শিল্পের সাথে যুক্ত কর্মীরাও কতোটা অসহায়,তা বলছিলেন সিআরইউ’র প্রতিনিধি। ঘুম থেকে উঠে সাধারণ একটা ই-মেলে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ’রা জানতে পারছেন আর চাকরি নেই। এভাবে ছাঁটাইয়ের ফলে জীবন-জীবিকা বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছে। চরম হতাশায় বহু কর্মী আত্মহত্যা করছেন। সিআরইউ’র প্রতিনিধি জানান, বামপন্থী আন্দোলনের মূলস্রোতে থেকেই পেশা বাঁচাতে লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।

ওএনজিসি কর্মী ইউনিয়নের প্রতিনিধি বলছিলেন, মোদির শাসনে দেশে আর্থিক বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। করপোরেট সংস্থার দালাল হয়ে কাজ করছে বিজেপি সরকার। স্বাধীনতার পর মজবুত ভিতের ওপর দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিল পিএসইউগুলি। সেগুলিকে ইচ্ছে করে দুর্বল করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ৩০০টি সিপিএসইউ-কে ২৪ টি’তে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। স্থায়ী চাকরি বলে কিছু থাকবে না। ওএনজিসি’ কেও ঋণে জর্জরিত করে ফেলা হচ্ছে। রিজার্ভ ক্যাশ শূন্যে নামিয়ে আনা হয়েছে। পেট্টোলিয়ামের উৎপাদন বৃদ্ধির নামে ওএনজিসি’র হাতে থাকা ফিল্ডগুলি বেসরকারি কোম্পানিগুলির হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

শ্রমজীবী নারীদের পক্ষে আলোচনায় অংশ নিয়ে মণিকা দত্ত রায় বলেন, প্রকল্প কর্মীদের অসহনীয়, দুর্দশাগ্রস্ত জীবন কাটছে। অসংগঠিত এই মহিলাদের ঐক্যবদ্ধ করার দায়িত্ব নিতে হবে সিআইটিইউ’কে। মিড-ডে মিল প্রকল্প কর্মীরা মাসে মাত্র ১৫০০ টাকা ভাতা পান। বিজেপি জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর সাড়ে ৪০০ মিড-ডে মিল কর্মীকে ছাঁটাই করে দেওয়া হয়েছে। পথে যতই প্রতিবন্ধকতা থাকুক, এগিয়ে যেতে হবে লালঝান্ডা হাতে।

সংগঠনের বিভিন্ন মহকুমা কমিটির প্রতিনিধিদের কণ্ঠেও হার না মানা প্রত্যয় ধ্বনিত হয়। ২০১৮ সালে সরকার পরিবর্তনের পর বিজেপি’র দখলদার বাহিনীর চোখ পড়ে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের সিআইটিইউ’র অফিসগুলির উপর। কোনো কোনো স্থানে পুড়িয়ে দেওয়া হয় অফিস। লুট করা হয় শ্রমিকদের জমানো সমস্ত অর্থ। পরিবহণ ক্ষেত্রের শ্রমিকদের সবচেয়ে বেশি আক্রমণের নিশানায় পড়তে হয়। কেড়ে নেওয়া হয় গাড়ি, গাড়ির চাবি। রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বহির্রাজ্যে পাড়ি দিতে হয়েছে বহু শ্রমিককে। ধীরে ধীরে চা, রাবার, নির্মাণ প্রতিটি ক্ষেত্রেই আঘাত নেমে আসে। পানিসাগরের প্রতিনিধি বলেছিলেন, দামছড়া ও খেদাছড়া এলাকার পরিবহণ শ্রমিকরা জীবিকার সংকট কাটাতে লঙ্গাই নদীতে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করছেন। আমবাসার প্রতিনিধি বলছিলেন, নেতাদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে শ্রমিক আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিতে শাসকের চক্রান্তের কথা। বিএমএস, বিবেকানন্দ মঞ্চ নামধারী কিছু সংগঠনের উল্লেখ করে প্রতিনিধিরা জানান, শ্রমিকস্বার্থের সাথে ওই সমস্ত সংগঠনের কোনো সম্পর্ক নেই। সিআইটিইউ’র প্রতিই আস্থা ফিরছে শ্রমিকদের। বিজেপি জোট সরকারের নামিয়ে আনা ফ্যাসিস্তসুলভ আক্রমণকে প্রতিহত করেই এগোতে হবে। খাবার সরবরাহসহ বিভিন্ন অনলাইন মার্কেটিং সংস্থায় যুক্ত কর্মীদের মধ্যে সিআইটিইউ’র সংগঠন কীভাবে গড়ে তোলা যায় তারও প্রস্তাব এসেছে প্রতিনিধি আলোচনায়।