E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৪২ সংখ্যা / ৩ জুন, ২০২২ / ১৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯

ত্রিপুরার চিঠি-২

উপনির্বাচনে চ্যালেঞ্জ নিয়ে জনগণকে ভোটদানের ডাক বামফ্রন্টের

সুমন ত্রিপুরা


সুরমা কেন্দ্রের বামফ্রন্ট প্রার্থী অঞ্জন দাসের সমর্থনে মিছিল।

উপনির্বাচন আটকে রাখার চেষ্টা হয়েছিল। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় ২৩ জুন ত্রিপুরার চারটি বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন হচ্ছে। চার কেন্দ্রের মধ্যে তিনটিতে সিপিআই(এম) এবং একটিতে ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী বামফ্রন্টের পক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ইতিমধ্যে চার কেন্দ্রেই বামফ্রন্ট প্রার্থীদের সমর্থনে প্রচার শুরু হয়েছে। বিজেপি’র তিন বিধায়কের পদত্যাগ ও একটি কেন্দ্রে সিপিআই(এম) বিধায়কের মৃত্যুতে মোট চারটি আসন শূন্য হয়েছে। অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির দাবি জানিয়েছে বামফ্রন্ট। কিন্তু পরিবেশ আরও বিষাক্ত করার কাজ শুরু করেছে গেরুয়াবাহিনী। বিজেপি-আইপিএফটি শাসনে আজ পর্যন্ত একটি নির্বাচনও অবাধ হয়নি।

প্রার্থী ঘোষণা করে বিজেপি-আইপিএফটি জোটের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের মানসিকতা নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে ভোট দেওয়ার জন্য নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে আবেদন রেখেছে রাজ্য বামফ্রন্ট কমিটি। ৫০-৫১ মাসের অসহনীয় পরিস্থিতির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে নিজের ভোট নিজে দেওয়ার জন্য সাধারণ মানুষের কাছে আবেদন জানিয়েছে বামফ্রন্ট কমিটি। এছাড়াও সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন জানিয়েছেন বামফ্রন্ট নেতৃত্ব। উপনির্বাচনে বামফ্রন্ট ঐক্যবদ্ধভাবেই লড়াই করছে।

কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার থেকে বিপ্লব কুমার দেবকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বসানো হয়েছে রাজ্যসভার সদস্য ডাঃ মানিক সাহাকে। কিন্তু এতে কী জনগণের ক্ষোভ আড়াল করা যাবে? মুখ্যমন্ত্রী বদল বড়ো বিষয় না। যিনি মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে অপসারিত হয়েছেন তিনি ২০৪৭ সাল পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন বলে নিজে ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু ৬০ মাসের জন্য জনাদেশ নিয়ে সবটা সময় টিকতে পারলেন না।

২০১৮ সালের ৩ মার্চের পর সাব্রুম থেকে ধর্মনগরে ফ্যাসিস্তসুলভ আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছিল। বামপন্থীরা মূলত আক্রান্ত হলেও অন্য রাজনৈতিক দলও রেহাই পায়নি। সিপিআই(এম)’র রাজ্য অফিস থেকে মহকুমা অফিস সবই আক্রান্ত হয়েছে। আক্রান্ত হয়ে শুধু রাজ্যের বাইরে নয়, দেশের বাইরে চলে যেতে হয়েছে অনেককে। রাজ্যজুড়ে সম্পদ লুটপাট থেকে বাড়িঘরে আগুন দেওয়ার অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে।

গ্রাম পাহাড়ে চরম সংকট। কাজ নেই। শ্রমজীবী মানুষের কাজ নেই। শহরে টুয়েপের কাজ নেই। গরিব মানুষ কাজ খাদ্যের জন্য হাহাকার করছেন। মা সন্তান বিক্রি করছেন - অভাবের কারণে এটাও ঘটেছে রাজ্যে।জনগণের কথা বলার অধিকার নেই। সংবিধানে দেওয়া রাজনৈতিক অধিকার নেই। গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত। সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে মানুষের।

এদিকে, উপনির্বাচনেও নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের যেন হুড়োহুড়ি লেগে গেছে প্রশাসনের রাজনৈতিক নীতি নির্ধারকদের মধ্যে। এই দৌড়ে বাদ থাকলেন না মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী! নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করার অভিযোগে মুখ্যমন্ত্রীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করেছে নির্বাচন কমিশন। ত্রিপুরার উপনির্বাচনে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। গত ৩০ মে এনিয়ে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের কাছে অভিযোগপত্র পাঠিয়েছেন সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক জীতেন্দ্র চৌধুরী। অন্যদিকে, আচরণবিধি ভেঙে ফায়ার সার্ভিস দপ্তরের অধিকর্তা আগরতলায় চাকরির টোপে আবেদনপত্র সংগ্রহ করছেন।

৩১ মে গ্রীষ্মের গনগনে রোদে মানুষের স্রোতে ভেসে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন সুরমা কেন্দ্রের বামফ্রন্ট প্রার্থী অঞ্জন দাস। বিজেপি’র সমস্ত হুমকি ও প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করেই সংগ্রামী মেজাজে মানুষ সেদিন রাজপথ প্রকম্পিত করেন। সেই মেজাজকে অভিনন্দন জানিয়ে উপস্থিত জনগণ এবং সুরমা কেন্দ্রের সমস্ত ভোটারের কাছে সিপিআই(এম) রাজ্য কমিটির সম্পাদক জীতেন্দ্র চৌধুরীর বার্তা ছিল - চোয়াল শক্ত করে দাঁড়ান। ত্রিপুরার হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনার রাস্তা আরও প্রশস্ত করুন। গণতন্ত্রের শত্রু বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উপনির্বাচনকে হাতিয়ার করুন। ভোট লুট, ভোটাধিকার হরণের সমস্ত ষড়যন্ত্রকে পরাস্ত করে নিজের ভোট নিজে নির্বিঘ্নে দেবার পরিবেশ তৈরি করুন।

দীর্ঘদিন পর লালঝান্ডার এত বড়ো মিছিল দেখল কমলপুর শহর। বিজেপি একটানা ফ্যাসিস্তসুলভ সন্ত্রাস চালিয়ে, আক্রমণের পর আক্রমণ করে প্রতিবাদী মানুষকে দাবিয়ে রাখতে চাইছে। সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে বল্গাহীন সন্ত্রাস। ৩১ মে রাজপথে নেমে এসে আক্রান্ত মানুষই শিরদাঁড়া টান রেখে, কণ্ঠ উঁচিয়ে শাসককে দিয়েছে হুঁশিয়ারিঃ ‘অনেক সহ্য করেছি অত্যাচার। আর নয়। এখন শাসকের চোখে চোখে রেখে পালটা প্রতিরোধ করার সময়।’

সুরমা বিধানসভা কেন্দ্রের বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা পেশার মানুষ কমলপুর শহরে জড়ো হতে থাকেন ওইদিন সকাল থেকে। সিপিআই(এম) কমলপুর অঞ্চল অফিসের সামনে প্রথমে হয় জমায়েত। এরপর লাল পতাকায় সজ্জিত মিছিল বামফ্রন্ট প্রার্থী অঞ্জন দাসকে নিয়ে রহনা হয় রিটার্নিং অফিসার তথা কমলপুর মহকুমা শাসকের অফিসের দিকে।

শত শত নারী-পুরুষের হাতে হাতে ছিল লাল পতাকা। মাথায় ছিল লাল টুপি। গগনভেদী স্লোগানের সাথে ছিল ব্যান্ডের তাল। উদ্দীপনায় ভরপুর ছিল গোটা মিছিল। পথচলতি মানুষসহ শহরের নাগরিকরাও উৎসাহ নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে ও বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করেন মিছিল। দীর্ঘদিন পর লালঝান্ডার এত বড়ো মিছিল তাদেরও নাড়া দেয়। সাধারণ মানুষের চেহারায় তারই ছাপ ছিল।

বিধানসভা উপনির্বাচনে বামফ্রন্ট প্রার্থীদের নাম ঘোষণা হতেই স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসে পথে নামেন মানুষ। টাউন-বড়দোয়ালী, আগরতলা, সুরমা ও যুবরাজনগর কেন্দ্রের প্রার্থীদের সামনে রেখেই চলছে জোর প্রচার। স্থানে স্থানে হচ্ছে পথসভা। লালঝান্ডার মিছিলে পা মেলাচ্ছেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। স্লোগানে স্লোগানে ছড়িয়ে পড়ছে রাজ্যে মানুষের অধিকার, গণতন্ত্র, শান্তি-সম্প্রীতির পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে বামফ্রন্ট প্রার্থীদের জয়ী করার সংকল্পের কথা।

আগরতলা কেন্দ্রে বামফ্রন্টের সিপিআই(এম) প্রার্থী কৃষ্ণা মজুমদারকে সাথে নিয়ে সাধারণ মানুষ লালঝান্ডার মিছিলে পা মেলান জিবি বাজার এলাকায়। শ্যামলী বাজার-কুমারীটিলা হয়ে ফের জিবি বাজারে গিয়ে শেষ হয় মিছিল। মিছিল হয় অভয়নগর ও ইন্দ্রনগর এলাকাতেও।

টাউন-বড়দোয়ালী কেন্দ্রে মিছিল হয় বামফ্রন্ট মনোনীত ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী রঘুনাথ সরকারের সমর্থনে। সিপিআই(এম) জয়নগর-মেলারমাঠ, দক্ষিণ আগরতলা এবং আগরতলা অঞ্চল এলাকায় মিছিলে মানুষের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো।

যুবরাজনগর কেন্দ্রের সিপিআই(এম) প্রার্থী শৈলেশ চন্দ্র নাথকে জয়ী করার আহ্বানে কৃষ্ণপুর, আনন্দবাজার, হাফলং এলাকায় মিছিল ও পথসভা সংগঠিত হয়। বিভিন্ন সভায় বক্তব্য রাখেন পার্টি নেতা প্রসন্ন ত্রিপুরা, হরকুমার নাথ, অর্জুন নাথ, তিলক দেববর্মা, চিত্ত দেববর্মা, রুপেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী, করুণা নাথ, সুকান্ত নাথ প্রমুখ। এদিকে ধর্মনগর শহরে হয় চারটি কেন্দ্রেই বামফ্রন্ট প্রার্থীদের জয়ী করার আহ্বান জানিয়ে মিছিল। শেষে রতন রায়ের সভাপতিত্বে একটি সভায় বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এম) রাজ্য কমিটির সদস্য দুর্গেশ রায়, বিধায়ক ইসলামউদ্দিন এবং বিধায়িকা বিজিতা নাথ।