E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬১ বর্ষ ১২ সংখ্যা / ৩ নভেম্বর, ২০২৩ / ১৬ কার্তিক, ১৪৩০

আরএসএস’র শিয়রে সংক্রান্তি!

অজয় দাশগুপ্ত


মহাফাঁপড়ে পড়েছে নাগপুর। ২০২৫ সালে সঙ্ঘের শতবর্ষ। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি’র সরকার আবার ক্ষমতায় ফিরে আসলে শতবর্ষে তাদের দীর্ঘলালিত ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ গড়ার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে এগোবেন, এই আশা পোষণ করে আসছিলেন সঙ্ঘের হর্তাকর্তারা। কিন্তু সে আশা জলে যেতে বসেছে ভারতের রাজনীতির সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতিতে। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি’র ফিরে আসার প্রশ্ন তো পরের কথা, এমাসে পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনে তাদের রাজনৈতিক দলের সম্ভাবনা ভালো দেখছেন না সঙ্ঘকর্তারা।

অতি সম্প্রতি কর্ণাটকের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল এবং লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে তার ইঙ্গিত মিলেছে। পুনরুজ্জীবিত কংগ্রেস এবং অ-বিজেপি বিরোধী দলগুলির ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ঘটনাই আরও উদ্বেগ বাড়িয়েছে।

যে পাঁচটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন হতে চলেছে, সেগুলির বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থায় চোখ বোলালে এটা আরও স্পষ্ট হবে।

নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত সূচি অনুযায়ী, উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্য মিজোরামে নির্বাচন হবে ৭ নভেম্বর। ছত্তিশগড়ে ৭ নভেম্বর এবং ১৭ নভেম্বর এই দুই দিন মোট দুই দফায় ভোট হবে। মধ্যপ্রদেশে ১৭ নভেম্বর, রাজস্থানে ২৩ নভেম্বর এবং তেলেঙ্গানায় ৩০ নভেম্বর। পাঁচ রাজ্যেই একসঙ্গে ৩ ডিসেম্বর ভোটের ফলপ্রকাশ করা হবে। এবং ৫ ডিসেম্বরে যাবতীয় নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষ হবে বলে জানিয়েছেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার।

এই পাঁচ রাজ্যে লোকসভা আসন ৮৩টি। এর মধ্যে মধ্যপ্রদেশে সবথেকে বেশি ২৯টি লোকসভা আসন।রাজস্থানে লোকসভা আসন ২৫টি। তেলেঙ্গানায় ১৭, ছত্তিশগড় ১১ এবং মিজোরামে একটিমাত্র লোকসভা আসন। মিজোরামে বিজেপি’র জোটসঙ্গী মিজো ন্যাশন্যাল ফ্রন্ট (এমএনএফ) রাজ্যে ক্ষমতায় রয়েছে। এখানে মূল লড়াই ক্ষমতাসীন মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের সঙ্গে কংগ্রেসের। তেলেঙ্গানায় ক্ষমতায় রয়েছে মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও-এ ভারত রাষ্ট্র সমিতি(বিআরএস)। সেখানে এবার ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে কংগ্রেসের মূল লড়াই। বিজেপি এখানে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই চালাচ্ছে। অপরদিকে, বিজেপি শাসিত রাজ্য রয়েছে মধ্যপ্রদেশ। ২০১৮-র বিধানসভা ভোটে জিতে মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস ক্ষমতা দখল করলেও দেড় বছরের মাথাতেই বিধায়ক ভাঙিয়ে মুখ্যমন্ত্রী কমলনাথের সরকারের পতন ঘটিয়েছিল বিজেপি। ছত্তিশগড় ও রাজস্থানে রয়েছে কংগ্রেসের সরকার। ওই দুই রাজ্যেই বিজেপি’র সঙ্গে তাদের সরাসরি লড়াই।

এই পাঁচ রাজ্যের মধ্যে বিজেপি সবচেয়ে অস্বস্তিতে পড়েছে মিজোরামকে নিয়ে। যদিও সেখানে বিজেপি যে জোটের শরিক, তারাই ক্ষমতায়। কিন্তু খোদ সেই জোটের মুখ্যমন্ত্রীই নির্বাচনী প্রচারে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একই মঞ্চে উপস্থিত থাকতে অস্বীকার করেছেন। যারফলে সেখানে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত সফর বাতিল করতে হয়েছে। বাতিল হয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সফরও। মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা সাফ জানিয়ে দেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মঞ্চ ভাগ করবেন না তিনি। কারণ, প্রতিবেশী রাজ্য মণিপুরের আঁচ মিজোরাম বিধানসভার নির্বাচনে পড়তে পারে। গত ৩০ অক্টোবর মিজোরামের মামিটে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিজেপি প্রার্থীদের সমর্থনে সভা করার কথা ছিল। কিন্তু জোরামথাঙ্গা জানিয়ে দেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একই মঞ্চে তিনি থাকবেন না।

আসলে গত ছমাসের বেশি সময় ধরে মিজোরামের প্রতিবেশী রাজ্য মণিপুরে যে হিংসার ঘটনা ঘটেছে, তার আঁচ এসেছে মিজোরামেও। মণিপুরে ক্ষমতায় বিজেপি। ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকার থাকা সত্ত্বেও যেভাবে শাসকদলের মদতে জাতিদাঙ্গা, খুন, জখম, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, লুটপাটের ঘটনা ঘটেই চলেছে তাতে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, এই ঘটনায় দেশের সর্বত্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হলেও খোদ প্রধানমন্ত্রী এই প্রশ্নে আশ্চর্যজনক নীরবতা পালন করে চলেছেন।

মণিপুরে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই সম্প্রদায়ের দ্বারা শতাধিক গির্জা পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা এবং হিংসার বিরুদ্ধে দেশের অন্য প্রান্তের মতো মিজোরামেও বিশাল বিশাল বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী মনে করছেন, তাঁর দল বিজেপি’র সঙ্গে জোটবদ্ধ থাকার ফলে ভোটে তাদের খুবই অসুবিধা হবে। তিনি বলেছেন, ‘মিজোরামের সবাই খ্রিস্টান। কিন্তু মণিপুরে চার্চ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা মিজোদের ভাবনার বিরুদ্ধে।’

তাঁর মতে, ‘‘এই সময়ে বিজেপি’র প্রতি সহানুভূতিশীল থাকা আমার দলের জন্য একটি বড়ো ‘মাইনাস পয়েন্ট’ হবে।’’ তাই তিনি চান, প্রধানমন্ত্রী এসে একাই ওই মঞ্চে থাকুন। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে ছাড়াই নির্বাচনী প্রচার করতে হচ্ছে বিজেপি’কে।

৪০ আসনের মিজোরাম বিধানসভা দীর্ঘদিন দখলে ছিল কংগ্রেসের। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তা হস্তান্তরিত হয় মিজো আন্দোলনের অন্যতম মুখ জোরামথাঙ্গার হাতে। তাঁর নেতৃত্বে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট জিতে নিয়েছিল ২৬টি আসন। কংগ্রেস ৫টি, বিজেপি মাত্র একটি। এবারও জনসমর্থন জোরামের দিকেই আছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

অন্যদিকে, দক্ষিণ ভারতের রাজ্য তেলেঙ্গানায় বিজেপি’কে কার্যত একাই লড়তে হচ্ছে। এমনিতেই দক্ষিণ ভারতের পাঁচ রাজ্যের মধ্যে বিজেপি’র ‘ব্যাঙের আধুলি’ ছিল কর্ণাটক। সম্প্রতি বিধানসভা নির্বাচনে প্রাণপণ চেষ্টার পরেও সেটা হাতছাড়া হয়েছে মোদি-শাহ জুটির। কর্ণাটকে জয়ের পর তেলেঙ্গানায় কংগ্রেসের পুনরুজ্জীবিত চেহারা আরও স্পষ্ট হয়েছে। তেলেঙ্গানায় ক্ষমতাসীন দল টিআরএস। অধুনা নাম বদলে যারা হয়েছে বিআরএস। তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি থেকে ভারত রাষ্ট্র সমিতি। ২০১৪ সালে অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে আলাদা হয়েছিল এই রাজ্যটি। পৃথক তেলেঙ্গানার জন্য দীর্ঘ লড়াই করেছিলেন কেসিআর ওরফে কে চন্দ্রশেখর রাও। তিনিই এই রাজ্য গঠনের পর থেকে মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর নেতৃত্বাধীন বিআরএস’কে এবার জোরদার টক্কর দিতে পারে কংগ্রেস, সেটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এখানে বিজেপি তেমন একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না বলেই মনে করছেন ভোটপণ্ডিতরা।

এবার হিন্দি বলয়ের যে তিন রাজ্যে ভোট হচ্ছে, তা বিজেপি’র কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যপ্রদেশে বিজেপি’র সরকার রয়েছে। রাজস্থান এবং ছত্তিশগড়ে কংগ্রেসের সরকার। এই তিনরাজ্যেই কংগ্রেসের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই বিজেপি’র এবং লোকসভা নির্বাচনের ওপর এর ফলাফলের উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়বে। পাঁচ রাজ্যে এই বিধানসভা নির্বাচনকে অনেকেই লোকসভা ভোটের সেমিফাইনাল হিসাবে দেখছেন। তবে এমন সমীকরণ তৈরি করা সঠিক হবে না। কারণ এই পাঁচ রাজ্যের জনগণের সাথে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের একটা পার্থক্য আছে এবং এই নির্বাচনগুলোতে ভোটারদের যে উদ্বেগ রয়েছে, তাও ভিন্ন।

উত্তর-মধ্য ভারতের বিপুল সংখ্যক হিন্দিভাষী জনগণের রাজ্যগুলোতে বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকারের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি তাদের হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শে জোর দিতে দ্বিধা বোধ করছে না। কংগ্রেস ঠিক এই জায়গাতে আঘাত করে, জাতপাতভিত্তিক জনগণনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, জনকল্যাণমূলক কার্যাবলি বাস্তবায়নে নিজেদের সরকারের রেকর্ডে নজর দিয়ে বা একগুচ্ছ অঙ্গীকারের মাধ্যমে লড়াই করছে।

বিজেপি এই তিনরাজ্যের প্রচারে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কাউকে তুলে না ধরে মোদির ক্যারিশমাকে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দীর্ণ কেন্দ্রের শাসকদলের এই কৌশল যদিও কর্ণাটকে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

রাজস্থানে মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট তাঁর সরকারের নানা জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তবে তাঁর দলের বিধায়কদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ রয়েছে। দলের মধ্যে তৈরি হওয়া কোন্দল আপাতত চাপা পড়ে গেলেও রাজ্যে কংগ্রেসের ক্ষমতা ধরে রাখার ব্যাপারে জটিলতা রয়েছে। কেরালার মতো (যদিও গত নির্বাচনে তার ব্যতিক্রম হয়েছে) রাজস্থানেও পাঁচ বছর অন্তর সরকার বদলের রেওয়াজ আছে। ২০১৮ সালে ২০০ আসনের রাজস্থান বিধানসভায় ১০৩টি আসন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল কংগ্রেস। বিজেপি পেয়েছিল ৭৩টি আসন। এর আগে রাজস্থানে দীর্ঘদিন রাজত্ব করেছে বিজেপি। রাজস্থানে কংগ্রেসের অন্তর্দ্বন্দ্ব যেমন সাংঘাতিক, বিজেপি’র মধ্যেও তেমন তীব্র গোষ্ঠীকোন্দল। সেকারণেই রাজস্থানে দলের সবচেয়ে বড়ো মুখ, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়াকে এবার প্রচারে সামনেই আনেনি বিজেপি। ঠাকুর, জাঠ সহ বিভিন্ন জাতপাতের সমীকরণেও বিজেপি’র অবস্থা সুবিধাজনক নয়। কার্যত সুতোর ওপর ঝুলছে এই রাজ্যের নির্বাচনী ভবিষৎ।

মধ্যপ্রদেশের নির্বাচনে ২০১৮ সালে কংগ্রেস পেয়েছিল ১১৪টি আসন। বিজেপি পেয়েছিল ১০৯টি আসন। কিন্তু নির্বাচনের কিছুদিনের মধ্যেই জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া একাধিক বিধায়ক নিয়ে বিজেপি-তে যোগ দেন। ফলে সরকার উলটে যায়। এবছরেও মধ্যপ্রদেশে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

মধ্যপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ চৌহান মোট ১৮ বছর শীর্ষপদে রয়েছেন। তাঁর আমলেই শিক্ষাক্ষেত্রে ‘ব্যাপম’ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে।

অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বৈষম্যের সমস্যা নিয়ে রাজ্যে সরকারবিরোধী একটা হাওয়া তৈরি হয়েছে। রাজ্যে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক প্রচার নিয়ে হাজির হওয়া বিজেপি শিবরাজ চৌহানকে সামনে না এনে একগুচ্ছ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও লোকসভা সদস্যকে বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী করেছে। তবে নির্বাচনে বিজেপি’র অবস্থা যে সুবিধার নয়, তা সমীক্ষাতেও উঠে আসছে।

এদিকে, ছত্তিশগড়ে মুখ্যমন্ত্রী ভুপেশ বাঘেল তাঁর দল কংগ্রেসের মধ্যে তৈরি হওয়া ক্ষোভের আগুন প্রশমিত করার উদ্যোগ নিয়েছেন। তাঁর সরকারের জনকল্যাণমূলক কাজের রেকর্ড, কৃষি ঋণে ছাড়, খাদ্য শস্য এবং ক্ষুদ্র বনজ সম্পদের সহায়ক মূল্য বাড়ানোর মতো বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে প্রচারে তিনি টক্কর দিচ্ছেন।

২০১৮ সালে ৯০ আসনের ছত্তিশগড় বিধানসভায় কংগ্রেস পেয়েছিল ৬৮টি আসন। বিজেপি পেয়েছিল ১৫টি আসন। এর আগে ওই রাজ্যে ১৫ বছর রাজত্ব করেছে বিজেপি। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, এবারও কংগ্রেসের দিকেই পাল্লা ভারি ছত্তিশগড়ে।

‘ভারত জোড়ো’ অভিযানের পর নতুন করে জেগে ওঠা এবং ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের বলে বলীয়ান কংগ্রেস মনে করছে এই তিনটি রাজ্যে বিজেপি-কে পরাজিত করার মতো সাংগঠনিক দক্ষতা তাদের দলে রয়েছে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস আদৌ কতটা কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে পারবে, তা এই রাজ্যগুলোর নির্বাচনের ফলাফল থেকে অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে যাবে। এটাকে একটা ড্রেস রিহার্সাল হিসেবে গণ্য করছেন বিশ্লেষকরা।

সামগ্রিকভাবে এই পাঁচ রাজ্যের ফলাফল যে খুব একটা আশাব্যঞ্জক হবে না, তা নাগপুর টের পেয়েছে। সেকারণেই তারা সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতিকে জোর দিতে চাইছে। তাই রামমন্দিরকে আবার রাজনীতির কেন্দ্রে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। দশেরা উপলক্ষে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জাতপাতভিত্তিক জনগণনার তীব্র সমালোচনা করে ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধনকে বেশি গুরুত্ব দিতে বলেছেন। অন্যদিকে, বিজয়াদশমীর বার্ষিক ভাষণে সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতও রামমন্দির উদ্বোধনের কথা বলে আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি এবং তার সরকারের সমর্থনে সমস্ত স্বয়ংসেবককে আরও সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সবচেয়ে হাস্যকর এই যে, উভয়েই বিজেপি’র নেতৃত্বে দেশের এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বামপন্থীদের।

মোদির বক্তব্য, ‘ভগবান শ্রীরাম বস আনে হি ওয়ালা হ্যায়’। লোকসভা ভোটের আগে এই রামমন্দিরকে ঘিরেই মেরুকরণ তীব্র করতে যে গেরুয়া শিবির কোমর বেঁধে রয়েছে, তা মোদি এবং আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের একসুরে এবং একই দিনে ঘোষণাতেই স্পষ্ট।

রাজনৈতিক মহলের মতে, রামমন্দিরের উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে গোটা দেশে হিন্দুত্বের প্রচারকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে আরএসএস-বিজেপি’র, যাতে তা দিয়ে ভোট-বৈতরণী তৃতীয় বারের জন্য পেরিয়ে যাওয়া যায়। লক্ষ্য একটাই, প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়া, অর্থনৈতিক ইস্যুর সঙ্গে স্বৈরাচারী পদক্ষেপ থেকে মানুষের মন ঘুরিয়ে দিয়ে মূলত হিন্দু ভোটের মেরুকরণ। তাই মোদির সাথে গলা মিলিয়ে নাগপুরে বিজয়া দশমীতে সঙ্ঘ পরিবারের কর্মীদের আগামী একবছরের দিশা ঠিক করে দিতে গিয়ে সরসঙ্ঘচালক ভাগবত জানান, রামমন্দির উদ্বোধন উপলক্ষে দেশজুড়ে কর্মসূচি নিতে চলেছে সঙ্ঘ পরিবার।

সঙ্ঘ সঠিকভাবেই অনুধাবন করেছে যে, তাদের এই মেরুকরণের খেলায় বড়ো বাধা হয়ে দাঁড়াতে চলেছে সাম্প্রতিক সময়ে তৈরি হওয়া দেশের বিরোধী মঞ্চ ‘ইন্ডিয়া’ এবং বিশেষ করে সঙ্ঘের চিহ্নিত শত্রু কমিউনিস্টরাই। তাই রামমন্দির জিগিরের সঙ্গেই উভয় নেতাই আক্রমণ শানিয়েছেন এঁদের বিরুদ্ধে। জাতগণনার যে দাবি দেশজুড়ে উঠছে, তাতে যে আসলে হিন্দু ভোট এককাট্টা করার চেষ্টা বড়ো ধাক্কা খাবে, এটা তাঁরা উপলব্ধি করতে পারছেন। আরএসএস প্রধান সরাসরি আক্রমণ শানিয়েছেন মার্কসবাদীদের। মোহন ভাগবত বলেছেন, সাংস্কৃতিক মার্কসবাদীরা মিডিয়া ও বিশিষ্টজনদের একাংশকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে নিজেদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থে দেশের সংহতিকে বিপন্ন করছে, সমাজে দ্বন্দ্ব বাড়াচ্ছে। ‘কালচারাল মার্কসবাদী’ শব্দবন্ধ বামপন্থীদেরই দেশের সংহতির পক্ষে বিপজ্জনক বলে প্ররোচনা ছড়িয়েছেন মোহন ভাগবত। তিনি পরিকল্পিতভাবেই আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে এমন উসকানিমূলক মন্তব্য করেছেন, অভিমত রাজনৈতিক মহলের।

আসলে বিজেপি সমস্ত ধরনের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও শক্তি প্রয়োগ করে, এমনকী প্রধানমন্ত্রীর মুখের ছবি সামনে রেখেও নিশ্চিত নয়। খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই, তা টের পাচ্ছে। তাই আরএসএস-কে সামনে আনতে হচ্ছে। সামনে আনতে হচ্ছে ধর্মীয় জিগিরকেই। বিজেপি সরকারের জনবিরোধী অর্থনীতি, আরএসএস-বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক কার্যকলাপ এবং প্ররোচনার বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত দেশজুড়ে জনমত তৈরির চেষ্টা করছেন বামপন্থীরাই। তাই এখন ‘সাংস্কৃতিক মার্কসবাদী’দের প্রধান শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করতে হচ্ছে মোহন ভাগবতকে।

দেশের মানুষও সাম্প্রদায়িক ও বিভাজনকারী দাঙ্গার শক্তিকেই দেশের কাছে ‘অশুভ শক্তি’ হিসাবে চিহ্নিত করছেন। আর সেই শক্তির প্রতিনিধি আরএসএস-বিজেপি। এই প্রেক্ষিতে আগামী লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি’র ফিরে আসা যে ‘কেক-ওয়াক’ হবে না, তা বুঝতে পেরেই ঘুম ছুটেছে নাগপুরের। ইতিমধ্যেই ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ নিয়ে অন্য সুরে কথা বলতে শুরু করেছেন তারা।

সম্প্রতি আরএসএস’র সাধারণ সম্পাদক দত্তাত্রেয় হোসাবালে একটি সভায় বলেছেন, ভারতের সাংস্কৃতিক বিভিন্ন ধারাকে যে নামেই ডাকা হোক, তা আসলে হিন্দু রাষ্ট্র। তবে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র (থিওক্র্যাটিক স্টেট) নয়।

আরএসএস’র সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী সংগঠন অখিল ভারতীয় প্রতিনিধি সভার বৈঠকে সম্প্রতি এই মন্তব্য করেছেন হোসাবালে। আরএসএস’র প্রধান মোহন ভাগবত সহ এই বৈঠকে সংগঠনের সব শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে হোসাবালে বলেন, ‘হিন্দু রাষ্ট্র সম্পর্কে সঙ্ঘ (আরএসএস) আগেই বলেছে যে, এটি একটি সাংস্কৃতিক ধারণা। এটি ধর্মভিত্তিক ধারণা নয়। ১০০ বছর ধরে আমরা বলে আসছি, ভারত আসলেই একটি হিন্দুরাষ্ট্র, একে নতুন করে (হিন্দুরাষ্ট্র) বানানোর প্রয়োজন নেই। এখানে বলা দরকার যে, রাষ্ট্র (স্টেট) এবং জাতি (নেশন) দুটি পৃথক বিষয়।’

হোসাবালে বলেন, সংবিধান দ্বারা যে প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে, তা হলো রাষ্ট্র। জাতি একটি সাংস্কৃতিক চিন্তা। জাতি হিসেবে ভারত হিন্দু। এখানকার সাংস্কৃতিক যে ধারণা রয়েছে, তাকে নানা নামে ডাকা যেতে পারে। হিন্দু বলা যেতে পারে, ইন্ডিক বলা যেতে পারে, আর্য বা সনাতনও বলা যেতে পারে। আরও হয়তো কয়েকশো নাম দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু আসলে তা হিন্দুরাষ্ট্র এবং সেই কারণেই সেটি একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র নয়।

অর্থাৎ, কার্যত ভারতের ‘স্টেট’ এবং ‘নেশন’ দুটিই আদতে হিন্দু হলেও, ভারতকে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করেননি হোসাবালে। সংবিধান নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রকেও হিন্দুরাষ্ট্রের সংজ্ঞার বাইরেই রেখেছেন।

বিজেপি’র জাতীয় সভাপতি জগৎপ্রকাশ নাড্ডা এবং সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) বিএল সন্তোষ অখিল ভারতীয় প্রতিনিধি সভার তিন দিনের সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।

সাম্প্রতিক সময়ে সঙ্ঘে মোহন ভাগবতের উত্তরসূরি হিসেবে হোসাবালেকে গণ্য করা হয়ে থাকে। ফলে তাঁর এই মন্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সঙ্ঘের উদ্বেগই এর মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে।