৬১ বর্ষ ১২ সংখ্যা / ৩ নভেম্বর, ২০২৩ / ১৬ কার্তিক, ১৪৩০
রামমন্দিরঃ হিন্দুত্ব জাগরণের হীনপ্রচেষ্টা - একে রুখতেই হবে
দেবাশিস আচার্য
মোদির শাসন হলো হিন্দুত্বের সঙ্গে করপোরেট মিশেল।
বংশদবদ গদি মিডিয়া যতই ঢাক পেটাক সংকটকে আড়াল করতে পারছে না। তাই আর ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ নয়, এখন উচ্চারিত হচ্ছে মরণকালে “রাম নাম সত্য হ্যায়।’’
মোদি সরকার দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পরই বিশ্বের সাথে আমাদের দেশও ভয়াবহ কোভিড-১৯-এর কবলে পড়ে। এই পর্বে মোদি সরকারের ব্যর্থতা আরও প্রকট হয়ে পড়ে। মাত্র একদিনের নোটিশে লকডাউন ঘোষণা, অপ্রতুল সরকারি পরিকাঠামো, ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, দেশের মানুষের ভয়াবহ অবস্থা, পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরবস্থা ও তাদের প্রতি সরকারের নিষ্ঠুর কদর্য নির্মমতা বিশ্বের কাছে দেশের মাথা নিচু করে দেয়। অথচ একই দেশে বিকল্প কেরালার বাম গণতান্ত্রিক ফন্ট সরকারের কোভিড মোকাবিলায় ভূমিকা রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রশংসাও লাভ করে। করোনাকালে দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে। জিডিপি হ্রাস পায় ২৩.৯ শতাংশ। দেশে নতুন করে ৪০ কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে অথচ কোন জাদুবলে দেশের মানুষের সর্বনাশের কালে দেশের হাতেগোনা ধনীদের পৌষ মাস হয়। এই দুঃসময়ে রিলায়েন্সের লাভবৃদ্ধি পায় চার হাজার কোটি টাকা। ২০১৯ সালের জুলাই মাসের তুলনায় পরবর্তী বছরে তাদের সম্পত্তির পরিমাণ লাফ দিয়ে ২৫০০ কোটি ডলারের বেশি বেড়ে যায় আর এই বিপর্যয়ের সুযোগে মোদি সরকার ব্যাঙ্ক, বিমা, বিমানবন্দর, কয়লা খনি বেঁচে দেওয়ার মতো পদক্ষেপ নেয় গণতান্ত্রিক রীতিনীতি তোয়াক্কা না করে। দেশের সরকারের বন্ড বেসরকারি হাতে বেচে দেওয়া হয়। দেশের কৃষকের হাত থেকে জমি করপোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার সর্বনাশা কৃষি বিল আনে। দেশের শ্রমজীবী মানুষের কাজের সময় ৮ ঘণ্টার বদলে ১২ ঘণ্টা করার আইন চালু করে।আর এইসব ব্যর্থতা জনবিরোধী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রাচীরকে ভাঙতে আস্তিনে গোটানো পুরানো তাস রাম মন্দিরের শিলান্যাস করেন। আসলে করোনাকালে বিপন্ন মানুষের জন্য হসপিটাল, খাদ্য, ওষুধের চেয়ে শাসকের কাছে সরকারি অর্থে মন্দির নির্মাণ অনেক বেশি জরুরি হয়ে পড়ে। যে মন্দির তাকে চব্বিশে সমস্যা জর্জরিত দেশের প্রধানমন্ত্রীর কুর্সি এনে দেবে আর তিনি তার আদর্শ সংঘের শতবর্ষের স্বপ্নপূরণে সংঘসেবকের অনুগত ভূমিকা পালন করে ভাগওয়া ঝান্ডার সামনে নতজানু হয়ে গুরুদক্ষিণা প্রদান করবেন।
রাম মন্দির ইস্যু আরএসএস-এর পুরনো অ্যাজেন্ডা।হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণ সংকল্পের প্রাথমিক পর্ব। ১৯৯২-এর ছয় ডিসেম্বর তারই ভয়ংকর পরিণতি ডেকে এনেছিল ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে। আমাদের জাতীয় জীবনে অযোধ্যার ৬ ডিসেম্বরের ঘটনা ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কের দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
দেশের সংবিধানে বর্ণিত ধর্মনিরপেক্ষতা ও আইনের শাসনের এই বিরুদ্ধাচরণের সূত্রপাত ১৯৪৮ সালের ২২-২৩ ডিসেম্বর চুপিসারে বাবরি মসজিদের ভেতর রামের মূর্তি স্থাপন করে। রাষ্ট্র সেদিনও নীতিগত অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়। এরপর ১৯৪৯ থেকে ’৮৬ বিতর্কিত এলাকা আদালত নিযুক্ত রিসিভারের আওতায় থাকে। ১৯৮৬-তে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী হিন্দু ভোটের আশায় প্রস্তাবিত রাম মন্দির তৈরির অনুমতি দেয় আর শাহবানু মামলায় ১৯৮৫ রায়ের পর মুসলিম মৌলবাদীদের তোষণ করতে মুসলিম মহিলা বিল চালু করেন। এসব করেও রাজীব গান্ধী ভোটে জিততে না পারলেও দেশের হিন্দুত্ববাদীদের পালে হাওয়া উঠিয়ে দিতে সমর্থ হন। আর তারই পরিণতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার কফিনে ৬ ডিসেম্বর পেরেক পোঁতার কাজ সম্পন্ন করে সংঘ আর তার সংগঠনগুলো।
পুনরায় রাম ভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের রায় এ দেশে হিন্দুত্ববাদীদের উৎসাহিত করেছে। কোর্টের রায়কে সামনে রেখে সরকার মন্দির নির্মাণে যতটা তৎপর। বাবরি ধ্বংসলীলার সাথে যুক্ত অপরাধীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছা প্রকাশ করেনি, ইতিপূর্বে দেশের সুপ্রিম কোর্ট দেশের শ্রমজীবী মানুষের কাজে সমবেতনের কথা বললেও সেই বিষয়ে কার্যকর করতে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
অদ্যাবধি যে রামচন্দ্রকে নিয়ে বিজেপি তার নির্বাচনের রণধ্বনি দিচ্ছে রামকে যেভাবে চিত্রিত করতে চাইছে মহাকাব্য সাহিত্যে যে রামের বৈচিত্র্যময়তা রয়েছে এ তারও বিরুদ্ধচারণ। এক দেশ এক ধর্ম এক জাতি এক ভাষার মতোই বিজেপি এক রামের মূর্তি নির্মাণ করতে চাইলেও বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ভারতে নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানের মতো হিন্দু ধর্ম তার দেব-দেবী উপাসনা উৎসবের যেমন বৈচিত্র্য রয়েছে। রামচন্দ্রের ক্ষেত্রেও সেই বৈচিত্র্য আছে। আদি সংস্কৃত রামায়ণের রচয়িতা যে মহাকবি বাল্মীকি এ বিষয়ে গবেষকরা একমত হলেও এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, রচনার পূর্বে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রামকে নিয়ে প্রচুর লোককথা প্রচলিত ছিল। পরবর্তীকালে দেশের নানা ভাষায় রামায়ণ লেখা হয়েছে যার উৎস বাল্মীকি রামায়ণ হলেও আক্ষরিক অনুবাদ ছিল না। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য শ্রীরাম পাঁচালি (কৃত্তিবাস, বাংলা পঞ্চদশ শতাব্দী) রামচরিত মানস (তুলসী দাস, হিন্দি ষোড়শ শতাব্দী), বিলঙ্কা রামায়ণ (সরলা দাস, ওড়িয়া পঞ্চদশ শতাব্দী) রামায়ণ (অঙ্গম, গোপী মণিপুরী অষ্টাদশ শতাব্দী) রামায়ণ (ভানুভক্ত, নেপালি ঊনিশ শতাব্দী।) এছাড়াও জৈমিনী রামায়ণ দক্ষিণ ভারতে রাবণায়ন রয়েছে। এইসব রাম কথার কাহিনি আঙ্গিকে রয়েছে প্রচুর বৈচিত্র্য। বাংলার কৃত্তিবাসী রামায়ণে এমন অনেক বিবরণ আছে এমনকী অকালবোধনের মতো কাহিনি কৃত্তিবাস লিখলেও বাল্মীকি রামায়ণের তার কোনো উল্লেখ নেই। পঞ্চদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যদিও ক্ষয়িঞ্চু ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির যুগ তবুও পণ্ডিতদের দাপট কিছু কম ছিল না। সংস্কৃত ভাষার জটাজাল থেকে কৃত্তিবাসই রাম কথাকে বাঙালির করে তোলেন। একজন মুসলমান শাসকের ছত্রছায়ায় তিনি প্রবল ব্রাহ্মণ্যবাদী চাপের মুখে দাঁড়িয়ে এই কাজ করেন।
রামের কাহিনি শুধু ভারতে নয় বহির্ভারতেও আছে। ইন্দোনেশিয়ার বালিতে এখনো পর্যন্ত বিভিন্ন পূজা অর্চনা এবং সামাজিক অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে রামায়ণ পাঠ হয় কম্বোডিয়ার রামকথা অত্যন্ত জনপ্রিয়। থাইল্যান্ডের ললিতকলায় রামায়ণের প্রাধান্য চোখে পড়ে। শ্রীলংকায় কোহোম্বো নামে এক দীর্ঘ নৃত্যানুষ্ঠান হয় যার কাহিনিতে রাম-রাবণ রয়েছেন। শুধুমাত্র রাম নন, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে মন্দির নির্মাণের বৈচিত্র্য, হিন্দুদের দেবদেবীর মূর্তি, প্রকরণ শৈলী, মূর্তির রং তার উপাসনার ধরন পদ্ধতির মধ্যে প্রচুর বৈচিত্র্য আছে। এক রাম নির্মাণের মধ্য দিয়ে হিন্দু ধর্মের সেই বৈচিত্র্যকেই ভাঙতে চায় হিন্দুত্বের শক্তি। আসলে হিন্দুত্বের তত্ত্ব শুধুমাত্র ভারত দর্শন, ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধানের পরিপন্থী নয়, হিন্দু ধর্মের ও ভারত সংস্কৃতির রিরোধী। ভারতীয় সংস্কৃতি বলতে আমরা যা বুঝি তা পারশি, গ্রিক, হিন্দু, সাইথিয়, ইসলাম, খ্রিস্ট সহ বিভিন্ন ধারার মিশ্রণ। ভারতীয় মার্গসঙ্গীত, সাহিত্য ইসলামিক সংস্কৃতির প্রভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে। গান্ধার শিল্পরীতিতে হেলেনিস্টিক বিষয়বস্তুর ছোঁয়া পাওয়া যায়। পাশ্চাত্য ও জৈন ধারা মুঘল ধারায় মিশে রাজস্থানী চিত্রকলার রূপ পেয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দ সর্বদা মোঘল স্থাপত্য-সংগীতের উত্তরসূরিতার জন্য গর্ববোধ করতেন। হিন্দু ও মুসলিম ধর্মের মানবিক ভাবনা মিশ্রণে ভারতে ভক্তি ও সুফিবাদের সৃষ্টি হয় বাংলায় তার ঐতিহাসিক পরম্পরা আছে। বাউল গান, ভালো ফসলের আশায় কিংবা রোগ মহামারী থেকে মুক্তির জন্য হিন্দু-মুসলমান একসাথে কণ্ঠ মিলিয়েছে, একসাথে উপাসনা করেছে। আমাদের দেশের বিভিন্ন অংশে রাবণ পূজিত হন। এমনকী মহাভারতের তথাকথিত খলচরিত্র শকুনিকে কেরালার কোল্লাম জেলার মায়ামকুট্টুর পবিত্রশ্বরমে কুরুবার সম্প্রদায় উপাসনা করেন।
করপোরেট মদতপুষ্ট শাসকশ্রেণির পরিকল্পনা অনুযায়ী ঠিক হয়েছিল মোদিকে বিপণন করা হবে বিকাশপুরুষ উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসেবে। কিন্তু সংঘ সমান্তরালভাবে তার হিন্দুত্বের প্রচার জারি রাখবে ও সরকার তাদের নির্দেশিত কার্যক্রম রূপায়ণ করবে। হিন্দুত্ববাদী কর্মসূচি হবে বিজেপি’র প্রচারের মূল ভিত্তি, যদিও করপোরেট মিডিয়ায় সরকারের বিকাশের প্রচারের ঢাক পেটাবে। উন্নয়ন ও সুশাসনের করপোরেট বাইন্ডিংয়ে রূপান্তরিত হিন্দুত্ব। সংঘের শতবর্ষে তাদের মূল লক্ষ্য হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণ - যা দলিত নিপীড়িত জাতি, আদিবাসী মহিলা ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্বার্থের পরিপন্থী। হিন্দু রাজ্যের সামাজিক ভিত্তি হবে বর্ণাশ্রম ধর্মের সামাজিক ব্যবস্থা। যে রাষ্ট্রে ক্ষমতা কবজা করবে বৃহৎ পুঁজিপতি ও ধনিককুল। এরই অঙ্গ হিসাবে ইতিমধ্যে ৩৭০ ধারা বাতিল, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি লাগু করা, জাতীয় নাগরিক পঞ্জি বিল পাস হয়েছে। রাষ্ট্রের সক্রিয় উদ্যোগে রাম মন্দির নির্মাণ করে হিন্দুত্বের ধ্বজা উড়িয়েই ২৪-এর নির্বাচনে শামিল হতে চায় সংঘ চালিত মোদি সরকার। শাসকশ্রেণি যে কোনো বিপদ সামলাতে বিভাজনের রাজনীতি, আর উগ্র জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করে এটা পরীক্ষিত কৌশল। ২০১৯- এর লোকসভা নির্বাচনের আগে হাজারো ব্যর্থতা, বিভিন্ন রাজ্যে পরাজয়, বেহাল আর্থিক অবস্থা থেকে বিজেপি’র পরাজয়ের সম্ভাবনা তৈরি হলেও পুলওমার সন্ত্রাসবাদী হামলাকে সামনে রেখে উগ্র জাতীয়তাবাদের জোয়ারে বিজেপি'র বেসামাল নৌকার পালে হাওয়া লাগে ও দ্বিতীয়বারের জন্য মোদি ক্ষমতাসীন হন। সম্প্রতি তদানীন্তন জম্মু কাশ্মীরের রাজ্যপাল সৎপাল মালিকের বক্তব্য পুলওয়ামা ষড়যন্ত্রের পর্দা ফাঁস করে দিয়েছে।
সংঘের হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্কল্প আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের পরিপন্থী। গান্ধী-নেতাজি, আম্বদকর নেহরু-আজাদ, ভগৎ সিং-আসফাকুল্লারা ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের স্বপ্ন দেখতেন। ভারতের অতীত ইতিহাসেও সেই সম্বন্বয়ী ধারাই ছিল। সেকারণেই এরা সেই ঐতিহ্যময় ইতিহাসকে বদল করছে, বিকৃত করছে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গ হিসেবে।
সারা ভারতে হিন্দুত্ববাদীরা তাদের বিভাজনের রাজনীতি ছড়াতে সমর্থ হলেও তাদের অন্যতম স্থপতি জনসংঘের প্রাণপুরুষ শ্যামাপ্রসাদের জন্মভূমি চৈতন্য-লালনের বাংলায় তাদের সে স্বপ্ন অধরাই ছিল। বিরানব্বই-এও সারা দেশে তারা দাঙ্গার আগুন ছড়িয়ে দিতে পারলেও বাংলায় তাদের সেই ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। এরাজ্যের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সুদীর্ঘ ঐতিহ্য আর তার যোগ্য উত্তরাধিকার শ্রমজীবী মানুষের লড়াইয়ের সাথি বাম প্রগতিশীল মানুষ ও বাম সরকার সেই চক্রান্ত রুখে দিয়েছেন।
অথচ সেই বাংলা এখন হিন্দুত্ববাদীদের শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হচ্ছে। এ রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীকে অনেক আগেই হিন্দুত্ববাদীরা সাক্ষাৎ দুর্গা বলে অবিহিত করে তাঁকে কমিউনিস্ট অসুরবধে সহায়তায় প্রতিশ্রুতি দেয়।
মমতা অতীতে বারবার বিজেপি’র সাথে ঘর বেঁধেছেন, আরএসএস-কে দেশপ্রেমিক বলে প্রশংসা করেছেন, রামমন্দির নির্মাণ ইস্তাহারে বিজেপি’র সাথে স্বাক্ষর করেছেন। আরএসএস-ও তাদের চিরশত্রু কমিউনিস্টদের সরিয়ে মমতাকে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী করতে সর্বাত্মক সহায়তা করেছেন। বদলে মুখ্যমন্ত্রী তাদের কাঙ্ক্ষিত বঙ্গদেশে আরএসএস-কে শক্ত ঘাঁটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন।
এ রাজ্য বরাবরই ধর্ম আর রাজনীতি তার নিজের জায়গায় থেকেছে,অথচ সেই বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ধর্মের সাথে রাজনীতি ও সরকারকে মিশিয়ে দিলেন, কখনো নামাবলি কখনো হিজাব তার আভরণ হলো। হিন্দু ও মুসলিম উভয় সাম্প্রদায়িক শক্তি বাংলায় তাদের জাল বিস্তার করলো প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার হাত ধরে। এরাজ্যে রাজনীতির মিছিলে জয়শ্রীরাম ধ্বনি উঠলো। তাই সারাদেশে যখন হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ দেশপ্রেমিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে, তখন বাংলার পরিস্থিতি একটু ভিন্ন, এখানে তৃণমূলকে পরাস্ত না করে বিজেপি তথা হিন্দুত্বের রাজনীতিকে পরাস্ত করা যাবে না। দুই শক্তিই আরএসএস’র মদতপুষ্ট। তাই এই লড়াইয়ে বাংলার মানুষকে তৃণমূল-বিজেপি দুই অপশক্তির বিরুদ্ধে যুগপৎ লড়াইয়ে নামতে হবে।
এদিকে দেশে চলছে এক অঘোষিত জরুরি অবস্থা। সরকারের নীতির বিরোধিতা করলেই ইউএপিএ-তে লটকে দাও। সম্প্রতি পঞ্চাশ জন সাংবাদিকের বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়েছে। নিউজক্লিকের সম্পাদককে গ্রেফতার করেছে সরকার। এদের অপরাধ সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে এরা সরব হয়েছেন।
এতো সব করেও দেশের মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ দেখে ক্ষমতা হারানোর ভয় দানা বাঁধছে শাসক আর তার করপোরেট বন্ধুদের বুকে।
কেরালা, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্র, কর্ণাটকের সাথে হরিয়ানাতে তারা পরাস্ত হয়েছে। উত্তরপ্রদেশেও অবস্থা ভালো নয়। বিহার হাতছাড়া, পুরোনো বন্ধুরা একে একে হাত ছাড়ছে।ওদিকে দেশের তামাম বিরোধী শক্তি একজোট হয়ে ইন্ডিয়া গড়েছেন। গত দশ বছরে দেশের লোক যে সরকারকে মোদি সরকার বলে জেনে এসেছেন হঠাৎ ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রীর মনে করিয়ে দিলেন এনডিএ’র কথা।শুধু তাই নয়, রামমন্দির উদ্বোধন প্রসঙ্গে নিজেদের উচ্ছ্বাসের কথা বলতে গিয়ে রামের নামে জিগির তুলে আবারও কমিউনিস্টদের এই কাজের প্রধান বাধা বলে আরএসএস প্রধান তাঁর দীর্ঘ বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন।
আসলে রামের নামে বামপন্থীদের বিরুদ্ধে তীর নিক্ষেপ করে আরএসএস এই লড়াইয়ের বাম-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ দেশপ্রেমিক মানুষের দায়িত্বই স্মরণ করিয়ে দিলেন। এই মুহূর্তে ভারতের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রধান কতব্য ধর্মনিরপেক্ষতার নিশানকে তুলে ধরা। এই কাজ করতে হলে একদিকে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ দেশপ্রেমিক মানুষের ব্যাপকতম ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। আরএসএস পরিচালিত সরকারের জনবিরোধী আর্থিকনীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক অংশের শ্রমজীবী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শামিল করাতে হবে। অন্য দিকে দেশের বৈচিত্র্যময় মিশ্র সংস্কৃতি, জীবনচর্চা, ভক্তিবাদী মানবিক সৃজনশীল ধারা যা যুগ যুগ ধরে ভারতের ঐক্যকে মজবুত করেছে তাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে বিভাজনের শক্তিকে প্রতিহত করতে হবে, দেশের শাসন ক্ষমতা থেকে তাদের অপসারিত করতে হবে।