৬০ বর্ষ ২৯ সংখ্যা / ৩ মার্চ, ২০২৩ / ১৮ ফাল্গুন, ১৪২৯
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বাঁচানোর দাবিতে সোচ্চার হতে হবে
সেখ সাইদুল হক
বিগত প্রায় তিন বছর ধরে র্গবের প্রতিষ্ঠান আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি হয়েছে অচলাবস্থা। বর্তমান রাজ্য সরকারের নেতিবাচক অবস্থানের কারণে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ভুলুণ্ঠিত হচ্ছে। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে বাঁচাতে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং আধিকারিক ও শিক্ষাকর্মীরা আন্দোলন করছেন। ওই আন্দোলনের আগুয়ান কর্মী, ছাত্র নেতা আনিস খান পুলিশের হাতে নির্মমভাবে খুন হয়েছেন।
উচ্চশিক্ষা, প্রযুক্তি এবং কারিগরি শিক্ষায় সংখ্যালঘুদের অংশগ্রহণ বাড়াতে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ২০০৮ সালে তৈরি হয় আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কলকাতা মাদ্রাসাকে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবর্তিত করা হয়। তিনটি ক্যাম্পাসে বাম জামানাতেই শুরু হয় পঠন-পাঠন। তালতলা ক্যাম্পাসে বিএড, পার্ক সার্কাস ক্যাম্পাসে আরবি সহ কলা বিভাগ, নিউটাউন ক্যাম্পাসে বিজ্ঞান, কারিগরি ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ পূর্ণ কদমে চালু হয়ে যায়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সহ সব অংশের ছাত্রছাত্রীরা এখানে পড়াশোনা করেন। বর্তমানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর এবং গবেষক মিলিয়ে প্রায় ৭ হাজার ছাত্রছাত্রী রয়েছেন।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন রাজ্য সরকার পরিকল্পিতভাবে তৈরি করেছে অচলাবস্থা। রাজ্য সরকার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ আটকে রেখেছে। সরকার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ না দিয়ে উলটে নিয়োগ দুর্নীতি ও অর্থ ব্যয়ে অসঙ্গতির কথা তুলে সংখ্যালঘু দপ্তরের প্রধান সচিবের মাধ্যমে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। প্রসঙ্গত, এই সমস্ত নিয়োগ ও অর্থ ব্যয় হয়েছে বর্তমান সরকারের জামানায়, আবার সেই সরকারই দুর্নীতির কথা তুলে তদন্ত কমিটি তৈরি করেছে। বরাদ্দ আটকে রেখেছে। তৃণমূলীদের নিজেদের ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে ঝামেলার শিকার হচ্ছে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পঠনপাঠন, গবেষণা। ইন্টারনেট পরিষেবা প্রায়ই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অস্থায়ী অশিক্ষক-কর্মচারীরা ঠিকমতো নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন না। দুই বছর ধরে পিএইচডি বন্ধ আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। নেট, জুনিয়ার রিসার্চ ফেলোশিপের মেয়াদ শেষ হতে চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতে ২৯৭ জনের শিক্ষক পদ তৈরি হয়। এখনও পর্যন্ত নিযুক্ত হয়েছেন ১৭২ জন। এখনও ১২৫টি শূন্যপদে নিয়োগ বাকি। গত ১১ বছরে তৃণমূল সরকার মাত্র ৩৮ জন অধ্যাপক নিয়োগ করেছে। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন বিভাগ খোলার জন্য কোনো চেষ্টা বর্তমান রাজ্য সরকার করেনি। ইউজিসি’র অনুমোদন ছাড়া কোনো বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের মান খতিয়ে দেখার জন্য তিন বছর অন্তর ন্যাক পরিদর্শন হয় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে। কিন্তু চার বছর হয়ে গেলেও আলিয়াতে ন্যাকে’র প্রতিনিধিদল আসেনি। ২০১৮ সালে ইউজিসি’র একটি প্রতিনিধিদল আলিয়াতে এসেছিল। তার তিন বছরের মধ্যে ন্যাক পরিদর্শনের কথা থাকলেও হয়নি। ন্যাকে’র প্রতিনিধিদল যদি না আসে, তাহলে বাতিল হতে পারে আলিয়ার ইউজিসি’র স্বীকৃতি। ঠিক যেমন হয়েছিল বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে। আলিয়া নিয়ে রাজ্য সরকার চুপ কেন?
আনিস খান
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে থাকার সুযোগ পায় প্রায় ১৩০০-র মতো শিক্ষার্থী। হোস্টেলে পর্যাপ্ত আসন না থাকায় দূরবর্তী জেলার ছাত্রছাত্রীদের বেশি ভাড়া দিয়ে অন্যত্র থাকতে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি খালি পড়ে থাকলেও পার্ক স্ট্রিট ক্যাম্পাস সংলগ্ন এলাকায় এখনো কোনো হোস্টেল তৈরি হয়নি। নেই কোনো খেলার মাঠ। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে বাম জামানাতেই চিত্তরঞ্জন হাসপাতালের পাশে একটি জমি দেওয়া হয়েছিল খেলার মাঠ এবং হোস্টেল নির্মাণের জন্য। সেই জমিকে ওই কাজে ব্যবহার না করে বর্তমান রাজ্য সরকারের সংখ্যালঘু উন্নয়ন দপ্তরের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপ তৈরি করা হচ্ছে ওই জমি রাজ্য সরকারকে ফেরত দেবার জন্য, যাতে ওই জমি হাসপাতালকে দেওয়া যায়। ছাত্রছাত্রীরা এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক মানুষ রাজ্য সরকারের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছে এবং ওই জমিতে প্রস্তাবিত পরিকাঠামো গড়ে তোলার জন্য বারেবারে কতৃপক্ষের দারস্থ হয়েছে। দাবি জানানো হয়েছে, নিউটাউনে আরও ১০ বিঘা জমি বরাদ্দ করতে হবে রাজ্য সরকারকে হোস্টেল ও খেলার মাঠের জন্য।
এখন ছাত্রছাত্রী ও অন্যান্য শুভানুধ্যায়ীরা কার কাছে যাবে? ১০ মাস কোনো স্থায়ী উপাচার্য নেই আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। মাদ্রাসা বোর্ডের সভাপতি আপাতত উপাচার্য হিসেবে কাজ করছেন। তবে তাঁর একাডেমিক যোগ্যতা নিয়ে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মহল হতে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। তিনি অধ্যাপক (প্রফেসর) নন এবং তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর কোনো অভিজ্ঞতা নেই। উপাচার্য নিয়োগের জন্য এখনও কোনো সার্চ কমিটি গঠন করা হয়নি। রাজ্য সরকার আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যা করছে তা কি অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে করতে পারবে? এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সংখ্যালঘু পড়ুয়ারা বেশি পড়াশোনা করে বলেই কি এই অনীহা ও বঞ্চনা? এই সব প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
বর্তমান বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের আমলে সংখ্যালঘুদের উন্নয়ন ও নিরাপত্তা পরিকল্পিত আকারে বিঘ্নিত করা হচ্ছে। এই বছর বাজেটে সংখ্যালঘু উন্নয়ন খাতে ৩৮ শতাংশ বরাদ্দ কমানো হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য বরাদ্দ গতবারের ১৬০ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে মাত্র ১০ কোটি টাকা করা হয়েছে। মৌলানা আজাদ ন্যাশনাল ফেলোশিপ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
আমাদের রাজ্যের সরকার সংখ্যালঘু উন্নয়নের বাগাম্বর করলেও সংখ্যালঘুদের শিক্ষা এবং মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নে কার্যত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। রাজ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে সংখ্যালঘুরা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছে। রাজ্যের মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা নানা ধরনের বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। রাজ্য সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা শিক্ষা দপ্তরটি তৈরি হয় বাম সরকারের সময়ে। সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের আমলে গঠন করা হয় মাদ্রাসা শিক্ষা দপ্তরের অধীন পৃথক মাদ্রাসা শিক্ষা ডাইরক্টরেট। মাদ্রাসা শিক্ষার অধুনিকীকরণের ও উন্নয়নের লক্ষ্যে বাম সরকার ১৯৭৭ সালে মোস্তাফা বিন কাশেমের নেতৃত্বে এবং ২০০১ সালে প্রাক্তন রাজ্যপাল ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এ আর কিদোয়াই-এর নেতৃত্বে কমিটি গঠন করে এবং তাঁদের সুপারিশগুলি কার্যকর করে। ১৯৭৭ সালে মাদ্রাসা ছিল ২৩৮টি। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে তা বেড়ে হয় ৬০৯টি।
তৃণমূলের জামানায় গত ১১ বছরে রাজ্যে মাদ্রাসার সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ৫টি। অর্থাৎ ৬০৯ থেকে হয়েছে ৬১৪টি। যে ২০০টি নিউ সেট আপ মাদ্রাসার কথা এই সরকার বলছে তার অনুমোদন হয় বাম সরকারের সময়ে। গত ১১ বছরে এর মধ্যে কয়টি চালু হয়েছে? ওইগুলির জন্য ১০০০টি শিক্ষক-শিক্ষিকার পদ অনুমোদিত হয় বাম জামানায়। আজ পর্যন্ত কতগুলি পদপূরণ হয়েছে? মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসেই তৃণমূল নেত্রী বলেছিলেন ১০ হাজার মাদ্রাসাকে অনুমোদন দেওয়া হবে। কতগুলি দেওয়া হয়েছে? মাত্র ২৩৪টি। তাও এদেরকে কোনো আর্থিক অনুদান দেওযা হয় না। কেন? কেন এগুলি আজও চরম বঞ্চনার শিকার? এখানকার প্রায় ২৫০০ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষাকর্মী চরম বঞ্চনার শিকার। ছাত্রছাত্রীরা মিড-ডে মিলের বরাদ্দ পর্যন্ত পায় না। যে ৪০৫টি মাদ্রাসা শিক্ষা কেন্দ্র বাম জামানার শেষে অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় ছিল তা আজও অনুমোদন পায়নি। বর্তমান রাজ্য সরকার মাদ্রাসাগুলিকে অপাঙক্তেয় করে রেখে দিয়ে এগুলির মর্যাদা ও গুরুত্বকে নষ্ট করে দিতে চাইছে। এই শিক্ষাব্যবস্থাকে দ্বিতীয় শ্রেণির পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাইছে যাতে অভিভাবকরা ছাত্রছাত্রী না পাঠায় এবং মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা শুকিয়ে মরে। ২০১০ সালে বামফ্রন্ট সরকার মাদ্রাসা শিক্ষক নিয়োগ ও বদলির বিধি তৈরি করে। ইতিমধ্যে শিক্ষার অধিকার আইন লাগু হয়। তারপর এনসিটিই ছয়বার বিধি সংশোধন করেছে, কিন্তু তার সাথে সঙ্গতি রেখে গত ১১ বছরে তৃণমূল সরকার কোনো বিধি তৈরি করেনি। ফলে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে বাঁচানোর দাবির সাথে সাথে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি সরকারের এই বঞ্চনার বিরুদ্ধেও আমাদের সোচ্চার হতে হবে।
আসলে বিজেপি-আরএসএস চায় না সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার প্রসার ঘটুক। রাজ্যের বর্তমান সরকারও কি বিজেপি’র এই পলিটিক্যাল অ্যাজেন্ডাকে কার্যকর করতে চাইছে? এই সব প্রশ্ন সংখ্যালঘু জনমানসে বড়ো আকারে দেখা দিচ্ছে।
এই পটভূমিতে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে বাঁচানোর দাবিতে রাজ্যের সমস্ত গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ মানুষকে সোচ্চার হতে হবে।
আমাদের দাবিঃ
১) আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউজিসি গাইড লাইন মেনে পূর্ণ সময়ের জন্য স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করতে হবে।
২) আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অন্য কোনো স্থানে হস্তান্তর করা চলবে না।
৩) আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপযুক্ত পরিকাঠামো, হোস্টেল, খেলার মাঠ নির্মাণে রাজ্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।
৪) গবেষণা সহ অন্যান্য বিষয়ে রাজ্য সরকারকে আর্থিক দায়িত্ব নিতে হবে।
৫) ইউজিসি’র স্বীকৃতি রক্ষা করতে ন্যাক পরিদর্শনের ব্যবস্থা রাজ্য সরকারকে করতে হবে।
৬) বিশ্ববিদ্যালয়ে শূন্যপদে মেধার ভিত্তিতে অবিলম্বে শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। অন্যান্য শূন্যপদগুলিও পূরণ করতে হবে।