৬১ বর্ষ ১২ সংখ্যা / ৩ নভেম্বর, ২০২৩ / ১৬ কার্তিক, ১৪৩০
বাড়ছে বেকার, হারছে বেকার?
সোহম মুখার্জি
মাস খানেক আগের সকালের খবরের কাগজের চারের পাতার লম্বালম্বি একটা ছোট্ট বক্স খবর। এমনিতে পাতার বাঁ দিকের চিলতে ফালি খবর তেমন খায় না ব্রেকিং ব্রেকফাস্টের খবরের সাথে।
‘‘ঝাড়খণ্ডের বরকাকানা জেলার সেন্ট্রাল কোল ফিল্ডস লিমিটেডের কর্মী ৫৫ বছর বয়সি কৃষ্ণ রাম তার ছেলের হাতে খুন হয়েছেন। পুলিশ জানিয়েছে, ৩৫ বছর বয়সি বেকার ছেলে বেকারত্বের তীব্র জ্বালায় বাবার চাকরি পাওয়ার আশায় তাকে গলা কেটে খুন করেছে...’’
নয়া ডিজিটাল ‘ইন্ডিয়ায়’ এরকম অনেক ‘ভারতের’ খবর আমাদের চোখের আড়ালেই থেকে যায়। কারণ সত্যি খবর করা এবং পড়া দুই-ই আজ শাস্তিযোগ্য অপরাধ! এসবের মধ্যেই আমাদের ‘ইয়াংগিস্তান’কে রাষ্ট্রসংঘের মধ্যেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার দেশ বলে ঘোষণা করেছে। ভারতে বর্তমানে জনসংখ্যা ১৪২.৮৬ কোটি। চীনের সেখানে ১৪২.৫৭ কোটি। চীনের চেয়ে ২৯ লক্ষের বেশি জনসংখ্যা ভারতে। আর ভারতের গড় বয়স ২৮.৪ বছর যা চীনের (৪১.১ বছর) তুলনায় অনেকটাই কম। এটাই আমাদের দেশের শক্তি হতে পারত কিন্তু তা ক্রমশ পরিণত হচ্ছে বেকারত্বের অভিশাপে। কারণ দেশের সরকার জানেই না দেশের প্রকৃত জনসংখ্যা কত, ফের জনগণনা কবে হবে তা নিয়ে আরএসএস-বিজেপি’র মধ্যে মন কষাকষি চলছে। কারণ প্রকৃত জনগণনা হলেই দেশের ধর্মীয় বিশ্বাস ভিত্তিক জনসংখ্যার বিন্যাসের আসল ছবি স্পষ্ট হবে, আদপে যে ‘হিন্দু খতরে ম্যাঁয়’র প্রচার স্রেফ ভোট ভাগের রাজনীতি তা আরও একবার দেশের জনগণ বুঝতে পারবে! আধা রুটি খেয়ে রামমন্দির বানানো দেশের ভুখাপেট যুবরা এবারে যদি বছরে দু’কোটি চাকরির হিসেব চাইতে শুরু করে তাহলেই যে বিপদের শেষ থাকবে না, এটা মোদি-শাহ ভালোই জানে। দেশের অধিকাংশ সরকারি তথ্য সংগ্রহকারী সংস্থা লাটে তুলে দিলেও বিশ্বব্যাঙ্ক যে তথ্য সামনে আনছে তাতে বোঝাই যাচ্ছে ধুঁকছে দেশের নয়া প্রজন্ম!
বিরাট কোহলির ব্যাটে শচীনের রেকর্ড ভাঙার আগেই মোদি ৫৬ ইঞ্চির জমানায় দেশের বেকারত্বের হারে ৪৫ বছরের রেকর্ড ভেঙে গেছে। ২০২২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী পড়শি দেশ পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভুটানের থেকেও ভারতে বেকারত্বের হার বেশি। এদেশের যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে কর্মহীন ২৩.২২ শতাংশ। সেখানে তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থায় রয়েছে পাকিস্তান (১১.৩ শতাংশ), বাংলাদেশ (১২.৯ শতাংশ) ও ভুটান (১৪.৪ শতাংশ)। পরিসংখ্যানের হিসেবে ভারতের কাছাকাছি রয়েছে সিরিয়া। সেখানে বেকারত্বের হার ২২.১ শতাংশ। ভারতের তুলনায় ভালো অবস্থানে রয়েছে চীন (১৩.২ শতাংশ), ইন্দোনেশিয়া (১৩ শতাংশ), মালয়েশিয়া (১১.৭ শতাংশ), ভিয়েতনাম (৭.৪ শতাংশ), সিঙ্গাপুর (৬.১ শতাংশ)। মোদি কদিন আগে বেকার কমিয়ে দিয়েছি বলে যে পিরিওডিক লেবার সার্ভের কথা প্রচারে বলেছিল!! তার পরেও কীসের ভিত্তিতে এই রিপোর্ট প্রকাশ করল বিশ্বব্যাঙ্ক? তারা জানাচ্ছে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন (ILO) থেকে পাওয়া তথ্যের নিরিখে এই রিপোর্ট তৈরি হয়েছে। মূলত ১৫ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে চাকরিপ্রার্থীদের তালিকা থেকেই বেকারত্বের হার বের করেছে বিশ্বব্যাঙ্ক। সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, যুব সম্প্রদায়ের ৩৬ শতাংশই মনে করেন বেকারত্বই দেশের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা। ভারতে গ্রামের চেয়ে শহরাঞ্চলে বেকারত্বের হার অনেক বেশি। গ্রামে বেকারত্বের হার ৫.৩ শতাংশ, সেখানে শহরাঞ্চলে বেকারত্বের হার ৭.৮ শতাংশ। সামগ্রিকভাবে সারা দেশে বেকারত্বের হার গত ছয় বছরে ২.২ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.১ শতাংশে। গ্রামের কাজের জন্য দেশের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকের কোনো তথ্য নেই সরকারের কাছে! দেশের যুবসমাজের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৩ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ শতাংশে। গ্রামের ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সি যুবকদের ক্ষেত্রে বেকারত্বের হার এখন শোচনীয়। ২০১১-১২ সালে সমাজের এই অংশের বেকারত্বের হার ছিল ৫ শতাংশ। ২০১৭-১৮ সালে তা প্রায় তিনগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭.৪ শতাংশে। গ্রামের ১৫ থেকে ২৯ বছরের নারীদের ক্ষেত্রেও বেকারত্বের হার উদ্বেগজনক। ২০১১-১২ সাল থেকে ২০১৭-১৮ পর্যন্ত তাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৪.৮ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৩.৬ শতাংশ। আর মোদির কদিন আগেই করা সাধের ওই ‘পিরিওডিক লেবার সার্ভের’ যে তথ্য তিনি আর তার সাধের ‘গোদি মিডিয়া’ যা বেমালুম চেপে গেলেন তা হলো ওই সার্ভেই বলছে এই মুহূর্তে সারা বিশ্বের মধ্যে তরুণ প্রজন্মের বেকারির হার ভারতেই সব থেকে বেশি।
মোদির ঘোষণার একটার পর একটা ধাপ্পাবাজি আজ জলের মতো পরিষ্কার। ‘মুদ্রা যোজনা’ থেকে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ হয়ে ‘বিশ্বকর্মা প্রকল্প’ - ক্রোনোলজি অনুযায়ী বছরের পর বছর বেকারদের ঠকানো চলছে, না দেওয়া হয়েছে প্রতিশ্রুতি মতো সুদহীন লোনের ব্যবস্থা, না হয়েছে কাজের সুযোগ। সিএসআইই-র (CSIE) রিপোর্টে বেকারত্বের আরও যে ভয়াবহ দিক উঠে এসেছে তা হলো ডিমনিটাইজেশনের পরে দেশে কাজে শ্রমিক যোগদানের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। লেবার পার্টিসিপেশন রেট বা শ্রমিক যোগদানের হার হলো ১৬ থেকে ৬৪ বছর বয়সি কর্মোপযোগী মানুষের মধ্যে মোট কত শতাংশ মানুষ বর্তমানে কাজে নিযুক্ত রয়েছেন বা কাজের খোঁজে রয়েছেন। ডিমনিটাইজেশনের আগে ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাস অবধি দেশে শ্রমিক যোগদানের হার ছিল ৪৮ শতাংশ। মানে ডিমনিটাইজেশনের আগে ভারতে কর্মোপযোগী মানুষের মধ্যে প্রতি ১০০ জনের ৪৮ জন কাজ করতেন। কিন্তু ডিমনিটাইজেশনের পরে সেই হার নেমে এসেছে ৪২.৮ শতাংশে। দেখা যাচ্ছে মাত্র ২ বছরের মধ্যে কর্মোপযোগী মানুষের মধ্যে শতকরা ৬ জন ব্যক্তি কাজ হারিয়েছেন। আরও যে ভয়াবহ তথ্য এই রিপোর্টে উঠে এসেছে তা হলো, ২০১৭ সালে যেখানে দেশে ২ কোটি ১৬ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি কাজে যুক্ত ছিলেন, সেখানে বর্তমানে ২ কোটি ৯৫ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক কাজের খোঁজে রয়েছেন। সমীক্ষার রিপোর্টে বলছে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কয়েক দশক ধরে ক্রমাগত বেতন বৃদ্ধি হলেও দেশের ৮২ শতাংশ পুরুষ কর্মী এবং ৯২ শতাংশ মহিলা কর্মী এখনও মাসে ১০ হাজার টাকার কম বেতন পাচ্ছেন। সংগঠিত নির্মাণ ক্ষেত্রের অধীনে ৯০ শতাংশ শিল্পক্ষেত্রে ন্যাশনাল পে-কমিশন নির্ধারিত ন্যূনতম মাসিক বেতন দেওয়া হয়না। দেশের লাভজনক সংস্থাগুলোকে একের পর এক আদানিদের হাতে স্রেফ কম পয়সায় বেচে দেওয়ার প্ল্যান করছে মোদি-শাহ! তা সে উত্তরাখণ্ডের জঙ্গল থেকে জীবন বিমা, বিএসএনএল, ইন্ডিয়ান অয়েল, ভারতীয় রেল। একের পর এক রেল দুর্ঘটনার খবর ব্রেকিং নিউজ হবার পরে সামনে এলো রেলকে ধ্বংস করার ব্লু-প্রিন্ট। স্থায়ী পদ তুলে দেওয়া থেকে অস্থায়ী নিয়োগের কাজ চালানোর সাথে রেলে শূন্যপদের যে সংখ্যা সামনে এসেছে তা চমকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট!
২০১৯’র পর থেকে রেলে নতুন কোনো নিয়োগ হয়নি। বহু পদ তুলে দেওয়ার পরেও যে শূন্যপদের সংখ্যা আসছে তা হলো - মধ্য রেল-২৮,৬৫০, ইস্ট-কোস্ট-১০,০৪৩, পূর্ব-মধ্য-১৪,৭২৩, পূর্ব রেল-৩০,১৪১, মেট্রো রেল-৯৩৫, উত্তর-মধ্য-১৮,৫০৯, উত্তর-পূর্ব-১৪,০৭৪,উত্তর-পূর্ব ফ্রন্টিয়ার- ১৫,৬৭২, উত্তর রেল-৩৮,৭৫৪, উত্তর-পশ্চিম-১৫,১৮৪, দক্ষিণ-মধ্য-১৭,০৬৮, দক্ষিণ-পূর্ব মধ্য-৮,১০৬,দক্ষিণ-পূর্ব -১৭,৫৭৯, দক্ষিণ রেল-২২,৫০৬, দক্ষিণ-পশ্চিম-৬,৬১৯,পশ্চিম মধ্য-১১,৫৫৯, পশ্চিম রেল-৩০,৪৭৬ অন্যান্য ইউনিট-১২,৩৪৩। মোট প্রায় ৩.১২ লাখ শূন্যপদ। তাও চার হাজার কোটি টাকায় তৈরি হলো নতুন সংসদ ভবন!
এই সবের সাথেই মোদি সরকারের সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহেশ ব্যাস জানাচ্ছেন, ‘‘দেশে বেকারত্বের হার ফেব্রুয়ারিতে ৭.৫ শতাংশ থেকে মার্চ মাসে ৭.৮ শতাংশে পরিণত হয়েছে। এর প্রভাব দেশে কাজে শ্রমশক্তির অংশগ্রহণের হারে পতনের অবস্থা লক্ষ করা গিয়েছে। বস্তুত কাজে শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ মার্চ মাসে ৩৯.৯ শতাংশ থেকে ৩৯.৮ শতাংশে নেমে এসেছে।’’ রাজ্যগুলির মধ্যে হরিয়ানায় বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি ছিল। মার্চ মাসে হরিয়ানায় বেকারত্বের হার ২৬.৮ শতাংশ ছিল বলে জানা যায়। এর পরে ছিল রাজস্থান। রাজস্থানে বেকারত্বের হার ছিল ২৬.৪ শতাংশ। জম্মু ও কাশ্মীরে বেকারত্বের হার ছিল ২৩.১ শতাংশ। সিকিমে বেকারত্বের হার ছিল ২০.৭ শতাংশ। বিহারে বেকারত্বের হার ছিল ১৭.৬ শতাংশ এবং ঝাড়খণ্ডে বেকারত্বের হার ছিল ১৭.৫ শতাংশ। বাংলাও খুব একটা পিছিয়ে নেই ওনার অনুপ্রেরণায় - তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না! তাও এই রাজ্যগুলোর বেকারদের অবস্থা নিয়ে কথা বলার পরিবেশ আছে, কিন্তু মণিপুরের শেষ কয়েক মাসের নারকীয় জাতিদাঙ্গার হত্যালীলার পরে মানুষ নিরাপদে নিশ্বাস নিতে চাইছে শুধু! স্বাভাবিক জনজীবন নেই, ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ! সরে যাচ্ছে কাজের দাবি! হকের কাজের দাবি।
আর এটাই চায় বিজেপি!
আজ খাদের কিনারায় আমাদের বহুবৈচিত্র্যের দেশ। দেশের সংবিধান। দেশের আগামী প্রজন্ম।
।। দুই ।।
অতনু মিস্ত্রীকে মনে পড়ে?
নাহ। শাসকদেলের গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে সুপারি কিলারের হাতে বা বোমা বাঁধতে গিয়ে ফেটে ফুটে মরেনি অতনু। বরুণ বিশ্বাসের মতো অতনুকেও আমরা ভুলে গেছি।
সোনারপুর দক্ষিণ থানার বছর ত্রিশের অতনু বছর দুই আগে একদিন রাতে লরির সামনে ঝাঁপ দিয়েছিল। তার পকেট থেকে একটা চিরকুট পেয়েছিল পুলিশ।
তাতে লেখা ছিল - ‘‘এই সমাজ আমাকে বাঁচতে দিলো না!’’ অতনু’র পরিবার জানিয়েছিল ইংরেজিতে এমএ, বিএড করার পরেও চাকরি না পেয়ে অতনু একটা বেসরকারি সংস্থায় ঘর মোছার কাজ করছিল আর সেই মানসিক অবসাদই তাকে আত্মহত্যার পথে লরির সামনে ঠেলে দেয়! সারা দেশে বেকারত্বের জ্বালায় আত্মহত্যার নিরিখে যথারীতি এগিয়ে আছে বাংলা! এরকম হাজার হাজার অতনু আজ ছড়িয়ে বাংলা জুড়ে!
বাংলার মমতার সরকারও মোদি দাদার যোগ্য ছাত্রীর মতো আর আরএসএস’র সাক্ষাৎ দুর্গার মতো একটা প্রজন্মের চাকরি খেয়ে ফেলেছে সদলবলে। নিত্য নতুন চাকরি দুর্নীতি, সাদা খাতা জমা দিয়ে বিডিও হওয়া থেকে অনুব্রত’র মেয়ের ডবল ডবল সরকারি চাকরি পাওয়ার এপিসোড পেরিয়ে এখন একে একে চোর মন্ত্রীদের কামানো কাটমানি সমেত বমাল জেল যাত্রা শুরু হয়েছে। তদন্তের নামে একদিকে যখন দিদি-মোদির লোকসভার বাংলার সিট রফা চলছে তখনই দাঁতে দাঁত চেপে রাস্তায়, আদালতে, মিছিলে লড়ে যাচ্ছে বঞ্চিত যোগ্য চাকরি প্রার্থীরা। কালীঘাট থেকে ক্যামাক স্ট্রিটের শত প্রলোভনেও ভাঙা যাচ্ছে না আন্দোলন! ঝাঁঝ বাড়ছে রোজ! রাজ্য সরকারের মোট শূন্যপদ প্রায় ত্রিশ লক্ষেরও বেশি।
এরমধ্যেই কয়েক লাখ নিয়োগের প্রতিশ্রুতি এলে বাস্তব ছবিতে রাজ্য সরকারের প্রাইমারি স্কুল গুলোতেই শূন্যপদের সংখ্যা ৮ লাখ ৩৭ হাজার ৫৯২! বছর বছর টেট’র দুর্নীতি, চাকরি বিক্রি, আদালতের মুখঝামটা, প্যানেল বাতিল, পরীক্ষা বাতিল, প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতির জেল, এসবের পরেও ’২২ সালে পরীক্ষা হলেও একজনেরও নিয়োগ হয়নি। তার ওপরে ’২৩ সালের পরীক্ষার ঘোষণা করে ফর্মের দাম এক লাফে একশ’ থেকে করে দিয়েছে পাঁচশ টাকা! এছাড়াও সরকারি শূন্যপদ প্রায় ৩লক্ষ তা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে সরকার। পঞ্চায়েতে শূন্যপদ ১২ হাজার। পুরসভায় শূন্যপদ ৪০ হাজার। যা নিয়োগ হয়েছে পুরসভায় তাতেও উঠেছে দুর্নীতির অভিযোগ! ১৪টা পুরসভায় তদন্ত চলছে! ২০২৩ সালে এই বাংলায় একদিকে যেমন মিড ডে মিলের ডিম চুরি করেছে সরকার, তার সাথেই স্কুল ছুটের পরিসংখ্যান ৫শতাংশ বেড়েছে, একই সাথে ৪ লাখ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী কমেছে আর স্কুলে ছাত্র-শিক্ষক না থাকার অজুহাতে মাধ্যমিক, প্রাইমারি, আপার প্রাইমারি মিলিয়ে সরকার ৮,২০৭টা স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। এমনিতেই টাকা দিয়ে প্রাইমারি মাস্টারের চাকরি কেনার আর আদালতের রায়ে চাকরি চলে যাওয়ার ঘটনা সরকারি স্কুলগুলোর মাজা ভেঙে দিয়েছে। গ্রাম বাংলায় রেগার কাজে নথিভুক্ত যুবক-যুবতীর সংখ্যা ১ কোটি ২০ লক্ষ। কাজ মিলেছে ৫শতাংশের। ২০১১ সালের আগে কোনোদিন কেউ অভিযোগ করতে পারেনি এসএসসি, ডব্লিউপিএসসি-তে কোনো দুর্নীতি হয়েছে বলে। ২০১১ সালেও নিয়োগ হয়েছিল ১১,৭২৩ জন।
২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর শুরু হয় জালিয়াতি।
২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দু’জন ব্যক্তি সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে পিএসসি’র মেম্বার হয়ে আসেন। একজন আজকের জেল বাসিন্দা পার্থ চ্যাটার্জির ঘনিষ্ঠ দীপঙ্কর দাসগুপ্ত ও অন্যজন তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী, ৭০০ গুণ সম্পত্তি বাড়িয়ে আজকের জেলে খাবি খাওয়া বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের দাদা দেবপ্রিয় মল্লিক। শুরু হলো দুর্নীতি। ইন্টারভিউ বোর্ডেও তারা থাকতেন। আদালতের তদন্তে উঠে এসেছে থাকতেন অনেক ক্লাস এইট ফেল তৃণমূলের নেতারাও! এই দু’জনের অত্যাচারে দু'জন চেয়ারম্যানই, সব্যসাচী সেন ও নুরুল হক পদত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্য হন সেই সময়। মাননীয় সব্যসাচী সেন পরবর্তীকালে ইউপিএসসি’র চেয়ারম্যান হন।
এরপর সংবিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ছয় বছর মেম্বার থাকার সময় সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পরও দীপঙ্কর দাসগুপ্তকে ফের চেয়ারম্যান করা হয়।
এরপর শুরু হয় চরম জালিয়াতির যুগ। টাকার বিনিময়ে সাদা খাতা জমা দিয়ে চাকরি পাওয়ার যুগ। একের পর একটা পরীক্ষাতে জালিয়াতি শুরু হলো। ২০১৬, ২০১৭ সালে ডব্লিউবিসিএস (EX) পরীক্ষাতে শুরু হলো জালিয়াতি। সাদা খাতায় বিডিও হলো প্রশান্ত বর্মন সহ আরও অনেকে। পরে আবার মৃগাঙ্ক মাহাতো প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদও পিএসসি’র বোর্ড মেম্বার হন। গড়ে উঠতে থাকে দুর্নীতির ইমারত! এরসাথেই ক্রমশ ফুটে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গে কর্মসংস্থানের ভয়াবহ ছবি। খাদ্য দপ্তরে এসআই পদের ৪৮০ সিটের চাকরির জন্য আবেদন পড়েছিল ১৩ লক্ষ ৩৫ হাজার! এরমধ্যেই রায় আসে সুপ্রিম কোর্টের। ২০২২’র ১১,৫০০ জন প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্থগিতাদেশ দেয় কোর্ট। ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি আপার প্রাইমারি নিয়োগের ঘোষণার পরে আজও নিয়োগ শেষ করতে পারেনি সরকার। ২০১৫ সালের ১৬আগস্ট টেট পরীক্ষার পরে ১৪,৩৩৯টি শূন্যপদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি বেরোয় ২০১৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। প্রথম ইন্টারভিউয়ের পরে মেধা তালিকা প্রকাশ পায় ২০১৯ সালের ৪ অক্টোবর। আর হাইকোর্ট ২০২০ সালের ১১ ডিসেম্বর দুর্নীতির প্রমাণ পেয়ে প্যানেল ও নিয়োগ প্রক্রিয়াই বাতিল করে দেয়। আজ ৯ বছর পরেও একজনেরও চাকরি হয়নি। একইভাবে এসএসসি’র শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগও বন্ধ রয়েছে। এসএলএসটি (IX-X)’র পরীক্ষা হয় ২০১৬ সালের ২৭শে নভেম্বর, এসএলএসটি (XI-XII)’র পরীক্ষা হয় ২০১৬ সালের ৪ ডিসেম্বর, এসএসসি গ্রুপ ডি চাকরি প্রার্থীদের পরীক্ষা হয় ২০১৭ সালের ৫ মার্চ, Work & Physical Education’র সর্বশেষ পরীক্ষা হয় ২০১৭ সালের ৪ জুন। আজ অবধি একটা পরীক্ষার একজনকেও চাকরি দিতে পারেনি সরকার। এমন ভয়াবহ অবস্থা রাজ্য পুলিশের শূন্যপদে নিয়োগের ক্ষেত্রেও। মহিলা কনস্টেবলের ক্ষেত্রে চাকরির বয়স সীমা ২৭ থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করা হলে তার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছে চাকরিপ্রার্থীরা। কলকাতা পুলিশে ১২ হাজার, রাজ্য পুলিশে ৩২ হাজার কনস্টেবল, তার সাথে এসআই ওয়ারলেস অপারেটর, এক্সসাইজ সহ আরও ৬ হাজার শূন্যপদে নিয়োগের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি পুলিশ কনস্টেবলের ৮,৪১৯টা নিয়োগের জন্য ঘোষণার পর প্রিলি পরীক্ষা হয় ২০১৯ সালের ৪আগস্ট আর মেইন পরীক্ষা হয় ২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। আজ অবধি একজনেরও নিয়োগ হয়নি। তার বদলে অস্থায়ী সিভিক পুলিশ মাত্র ৯ হাজার টাকা মাইনে দিয়ে কাজ চালানোর পাশাপাশি একলাফে হাজতবাসী বিধায়কের মাইনে বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে।
এভাবেই এক দশক ধরে বাংলায় বেকার চাষ করে গেছে এই চোরেদের সরকার। এসএসসি’র প্রাক্তন চেয়ারম্যান সুবীরেশ ভট্টাচার্য, প্রাক্তন সচিব অশোক সাহা, প্রাক্তন উপদেষ্টা শান্তিপ্রসাদ সিনহা, প্রাক্তন মধ্যশিক্ষা পর্ষদ সভাপতি কল্যাণময় গাঙ্গুলি, প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের প্রাক্তন সভাপতি তৃণমূলের বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্য, প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি, প্রমোটার অয়ন শীল, তৃণমূলের যুব নেতা কুন্তল - এরা সবাই বাংলার বেকারদের চাকরি চুরির অপরাধে আজ জেল খাটছে! তাও এখনও রেশন দুর্নীতির দায়ে জেলে থাকা জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের টিউশনি করে বছরে ৪ কোটি টাকা কামানো সুযোগ্য কন্যা প্রিয়দর্শিনী মল্লিক উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সচিবের পদ আলো করে আছে! এভাবেই এক দশক ধরে লাখ লাখ যোগ্য চাকরিপ্রার্থীকে ক্রমশ আন্দোলনকারী বানিয়েছে মমতার সরকার।
।। তিন ।।
আগামী ৩ নভেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে ডিওয়াইএফআই’র ডাকে ইনসাফ যাত্রা। কোচবিহার থেকে কলকাতা। চুরির বিরুদ্ধে ইনসাফ। কাজের ইনসাফ। চাকরির ইনসাফ। চুরির বিরুদ্ধে ইনসাফের দাবিতে হাঁটা শুরু হবে বাংলার যৌবনের। একের পর এক জেলা পেরিয়ে যৌবনের ঢল আছড়ে পড়বে ৭ জানুয়ারি ব্রিগেডের সমাবেশে।
ধর্মতলায় তারই প্রচার, অর্থসংগ্রহ চলছিল, বাইক নিয়ে ক্লান্ত এক যুবক দাঁড়িয়ে আমাদের কথা অনেকক্ষণ শুনে কাছে এসে কৌটোতে টাকা গুঁজে দিয়ে একটাই কথা বললো -
‘‘ইনসাফ আমারও চাই। এই দাবি আমারও দাবি, ৬ বছর ধরে পাশ করে চাকরি না পেয়ে বাধ্য হয়ে বাইক চালাতে হচ্ছে! চাকরি আমার হকের। আর তা আদায় করেই ছাড়ব, লড়াই চলুক!’’
আমাদের বাংলা সমেত সারা দেশের বেকার বাড়ছে রোজ। কাজের নিরাপত্তা কমছে রোজ। তবু দেশের কয়েক কোটি যুব হারছে না। পরিযায়ী হচ্ছে। তবু লড়ছে। পেটের ভাতের জন্য। মাথা উঁচু করে বাঁচার জন্য। হকের জন্য। ইনসাফের জন্য।