৬১ বর্ষ ১২ সংখ্যা / ৩ নভেম্বর, ২০২৩ / ১৬ কার্তিক, ১৪৩০
ইনসাফ যাত্রা - বাঁচার লড়াই
মীনাক্ষী মুখার্জি
প্রায় দুই মাস পথ হাঁটবে বাংলার যৌবন। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে কোচবিহার থেকে শুরু হয়ে রাজ্যের সব জেলা ঘুরে শেষ হবে ব্রিগেডের মাঠে। যৌবনের ডাকে জনগণের সমাবেশ হবে।
এই ইনসাফ যাত্রার পথে থাকবে পশ্চিমবঙ্গের আশা আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, স্পর্ধা, প্রতিরোধ, প্রতিবাদ, সাহস। প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকা থেকে শহরতলি। ফসলের আল খেত থেকে স্মার্ট সিটির বুকের উপর দিয়ে চলবে এই অধিকারের যাত্রা কাজের দাবিতে, শিক্ষার দাবিতে, বেঁচে থাকার দাবিতে অধিকার যাত্রা। আমাদের ইনসাফ যাত্রা।
যেকোনো সভ্য সমাজে কাজ ও শিক্ষার অধিকার হলো মূল বিষয়।
দেশ রাজ্য এগিয়ে নিয়ে যেতে বাধা হবে যদি এই অধিকারগুলো না থাকে।
ভারতের মতো এত জাতি, ভাষা, বর্ণ, ধর্ম বিশিষ্ট মানুষের দেশে - বৈচিত্র্যময় দেশকে এক রাখতে অধিকারগুলি আরও প্রাসঙ্গিক ও খুব প্রয়োজনীয়। কিন্তু আমাদের দেশ ও রাজ্যে দাবি তথা অধিকারগুলির প্রতি সরকার নিষ্পৃহ। নির্বাচিত সরকার তার নির্বাচনী ইশতেহারের বিপরীতে চলছে। ২ কোটি বেকারের কাজের কথা বলে কেন্দ্রের বিজেপি শাসিত সরকার আজ কোটি কোটি মানুষের রোজগারের জায়গা শেষ করে দিচ্ছে। বেঁচে দিচ্ছে দেশের কাজের জায়গা, যা বহু লড়াই আন্দোলনের ফলে আমরা অর্জন করেছিলাম। জলের দরে বেসরকারিকরণ করেছে রেল, বিএসএনএল, কয়লা সহ খনিজ পদার্থগুলি। নদী নালা, জঙ্গল, প্রাচীন স্থাপত্য কিছুই বাদ দিচ্ছে না।
প্রতিদিন মানুষের আয় কমছে, বেঁচে থাকার সংকট বাড়ছে। সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে মানুষ যখন পথ হাতড়াচ্ছে তখন দেশের শাসক বৈচিত্র্যময় দেশে আমাদের শক্তিকে বিপদ বলে চালানোর চেষ্টা করছে। আমাদের ভাষা, ধর্ম, বর্ণ, জাতিকে কেন্দ্র করে একের বিরুদ্ধে অন্যকে লড়িয়ে দিতে চাইছে। দক্ষিণপন্থী শাসকরা এটাই করে। কিন্তু কোন অভিসন্ধিতে করছে, সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অভিসন্ধি - সরকারের সাথে করপোরেটের আঁতাত। পুঁজিপতিদের স্বার্থসিদ্ধি করতে গিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ সহ ছাত্র যুবদের গলা টিপে ধরছে।
তথ্য বলছে, প্রতি ৯ জনে ১ জন বেকার। শুধু বেকার না এবার তো কাজের বাজার থেকে, কাজ খোঁজার জায়গা থেকে বেকার যুব নিজে সরে যাচ্ছে।
চাষের কাজে আয় সেভাবে নেই। গ্রাম থেকে কাজের আশায় যুবরা শহরে আসছে। শহরেও কাজ নেই। প্রতিদিন সংকুচিত হচ্ছে কাজের জায়গা।
১০০ দিনের কাজে মজুরি বাড়ছে না। ১০০ দিনের কাজ দিয়ে হবে না। তাকে ২০০ দিন করতে হবে। সে নিয়ে সরকারের কোনো হেলদোল নেই। উলটে ১০০ দিনের কাজের টাকার বরাদ্দ কমিয়ে দিচ্ছে দেশের সরকার।
আমাদের রাজ্যে কাজের অবস্থা আরও করুণ। বর্তমান রাজ্য সরকার ১২ বছর আগে বছরে ২ লাখ বেকারের কাজ, সব হাতে কাজ সব পেটে ভাত - এইসব স্লোগান দিয়ে কার্যত রাজ্যটাকে শ্মশানে পরিণত করেছে। বাম আমলে MSME-তে আমাদের রাজ্য অনেকটা এগিয়েছিল। সেখানেও ধুঁকছে। অসংখ্য ছোটো কারখানা-ফ্যাক্টরি বন্ধ করেছে, নতুন কিছু খোলা যায় নি। চুরি দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে সরকার। চাকরি চুরি থেকে চাল চুরিতে হাত পাকিয়েছে রাজ্যের মন্ত্রী-নেতারা। জেল খাটছে মানুষের ভোটে জেতা মন্ত্রীরা। কিন্তু উৎসবের কার্নিভালে ফাঁক নেই। খিদে পেটে খালি গায়ে মানুষ উৎসব দেখছে। দেখাচ্ছে সরকার। মানুষ দেখছে তার খাবার, বাসস্থান, শিক্ষা, রোজগারের জায়গা তৈরির টাকা কীভাবে উৎসবে খরচ হচ্ছে। আমাদের রাজ্যে নতুন কলকারখানা নেই,সরকারি নিয়োগে স্বচ্ছতা নেই, চাষে আয় নেই, গ্রামের ১০০দিনের কাজে দুর্নীতি, আবাস যোজনাতে দুর্নীতি, সারের কালোবাজারি, লেখাপড়া জানা মেধাবীরা রাস্তায় বসে থাকছে যোগ্যতার মূল্য চেয়ে, আর সাদা খাতা জমা দিয়ে চাকরি করছে একদল সুযোগসন্ধানী, যাদেরকে জায়গা করে দিয়েছে গোটা সিস্টেমটা। আমাদের রাজ্যের স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে সরকারি স্কুলছুটের সংখ্যা। মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থী যেমন কমছে তেমন কলেজের ছাত্র ভরতির আসন খালি থেকে যাচ্ছে। ক্যাম্পাসিং হলেও নিয়োগের কাগজ হাতে পাচ্ছে না পড়ুয়ারা। আর অন্যদিকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিয়োগের কাগজ ঘটা করে হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন বেকারের। বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন আমাদের টাকায়। বিনিয়োগ আনবেন, নাকি আনবেন শিল্প। সে গুড়েও বালি, বরং রাজ্যের প্রস্তাবিত কারখানার জন্য অধিগৃহীত জমিতে কারখানা হবে না। সেই জমি সরকার আইন বদলে জমি হাঙ্গরদের হাতে তুলে দিচ্ছে। চা বাগানের জমি, জঙ্গলের সংরক্ষিত এলাকার জমিও করপোরেটদের হাতে তুলে দিচ্ছে। চা বাগান, পাহাড়, জঙ্গলমহলের বেকার যুবদের কাজের জায়গা হচ্ছে হোটেলে ন্যূনতম দিন হাজিরার কাজ। এভাবেই দেশ ও রাজ্যের যুবদের শ্রমশক্তির অপমৃত্যু ঘটছে প্রতিদিন। ক্ষতি কিন্তু আসলে আমাদের দেশ ও রাজ্যেরই।
তার বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়ানোর জন্য জানকবুল লড়াইয়ে শহিদ হয়েছেন শয়ে শয়ে কমরেড। ঘর ছাড়া হয়েছে। মিথ্যে মামলায় জেলে আছেন। কিন্তু স্বপ্ন দেখা ছাড়েননি। আর এই সাহসটা নিয়েই সিস্টেম পালটে ফেলার লড়াইয়ে এই পথ হাঁটা। পথের ধারে থাকা মানুষের কাছে মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের বার্তা পৌঁছে দেওয়া। মানুষকে সাথে নিয়ে মানুষের সাহায্যেই পৌঁছে যাওয়া ব্রিগেডের মাঠে ইনসাফ চাইতে, ইনসাফ পেতে।
কামদুনি যেমন ইনসাফ পায়নি, পায়নি হাথরস। মুর্শিদাবাদের যুবর সাথে বিহারের যুব একসাথে এক চিলতে ঘরে পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে দিন কাটাচ্ছে বেঙ্গালুরুতে। দেশের বিখ্যাত কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে গরিব ঘরের ছেলেপুলেদের রিসার্চ করার, পড়াশোনা করার টাকার বরাদ্দ যেমন কমিয়ে দিয়েছে দেশের সরকার, ঠিক তেমনি পশ্চিমবঙ্গের স্কুলের বাচ্চার মিড ডে মিলের থালা থেকে পুষ্টি কেড়ে নিয়েছে রাজ্যের সরকার। দেশ ও রাজ্য উভয় ক্ষেত্রে অপুষ্টিতে, রক্তাল্পতায় ভুগে প্রসূতির মৃত্যু খুব সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। খিদের তালিকায় আমাদের দেশ প্রতিদিন পিছনের দিকে ছুটছে।
পরিস্থিতির প্রতিবাদ করলে শুধু জেল, মিথ্যে মামলা বা আক্রমণ নয়, এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে যাতে মানুষ নিজে নিজেই প্রতিবাদ করা বন্ধ করে দেয়। আতঙ্ক-সন্ত্রাস-চাপের পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে। যাতে প্রতিবাদী একাধিক মানুষ নিজে থেকে জোটবদ্ধ হবার সাহস না করে। এক দমবন্ধ করা পরিস্থিতি। তাই পরিস্থিতির বদল ঘটাতে হবেই। সেই লক্ষ্যেই এখনো অনেক পথ হাঁটতে হবে আমাদের সবাইকে। আরও অনেক যুবকে পাশে পেতে হবে। তার জন্যই ইনসাফ যাত্রা। অধিকারের যাত্রা। প্রতিবাদ প্রতিরোধের যাত্রা। বড়ো মাঠে বড়ো রাস্তায় বেঁচে থাকার লড়াইয়ে জিতে আসার মেজাজেই আমাদের পথ হাঁটা।