৬০ বর্ষ ২৯ সংখ্যা / ৩ মার্চ, ২০২৩ / ১৮ ফাল্গুন, ১৪২৯
নিয়োগ দুর্নীতিতে শাসকদলের বহু নেতা-মন্ত্রীর গলা পর্যন্ত ডুবে রয়েছে
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ রাজ্যের স্কুলস্তরের শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতির ক্ষেত্রে ইডি-সিবিআই’র তদন্ত সূত্রে শাসক ঘনিষ্ঠ নানামাপের, নানা সম্পর্কের নাম উঠে আসছে প্রতিদিন। চলছে গ্রেপ্তারি। আঙুল উঠছে মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের দিকেও। পার্থ চ্যাটার্জির চেয়েও বেশি প্রভাবশালী ক্ষমতাবান ব্যক্তি রয়েছে এই দুর্নীতির পিরামিডের মাথায়, একথা ইডি ইতিমধ্যেই জানিয়েছে আদালতে। তবে আদালত অসন্তুষ্ট মামলার গতি প্রকৃতি নিয়ে। প্রায়ই কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতিরা উষ্মা প্রকাশ করছেন তদন্তের গতি নিয়ে।
নিয়োগ তদন্তে পার্থ চ্যাটার্জি, সপরিবারে মানিক ভট্টাচার্য, সুবীরেশ ভট্টাচার্য প্রমুখ গ্রেপ্তার হওয়া বড়োমাপের অভিযুক্তদের জামিন নাকচের সঙ্গেই তাল মিলিয়ে বাড়ছে গ্রেপ্তারির সংখ্যা। এই দুর্নীতি প্রসঙ্গে মমতা ব্যানার্জির ভাই কার্তিক ব্যানার্জির নামও উঠে এসেছে। আর এই পরিস্থিতিতে এই সময়ে সবচেয়ে আলোচিত চরিত্র ‘কালিঘাটের কাকু’। বেহালা নিবাসী এই ব্যক্তির নাম সুজয় ভদ্র। অনেকের মতে নিয়োগ দুর্নীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এই সুজয় ভদ্র স্বীকার করেছেন তিনি অভিষেক ব্যানার্জির ‘পার্ষদ’। আর তার কাছেই নিয়োগ দুর্নীতির টাকা জমা দিতেন তৃণমূল নেতা কুন্তল ঘোষ - তা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ্যে দাবি করেছেন শিক্ষা ব্যবসায়ী আরেক তৃণমূল নেতা তাপস মণ্ডল। সংবাদমাধ্যমে প্রায় একই কথা বলেছেন আরেক অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা গোপাল দলপতি। অভিষেক ব্যানার্জির প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির একদা ডিরেক্টর সুজয় ভদ্র কবুল করেছেন, তিনি রাজনৈতিক কারণে চেনেন কুন্তল ঘোষকে। এ প্রসঙ্গে ‘ভদ্র কাকু’ নামে পরিচিত সুজয় বাবু আরও জানিয়েছেন তিনি তাপস মন্ডলকেও চিনতেন, কিন্তু অস্বীকার করেছেন টাকা নেওয়ার প্রসঙ্গ।
এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে সিপিআই(এম) নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, সবাই বুঝতে পারছে কাকুর পেছনে পিসি আছে আর পিসির পাশে অভিষেক আছে। আবার তৃণমূল ঘনিষ্ঠ গোপাল দলপতি, তাপস মণ্ডল আর যুবনেতা কুন্তল ঘোষের চাপান-উতোর সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ...‘সব খেয়েছে হাওয়াই চটি’ এটা পশ্চিম বাংলার মানুষ জানেন।
নিয়োগ দুর্নীতিতে কেন্দ্রীয় দুই তদন্ত সংস্থার হাত দুর্নীতির শীর্ষস্তরের এখনও পর্যন্ত নাগাল না পেলেও কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতিদের সাম্প্রতিক একাধিক নির্দেশে ক্রমাগত বেআবরু হচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেসের ধারাবাহিক দুর্নীতি যোগ। তাতে আরও জনরোষ বাড়ছে শাসকদলের নেতা-নেত্রীদের প্রতি। সম্প্রতি ২৭ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় মানিক ভট্টাচার্যের সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। ২৫ জানুয়ারি দেওয়া কোর্টের পুরনো নির্দেশ অনুযায়ী দুই টেট পরিক্ষার্থীকে অসহযোগিতার দরুন ধার্য ক্ষতিপূরণ না দেওয়াতেই এই নির্দেশ।
দিন কয়েক আগেই চন্দ্রকোনার ক্ষীরপাইয়ে পার্থ চ্যাটার্জি ঘনিষ্ঠ তৃণমূলের প্রাথমিক শিক্ষা সেলের কোষাধ্যক্ষ সঞ্জীব কোলের বিরুদ্ধে নিয়োগ দুর্নীতিতে যুক্ত থাকার অভিযোগে ইডি-কে তদন্ত করার আবেদন জানিয়ে ওই এলাকায় পোস্টার পড়েছে। অভিযোগ, বহু পরিবারের থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়েছে এই ব্যক্তি। জানা গেছে, টাকা নিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে চাকরিস্থলের বদলি করিয়ে দেবারও অভিযোগ রয়েছে এই সঞ্জীব কোলের বিরুদ্ধে। তাঁর পরিবার-আত্মীয়স্বজন মিলিয়ে প্রায় ১৬ জন সদস্য, যাঁদের অধিকাংশেরই বেসিক ট্রেনিং বা ডিএলএড ডিগ্রি নেই, তারা প্রাথমিকে চাকরি পেয়েছেন বলে অভিযোগ।
এই সময় পর্বেই ২০১৬ সালের শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতি স্বীকার করে নিয়ে ৯১১ জনের ওএমআর শিট প্রকাশ করেছে এসএসসি। এর মধ্যে বেশ কিছু শিক্ষকের চাকরি বাতিলের সুপারিশও করেছে এসএসসি। ২০১৬ সালে প্রায় ১১ হাজার শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে। সিবিআই জানিয়েছে তদন্ত থেকে আরও ভুয়ো নিয়োগের তথ্য উঠে আসছে।
আবার ২৪ জানুয়ারি সংবাদপত্রের নিয়োগ দুর্নীতির প্রতিবেদনে মমতা ব্যানার্জির পরিবারের সদস্যের নাম উঠে এসেছে। ১৭ ফেব্রুয়ারি সিবিআই’র হাতে গ্রেপ্তার হয় বাগদার ‘সৎ রঞ্জন’ ওরফে চন্দন মণ্ডল, যিনি আবার পার্থ চ্যাটার্জির ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। এলাকায় মানুষ বলছেন, নিয়োগের ক্ষেত্রে পেশায় প্যারা টিচার চন্দন মণ্ডলের দুর্নীতির যে মডেল এখানে কাজ করেছে তা হলো, ‘খালি খাতা জমা দিলেও টাকার বিনিময়ে মিলবে চাকরি’। চাকরি প্রার্থীদের থেকে নেওয়া কোটি কোটি নগদ টাকা সড়ক পথে গাড়ি করেই কলকাতায় নির্দিষ্ট ঠিকানায় পাঠানো হতো। বাগদার মামা ভাগিনা গ্রামের জনৈক তৃণমূলী পঞ্চায়েত সদস্য বলেছেন, প্যারাটিচার চন্দনের বাড়িতে প্রায়ই আসতেন মুখ্যমন্ত্রীর ভাই সমীর (কার্তিক) ব্যানার্জি। কার্তিক ব্যানার্জির যাতায়াতের জেরেই নাকি চন্দনের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন। এই ‘সৎ রঞ্জনে’র গ্রেফতারি প্রসঙ্গে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, একা রঞ্জনকে গ্রেফতার করে কি হবে। সাত আট মাস ধরে তো অনেক কিছুই চলছে।
ইডি যুব তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক কুন্তল ঘোষকে গ্রেফতার করেছে ১৭ই ফেব্রুয়ারি। কুন্তল ঘোষকে জেলে গিয়ে জেরা করেছে সিবিআই। আবার উনিশ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করা হয়েছে মানিক ঘনিষ্ঠ শিক্ষা ব্যবসায়ী তাপস মণ্ডলকে। আর পারস্পরিক চাপান-উতোরের জেরে যুব তৃণমূল সম্পাদক কুন্তল ঘোষ এবং তাপস মণ্ডলকে মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করেছে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআই।
বীরভূমের তৃণমূল নেতা বিভাস অধিকারীর নামও উঠে এসেছে তদন্তে। পার্থ চ্যাটার্জি-মানিক ভট্টাচার্যের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থাকা বীরভূমের এই নেতা শিক্ষা ব্যবসায়ী। তার কলকাতার ফ্ল্যাট সিল করে দিয়েছে ইডি। বিজেপি’র শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যোগ থাকা এই বিভাস অধিকারীর নাম উঠে এসেছে আরেক অভিযুক্ত তাপস মণ্ডলের কথায়।
এদিকে সিবিআই-কে ভর্ৎসনার সুরে হাইকোর্টের বিচারপতি প্রশ্ন করেছেন, যারা টাকা দিয়ে চাকরি পেলেন তাদের কেন হাজির করানো যাচ্ছে না আদালতে। কেন তাদের গোপন জবানবন্দি নেওয়া হচ্ছে না।
সুজয় ভদ্র সম্পর্কে সংবাদ মাধ্যমের বিভিন্ন প্রকাশিত তথ্যে উঠে এসেছে অভিষেক ব্যানার্জি সহ ব্যানার্জি পরিবারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কথা। অভিষেক ব্যানার্জির অফিসের তিনি যে কাজ করতেন সে কথা একাধিকবার প্রকাশ্যে মিডিয়ার সামনে কবুল করেছেন এই ‘ভদ্র কাকু’। তবে তিনি এ কথাও বলেছেন, তার উপরওয়ালা বা বস অভিষেক ব্যানার্জি, তাকে ধরা ছোঁয়া যায় না।
কলকাতা থেকে দূরে থাকা দুর্নীতিতে যুক্ত গোপাল দলপতিও নিয়োগ দুর্নীতির প্রসঙ্গে টাকা আদায় এবং তার লেনদেন সম্পর্কে বহু প্রসঙ্গে মুখ খুলেছেন বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের ক্যামেরার সামনে। উঠে এসেছে তার স্ত্রীর নাম যিনি পেশায় একজন অভিনেত্রী।
তদন্ত সংক্রান্ত একটি হিসেব থেকে উঠে এসেছে, বেআইনি নিয়োগে মাথাপিছু গড়ে ৮ লক্ষ টাকা কর্মপ্রার্থীদের থেকে নেওয়া হয়েছে। যাবতীয় টাকা, অতি প্রভাবশালী মহলে পৌঁছাত একাধিক হাত ঘুরে। কোথায় পৌঁছানো হতো টাকা সে প্রসঙ্গে সরাসরি সংবাদ মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবসায়ী তাপস মণ্ডল জানিয়েছে, ‘কালীঘাটের কাকু’কে টাকা পৌঁছে দিতে হতো।
সিবিআই এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, নিয়োগ দুর্নীতির ক্ষেত্রে গ্রুপ সি এবং গ্রুপ ডি’র বিভিন্ন পদে শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী নিয়োগ এবং নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশ যা এসএসসি’র মাধ্যমে পূরণ করা হয়েছে তার তদন্তে উঠে এসেছে ওএমআর শিট সংক্রান্ত কারচুপির প্রসঙ্গ। তাঁদের বিভিন্ন রিপোর্টেও বলা হয়েছে, দুর্নীতি হয়েছে করপোরেটসুলভ মসৃণতায়।