৫৯ বর্ষ ৪২ সংখ্যা / ৩ জুন, ২০২২ / ১৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯
আ-কথা, কু-কথা এবং পরীক্ষার খাতা
পল্লব সেনগুপ্ত
সদ্য-সদ্যই পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। ফলের সামগ্রিক ভালোমন্দ নিয়ে অবশ্যই কথা বলার আছে; কিন্তু সেটা আপাতত মুলতবি থাক। এই পরীক্ষার সূত্রেই একটি গুরুতরভাবে দুশ্চিন্তাজনক খবর বেরিয়েছে পত্রান্তরে - যেটি নিয়ে সর্বস্তরেই একটা উদ্বেগ সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক ছিল, অথচ সেটা ঘটেনি। জানিনে ব্যাপারটাকে সেভাবে কেন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না কোনও স্তরেই - না সরকারি পর্যায়ে, না শিক্ষাবিদ মহলে, না অভিভাবক সমাজে, না গণমাধ্যমে। কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষ অবশ্য কিছু-কিছু অভিমত প্রকাশ করেছেন। তবে আরও অনেক, অনেক কথা বলার প্রয়োজন আছে এই বাবদে। এই নিবন্ধের অবতারণা সেই কারণেই।
ব্যাপারটা হয়তো অনেকেরই নজর এড়িয়ে গেছে। তাই সেটাই আগে বলা দরকার একটু।... এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষার বহু উত্তরপত্রেই একটা অভূতপূর্ব এবং শঙ্কাজনক ব্যাপার দেখা গেছে। অনেক খাতাতেই পরীক্ষার্থী ছেলে (এবং মেয়েরাও!) উত্তর লেখা শেষ করে বা শেষ না-করেই, পাতার পর পাতা জুড়ে অনুচ্চার্য, অশালীন, কুৎসিত, নোংরা সব শব্দ লিখে গেছে!! পরীক্ষার খাতায় এ ধরনের ক্রোধের বিস্ফোরণ এত বেশি পরিমাণে - এ ঘটনাটা অভূতপূর্বই শুধু নয়, অভাবিতপূর্বও বটে।
এই ব্যাপারটা যদি দু-চারজনের ক্ষেত্রে হতো তাহলে হয়তো বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যেতে পারত। কিন্তু তা তো নয়। হ্যাঁ, মোট পরীক্ষার্থীদের মধ্যে এরা হয়তো একটা সামান্য ভগ্নাংশই; কিন্তু, সেই সংখ্যাটা আবার অনুপেক্ষণীয়ও বটে। সামান্য ভগ্নাংশই বা কেন হবে?... এ নিয়ে কিছু-কিছু অভিমত যা মিলছে সেগুলো হলো এইঃ
ক. করোনার আক্রমণের এই দু-দুটো বছর স্কুল বন্ধ, খোলা, আবার বন্ধ - এমন একটা অস্থিরতার ফলে ওরা বিষাদ ও হতাশায়, নির্বান্ধব একাকীত্বে ভুগে এরকমভাবে মানসিক উপচঙ্কের প্রকাশ ঘটিয়েছে। যারা ওই অদ্ভুত পরিবেষ্টনীর চাপটা কাটাতে পেরেছে, তারা সুস্থভাবে খাতায় লিখেছে। যারা পারেনি, তারাই ওই বিকৃতির শিকার।
খ. পড়াশুনোর ফলে যে-মানসিক পরিশীলন হয়, সেটা সামগ্রিকভাবে একটা শুভবুদ্ধি এবং মূল্যবোধের সৃষ্টি করে। সেটা বিপুলভাবে ব্যাহত হচ্ছে বহুদিন ধরেই। এর ফলে শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কেরও প্রত্যাশিত সমীকরণ বহুলাংশেই নষ্ট হয়ে গেছে। তাই শিক্ষকদের হাতে যে-খাতা পৌঁছুবে, তাতে অশালীন, নোংরা, অনুচ্চার্য শব্দ লিখতে ওদের দ্বিধা হয়নি।
গ. রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে (ওরা দেখেছে) যে, ছাত্রনামা গুন্ডারা উপাচার্যের ঘরের দুয়ারে লাথি মারছে, অধ্যক্ষের কলার ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে, অশিক্ষিত রাজনীতিবিদ্ অধ্যাপিকার মুখে জলের জাগ ছুঁড়ে মারছে, শিক্ষকদের ধম্কে, চোখ রাঙিয়ে কাজ হাসিল করছে - তাই সাধারণভাবে শিক্ষকদের প্রতিও এইসব বিপথগামী কিশোর-কিশোরীরা শ্রদ্ধাহীন হয়ে পড়েছে।
ঘ. অন লাইনে দু’বছর ক্লাস হয়েছে ঠিকই। কিন্তু সে সুযোগ সকলে পায়নি। তারা হতাশায় ন্যুব্জ হয়ে পরীক্ষা দিতে এসে দিশেহারা হয়ে গেছে। এই অসভ্যতা তারই প্রমাণ।
ঙ. শিক্ষায় ব্যবসায়িক মানসিকতা এতই প্রকট যে, ওরা ধরেই নিয়েছে টিউশনবাজি করেন সব শিক্ষকই। তাই তাঁদেরকেও এক ধরনের ‘শ্রেণিশত্রু’ বলে ওরা মনে করে। এই ক্রোধ ও তার ইতর বহিঃপ্রকাশও তারই প্রতিক্রিয়া।
।। দুই ।।
সব কথাগুলোই ঠিক। তবে, অংশত। এগুলোকে একত্র করে নিয়েও সম্পূর্ণ কারণটা সম্পর্কে ধারণা করা যাবে না। বিষয়টাকে অনেক বৃহৎ পরিপ্রেক্ষায় বুঝতে হবে। এক-এক করে দেখা যাকঃ
প্রথমত, সারা দেশেই যে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক রাক্ষসিবেলা ঘনিয়ে এসেছে, এই পশ্চিমবাংলাও তো তার ব্যতিক্রম নয়। যে-সব উদ্ভ্রান্তির বিস্ফোরণ পরীক্ষার খাতায় ঘটেছে, তার পিছনে এই ব্যাপারটাও তো আছে। ওরা ভাবছে - ঠিকই ভাবছে - মাধ্যমিক পাশ যদি করিই, তাতে কী লাভ। পরে যখন কলেজে ভর্তি হতে যাব, তখন তো টিএমসিপি-র নামে মাস্লম্যানরা এসে টাকা চাইবে, হাজার-হাজার! কোথা থেকে সে টাকা দেবে আমার গরিব বাবা-মা? তাই এই পরীক্ষা দিয়ে পাশ করা, না-করা তো সমান!
দ্বিতীয়ত, ওরা দেখছে যে, রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে শাসকদলের পান্ডারা যথেচ্ছভাবে চাকরি নিয়ে বেচাকেনা করছে। তাই পাশ-টাস যদি করিও, তাহলেই বা কি? মেধার জোরে তো চাকরি পাবো না, তা পেতে হলে টাকার জোর চাই! সে টাকা কোথায় পাবো? চোখের সামনে হয় পার্টি ভাঙিয়ে, নয় টাকার বন্দোবস্ত করে অন্যরা আখের গুছিয়ে নেবে। আমার কী হবে?
তৃতীয়ত, এমন কোনও গ্যারান্টি নেই যে, যদি ছোটোখাটো ব্যবসা-ট্যাবসা করি, সেখানে অমুক দাদা তমুক দিদির হাতা-বেলচারা এসে হামলা করে তোলা চাইবে না! তাহলে, কোন্ দিশায় যাবো?
আসলে সর্বস্তরেই শাসকদের প্রশ্রয়ে যে ব্যাপক দুর্নীতি এবং ইতরতা চলছে, তারই প্রতিক্রিয়ায় অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের মন বিভ্রান্ত হচ্ছে, ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছে তারা। কোনও রোল মডেল তো নেই-ই চোখের সামনে, যাঁকে দেখে ওরা উদ্বুদ্ধ হতে পারে। ভোগবাদের ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মনকে, অথচ তার সোয়াদ ওরা পাচ্ছে না। একটা সামগ্রিক ফ্র্যাস্ট্রেশ্যন সৃষ্টি হচ্ছে এর ফলে ওদের কাঁচা মনে।
তারপরেও, আরও কথা থাকে তো। সেভাবে খেলাধুলোর সুযোগ নেই। পাড়ার মাঠগুলো প্রমোটারদের দাপটে বেহাত হচ্ছে। বাধা দিলে রাজনৈতিক হুংকার আসছে। বিনোদন বলতে তো শুধু টিভি। আর তার কথা তো বলাই সময়ের অপচয়! ... মূল্যবোধের যে অবক্ষয়ের কথা সমাজতাত্ত্বিকরা বলছেন, তার একটা বড়ো উৎস তো ওই ‘বোকা বাক্স’! এবং খবরের কাগজও খুব কম যায় না এক্ষেত্রে। টিভি-র নিউজ চ্যানেলগুলোতে যেভাবে হয়কে নয়, নয়কে হয় করে অহোরাত্র প্রচার চলে (চলতে বাধ্য, কারণ সেগুলো মাথা বিকিয়ে রেখেছে বিশেষ-বিশেষ দলের কাছে) - তাতে তো বিভ্রান্তি উত্তরোত্তর বেড়েই চলে। ওরা প্রচারে দেখছে, শুনছে, পড়ছে - উন্নতির বন্যায় না-কি দেশ ভাসছে, রাজ্য ভাসছে। আর চোখের সামনে দেখছে, বাড়ির হাঁড়িতে টান্ পড়ছে, দাদার চাকরি চলে গেছে, মেজদার দোকান বন্ধ, বাবার রিটায়ারমেন্ট আসন্ন, মায়ের চিকিৎসা করানো যাচ্ছে না, দিদির বিয়ের জন্য টাকা নেই! হতাশায়, ক্রোধে অস্থির হয়ে যাবে না একটা কিশোর মন?
কাগজের খবর মানেই দিদি ভজনা কিংবা দিদির দলের সঙ্গে দাদার দলের উতোর-চাপান। কারুর কোনও আদর্শ নেই। আজ আয়ারাম তো, কাল গয়ারাম। এই নীতিহীন, নেতাহীন সমাজে হাল ধরে সঠিক পথে নিয়ে যাবে কে, ওরা জানে না। অথচ, নিত্যনিয়ত অপপ্রচারের আঁধিতে ওরা কাহিল। ... আর মূল্যবোধ? চোখের সামনে প্রতিদিন টিভি-র পর্দায় দেখছে হয় ধর্মের বুজরুকির দাপট, আর নয় তো ‘রিয়ালিস্টিক’ কাহিনির নামে তাবৎ অনৈতিক কাজকর্ম। টিভি-র সিরিয়ালে ওরা দেখছে, একটা বউ থাকতেও আর একটা মেয়ে বউয়ের মতো! তাতে উস্কানি দিচ্ছে বাড়ির লোকই। মুঠো-মুঠো টাকা বিলিয়ে যাবতীয় অপকর্ম করাচ্ছে এবং তা করছে নারী পুরুষ নির্বিশেষে। বিষ খাওয়ানো, কিডন্যাপ করা, উৎপীড়ন (নেহাৎ, ধর্ষণটা দেখাতে পারে না। আইনে আটকায় বলে... তবে সেটা পুষিয়ে দেয় খবরের কাগজ), চুরি, খুন - এ তো আকছার। নৃশংসতা, জালিয়াতি, খুনের চেষ্টা, এমনও সিরিয়াল হয়ে গেছে যেখানে অপছন্দ বলে, শাশুড়ি পুত্রবধূকে গণিকাপল্লীতে বেচে দিচ্ছে, স্বামী স্ত্রীকে দিয়ে বেশ্যাবৃত্তি করাতে চাইছে! এগুলো তো হিমশৈলের চূড়ামাত্র। কী দুর্নীতি, কী অপহ্নব যে টিভি সিরিয়ালে দেখানো হয়, তার তো আর ইয়ত্তা নেই! ... অল্প বয়সিরা কেন ডিমরালাইজড্ হবে না বলুন তো?
এমন প্রশ্নও উঠেছে যে, খারাপ কতাবার্তাগুলো ওরা শিখল কোথায়। যেখানে মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে ‘শালা’ বলে উল্লেখ করেন, সেখানে শেখার অসুবিধে কোথায়। ক্লাবের উন্নতির নামে যেখানে সরকারি টাকায় গুন্ডা পোষা হয়, সেখানে সেই গুন্ডারাই তো পাড়ার বাচ্চাদের হিরো হয়! অপভাষণের দীক্ষা তো সেখানেই! তাই না?