৬০ বর্ষ ২৯ সংখ্যা / ৩ মার্চ, ২০২৩ / ১৮ ফাল্গুন, ১৪২৯
তৃণমূল এবং বিজেপি’র মেকি লড়াই ভেঙে ওড়াও লাল নিশান
পলাশ দাশ
সাগরদিঘি নতুন দিনের সূচনা ঘটালো। অভিনন্দন সাগরদিঘির জনগণকে। “তৃণমূল এবং বিজেপি ছাড়া বিকল্প নেই”, করপোরেট মিডিয়ার তৈরি এই ধারণা ভেঙে দিয়ে বাম ও গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির বিজয় পতাকা উড়ছে সাগরদিঘিতে। কাল গোটা বাংলায় তৃণমূল এবং বিজেপি মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হবে।
সামনেই পঞ্চায়েত ভোট। তৃণমূলের পঞ্চায়েতের ওপর ক্ষুব্ধ মানুষের রোষের সামনে পড়তে হচ্ছে বিডিও থেকে দিদির দূতদের। কদর্য দুর্নীতিতে আপাদমস্তক ডুবে থাকা তৃণমূল সম্পর্কে মানুষের তীব্র ঘৃণা সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ এটাও দেখছেন দুর্নীতির কোনো তদন্তই শেষ হচ্ছে না। কোর্টের নির্দেশে সিবিআই তদন্তে চুনোপুঁটি উঠলেও বিজেপি নিয়ন্ত্রিত এজেন্সির জালে রাঘববোয়ালরা উঠছে না। গোপন মিটিংয়ে বোঝাপড়া সাদা চোখেই ধরা পড়ছে। এদিকে বেকারি বেড়েছে সাংঘাতিক। দলে দলে ভিন রাজ্যে মানুষ কাজের সন্ধানে যেতে বাধ্য হচ্ছেন, আলু, সবজি সহ ফসলের দাম পাচ্ছে না কৃষক, ১০০ দিনের কাজ বন্ধ, বকেয়া টাকাও মিলছে না, শিক্ষাব্যবস্থা বেহাল, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, চরম দারিদ্র্যৃ বাড়ছে, খাদ্য সুরক্ষা থাকছে না কিন্তু দুটি দলের নেতারা এসব বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটে আছেন।
পরিণতিতে বিধানসভা ভোটের পর বাংলার রাজনীতির বিন্যাসের ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটছে যার প্রমাণ মিলছে সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলির ফলাফলে। বামপন্থীদের সমর্থন বাড়ছে, শত বাধা, আক্রমণ সত্ত্বেও। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই জমা হতে থাকা সমস্যা ক্ষোভ হয়ে ফেটে পড়ছে আন্দোলনের জোয়ারে। চাকরিপ্রার্থী থেকে সরকারি কর্মচারী, শ্রমিক এবং কৃষক, ছাত্র-যুবদের লড়াই দেখছে রাজপথ। বেকায়দায় পড়া দুটি দলই উত্তরণের পথ খুঁজছে মেরুকরণের পুরনো ছকে। আমাদের সজাগ থেকে তা ব্যর্থ করতে হবে।
সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
সমাজকে নিজেদের ছাঁচে ঢেলে, খণ্ডবিখণ্ড করে নিজেদের স্বার্থের অনুসারী রাজনৈতিক বিন্যাস তৈরির যে কৌশল বিজেপি-আরএসএস সারা দেশে প্রয়োগ করছে, ওদেরই ভাষায় তা হলো সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। ধর্মীয় বিভাজনের আধারে নানা জাতি-উপজাতি, অনগ্রসর বিভিন্ন গোষ্ঠী, সম্প্রদায়ের মানুষকে পরিচিতির ভিত্তিতে টুকরো টুকরো করে মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার ইঞ্জিনিয়ারিং আমাদের রাজ্যেও চলছে। বঞ্চনা, অনগ্রসরতা, আকাঙ্ক্ষাকে ব্যবহার করে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজনৈতিক লাভ তুলছে বিজেপি এবং তৃণমূল।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল এবং বিজেপি’র পারস্পরিক বাদানুবাদের মধ্যেই নিহিত ছিল সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ। ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে বিজেপি পেয়েছিল ১৭ শতাংশ ভোট। তৃণমূলের বেড়েছিল সংখ্যালঘু ভোট।
২০১৬-র নির্বাচনে লড়াই ছিল তৃণমূল বনাম বাম-কংগ্রেসের। তৃণমূল জিতলেও বাম-কংগ্রেসের মিলিত ভোটের পরিমাণ ছিল ৩৯ শতাংশ, তৃণমূলের ছিল ৪৪ শতাংশ। এই যৎসামান্য ব্যবধানই আশঙ্কার কারণ। অতএব মাস্টার প্ল্যান।
২০১৬ সালের নির্বাচনের পর থেকে বিজেপি এবং তৃণমূল পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও পরিচিতিসত্তার রাজনীতি শুরু করে। শ্রেণিগত অবস্থান থেকে সরিয়ে মানুষকে তার গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, ধর্মের বাউন্ডারির মধ্যে আবদ্ধ রেখে দুজনে তাদের ভোট ব্যাঙ্ক তৈরি করে।
সম্মতি উৎপাদন
তৃণমূল সরকারকে টেকাতে বিরোধী ভোট ভাগ করা জরুরি। তাই বিজেপি-কে প্রতিষ্ঠা দেওয়া হলো প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ব্যবহার করে। ২০১২ সালেই ইমাম-মুয়াজ্জিম ভাতা চালু করে রাজ্য সরকার আইনের তোয়াক্কা না করেই। মুখ্যমন্ত্রীর হিজাব পরা, বিজেপি এবং বিজেপি’র মুখপাত্র হয়ে ওঠা রাজ্যপালের সঙ্গে প্রতিনিয়ত ঝগড়া কিংবা বিজেপি নেতাদের ক্রমাগত মুখ্যমন্ত্রীকে খালা, বেগম, বাংলাকে মিনি পাকিস্তান বলা ইত্যাদি মেরুকরণে সাহায্য করে। সংখ্যালঘু অংশ যদি এককাট্টা হয়ে তৃণমূলকে ভোট দেয় তাহলে সংখ্যাগুরুকেও ভোট নষ্ট না করে বিজেপি-কে দিতে হবে - এই প্রচার চলে হিন্দু এলাকায়। এর ঠিক উলটো প্রচার চলে মুসলমান এলাকায়, বিজেপি হিন্দু ভোটে ভর করে ক্ষমতায় চলে আসতে পারে তাই সংখ্যালঘুদের তৃণমূলকেই সমর্থন করতে হবে। করপোরেট মিডিয়া বিরাট ভূমিকা নেয় এই ভাষ্য প্রতিষ্ঠিত করতে। যেন অন্য কোনো বিকল্প নেই।
তৃণমূলের লক্ষ্য অধিকাংশ সংখ্যালঘু ভোট আর যতটা সম্ভব হিন্দু ভোট, উল্টোদিকে বিজেপি’র ফোকাস হিন্দু ভোট। সিএসডিএস’র সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১৬, ২০১৯ ও ২০২১ সালের নির্বাচনে তৃণমূলের প্রাপ্ত সংখ্যালঘু ভোটের পরিমাণ ৫১ শতাংশ থেকে ৭০ হয়ে ৭৫ শতাংশে পৌঁছায়। উল্টোদিকে ২০১৬ থেকে ২০১৯-র নির্বাচনে সংখ্যাগুরু অংশে তৃণমূলের সমর্থন ১১ শতাংশ কমে যায়। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ১৮টি আসন জেতে। বিজেপি’র ভোট ২০১৬ সালের থেকে ২০১৯ সালে একলাফে ১০ শতাংশ থেকে বেড়ে হয় ৪০.৬৪ শতাংশ। ২০১৯ সালের তীব্র মেরুকরণের ফলে বিজেপি হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোট পায় ৫৭ শতাংশ, তৃণমূল ৩২ শতাংশ।
খতিয়ে দেখলে এদের যৌথ পরিকল্পনার অনেক ফুটপ্রিন্ট যত্রতত্র দেখা যাবে। কোনো বাধা ছাড়াই আরএসএস’র রামনবমীর অস্ত্র মিছিল হয় অথচ পুলিশ, প্রশাসন নানা অছিলায় বামপন্থীদের গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অনুমতি দেয় না। স্রেফ প্রচারের জোরে বাস্তব অস্তিত্বহীন বিজেপি-কে মূল বিরোধী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হলো। নোয়াম চমস্কির ভাষায় এটাই ‘‘ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট’’ বা ‘‘সম্মতি উৎপাদন’’।
বিজেপি’র প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল রাজ্যে পা রাখা। বিজেপি’র জমি তৈরি করেছে আরএসএস, তৃণমূলের সহযোগিতায়। আরএসএস এবং তৃণমূলের সম্পর্ক চিরকালই মধুর। এর সঙ্গে আছে তৃণমূলের অসংখ্য দুর্নীতির মামলায় রেহাই পাওয়ার তাগিদ। আসন থেকে ভোটরফা সবই হয়েছে, দুজনের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে।
হিন্দু চিত্ত দখলের লড়াই!
২০১৯সালের নির্বাচনের ফলাফলের সংশোধনের জন্য এবার ‘‘হিন্দুত্বের’’ তৃণমূলী ব্র্যান্ড সামনে এলো। একদা যে মুখ্যমন্ত্রী সংখ্যালঘু মানুষের চিত্ত জিততে হিজাব পরতেন, কলমা পড়তেন, ‘‘যে গোরু দুধ দেয় তার চাট সহ্য করতে হয়’’ - এমন উক্তি করতে যাঁর বাধতো না সেই তিনিই এবার নেমে পড়লেন হিন্দু চিত্ত জয় করতে। পুরনো কৌশল পরিত্যাগ করে মঞ্চে মঞ্চে চণ্ডীপাঠ, সরস্বতী-লক্ষী পুজোর মন্ত্র পাঠ করতে শুরু করলেন, যত্রতত্র বলা শুরু করলেন যে তিনি ব্রাহ্মণ কন্যা, নিয়মিত পুজো আচ্চা করা একজন ধার্মিক হিন্দু নারী। “বহিরাগত” বিজেপি’র চড়া হিন্দুত্বের ডোজ মোকাবিলায় তৃণমূল ব্যবহার করে বাংলার উদার, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজ সংস্কারের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে। একদিকে ‘‘জয় শ্রীরাম’’ আর তার পালটা ‘‘জয় বাংলা’’ রণধ্বনি। এক দল হনুমান পুজো করলে অন্যটি গণেশ পূজো, উভয়েই নামে রামনবমীর মিছিলে, হিন্দু পুরোহিতদের ভাতা চালু করা হয়, দুর্গা পুজোয় ক্লাবের হাতে নগদ টাকা, কার্নিভাল হয়। মুখ্যমন্ত্রী অসংখ্য পুজোর উদ্বোধন করেন। সেই প্রথম সংখ্যালঘু মানুষদের প্রকাশ্যে গোরু জবাই বন্ধ করার আবেদন করেন মুখ্যমন্ত্রী। ভোটের মুখে সরকারি প্রকল্পের নাম রাখা হয় হিন্দু দেবীর নামে - ‘‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’’। এসবই হলো সংখ্যালঘু তোষণের ইমেজ সংশোধনের চেষ্টা। বিজেপি’র থেকে হিন্দু ভোট ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি সংখ্যালঘু ভোটের একচেটিয়া দখলদারি রাখার কৌশল যেন সার্কাসের ট্রাপিজের খেলা। ২০২১ -র ভোটে তৃণমূলের থিম স্লোগান, থিম সং ছিল ‘‘খেলা হবে’’। সত্যি খেলাই বটে!
২০২১ সালের নির্বাচনে তৃণমূল ২০১৯ সালের তুলনায় হিন্দু ভোট বাড়াতে পেরেছে ৭ শতাংশ, বিজেপি’র কমেছে সমপরিমাণ। তৃণমূল ৩২ থেকে ৩৯ শতাংশ, বিজেপি ৫৭ থেকে কমে ৫০ শতাংশ। হিন্দুদের মধ্যে তৃণমূলের সমর্থন সামান্য বেড়েছে আবার সংখ্যালঘু ভোট বেড়েছে অনেকটা। যাঁরা তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন তাঁদেরও বিরাট অংশ মনে করেন তৃণমূলের বিরুদ্ধে ওঠা সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগের সারবত্তা আছে। কিন্তু তথাপি তাঁরা বিজেপি-কে আটকাতে তৃণমূলকেই বেছেছেন।
ছিন্নভিন্ন সমাজে ভোটের জটিল বিন্যাস
পরিচিতি সত্তার রাজনীতির প্রতিফলন ঘটেছে ২০১৯ ও ২০২১ সালের নির্বাচনে।
২০১৯ সালে বিজেপি ওবিসি-ভুক্ত মানুষের ৬৮ শতাংশ, রাজবংশী ও নমশূদ্র সম্প্রদায়ের ৭৫ ও ৫৪ শতাংশ এবং আদিবাসী মানুষের ৬২ শতাংশের সমর্থন পায়। গরিব আদিবাসী এলাকাসহ বিশেষত গ্রামাঞ্চলে আরএসএস অসংখ্য স্কুল, এনজিও ইত্যাদির মাধ্যমে গোপনে কাজ করে চলেছে। মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে ব্যবহার করে আরএসএস, ধর্মীয় নানা আচার, অনুষ্ঠান, ক্রিয়াকর্মের মধ্যে সরলমনা বিভিন্ন জনজাতির মানুষকে যুক্ত করে তাদের রাজনৈতিকভাবে বিজেপি অনুসারী করে তুলতে সচেষ্ট থেকেছে।
২০১৯ থেকে ২০২১ সাল তৃণমূল প্রতিটি সামাজিক ক্ষেত্রে নিজেদের সমর্থন বাড়াতে মরিয়া ছিল। ২০২১ সালের নির্বাচনে তৃণমূল রাজবংশী মানুষের মধ্যে ৮ থেকে ৪২ শতাংশ ভোটে পৌঁছায়, একইভাবে আদিবাসী মানুষের মধ্যে তাদের সমর্থন বাড়ে ২৪ থেকে ৪২ শতাংশ, ওবিসি ভোট ২৭ থেকে ৩৬ শতাংশে যায়। নমশূদ্র ও অন্যান্য দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের সমর্থন বিজেপি ধরে রাখতে পারে। নির্বাচন শেষ হলে সরকারে যায় কেউ, কেউবা বিরোধীদলের মর্যাদা পায়। কিন্তু সমাজে এদের দ্বারা সৃষ্ট গভীর ক্ষত থেকে যায়।
এ মাটি বিজেপি’র হয়নি, কখনও হবে না
২০১৯ ও ২০২১ সালে বাংলার রাজনীতির ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা বেশি ভোট, আসন বিজেপি পেয়েছে। ২০১৯ সালের পর মেরুকরণের আরও আগ্রাসী চেষ্টা সত্ত্বেও বিজেপি ২০২১ সালে বাংলায় সরকার গড়তে পারল না কেন?
২০১৯ নির্বাচন পরবর্তী সিএসডিএস’র সমীক্ষায় খুবই তাৎপর্যপূর্ণ কিছু চিত্র উঠে এসেছে। আশার কথা হলো বাংলার মানুষ আজও প্রধানত অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ।
বাংলায় প্রতি ৫ জন হিন্দু মানুষের ১ জন বাবরি মসজিদ ভাঙা ঠিক হয়েছে বলে মনে করেন যেখানে সারা দেশের গড় ৫ জনে ২ জন। মেরুকরণের তীব্র চেষ্টা সত্ত্বেও বাংলার ৮১ শতাংশ মানুষ মনে করেন দেশটা শুধু হিন্দুদের নয়, সব ধর্মের মানুষের, সারা দেশে যা ভাবে ৭৪ শতাংশ মানুষ। সংখ্যাগুরু অংশের আপত্তি থাকলেও সংখ্যালঘু স্বার্থরক্ষায় সরকারের বিশেষ পদক্ষেপের প্রয়োজন আছে বলে মনে করেছেন ৩৮ শতাংশ মানুষ। একই প্রশ্ন পরে আবার করা হলে দেখা যায়, ৫৮ শতাংশ মানুষ সংখ্যালঘু স্বার্থরক্ষায় সরকারের ভূমিকা নেওয়া উচিত মনে করছেন। বিজেপি যত তার আগ্রাসী মনোভাবের পরিচয় রেখেছে, মানুষ তত আশঙ্কিত হয়েছেন এবং বিজেপি থেকে সরে এসেছেন।
২০১৯ সালে যত মানুষ বিজেপি-কে সমর্থন করেছিলেন তাঁরা সব বিজেপি-আরএসএস’র হিন্দুত্বের সমর্থক হয়ে উঠেছিলেন, এমনটা নয়। তৃণমূল সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ মানুষ তৃণমূলকে হারাতে চেয়েছেন। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের সঙ্গে রাজনৈতিক মেরুকরণও ঘটেছিল। অধিকাংশ হিন্দু মানুষ সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের শিকার হননি তাও প্রমাণিত হয় ২০২১ সালের ভোটে। বাংলায় এমন অসংখ্য মানুষ আছেন যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষ, উদার মানসিকতার। বিজেপি’র উন্মত্ত, দায়িত্বজ্ঞানহীন, সাম্প্রদায়িক ভূমিকা সেই মানুষকে বিজেপি’র পক্ষ থেকে সরিয়ে এনেছে। বিজেপি’র আস্ফালনের প্রতিক্রিয়ায় আশঙ্কিত সংখ্যালঘু মানুষের সমর্থন তৃণমূলের দিকে আরও (৭৫%) ঝুঁকে পড়ে। এর উলটো প্রতিক্রিয়াতেও হিন্দু ভোটের ঘনীভবন ঘটে বিজেপি’র দিকে। আমরা তাই বারেবারে দুই দলের প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার কথা উল্লেখ করেছি। এরা পরস্পরের পরিপূরক।
২০২১ সালের ভোটে সিএসডিএসে’র সমীক্ষা অনুযায়ী তৃণমূলের প্রাপ্ত মোট ভোটের ৫৭ শতাংশ এসেছিল হিন্দু অংশ থেকে। সংখ্যালঘু অংশ ছিল ৪২ শতাংশ। ২০১৯ সালে যা ছিল ৫০-৫০।
দেখা যাচ্ছে সংখ্যালঘু ভোট যেখানে বেশি সেই সব এলাকায় ভোট একেবারেই মেরুকৃত হয়েছে আবার সংখ্যালঘু ভোট যেখানে কম সেইসব এলাকায় সংখ্যাগুরু অংশে মেরুকরণের প্রভাব ছিল না। বরং রাজনৈতিক মেরুকরণে তৃণমূল ও বিজেপি’র মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার ছবি দেখা গেছে সেখানে। আর কোনো বিকল্প নেই - এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায়, অধিকাংশ সংখ্যালঘু ভোট না চাইলেও তৃণমূলের দিকে গেছে। একইভাবে উলটো দিকে সংখ্যাগুরু অংশের ভোট গেছে বিজেপি’র দিকে। তৃণমূল এবং বিজেপি’র এই বাইনারি ভেঙে দিতে পারলে সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরু কোনো অংশের ভোটই এই দুই দলে ঘনীভূত হবে না।
আদিবাসী, ওবিসি, তপশিলি জাতির বিপুল সংখ্যক মানুষের সমর্থন ২০১৯ সালে বিজেপি পেয়েছিল। মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষকে বিজেপি, সিএএ-র মাধ্যমে নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ২০১৯, ২০২১ সাল দুটি নির্বাচনেই। ভোট, আসন সবই পেয়েছে তারা। উত্তরবঙ্গের আদি বাসিন্দা রাজবংশী, কোচ ইত্যাদি সম্প্রদায়ের কাছে বিজেপি’র প্রতিশ্রুতি ছিল এনআরসি। যার প্রয়োগে বাইরে থেকে আসা মানুষের নাগরিকত্বের অধিকারই থাকবে না। রাজ্যের দু'জায়গায় পরিচিতিসত্তার দুরকম সুবিধাবাদী রাজনীতি করতে গিয়ে চরম বিপাকে পড়ে বিজেপি। ব্যাপক পরিমাণ রাজবংশী, কোচ সম্প্রদায়ের সমর্থন ২০২১ সালে বিজেপি-কে হারাতে হয়েছে। আদিবাসী, অন্যান্য দলিত, ওবিসিভূক্ত মানুষের সমর্থনও ২০২১ সালে বিজেপি-কে উল্লেখযোগ্যভাবে হারাতে হয়েছে।
গুজরাট ভোটের আগে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনে ৩টি জেলার হিন্দু উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব প্রদান করেছে বিজেপি। বাংলায় মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রূপায়ণ না হওয়া এবং এখন ১৯৫৫-র আইনে নাগরিকত্ব প্রদান মতুয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিজেপি-কে ভিলেন করে তুলছে। একইরকমভাবে উত্তর বঙ্গের ক্ষোভ প্রশমিত করার জন্য কখনও পৃথক রাজ্য কখনও ইউনিয়ন টেরিটোরির খুড়োর কল দেখালেও, বিশ্বাস নষ্ট হয়েছে। বিধানসভা নির্বাচনের কয়েকমাসের মধ্যে হওয়া উপনির্বাচন ও পৌর ভোটে, রাজ্যের বিরোধী দল কোথাও তৃতীয়, কোথাও চতুর্থ স্থানে নেমে গেছে। সাগরদিঘিতে ভোটের আগেই ছিটকে গেছে লড়াই থেকে।
দিন বদলাচ্ছে তাই ফের মেরুকরণের চক্রান্ত
দুর্নীতি মামলায় তৃণমূলের নেতারা জেলে, প্রতিদিন আদালতে সরকার ভর্ৎসনার শিকার হচ্ছেন। দুর্নীতির পাঁকে ডুবেছে সরকার, ধূলিসাৎ মুখ্যমন্ত্রীর ইমেজ। রাজ্যে আর্থিক সংকট আরও গভীর হয়েছে। বেকারি, মূল্যবৃদ্ধিতে নাজেহাল মানুষ তবু দুর্নীতি কমছে না। বিজেপি’র অবস্থা তথৈবচ। নেই কর্মী, কমছে সমর্থন। দেশের অর্থনীতির হাল খারাপ। ক্ষোভ বিক্ষোভ বাড়ছে। এ অবস্থায় পঞ্চায়েত তারপর বছর ঘুরলেই লোকসভা নির্বাচন।
ফলে ২০২১ সালের পথে ইমেজ পুনরুদ্ধারে মনোনিবেশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী, সঙ্গী বিজেপি। ভরসা ধর্ম, সম্প্রদায়, বিভাজন, মেরুকরণ। তৃণমূলের আরেকটি ভরসার জায়গা হলো তাদের বেনিফিসিয়ারি, পঞ্চায়েতের সুযোগ সুবিধে বিলি বণ্টন। এটাও যে খুব কার্যকরী হবে না তা দিদির দূতেদের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ দেখে বোঝা গেছে। তাহলে হাতে থাকে সন্ত্রাস, কিন্তু সেই ভয়টাও ভাঙছে।
তৃণমূলের মন্দির পর্ব ও বিজেপি
তৃণমূল ইমেজ মেরামতির নতুন কৌশল নিয়েছে। বাংলাকে ধর্মীয় পর্যটন কেন্দ্র বানিয়ে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি, আবেগের রাজনীতিকীকরণ চাইছে। দক্ষিণেশ্বরের স্কাই ওয়াক নির্মাণ , কালীঘাট মন্দির সংস্কার, ১০ একর জমির ওপর দিঘার জগন্নাথ মন্দিরের রেপ্লিকা নির্মাণ , বেহালায় ৮টি মন্দিরের সংস্কার, বৈষ্ণোদেবী মন্দিরের রেপ্লিকা নির্মাণ, গঙ্গাসাগরে রাজ্যের বিভিন্ন মন্দিরের রেপ্লিকা - "বাংলার মন্দিরঃ আধ্যাত্মিক যাত্রা” ইত্যাদি নির্মাণের জন্য তৃণমূল সরকারি কোষাগার ব্যবহার করেছে। তারাপীঠ মন্দির, তারকেশ্বরের শিব মন্দির, হুগলির হংসেশ্বরী মন্দির সংস্কার করা হবে। বারাণসীর দশাশ্বমেধ ঘাটের গঙ্গা আরতির মতো হুগলি নদীর বহু ঘাটে গঙ্গা আরতির আয়োজন হয়েছে। গঙ্গা দেবীর মূর্তি স্থাপন করতে কলকাতার বাবুঘাটে কোরিয়ার আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি মন্দির নির্মাণ হবে সরকারি অর্থে। এছাড়াও সরকার কপিল মুনির আশ্রমে পুরোহিতদের বাসস্থান নির্মাণ করবে। এবারের গঙ্গাসাগর মেলায় মুখ্যমন্ত্রী বলেন তাঁরা চলেছেন সেই পথে যে পথ দেখিয়েছেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, স্বামী বিবেকানন্দ।
নিজেদের অ্যাজেন্ডা তৃণমূলের হাতে দেখে ক্ষুব্ধ বিজেপি প্রশ্ন তুলেছে, সরকারি টাকায় ধর্ম পালন কেন! রাজনৈতিক দলের কাজ মন্দির নির্মাণ নয়। হিন্দুত্বের প্রতিযোগিতায় বিজেপি ভুলে গেছে সারা দেশে, এই রাজ্যেও তারা ধর্মকে ব্যবহার করেই রাজনীতি করছে। মন কি বাতে প্রধানমন্ত্রী, ৭০০ বছর আগের ত্রিবেণী কুম্ভের মাহাত্ম্যের কথা জানিয়ে বাংলার সংস্কৃতির ঐতিহ্য স্মরণ করেছেন। দু'দলের অ্যাজেন্ডায় মানুষের জীবন-জীবিকা, পরিকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষা-স্বাস্থ্য, খাদ্য সুরক্ষা ইত্যাদি নেই।
ভবিষ্যৎ বামপন্থীদেরই
"হয় তৃণমূল নয় বিজেপি" ভাষ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। ভোটের আগে তৃণমূল থেকে বিজেপি, ভোটের পরে বিজেপি থেকে তৃণমূল, দুর্নীতিতে অভিযুক্তদের বিজেপি-তে গিয়ে ভালো মানুষ হয়ে যাওয়া, সিবিআইয়ের তদন্তে কোর্টের হতাশা প্রকাশ, ঘনঘন দ্বিপাক্ষিক গোপন মিটিং ইত্যাদি দেখে মানুষের দুটি দল ও তাদের পারস্পরিক বোঝাপড়া সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা তৈরি হয়েছে। বেপরোয়া দুর্নীতি, শিক্ষাকে রসাতলে পাঠানো, ভয়াবহ বেকারি, দারিদ্র্যে, পরিযায়ী শ্রমিকের ভীড়, ১০০ দিনের কাজ বন্ধ হওয়া, ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি, ফসলের দাম না পাওয়া, স্বাস্থ্যের বেহাল দশা সব মিলিয়ে মানুষ আক্রান্ত।
কাজ, শিক্ষা, জীবন জীবিকা, বেঁচে থাকার প্রশ্নে বামপন্থীরাই লড়াই করছে; এই বিশ্বাস, উপলব্ধি মানুষের মধ্যে তৈরি হচ্ছে। বামপন্থীদের প্রতি আগ্রহ, আস্থা, ভরসা বাড়ছে । বিধানসভায় শূন্য হওয়ার পরেও ফিনিক্সের মতো লাল ঝান্ডা উড়ছে গ্রাম, শহরে। বিশালায়তন সমাবেশে তরুণ প্রজন্মের উপচে ওঠা উপস্থিতি মানুষের আস্থা জোগাচ্ছে। সমর্থন বাড়ছে বামেদের। উপনির্বাচন ও পৌর নির্বাচনে বামপন্থীরাই যে প্রকৃত বিরোধী তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, আর তা করেছে রাজ্যের মানুষ। বামপন্থীদের ওপর আক্রমণ প্রমাণ করছে তার শক্তি বাড়ছে। তৃণমূলের রক্ষাকর্তা এখন পুলিশ। পুলিশি ধরপাকড়, মিথ্যা মামলা তাই বাড়ছে। বামপন্থীদের দিকে জনগণের ঢলে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এ অবস্থায় পুরনো ন্যারেটিভ ফেরানোর মরিয়া প্রচেষ্টায় নেমেছে তৃণমূল এবং বিজেপি। বিভাজনের, মেরুকরণের সবরকম হীন প্রচেষ্টা তারা চালাবে। বিজেপি’র হয়ে মাঠ প্রস্তুত করতে আরএসএস গোপনে তার কাজ চালাচ্ছে। দুজনের লক্ষ্য এক, বামপন্থীদের আটকাতে হবে। লাল ঝান্ডা আবার সহস্র বলিষ্ঠ হাতের মুঠোয় । ভয়, দ্বিধা কেটে প্রত্যয় আর সাহসের রণধ্বনি শোনা যাচ্ছে। আতঙ্কের আবরণ সরিয়ে বেরিয়ে আসছেন মানুষ। এখন সময় আরও নিবিড়ভাবে, মানুষের সাথে মিশে থেকে লড়াইয়ের নেতৃত্ব দেওয়া। মানুষের স্বার্থে উদাহরণযোগ্য লড়াই গড়ে তোলা। প্রতিটি গ্রাম, মহল্লায় মানুষের প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
আজ সাগরদিঘি কাল গোটা বাংলায় অবসান হবে তৃণমূল-বিজেপি রাজের। সব দ্বিধা-ভয় ভেঙে, বুক ভরা সাহস আর দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে, সেই গণজাগরণের নেতৃত্ব দেওয়ার উপযোগী ভূমিকা নিতে হবে আমাদের। মানুষের বিজয়কেতন উড়বেই।