৬১ বর্ষ ১২ সংখ্যা / ৩ নভেম্বর, ২০২৩ / ১৬ কার্তিক, ১৪৩০
জন্মভূমির জন্য প্যালেস্তাইনবাসীর সংগ্রামের পাশে দাঁড়াও - সিপিআই(এম)’র আহ্বান
জন্মভূমির জন্য প্যালেস্তাইনবাসীদের সংগ্রামের প্রতি সংহতি এবং ইজরায়েলের গণহত্যাকারী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ৩০ অক্টোবর কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক শেষে এক বিবৃতিতে পার্টির সমস্ত শাখাকে আরও জোরদার কর্মসূচি নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটি। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন পলিট ব্যুরোর সদস্য মানিক সরকার। এরই সঙ্গে বিদ্যুতে বেসরকারিকরণ ও মুনাফা বাড়ানোর লক্ষ্যে স্মার্ট মিটার বসানোর উদ্যোগের প্রতিবাদ, ২৬-২৮ নভেম্বর কিষান-মজদুর মহাপড়াও এবং ৪ঠা ডিসেম্বর দলিত সংগঠন ও মঞ্চের সংসদ অভিযানের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ও সংহতি জ্ঞাপনেরও আহ্বান জানানো হয়েছে। গত ২৭-২৯ অক্টোবর সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক শেষে ৩০ অক্টোবর এক বিবৃতিতে ওই আহ্বান জানানোর পাশাপাশি কেরালায় বিস্ফোরণ, ইজরায়েলের গণহত্যা, আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন, মণিপুরের পরিস্থিতি, মানুষের ঘাড়ে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বোঝা, এক দেশ-এক ভোট এবং জাতগণনা নিয়েও আলোকপাত করা হয়েছে।
প্যালেস্তাইনে ইজরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এআইপিএসও-র ডাকে ১ নভেম্বর শিয়ালদহ স্টেশন থেকে রাজাবাজার পর্যন্ত মিছিল।
প্যালেস্তাইনের ওপর ইজরায়ালের গণহত্যাকারী হামলা
প্যালেস্তাইনবাসীর সুরক্ষা এবং অবিলম্বে ত্রাণ পাঠানোর পাশাপাশি মানবিক যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে আনা প্রস্তাবকে অস্বীকার করায় মোদি সরকারের কড়া সমালোচনা করেছে সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটি। প্রস্তাবের ওপর ভোটদানে মোদি সরকারের বিরত থাকা এবং সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবাজদের পাশে থাকার অবস্থান প্যালেস্তাইনের প্রতি ভারতের সমর্থনের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের সম্পূর্ণ বিরোধী। রাষ্ট্রসঙ্ঘের আনা প্রস্তাবের দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইনকে লঙ্ঘন করে ইজরায়েল যেভাবে গণহত্যার যুদ্ধে চালিয়ে প্যালেস্তাইনবাসীকে দুর্দশার মধ্যে ফেলে দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা করে প্যালেস্তাইনবাসীর প্রতি সংহতি জানিয়েছে সংহতি জানিয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটি। এপর্যন্ত সরকারিভাবে ঘোষিত ৮ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ৪ হাজার শিশু এবং প্রতিদিনই মৃত্যুসংখ্যা বাড়ছে। আর শুধু গাজায় নয়, মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক থেকেও। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার দাবিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে বিপুল জনবিক্ষোভ চলছে, তার অংশীদার সিপিআই(এম)-ও এবং ১৯৬৭ সালের পূর্বেকার সীমান্তকে বজায় রেখে রাষ্ট্রসঙ্ঘ পূর্ব জেরুজালেমকে প্যালেস্তইনের রাজধানী করে দুই রাষ্ট্রের সমাধানের যে নির্দেশ দিয়েছিল তাকে কার্যকর করতে হবে।
কেরালায় বোমা বিস্ফোরণ
এর্নাকুলামের কনভেনশন সেন্টারে বোমা বিস্ফোরণের তীব্র ভাষায় নিন্দা করেছে কেন্দ্রীয় কমিটি। ওই বিস্ফোরণে ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং জখমও হয়েছেন বেশ কয়েকজন। রাজ্য পুলিশ ইতিমধ্যে এক সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করেছে। সমাজ মাধ্যমে এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রকৃত ঘটনা না জেনেই যেভাবে কেরালা এবং ওই রাজ্যের মানুষের প্রতি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ উগরে দিয়েছেন, তারও নিন্দা করেছে কেন্দ্রীয় কমিটি। কেরালার অনন্য এবং অতুলনীয় সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে যারা বিপর্যস্ত করার চেষ্টা করছে, আগে যেভাবে ওই সব শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে কেরালার মানুষ, সেভাবে আবার এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটি।
পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন
যে পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা ভোট হতে চলেছে তার মধ্যে চার রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটিতে। রাজস্থানে যে ১৭ জন প্রার্থীর তালিকা দিয়েছিল রাজ্য কমিটি, তাতে সিলমোহর দিয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটি। এর মধ্যে সিপিআই(এম)’র দুজন বিধায়কও আছেন। ছত্তিশগড়ে তিনটি আসনে এবং মধ্য প্রদেশে চার আসনে লড়াই করবে সিপিআই(এম)। তেলেঙ্গানা নিয়ে আলোচনা চলছে।
মণিপুর
মণিপুরের পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং সামলাতে যে মোদি ও তাঁদের ডবল ইঞ্জিন সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ, তা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। রাজ্যের জাতিগত বিভাজনে সাম্প্রদায়িক রঙ চড়েছে ধর্মীয় পরিচিতিসত্তার মেরুকরণের মাধ্যমে।
সরকারিভাবে মাত্র ১৭৫ জনের মৃত্যুর তথ্য দেওয়া হয়েছে, যদিও নিহতের সংখ্যা অনেক বেশি। মোট ৫,১৭২টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে রয়েছে ৪,৭৮৬টি বাড়ি, ৩৮৬টি ধর্মস্থান। লুট হয়ে যাওয়া ৫,৬৬৮টি আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ১,৩২৯টি। বহু মানুষ এখনও ঘরছাড়া। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং-কে অবিলম্বে সরিয়ে দিতে হবে এবং মণিপুরের হিংসা বন্ধ করতে হবে।
মানুষের ওপর ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বোঝা
মোদির প্রচারবাহিনীর মিথ্যা ফোলানো ফাঁপানো দাবিকে নস্যাৎ করে দিয়ে নিয়ন্ত্রণহীন দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি এবং বেকারত্বের জেরে দেশের সাধারণ মানুষের আয়ের মারাত্মক অবনমন ঘটেছে। এরই সঙ্গে হ্রাস পেয়েছে পারিবারিক আর্থিক সম্পদেরও। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০-২১ এবং ২০২২-২৩ সালে জিডিপি’র নিরিখে এই হ্রাসের হার ১১.৫ শতাংশ থেকে ৫.১ শতাংশে নেমে গিয়েছে। এর জেরে পারিবারগুলির ঋণের মাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
এরই সঙ্গে পেঁয়াজের দাম আকাশছোঁয়া, রেগায় অর্থ বরাদ্দ কমানোয় গ্রামীণ ক্ষোভ বাড়ছে, বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ঐতিহাসিকভাবে ভারতের সর্বনিম্ন অবস্থান, ১২৫ দেশের মধ্যে ১১১-তে নেমেছে।
এক দেশ-এক ভোট
প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি এক দেশ-এক ভোট চালুর প্রস্তাব সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলির মতামত চেয়েছে। দলগুলির মতামত কমিটির কাছে ২০২৪ সালের ১৮ জানুয়ারির মধ্যে দাখিল করতে হবে। বস্তুত, তার কয়েকদিনের মধ্যেই দেশে সাধারণ নির্বাচন হবে। এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে একেবারে স্পষ্ট অবস্থান রয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটির। এই প্রস্তাব পুরোপুরি ভারতীয় সংবিধানে বর্ণিত সংসদীয় গণতন্ত্র এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ওপর যুগ্ম আঘাত বলেই মনে করা হচ্ছে। সংবিধানের উল্লেখযোগ্য সংশোধন ছাড়া এই ধরনের প্রস্তাব আনায় হয় রাজ্য বিধানসভা মেয়াদ কমানো নতুবা বাড়ানোর উদ্দেশ্য থাকে লোকসভা ভোটের সঙ্গে সম্পৃত্ত করার লক্ষ্যে। মানুষের সরকার গঠনের অধিকারকে খর্ব করে যদি এই কেন্দ্রীয় আইন চালু হয়, তাহলে তা অবশ্যই গণতন্ত্র বিরোধী হিসাবেই গণ্য হবে।
জাতগণনা
২০১২ সালের জনগণনার সঙ্গেই আর্থ-সামাজিক অবস্থা বুঝে নিতে জাতগণনা অবিলম্বে শুরু করার দাবি জানাচ্ছে কেন্দ্রীয় কমিটি। যাঁদের সবচেয়ে প্রয়োজন তাঁদের জন্য সংরক্ষণ সহ আইনি স্বীকৃতি সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতগণনা শুরু করা জরুরি। বিহার ইতিমধ্যে রাজ্যভিত্তিক জাতগণনা করে ফেলেছে। আরও কয়েকটি রাজ্য শুরু করার ইচ্ছাপ্রকাশ করেছে। রাজ্যভিত্তিক জাতগণনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার একমাত্র নির্বাচিত রাজ্য সরকারেরই আছে। তবে তা কখনোই সর্বভারতীয় জাতগণনা বিকল্প হতে পারে না।