E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ২৯ সংখ্যা / ৩ মার্চ, ২০২৩ / ১৮ ফাল্গুন, ১৪২৯

গর্বের পঞ্চায়েত ধ্বংসের কিনারায়

অমিয় পাত্র


পঞ্চায়েত সম্পর্কে বামপন্থীদের বোঝাপড়া

১৯৭৮ সাল থেকে দলীয় প্রতীকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল পঞ্চায়েত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। তৎপূর্বে ১৯৬৪ সালের নির্বাচনে কমিউনিস্টরা দলীয় প্রতীক ছাড়া অনেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওই বছরে অনুষ্ঠিত পার্টির সপ্তম কংগ্রেসে কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হয়। সিপিআই(এম) দলের গৃহীত কর্মসূচিতে এ ধরনের সংস্থা বা রাজ্য সরকারে অংশগ্রহণের বিষয়টি স্পষ্ট করে দেওয়া হয়। উল্লেখ্য যে, ১৯৬৪ সালের ১৪ বছর পর রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন বামফ্রন্ট সরকারের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়। মার্কসীয় বিশ্লেষণ থেকে আমরা জেনেছি! শোষকশ্রেণির হাতে রাষ্ট্র, সরকার, পঞ্চায়েত বা পুরসভা থাকার অর্থ হলো এই ক্ষমতা-সংস্থা শ্রেণিশোষণের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হবে। মালিকশ্রেণি শোষণের স্বার্থেই এই রাজনৈতিক ক্ষমতা তাদের দখলে রাখতে চায়। পুলিশ, আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি শোষকের নিয়ন্ত্রণে থাকলে এই ব্যবস্থায় যারা পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে এবং শোষণের জাঁতাকলে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছে তাদের পক্ষে রুখে দাঁড়ানো বেশ কঠিন। শ্রেণি চেতনার বিকাশ ছাড়া এই শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই ফলপ্রসূ হয় না। সংগ্রাম-আন্দোলনের পথ বেয়েই শোষিত মানুষের মধ্যে একাত্মতা গড়ে ওঠে। মজুরের দল শ্রেণিতে ঐক্যবদ্ধ হয়। নিজেদের শক্তি সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে। শ্রমিক-কৃষকের ঐক্য গড়ে তোলার তাগিদ অনুভব করে। এই সংগ্রাম-আন্দোলনের পথ ধরে মুক্তির লড়াই সঠিক দিশায় অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে পার্টির ভূমিকাই প্রধান। আমাদের রাজনৈতিক বোঝাপড়া হলো - বর্তমান রাষ্ট্র কাঠামোর আমূল পরিবর্তন ছাড়া জনজীবনের মূল সমস্যা যেমন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদির সমাধান সম্ভব নয়। রাজ্যের সরকার বা পঞ্চায়েতের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। এ ধরনের সরকার জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যা কিছুটা লাঘব করতে পারে। শ্রেণির লড়াইয়ে গতি সঞ্চার করতে পারে। আমরা যে ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছি কেন তা উৎখাত করতে হবে সেই উপলব্ধিতে পৌঁছাতে এই সময়ের সংগ্রাম সহায়ক হবে। জনগণের কল্যাণের কাজে জনগণকে সাথে নিতে হবে। মানুষকে বুঝতে সাহায্য করতে হবে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তাঁরা ব্রাত্য নন। পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে অবলম্বন করে গণউদ্যোগ গড়ে তোলা যায় যা আংশিক দাবির সংগ্রামের অভিজ্ঞতায় বৃহত্তর গণসংগ্রামে পরিণত হবে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনার প্রসার ঘটবে। এই বোঝাপড়া থেকেই বামপন্থীরা রাজ্য সরকার বা পঞ্চায়েতে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

জনগণকে সাথে নিয়ে পথ চলা শুরু

১৯৭৮ সালে রাজ্যে অনুষ্ঠিত পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বামপন্থীরা জয়লাভ করে। গ্রামবাংলায় জনগণকে সাথে নিয়ে পথ চলা শুরু হয়। ১৯৭৮ সালের আগেও রাজ্যে পঞ্চায়েত ছিল। ১৯৬৪ সালের নির্বাচনে গঠিত চার-স্তরীয় সেই পঞ্চায়েতের কোনো কাজ ছিল না, নিজস্ব কার্যালয় ছিল না, উন্নয়ন বা জনকল্যাণের দায়িত্ব ছিল না, রাজ্যসরকার থেকে উন্নয়নের জন্য কোনো অর্থের জোগান ছিল না। জমিদার, মহাজন, বা সম্পদশালী ব্যক্তিদের হাতেই ছিল বেশিরভাগ পঞ্চায়েত। তাদের বৈঠকখানাই ছিল পঞ্চায়েতের ঠিকানা। ১৯৫৮ সালে যোজনা কমিশনের এক সমীক্ষায় দেখা যায় - পঞ্চায়েতে নির্বাচিত সদস্যদের ৮৮.১ শতাংশ এবং কর্মকর্তাদের ৯৫.৭ শতাংশ এসেছিলেন জোতদার এবং জমিদার পরিবার থেকে। বাম সরকারের আমলে তপশিলি জাতি, আদিবাসী, সংখ্যালঘু, মহিলা সহ সাধারণ পরিবার থেকে সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন শতকরা ৯৭ শতাংশ। রাজ্য সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া সমাজের আর্থিকভাবে দুর্বল, মহিলা সহ সব অংশকে এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় শামিল করা সম্ভব ছিল না। পরিবর্তিত ব্যবস্থায় গ্রাম জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে যেমন কাজ, মজুরি, শিক্ষা, রাস্তাঘাট, যোগাযোগ, পানীয়জল, সেচ, জল নিকাশি ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য ইত্যাদির ব্যবস্থাপনা এবং উন্নয়নে পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়িত্ব ও ক্ষমতা দেওয়া হয়। গ্রামোন্নয়নের সাফল্য পঞ্চায়েত পরিচালনা ও দায়-দায়িত্ব পালনের অভিমুখের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। জনমুখী পঞ্চায়েতের অন্যতম লক্ষ্য ছিল - ক) গ্রামীণ সম্পদের বিকাশ ও তার যথাযথ সদ্ব্যবহার এবং খ) গণউদ্যোগ সৃষ্টি ও উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। জনগণের মধ্যে দায়িত্ববোধ, অধিকারবোধ, এবং কর্তব্য সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলা ছিল পঞ্চায়েতের প্রাথমিক কাজ। গ্রাম উন্নয়নে জনমুখী পঞ্চায়েতের প্রশ্নাতীত সাফল্য শুধু আমাদের দেশে নয় বিদেশেও প্রশংসিত হয়েছে। রাজ্যে বিকেন্দ্রীকরণ ও উন্নয়নের এই মডেল সারা দেশে চালু করার জন্য ১৯৯২ সালে ৭৩তম সংবিধান সংশোধন করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের পথ প্রদর্শক ভূমিকা জাতীয় স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৭৮ সালে রাজ্যে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। ক্রমান্বয়ে অতিরিক্ত কয়েকটি বিভাগের কাজ - কৃষি, খাদ্য, ভূমিসংস্কার, সমবায়, বন, প্রাণী পালন, গৃহনির্মাণ, জনস্বাস্থ্য, সমাজকল্যাণ প্রভৃতি নানা বিষয়ের সঙ্গে পঞ্চায়েতকে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত করা হয়। সমষ্টি উন্নয়ন বিভাগের কাজকর্মে কিংবা সুসংহত গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্প রূপায়ণের ক্ষেত্রে পঞ্চায়েতের প্রত্যক্ষ ভূমিকা গড়ে ওঠে। সেই সময়ের নতুন অভিজ্ঞতা হলো আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন ও গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিতদের প্রশাসনের সমন্বিত কর্মপদ্ধতি।

২০১১: ধ্বংসের বীজ বপন

১৯৭৮ সালে ভয়াবহ বন্যার কবল থেকে মানুষ দুর্দম প্রাণশক্তিতে কীভাবে নতুন করে জেগে উঠছে সেটা একটা ইতিহাস।পঞ্চায়েত ও জনগণের উদ্যোগ ছাড়া বন্যা দুর্গত মানুষকে উদ্ধার, ত্রাণের ব্যবস্থা, রাস্তা, সেতু সহ সমস্ত পরিকাঠামো পুনর্নিমাণ, বিকল্প চাষের ব্যবস্থা করা এক দুঃসাধ্য কাজ ছিল। সেই কঠিন পরীক্ষায় সফল হয়েছিল নবগঠিত পঞ্চায়েত। খেতমজুরের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে পাশে দাঁড়িয়েছিল পঞ্চায়েত। জমিতে আধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই, শিক্ষা এবং কাজের দাবিতে লড়াই সফল হওয়ার পিছনে গণউদ্যোগ গড়ে তোলার প্রধান ভূমিকা ছিল পঞ্চায়েতের। আমরা দেখেছি, জনগণের গণতান্ত্রিক বোধ ও রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধির প্রশস্ত ক্ষেত্র ছিল পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। গ্রামীণ মানুষের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আর্থিক উন্নয়ন ও সামাজিক কল্যাণ সাধনের দরজা খুলে দিয়েছে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। প্রমাণিত হয়েছে, সরকারের সদিচ্ছা থাকলে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ায় জনগণের সহযোগিতা এবং অংশগ্রহণের পরিসর তৈরি হয়। বামফ্রন্ট পঞ্চায়েতকে প্রকৃত অর্থেই জনগণের প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করতে পথ দেখিয়েছে। ২০১১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত রাজ্য সরকার পঞ্চায়েত আইন ও তার মর্মবস্তুর ঠিক বিপরীতে হাঁটছে। ভূমিসংস্কারের কাজ কার্যত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বামজমানায় বণ্টিত জমি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। পাট্টা বাতিল করে সেই জমির দখল দেওয়া হচ্ছে পূর্বতন মালিককে। মোকদ্দমায় আটকে থাকা জমির ক্ষেত্রে সরকার মালিকের অনুকূলে অবস্থান গ্রহণ করছে। এবারের বাজেট অধিবেশনে ভূমিসংস্কার আইনের সংশোধন করে বলা হয়েছে - সরকারের হাতে থাকা জমি কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি বা করপোরেটকে তাদের আবেদনের ভিত্তিতে রায়তি স্বত্ব দেওয়া হবে। ভূমিহীন, বাস্তুহীনদের বিনামূল্যে জমি দেওয়ার পরিবর্তে কোম্পানি, করপোরেট এবং প্রমোটারদের বিক্রি করার ব্যবস্থা পাকা করা হয়েছে। আদিবাসীদের দখলে থাকা বনাঞ্চলের জমির অধিকার দেওয়ার আবেদন বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। গণতন্ত্রকে প্রসারিত করার পরিবর্তে বলা হচ্ছে, বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত করতে হবে। সর্বত্র দলীয়ভাবে পঞ্চায়েতকে কুক্ষিগত করা হয়েছে। পুলিশ ও আশ্রিত গুন্ডাবাহিনীর দাপটে গণতান্ত্রিক পরিসর ধ্বংস করা হয়েছে।

দুর্নীতিঃ শাসকদলের প্রাণভোমরা

রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস একটি আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত দল। নীতি ও আদর্শ বিবর্জিত একটি দলের অস্তিত্ব দুর্নীতি ও অসদুপায়ে অর্থ উপার্জনের উপর নির্ভরশীল। ফেল কড়ি মাখ তেল এই নিয়মেই দল চলে। লুটের অর্থের উৎস বন্ধ হলে এই দলে মাছি তাড়াবার লোক মিলবে না। এই আমলে সরকারি কাজের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় অবাধে লুট চলছে। কর্মী, নেতা, জনপ্রতিনিধি, মন্ত্রী, আমলা এবং পুলিশ সকলের জন্য লুটে খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। রাজ্যজুড়েই জোর-জুলুম, তোলাবাজি চলছে। প্রতিকারের কোনো জায়গা নেই। লুট, তোলাবাজির সামাজিকীকরণ করা হয়েছে। পুলিশ কার্যত তৃণমূলের দলদাসে পরিণত হয়েছে। দলীয়ভাবে নিয়োগ করা সিভিক ভলান্টিয়ারদের রাজনৈতিক নজরদারির কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। পঞ্চায়েত বা সরকারের কাজে কোনো স্বচ্ছতা নেই। এই আমলে গ্রাম সংসদ সভা হয় না। জনগণের অংশগ্রহণ বা মতামত দেওয়ার সুযোগ নেই। স্থায়ী সমিতি এখন গুরুত্বহীন। ব্লক স্তরে উন্নয়নের নির্ধারক হলো - ডেভেলপমেন্ট মনিটরিং কমিটি। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ৩৪১ টি ব্লকে এধরনের কমিটি গঠিত হয়েছে। বিডিও এই কমিটির সর্বেসর্বা। সদস্যরা হলেন বিভিন্ন বিভাগের আধিকারিক। উপভোক্তা ঠিক হচ্ছে অর্থের বিনিময়ে বা দলীয় আনুগত্য বিচারে। সমষ্টিগত ভাবনার ক্ষেত্রটি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ার পরিবর্তে ক্ষমতা চূড়ান্তভাবে কেন্দ্রীভূত হয়েছে - মুখ্যমন্ত্রী, জেলাশাসক, বিডিও - মূলত এই তিনস্তরে। এই প্রশাসনিক কর্তাদের কাজ করতে হচ্ছে দলীয় নেতাদের নির্দেশনায়। নির্বাচিত পঞ্চায়েত সদস্যদের কাজ হলো - বিভিন্ন প্রকল্পের ঠিকাদার, সুপারভাইজারদের থেকে কাটমানি আদায় এবং সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে উপভোক্তার থেকে উৎকোচ গ্রহণ। এদের বাড়ি, গাড়ি, সঞ্চয়, ঐশ্বর্য দেখলেই শাসকদলের লুটপাটের বহর বোঝা যায়।

মুখ পুড়ছে রাজ্যের

সম্প্রতি দুর্নীতির ঘটনাসমূহ পরপর উন্মোচিত হচ্ছে। শিক্ষক নিয়োগে কোটি কোটি টাকার উৎকোচ নেওয়া হয়েছে। নেতা, মন্ত্রী, আমলা, উপাচার্য, এজেন্ট ধরা পড়ে জেলে যাচ্ছেন। শিক্ষকদের টাকার বিনিময়ে বদলির ফলে বহু স্কুলে শিক্ষকের অভাবে পঠন পাঠন লাটে উঠেছে। অবিভাবকরা সরকারি স্কুলের উপর ভরসা রাখতে পারছেন না। সরকারি স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কমছে। এ বছর মাধ্যমিকে পরীক্ষার্থী কমেছে চার লক্ষ। যত্রতত্র গজিয়ে উঠেছে বেসরকারি সংস্থা বা ব্যক্তি মালিকানার স্কুল। বাম সরকারের সময় শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, অভিভাবক, শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবীদের যুক্ত করে প্রতিটি গ্রাম সংসদ ভিত্তিক গ্রাম শিক্ষা কমিটি গঠিত হয়েছিল। স্কুলছুটের সমস্যা, পরিকাঠামো, পরিবেশ, মিড-ডে মিল, পঠন-পাঠন সবকিছুই দেখভাল করা হতো। এই কমিটির জন্য কোনো আর্থিক দায় সরকারের ছিল না। ২০১২ সালে রাজ্যের বিদ্যালয় শিক্ষা দপ্তর এই গ্রাম শিক্ষা কমিটি তুলে দেয়। রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে পঞ্চায়েত দপ্তরের পরিচালনায় ও সর্বশিক্ষা অভিযানের সহায়তায় ১,৬০,১০৮টি শিশু শিক্ষা কেন্দ্র এবং ১,৯১৭টি মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র চালু হয়েছিল। এই শিক্ষা কেন্দ্রে পড়ুয়া যথাক্রমে ১৪ লক্ষ এবং ৪ লক্ষ। এই ছাত্রছাত্রীদের ৮৪.২৩ শতাংশ তপশিলি জাতি, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু পরিবারের। তৃণমূল সরকারের শাসনে এই শিক্ষাকেন্দ্রে কোনো শিক্ষক নিয়োগ হয়নি। কর্মরত শিক্ষকদের অবসরের পর শিক্ষকের অভাবে বহু শিক্ষা কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। রাজ্যের প্রাকৃতিক সম্পদ - জমি, জল, গাছ, বালি, পাথর, কয়লা ইত্যাদি বেপরোয়াভাবে লুটপাট করছে শাসকদলের ছোটো-বড়ো নেতা, মন্ত্রী, জনপ্রতিনিধি। লুটপাটের জন্য দেশের একমাত্র রাজ্যের শ্রমজীবীরা ১০০ দিনের কাজ থেকে বঞ্চিত। সরকারি নথিতে তথ্য আছে কারা রেগা-র অর্থ চুরি করেছেন, কিন্তু একজনের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। একই কারণে গৃহহীন মানুষের বাড়ি নির্মাণের কাজ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। স্ব্যাস্থ্য পরিষেবা বেহাল। গ্রাম্য রাস্তা যানবাহন চলাচলের অবস্থায় নেই। গণতান্ত্রিক নীতি, নিয়মের বালাই নেই। সর্বত্র গুন্ডা ও পুলিশের দাপাদাপি চলছে। রাজ্যে কাজ নেই, শিল্প নেই। বাঁচার তাগিদে লাখ লাখ তরুণ তরতাজা ছেলেরা অন্য রাজ্যে যেতে বাধ্য হচ্ছে। মোদি সরকার জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প আইনে ১০০ দিনের কাজ কার্যত বন্ধ করতে চাইছে। ক্রমান্বয়ে বরাদ্দ কমছে। গত বছরের সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ করা হয়েছিল ৮৯,৪০০ কোটি টাকা যা প্রায় ৩৩ শতাংশ কমিয়ে এবারে বরাদ্দ করা হয়েছে ৬০,০০০ কোটি টাকা।

বিপন্ন কৃষক, বিপন্ন অর্থনৈতিক অবস্থা

গ্রামের অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। কৃষিতে জিডিপি-র অংশ কমতে কমতে চলতি বছরের গোড়ায় প্রায় ১৪ শতাংশে নেমেছে, যেখানে জনগণের ৫৮ শতাংশ কৃষির উপর নির্ভরশীল। এ থেকেই কৃষির উপর নির্ভরশীল মানুষের আর্থিক দুরবস্থা অনুমান করা যায়। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে কৃষি ও শিল্প উভয় ক্ষেত্রেই যুগপৎ উন্নতির পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে পশ্চিমবাংলা কৃষির বিকাশে দেশের মধ্যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। সেচের সুযোগ সম্প্রসারিত হয়েছিল শতকরা ২৭ ভাগ থেকে শতকরা ৭২ ভাগ জমিতে। ধান, মাছ, আলু, সবজি উৎপাদনে প্রথম স্থানে ছিল। শস্য নিবিড়তা বৃদ্ধি ও কৃষি বৈচিত্র্যে উল্লেখযোগ্য সাফল্যের অধিকারী ছিল এ রাজ্য। পঞ্চায়েত ও ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে কৃষি ও সামগ্রিক উন্নয়নে জনগণকে যুক্ত করার ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকার দিশারি। বনাঞ্চলের জমিতে আদিবাসী জনগণকে পাট্টা প্রদান, নারী পুরুষের যৌথ পাট্টা ব্যবস্থা, কিষান ক্রেডিট কার্ড, নারীর সশক্তিকরণ বাম সরকারের অবদান। বর্তমানে তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত সরকারের আমলে এ রাজ্যে কৃষি, কৃষক, শিল্প, শ্রমিক, শিক্ষা, শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নারীর সম্মান, নিরাপত্তা, গণতন্ত্র, শান্তি, সম্প্রীতি সব কিছুই বিপদাপন্ন । কৃষকের জীবনে এক ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। জীবন-জীবিকা ও সম্পত্তির অধিকার বিপন্ন। নিজের বাড়িতে থাকার জন্য নিজের জমি চাষের জন্যে তোলাবাজদের দাবি মতো টাকা দিতে হচ্ছে। পঞ্চায়েত, পুরসভা, সমবায় সহ সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। সমবায় সমিতিগুলি এই জমানায় কৃষক ও সাধারণ মানুষের প্রতিষ্ঠান নয়। সমবায়ের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে বলপ্রয়োগে দখল কায়েম করেছে শাসকের অনুগামী লুটেরার দল। সমবায় ফসলের বিমার সুযোগ কৃষককে দিতে পারে না, সার, বীজ, ঋণ সহ কৃষি উপকরণ ন্যায্য মূল্যে কৃষককে সরবরাহ করে না। সমবায়ে কৃষকের ফসল সহায়ক মূল্যে সংগ্রহের ব্যবস্থা অপ্রতুল। প্রতিশ্রুতি মতো ব্লকে, কিষান মান্ডিতে এবং গ্রাম পঞ্চায়েতে ধান কেনার দৃশ্য দুরবিন দিয়েও চোখে পড়ে না। সরকারের পছন্দ কৃষক নয় ফড়ে। তাদের থেকেই ফসল কেনার ঝোঁক বেশি। এই অবস্থায় চাষি সহায়ক মূল্যের আশা করেতে পারে কি? যে কয়েকটি সরকারি ক্রয় কেন্দ্র আছে সেখানে নানান ফিরিস্তি। ৮-৯ রকমের নথি যেমন- রেশন কার্ড, আধার কার্ড, ব্যাংকের পাশ বই, জমির রেকর্ড, ভোটের কার্ড ইত্যাদি জমা করে নাম নথিভুক্ত করতে হবে। ধান বিক্রির সময় কুইন্টাল প্রতি ৫-৭ কেজির দাম কম দেওয়া হচ্ছে। ধানের দাম নগদে নয় দেওয়া হবে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। অনেক ক্ষেত্রে সময়মতো অ্যাকাউন্টে টাকা জমা হচ্ছে না। অভাবের তাড়নায় যে কৃষক ফসল বিক্রি করছে সে দাম সময়মতো না পেলে পরবর্তী চাষ করবে কীভাবে? নিরুপায় হয়ে ফড়েদের কাছে যেতে বাধ্য হচ্ছে। মাইক্রোফাইনান্স কোম্পানি থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে। এ রাজ্যে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ছিল না। তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত সরকারের কৃষক স্বার্থ বিরোধী অবস্থানের ফলে প্রথম ৫ বছরে ১৬৭ জন কৃষককে আত্মহত্যায় বাধ্য করেছে। সরকার এই বিপন্ন পরিবারের পাশে দাঁড়ায়নি এমনকী মৃত্যুর ঘটনা পর্যন্ত অস্বীকার করেছে। রাজ্য সরকার সেচের সুযোগ বৃদ্ধির জন্য “জল ধরো জল ভরো” আওয়াজ তুলেছিল বাস্তবে যা চলছে সেটা - দাদা ধরো, পকেট ভরো। মেলা, উৎসব, হুল্লোড় আর ভুরিভোজে জলের মতো সরকারি অর্থ ব্যয় হচ্ছে, অন্যদিকে কৃষকের শস্য বিমার প্রিমিয়াম দেওয়ার টাকা নেই। এই হচ্ছে কৃষক দরদের নমুনা। সর্বস্বান্ত কৃষক ঋণগ্রস্ততার বিপদ থেকে বাঁচতে জমি ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। কর্মহীন, ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই পরিণতি দেখে নতুন প্রজন্ম চাষবাসে আদৌ আগ্রহী নয়। এই উদ্ভূত পরিমণ্ডল করপোরেটকে কৃষিতে অনুপ্রবেশের জায়গা করে দিচ্ছে।

(আগামী সংখ্যায়)