৬০ বর্ষ ২৯ সংখ্যা / ৩ মার্চ, ২০২৩ / ১৮ ফাল্গুন, ১৪২৯
উত্তর দিনাজপুরের গ্রামীণ যুবকেরা সংসার বাঁচাতে পাড়ি দিচ্ছে ভিন রাজ্যে
বিশ্বনাথ সিংহ
গ্রামে কাজ নেই, অভাবের তাড়নায় পরিবারবর্গকে সঙ্গে নিয়েই ভিন রাজ্যে ছুটছে গ্রামীণ যুবকেরা।
রায়গঞ্জ শিলিগুড়ি মোড়ে তোলা ছবি।
একশো দিনের কাজ অমিল। অন্যদিকে কৃষকের ফসলের দাম নেই। বিড়ি শ্রমিকের মজুরিও তথৈবচ। চোপড়া ইসলামপুর এলাকায় চা বাগানের দালালির দাপটে মারাত্মক অচলাবস্থা চলছে। জলের অভাবে উচ্চফলনশীল ধান লাগানোর কাজ আটকে পড়েছে। এই অবস্থায় সংসার বাঁচাতে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে গ্রামের হাজার হাজার যুবক। অবস্থার চাপে পরিবার নিয়ে একরকম পালাবার পথ ধরেছেন আনসার, সোলেমান, সৈয়দ, নিয়াদাদ, মোস্তাফা, সাবেদুর, জৈনুলরা। বাস্তবে জেলায় কাজ নেই স্বাভাবিকভাবেই কচি কচি ছোট্ট ছোট্ট ছেলে মেয়েদের বাড়িতে বয়স্ক বাবা-মায়ের উপর ভরসা করে রেখে উপার্জনের রাস্তা খুঁজতে ওরা জোটবদ্ধভাবেই ঠিকাদারের হাত ধরে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছে।
উত্তর দিনাজপুর জেলার হেমতাবাদ ব্লকের বাহারাইল, মালোন, জগদীশপুর, ভিটি, পাড়ের গ্রামে রাজস্থান-হরিয়ানার বড়ো বাস সপ্তাহে তিনদিন যাতায়াত করছে। বাসের মালিকানা কেউ জানে না। তবে গ্রামে গ্রামে এজেন্ট আছে। টিকিট কেটে দেওয়া থেকে শুরু করে প্রতিদিনের খাওয়া দাওয়া হাত খরচের টাকা দিয়েই গ্রামের জওয়ানদের অন্য রাজ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এদের কেউ রাজমিস্ত্রির সঙ্গে জোগানদারের কাজে, আবার কেউ মার্বেলের কাজে, কেউ আবার সোনার দোকানে, আবার কেউ আছে রাজস্থানে জরি শিল্পের কাজে। এভাবেই গ্রাম থেকে একে একে সবাই পাড়ি দিচ্ছে অন্য রাজ্যে।
রায়গঞ্জ, চোপড়া, ইটাহার ইসলামপুর ব্লক প্রশাসনের কাছে এসব কোনো তথ্য নেই। এমনকী জেলার লেবার কমিশনার অফিসে কেউ জানে না উত্তর দিনাজপুর জেলা থেকে কোথায় কোথায় কত যুবক ভিন রাজ্যে আছে। বিভিন্ন গ্রামপঞ্চায়েত সূত্রে জানা গেছে, একশো দিনের কাজ কয়েক মাস ধরে বন্ধ। টাকা নেই। অন্য কোনো স্কিমের টাকাও আপাতত নেই। দু’একজন গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান, মেম্বাররাও জানাচ্ছেন, এমজিএনআরইজিএ প্রকল্পের কাজ করানোর পরেও জব কার্ড হোল্ডারদের বকেয়া মজুরি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পঞ্চায়েতের কাজ করার পর সেই বকেয়া টাকার জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরছে অনেকেই। পানিশালা, বাহিন, সুরুন, বিন্দোল গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় লক্ষ লক্ষ টাকা পাওনা রয়েছে। বরুয়ার সহদেব দাস জানান, গ্রামগঞ্জে মানুষের হাতে কোনো রোজগারের পথ নেই। স্বাভাবিকভাবে বউ বাচ্চাকে বাঁচাতে যে করে হোক উপার্জনের পথ খুঁজতে এখন ভিন রাজ্যে প্রতিদিন ছুটছে গ্রামের ছেলেরা। গ্রাম ছেড়ে ভিন রাজ্যে যাওয়া আসা এখন নিত্য দিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছাতেই শুনতে পাওয়া যায়, ভবিষ্যতে পুরুষ শূন্য গ্রাম হয়ে যেতে পারে ভিটিয়ার, বিষাহার, নমনিয়া, সরিয়াবাদ, খারিসরিয়াবাদ গ্রাম। রায়গঞ্জ জেলা সদর শহর থেকে গ্রামের দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার। নাগর নদীর পশ্চিমে অবস্থিত গ্রাম। নদীর ওপারে বিহার রাজ্যের বারসোই সড়ক ধরে বিস্তীর্ণ এলাকা। এক কথায় জেলার ছিটমহল গ্রাম নামেই পরিচিত। দুপুরের রোদে গাছের নিচে মাচা অথবা চায়ের দোকানের টুলে বসে গল্প গুজবেই জানা যায়, গ্রাম ঢাকা পড়ছে অন্ধকারে। রায়গঞ্জ ব্লকের গৌরী গ্রাম পঞ্চায়েতের ছোটো ভিটিয়ার। সূর্যাস্তের পর গ্রামে নেমে আসে অন্ধকার। কাছাকাছি স্বাস্থ্য কেন্দ্র রায়গঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। হাইস্কুলে আসতে হয় শংকরপুর হাই মাদ্রাসা অথবা সুভাষগঞ্জ। নাগর নদীর শাখা নদী ছোটো ভিটিয়ার আর বড়ো ভিটিয়ার দুই গ্রামের বুক চিড়ে বয়ে গেছে। বছর ২০ আগে রায়গঞ্জ থেকে পিএমজিএসওয়াই প্রকল্পের ঝাঁ চকচকে রাস্তা গড়ে ছিল বামফ্রন্ট পরিচালিত জেলা পরিষদ। পাড়ার ভেতরে পৌঁছে যাচ্ছে অটো-ট্রেকার। রাস্তা ভাঙছে, পিচের আস্তরণ উঠে যাচ্ছে এই জমানায়, মেরামত হচ্ছেনা। এই অভিযোগে সরব গৌরী বাহিন এলাকার বাসিন্দারা। আগের সরকারের আমলে রায়গঞ্জ থেকে বিষাহার গোড়াহার পর্যন্ত, আবার রায়গঞ্জ থেকে বাহিন হয়ে ভিটিয়ার পর্যন্ত সড়ক প্রশস্ত হওয়ার পর বেশ কিছু উন্নয়নের জেরে শ্যামপুর, রুদ্রখণ্ড, বিরামখণ্ড, বিষাহার, গোড়াহার, ভিটিয়ার বাহিন, চাপদুয়ার সকাল থেকে রাত অবধি কিছুটা হলেও জমজমাট ছিল। বিষাহার গ্রামে ৩৪২টা এবং ছোটো ভিটিয়ার গ্রামে ১৪৭টা পরিবারের বসবাস। অধিকাংশ মানুষ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। এছাড়াও তপশিলি জাতিভুক্ত মানুষও রয়েছেন। ৪/৫টি গ্রামের যুবকদের সংখ্যা মাত্র ৭/৮ বছরে কমে গেছে প্রায় ৭০ শতাংশ। বাড়িতে এখন প্রবীণ মানুষেরা রাত পাহারায়। ১০০ দিনের কাজে কোনো ছিটেফোঁটা আঁচ লাগেনি। যা হয়েছে তার বকেয়া মেটাতে পারেনি পঞ্চায়েত। গ্রামগঞ্জে ছেলেরা যদি রেগার কাজে যুক্ত থাকতে পারত তবে কি কেউ মা বাবা স্ত্রী ছেলে সংসার ফেলে মাসের পর মাস ভিন রাজ্যে কাজের ধান্ধায় ছুটত? প্রশ্ন তুলেই দিলেন এলিঙ্গার নজরুল সাহেব, গোড়াহারের সফির উদ্দিন, কুমারজোলের হোসেন সাহেবরা।
বিভিন্ন গ্রামে একই ছবি। কাজ নেই। আবাদি ফসলের সঠিক দাম নেই। বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব। প্রায় ৮/১০টা গ্রামের মানুষের অভিযোগ, ইন্দিরা আবাস যোজনার ঘর প্রকৃত গরিব একটি পরিবারেও মেলেনি। আবাস যোজনার কথা শুরু হতেই গ্রামের মহিলারাও রে রে করে ওঠেন। গ্রামের অধিকাংশ বাড়ি মুলিবাঁশের ঘেরা অথবা টিনের ছাউনি। একজন পরিবারের মুখেও জানা যায়নি আবাস যোজনার উপভোক্তার নাম। খেতি গৃহস্থালির উপর নির্ভরশীল মানুষের ক্ষোভের আঁচ মিলল সাব্বির সাহাবের গলায়। সত্তরোর্ধ্ব কলিমুদ্দিন সেখ অভিযোগ করে বলেন, গ্রামে নেমে এসেছে ভয়ংকর দুর্দিনের অন্ধকার। তিনি জানান, দেড়শোটা মতো পরিবারের বসবাস ছোটো ভিটিয়ার গ্রামে। গ্রামে ২৮০-৩০০ জন ছেলে ছোকরা ছিল। কাজের খোঁজে অন্য রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজে সবাই এখন গ্রামের বাইরে আছে। সব পরিবারে বয়স্করা গ্রাম পাহারাতেই থাকেন। কৃষি কাজে এত খরচ আর এত ঝুঁকি যে, আজকের প্রজন্মের ছেলেরা কৃষি কাজেও মন দিতে চায় না। ধানের আবাদিতে খুব সমস্যা। বন্যা কবলিত (নামলা) নিচু এলাকা। প্রতিবছর ধানের খুব ক্ষতি হচ্ছে। মাটি ভালো, সবজির চাষ ভালো হয়, অথচ দাম মেলে না। অনেকের ঘরের ছেলেরা ভাদ্র আশ্বিন মাসে বাড়ি আসে। সবজি চাষে ছেলেরা একটু হাত লাগাতে থাকে। গ্রামে ভালো উন্নত মানের বেগুন চাষ হয়। ফলনও ভালো হয়, কিন্তু ন্যায্য দাম নেই। সেইজন্য চাষ আবাদে আগ্রহ হারাচ্ছে ছেলেরা। কাজেই এই অবস্থার চাপে ছোটো ভিটিয়ার খিরাবাড়ি, বালুরপর, ভিটিয়ার গ্রাম ভবিষ্যতে পুরুষ শূন্য গ্রামের চেহারা নেবে কিনা তা ভবিষ্যতই বলবে।