৫৯ বর্ষ ৪২ সংখ্যা / ৩ জুন, ২০২২ / ১৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা রক্ষার লড়াইয়ে নয়া ইতিহাস কেরালার এলডিএফ সরকারের
শংকর মুখার্জি
কেপিপিএল-র উদ্বোধন করছেন পিনারাই বিজয়ন।
বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এক নতুন ইতিহাস রচনা করল কেরালার বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট সরকার এবং রাজ্যের বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন। ২৩ মে সেই ইতিহাসের সাক্ষী রইল কেরালার কোট্টায়াম জেলার ভেল্লোরের মানুষ। ওইদিন নতুন করে পথ চলা শুরু হলো পূর্বতন হিন্দুস্তান নিউজপ্রিন্ট লিমিটেড (এইচএনএল)-এর, যার বর্তমান নাম কেরালা পেপার প্রোডাক্ট লিমিটেড (কেপিপিএল)। এই কাগজ কারখানার উদ্বোধন করেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন।
এই কাগজ কোম্পানি নথিবদ্ধ হয়েছে পাবলিক সেক্টর আন্ডারটেকিং (পিএসইউ) হিসেবে, যার সম্পূর্ণ মালিকানা রাজ্য সরকারের। পূর্বতন হিন্দুস্তান নিউজপ্রন্ট লিমিটেডও ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত হিন্দুস্তান পেপার করপোরেশন লিমিটেড (এইচপিসিএল)-এর সম্পূর্ণ মালিকানধীনে থাকা একটি সংস্থা। কেন্দ্রের মোদি সরকার ২০১৮ সালের মার্চ মাসে এইচএনএল’র ১০০ শতাংশ শেয়ারের স্ট্রাটেজিক বিলগ্নিকরণের ঘোষণা করে। তখন থেকেই মোদি সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শুরু হয় এইচএনএল’র শ্রমিক-কর্মচারীদের লড়াই। সিটিআইটিইউ অনুমোদিত কেরালা নিউজপ্রিন্ট এমপ্লয়িজস ইউনিয়ন কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টেও যায়। এইচএনএল’র রাষ্ট্রায়ত্ত চরিত্র অক্ষুণ্ণ রাখতে সরকারিস্তরে পদক্ষেপ নিতে শুরু করে রাজ্যের এলডিএফ সরকার। গত চার বছর ধরে এলডিএফ সরকার এবং রাজ্যের বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের লড়াইয়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার পিছু হটে। অক্ষুণ্ণ থাকে এইচএনএল’র রাষ্ট্রায়ত্ত চরিত্র। এই সংস্থাই নবরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে কেপিপিএল নামে। কাগজ কারখানার উদ্বোধন করে বিজয়ন বলেনঃ ‘‘এইচএনএল’র পুনরুজ্জীবনের মধ্যদিয়ে কেরালা উন্নয়নের এক বিকল্প মডেলকে তুলে ধরল। সরকারের লক্ষ্য কেপিপিএল’কে দেশের সর্ববৃহৎ কাগজ উৎপাদনকারী সংস্থায় পরিণত করা। প্রথম পর্যায়ের ৩৪.৩০ কোটি টাকা ইতিমধ্যে ব্যয় সম্পূর্ণ হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের উন্নয়নের জন্য ৪৪.৯৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এবছরের আগস্টের মধ্যে এই পর্যায়ের কাজ সম্পন্ন হবে। এই সময় থেকেই সম্ভব হবে পূর্ণমাত্রায় উৎপাদন শুরু করা। মোট চার পর্যায়ের এই উন্নয়ন পরিকল্পনার কাজ সম্পন্ন হলে কোম্পানির বাৎসরিক ব্যবসার পরিমাণ দাঁড়াবে ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা। বর্তমানে এই সংস্থায় শ্রমিক-কর্মচারী আছেন ২৫২ জন। ভবিষ্যতে ৩ হাজার জনকে এখানে কাজ দেওয়া যাবে।’’ এই কাজের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়ছে ৪৬ মাস। প্রসঙ্গত,উৎপাদনও হবে প্রতিবছর প্রায় ১ লক্ষ টন।
● ● ●
এইচএনএল দেশের একটা মিনিরত্ন কোম্পানি ছিল। নিউজপ্রিন্ট এবং বিভিন্ন ধরনের লেখার কাগজ এখানে তৈরি হতো। ২০১২-১৩ আর্থিক বছর থেকে এইচএনএল লোকসান করা শুরু করে। এই অজুহাত দেখিয়ে সংস্থাকে বেচে দিতে চেয়েছিল মোদি সরকার। কেরালা নিউজপ্রিন্ট এমপ্লয়িজস ইউনিয়নের কার্যকরী সভাপতি টি বি মোহানন ‘নিউজক্লিক’-কে জানিয়েছেনঃ “পরিচালকমণ্ডলীর ব্যার্থতার জন্যই সংস্থার এই পরিণতি হয়েছিল”। তাঁর কথায় অবশ্যই যথেষ্ট ভিত্তি আছে। ১৯৮৩ সালের ১ অক্টোবর থেকে এইচএনএল’র ব্যবসায়িক ভিত্তিতে উৎপাদন শুরু হয়। তারপর থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এইচএনএল টানা লাভ করে গেছে। এর মূল কোম্পানি এইচপিসিএল’কে এপর্যন্ত ডিভিডেন্ড দিয়েছে ১২০ কোটি ৯৩ লক্ষ টাকা। যা এই সংস্থা তৈরি হওয়ার সময় প্রাথমিক যা বিনিয়োগ করা হয়েছিল তার থেকেও বেশি। ডিভিডেন্ড ছাড়াও প্রতিবছর কর ও শুল্ক বাবদ সরকারের কোষাগারে ভালো অবদান রাখে এইচএনএল। শুধু ২০১৫-১৬ সালে এর পরিমাণ ছিল ৭৩০ লক্ষ টাকারও বেশি। একটা সময় পর্যন্ত এখানে কাজ করতেন প্রায় ১২০০জন। আধুনিকীকরণের পর তা কমে হয় ৫০০জনের মতো। আবার এই সংস্থাকে কোনো সংস্থার কাছে বিক্রি করতে গেলেও আইনি বাধা ছিল। যেটাকে কেন্দ্রীয় সরকার উপেক্ষা করতে চাইছিল। এর বিরুদ্ধেই কেরালা নিউজপ্রিন্ট এমপ্লয়িজস ইউনিয়ন হাইকোর্টে যায়। এই আইনি বিষয়টি এইচএনএল তৈরির সময় থেকেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
● ● ●
এই কাগজ কল তৈরির জন্য কেরালা সরকার ৬৫০ একর জমি অধিগ্রহণ করে এইচপিসিএল’কে দেয়। প্রকৃতঅর্থে এই জমির মালিক কেরালা সরকার। পরবর্তী সময়ে রাজ্য সরকারের সহযোগিতায় এখানে এইচএনএল’র উপনগরী গড়ে ওঠে। রাজ্যের অর্থনীতি এবং কর্মসংস্থান গড়ে তোলার লক্ষ্যে রাজ্য সরকার এই সংস্থাকে আরও বেশ কিছু সুবিধা দিত। সরকার ভরতুকি মূল্যে ইউক্যালিপটাস ও বাঁশগাছের কাগজমণ্ড সরবরাহ করত। সংস্থার উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জল ও বিদ্যুতেও ভরতুকি দিত। এরও অনেক আগে, কাগজ শিল্পের কাঁচামালের জন্য ১৯৬৩ সালে কেরালা সরকার ৫ হাজার ৬০০ হেক্টর বনদপ্তরের জমি নির্ধারিত করেছিল। বর্তমানে সেই জমির ৩ হাজার ৩৫ হেক্টর অবশিষ্ট রয়েছে। বাকি জমি জবরদখল এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। এইচপিসিএল তৈরি হয় ১৯৭০ সালের ২৯ মে। লক্ষ্য ছিল, দেশেই নিউজপ্রিন্ট ও অন্যান্য কাগজ তৈরির ব্যবস্থা গড়ে তোলা। কাগজ আমদানির ওপর নির্ভরতা কমানো। এইচপিসিএল’ই ১৯৭৬ সালে কেরালা নিউজপ্রিন্ট প্রোজেক্ট হাতে নেয়। এই প্রোজেক্টের জন্য কেরালা সরকার ৬৫০ একর জমি অধিগ্রহণ করে। এইচপিসিএল’কে দেয়। তারাই এখানে কাগজ কারখানা গড়ে তোলে। এই প্রোজেক্টে প্রথম কাগজ উৎপাদন শুরু হয় ১৯৮২ সালের ১ নভেম্বর। এইচএনএল এই প্রোজেক্টকে অধিগ্রহণ করে, এবং ১৯৮৩ সালের ৭ জুন এইচএনএল, এইচপিসিএল’র সম্পূর্ণ মালিকানাধীন সংস্থায় পরিণত হয়। আবার যখন সম্প্রতি অতীতে এইচএনএল আর্থিক সংকটে পড়ে তখন কেরালার এলডিএফ সরকার সংস্থার উৎপাদন দ্রব্যের ওপর রাজ্যের জিএসটি’তেও ছাড় দেয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তার কর ও শুল্কতে কোনো ছাড় দেয়নি।
এই পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য সরকার হাইকোর্টে জানায়, সংস্থার জমি হাতবদলের যেকোনো সিদ্ধান্তই বেআইনি। কেন্দ্রীয় সরকার যদি কোনো বেসরকারি সংস্থার হাতে এই কোম্পানিকে তুলে দেয় তাহলে জমির ব্যাপারে রাজ্য সরকারের সঙ্গে সংস্থার যে চুক্তি আছে তা তারা ফিরিয়ে নেবে। রাজ্যের তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী ই ডি জয়রাজন আরও অগ্রবর্তী হয়ে কোর্টে জানিয়েদেন, রাজ্য সরকার এইচএনএল’কে অধিগ্রহণ করতে ইচ্ছুক। এরপর নিয়মানুসারেই কেশ ন্যাশনাল কোম্পানি ল ট্রাইবুনালে যায়। ২০১৯ সালের ২৫ নভেম্বর ট্রাইবুনাল নির্দেশ দেয় এইচএনএল’র সমস্ত শেয়ার কেরালা সরকারের হাতে তুলে দেওয়ার। এই নির্দেশ সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার মালিকানা হাতবদল করতে টালবাহানা করে। এই সময় এইচএনএল’র মোট দায় ছিল ৪০৯ কোটি টাকা। আর সংস্থার সমস্ত শেয়ারের জন্য দিতে হয় ২৫ কোটি টাকা। তখন সংস্থায় কর্মরত ছিলেন ৩৬৪জন স্থায়ী এবং ৪০০জন অস্থায়ী শ্রমিক-কর্মচারী। এরা প্রায় ১৩ মাস বেতন পায়নি। চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এবং দুটি বেসরকারি সংস্থা এইচএনএল কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। এইচএনএল কেনার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলের জোগান দিয়েছে রাজ্য সরকারের সংস্থা কেরালা ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড বোর্ড।
● ● ●
এইচপিসিএল’র আরও দুটি কাগজ কল অসমে বন্ধ। এগুলি হলো কাছাড় পেপার মিল হাইলাকান্দি জেলায় এবং নগাঁও পেপার মিল জাগিরোডে। এই দুটি মিল যথাক্রমে ২০১৫ সালের অক্টোবর এবং ২০১৭ সালের মার্চ থেকে বন্ধ। কেন্দ্রে মোদি সরকার আসার পরেই মিল দুটি বন্ধ হয়েছে। প্রথম মিলটি বন্ধ হওয়ার সময় রাজ্যে ছিল কংগ্রেস সরকার এবং দ্বিতীয়টির সময় বিজেপি সরকার। ২০২১ সালে বিজেপি দ্বিতীয়বারের জন্য রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে।
এই দুটি মিল খোলার ব্যাপারে না কেন্দ্র, না রাজ্য - কোনো বিজেপি সরকারেরই কোনো উদ্যোগ নেই। দীর্ঘদিন এর শ্রমিকরা বেতন থেকে বঞ্চিত। বন্ধ হবার পর থেকে এপর্যন্ত ৯৮জন শ্রমিক নিদারুণ অর্থকষ্টের শিকার হয়ে মারা গেছেন। এঁদের মধ্যে ৪জন আত্মহত্যা করেছেন। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অসম সরকার এইচপিসিএল’র ইউনিয়নগুলি এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে নিয়ে একটা সভা করে। সেখানে ঠিক হয়, ত্রাণ প্যাকেজ বাবদ সরকার ৫৭০ কোটি টাকা ব্যয় করবে। ন্যাশনাল কোম্পানি ল ট্রাইবুনালও এই প্যাকেজে অনুমোদন দেয়। এখানকার ট্রেড ইউনিয়নগুলিও দাবি জানিয়েছিল, কেরালা সরকারের মতো অসম সরকারও এই দুটি মিল অধিগ্রহণ করুক। কিন্তু ‘ডবল ইঞ্জিনে’র অসম সরকার তাদের প্রতিশ্রুত ত্রাণ প্যাকেজও এখনো রূপায়ণ করেনি। আর বিজেপি দল নীতিগতভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণের পক্ষে। তাই স্বাভাবিকভাবে ইউনিয়নগুলির দাবি তাদের মানা সম্ভব নয়। এখানেই দুটি সরকারের দেশের সম্পদ রক্ষার ক্ষেত্রে দুই পৃথক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে।
এই কাগজ কারখানার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কেরালার বর্তমান শিল্পমন্ত্রী পি রাজীব বলেছেনঃ প্রথম এলডিএফ সরকারের দৃঢ় প্রত্যয়ই এই অসাধারণ পনুরুজ্জীবনের লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করেছে। এটাকে একটা বৃহৎ নীতিগত সিদ্ধান্ত হিসেবে এবং তা যেন ভালোভাবে রূপায়িত হয় তার ওপর মুখ্যমন্ত্রী জোর দিয়েছিলেন। কেপিপিএল’র উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে সেই লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। পরিচালকমণ্ডলীকে পেশাদারিত্বের সাথে এই কোম্পানিকে পরিচালনা করতে হবে। যাতে এই কোম্পানি যেকোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সক্ষম হতে পারে এবং লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
নিশ্চিতভাবেই এটা কেরালার এলডিএফ সরকারের কাছে আগামীদিনে চ্যালেঞ্জ। এলডিএফ সরকার আগেও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা রক্ষায় নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী কিছুদিনের মধ্যে পালাক্কাডে রাষ্ট্রায়ত্ত ইন্সট্রুমেনটেশন লিমিটেডকেও এলডিএফ সরকার অধিগ্রহণ করবে। ভবিষ্যতে হয়তো এধরনের আরও অনেক পরিকল্পনা তাদের আছে। তাই বর্তমান এই চ্যালেঞ্জকে তাদের সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। এ যেমন কেরালার এলডিএফ সরকারকে শক্তিশালী করবে, একইভাবে সারাদেশে বেসরকারিকরণবিরোধী আন্দোলনকেও কয়েক কদম এগিয়ে দেবে।