৬১ বর্ষ ১২ সংখ্যা / ৩ নভেম্বর, ২০২৩ / ১৬ কার্তিক, ১৪৩০
মতুয়া মতাদর্শ - নমশূদ্র জনজাতির আত্মজাগরণের এক আলেখ্য (শেষাংশ)
অরুণকান্তি মহাপাত্র
মতুয়া ধর্মদর্শনের দিকনির্দেশ হলো ভেদাভেদহীন সমাজব্যবস্থা ও কর্মমুখী জীবনযাপন - ত্যাগসর্বস্ব ধর্ম-ভক্তি নয়। পরিবার এবং সমাজকেন্দ্রিক কার্মিক জীবন - যে হরিনাম এবং কাজ একসাথে করে।
'হাতে কাম, মুখে নাম ভক্তি প্রবল' - মতুয়া জীবনে এই মহৎ বাণী মানব জীবনে এক নতুন ধারার দিগদর্শন। আত্ম-সংযম মতুয়াদের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়। মতুয়া ধর্মে বাল্যবিবাহ সমর্থনযোগ্য নয়। দেশ, কাল, পাত্র ভেদে মতুয়াগণ ভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে অসবর্ণ বিবাহ সমর্থন করে। গুরুচাঁদ ঠাকুরের সময়কালে অন্যান্য বহু জাতি যেমন পৌণ্ড্র, তাঁতি, তিলি, মুচি, হাড়ি, ডোম, মুসলমান এমনকী ব্রাহ্মণরাও এই ধর্মে যোগদান করেন। তবে নমশূদ্ররাই ছিলেন প্রধান শক্তি। প্রত্যেক মতুয়া পরিবারে বালক বালিকাদের স্কুল শিক্ষা বাধ্যতামূলক। শক্ত সবল দেহ গঠনের জন্য মতুয়া ধর্মীয় আদর্শের স্বাস্থ্যবিধি নির্ণীত হয়েছে যা-মানা বাধ্যতামূলক।
ভারতীয় ধর্মসাধনার ইতিহাসে অধ্যাত্ম জীবন ও গার্হস্থ্য জীবনের কোনো সম্পর্ক নেই। মতুয়া ধর্মের মূল আদর্শ গার্হস্থ্য ধর্ম: হরিচাঁদ ঠাকুর গৃহাশ্রমে থেকেই ধর্মীয় স্পষ্ট নির্দেশ দেন -
"চতুর্বিধ ধর্ম মধ্যে প্রধান গার্হস্থ।
গৃহস্থ ধার্মিক কর্ম অতি সুপ্রসস্থ।।"
মতুয়া ধর্মের আদর্শ ও লক্ষ্য - চতুর্বর্গ ফললাভ - (১) গার্হস্থ্য ধর্ম, (২) ধর্ম ও কর্ম, (৩) সদাচার এবং (৪) আত্মোন্নতি ও সমোন্নয়ন।
প্রতিবাদী লোকায়ত ধর্মআন্দোলন
মতুয়া ধর্ম বৌদ্ধ ও বৈষ্ণব ধর্মের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত জীবনবাদী বলিষ্ঠ লোকায়ত ধর্মের আদর্শ। লোকায়ত ধর্মমতের বিরুদ্ধে তাকে ধ্বংস করার লক্ষ্য নিয়ে যে বিদ্বেষ, আক্রমণ - বাস্তববাদী গুরুচাঁদ তাকে প্রতিরোধ করার জন্য শক্তি ও সংঘবদ্ধতার উপর গুরুত্ব দেন - 'শক্তি না দেখিলে কেহ করে না সম্মান'।
পূর্ববঙ্গের নমশূদ্ররা প্রধানত কৃষিজীবী। তাদের মধ্যে জেলে, মাঝি, সূত্রধর, কর্মকার ইত্যাদি বিভিন্ন বৃত্তির প্রচলন থাকলেও মুখ্যত নমশূদ্র সমাজ ছিল চাষি ও কৃষিশ্রমিক। ফলে জমিদার, তালুকদার, নায়েব-গোমস্তা ও মহাজনদের বিরুদ্ধে লড়াই লেগেই থাকত। হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরকেও ওইসব কৃষকবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সাথে কৃষকদের পক্ষে লড়াই করতে হয়েছে।
নমশূদ্র কৃষিজীবী মানুষদের সবচেয়ে বড়ো লড়াই ছিল নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে নীলচাষবিরোধী বিদ্রোহ। ১৮৫৯-৬০ সালে নীল বিদ্রোহ নির্দিষ্ট রূপ লাভ করলেও তার সূত্রপাত ঘটেছিল অনেক বছর আগে থেকেই। নীলচাষ বিরোধী আন্দোলন, তেভাগার আন্দোলন এবং কৃষকদের অনেক আন্দোলনে নমশূদ্র কৃষকদের ভূমিকা ছিল মুখ্য। প্রকৃতঅর্থে নিপীড়িত, উপেক্ষিত মানুষের জাগরণের বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিল লোকায়ত বৌদ্ধধর্মমত। কিন্তু ওই ধর্মমতের বিরুদ্ধে উগ্র ব্রাহ্মণ্যবাদী আক্রমণ হয় খুবই তীব্র।
কিন্তু লোকায়ত বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মকে নিকেশ করে দেওয়া যায়নি। আজও তার অস্তিত্ব ও প্রভাব সমানভাবে বহমান। মধ্যযুগের ভারতে একই আলোড়নের তরঙ্গ সৃষ্টি করেছিলেন চৈতন্যদেব তাঁর বৈষ্ণব ধর্মের মাধ্যমে। দ্বাদশ শতাব্দীর পরবর্তীকালে বাংলার জীবন ও সংস্কৃতি তুর্কি আক্রমণে আঘাতে, অরাজকতায় ও ধ্বংসলীলায় একেবারে অবসন্ন হয়ে পড়েছিল। হয়ত বা সেসময়ে সৃষ্টিশীল কিছু করার প্রেরণাই কেউ পায়নি। কিন্তু তুর্কি আক্রমণোত্তরকালে এই অনুপ্রেরণাহীন তমসাচ্ছন্ন পরিমণ্ডলে যা পরিস্থিতি দাঁড়াল সে বিষয়ে জানা যায় বিশেষজ্ঞ গোপাল হালদার লিখিত 'বাংলা সাহিত্যের রূপরেখা' গ্রন্থে - "এই দুর্যোগটা সাহিত্যে অন্ধকারের যুগ, সমাজে আবর্তনের যুগ। এই আবর্তন অবশ্য শেষ হ'ল প্রায় দেড়শ' বৎসরে; তার পরেকার দেড়শ' বৎসর ধরে চলল বাংগালী সমাজের বিবর্তন। কারণ, তুর্ক-বিজয়েও ভারতীয় পল্লীসমাজ ভগ্ন হ'ল না, অভ্যাহতই রইল। ভারতীয় বর্ণভেদও অক্ষুণ্ণ রইল, জন্মান্তর ও কর্মফলের আধ্মাত্মিক ধারণা বরং দৃঢ় হ'ল।"
বিষয়টি দাঁড়াল এই যে অধ্যাত্ম চেতনাই সেই সমাজের বাহন হয়ে রইল।
আর একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য পরিস্থিতি তৈরি হলো - তুর্কি আক্রমণের ফলে ব্রাহ্মণ্যবাদী উচ্চবর্গের পরাজিত হিন্দু সমাজ তখন নিজস্বভাবে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ সৃষ্টি করে, স্বকীয়তা বজায় রাখার চেষ্টা করে এবং তা বাস্তব সামাজিক বাধ্যবাধকতায় উচ্চ ও নিম্নবর্ণের সংযোগ সান্নিধ্য কিছুটা নিকটতর হয়ে ওঠে। লোকায়ত জনসমাজের লৌকিক ধর্মীয় দেবদেবী নানা লৌকিক আখ্যানে পরিণত হয়ে উচ্চবর্গের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। অন্যদিকে নিম্নবর্ণের মানুষেরাও সুযোগ ও সাধ্যমত ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে অনেকখানি নিজেদের মধ্যে গ্রহণ করতে শুরু করে। এই বর্ণ সংযোগের পরিমণ্ডলে মহাপ্রভু চৈতন্য জাত-পাত-সংকীর্ণতা-ভেদবৈষম্যহীন উদার মানবতাবাদী নবপ্রেমভক্তির নতুন ধর্মের প্রবর্তন করেন - 'বৈষ্ণব ধর্ম'। এই ধর্ম দেশের সার্বিক জনজীবন, পরিবেশ-পরিমণ্ডল এবং সামগ্রিক ভারতীয় জীবনবোধের সঙ্গে লীন হয়ে গিয়েছিল এবং সর্বজনগ্রাহ্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
স্মৃতি-পুরাণ-পুরোহিত-ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র-শাসিত আনুষ্ঠানিক শাস্ত্রীয় ধর্মের সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে - প্রেম, সাম্য, মৈত্রী ও মানবতার যে বৈষ্ণবীয় ভাবনা চৈতন্য তাঁর নবভক্তিবাদী ধর্মআন্দোলনে যুক্ত করেছিলেন, তার ঐতিহাসিক ফলশ্রুতি ঘটেছিল শিষ্ট ঐতিহ্য সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও আদিম লৌকিক ঐতিহ্যের মধ্যে মিলন মিশ্রণ সম্পাদনে। বিশেষকরে এই মহৎ প্রভাব পরিলক্ষিত হয় শ্রীগৌরাঙ্গ অব্যবহিত পরবর্তী কর্তাভজা, বাউল, সাই-দরবেশ, মতুয়া প্রভৃতি গণভিত্তিক লোকায়ত ধর্মসম্প্রদায়ের উদ্ভব ও বিকাশের মধ্যে। অবশ্য এই অবস্থারও পরিবর্তন হয় চৈতন্য পরবর্তীকালে। চৈতন্য প্রবর্তিত বৈষ্ণব ধর্ম তার স্বকীয়তা বজায় রাখতে পারল না। নানারকম বিচ্যুতি ও বিপথগামিতা তার গুণগত আকর্ষণ হারিয়ে ফেলল। তাছাড়া উনিশ শতকের গোড়ায় তুর্কি আক্রমণোত্তর বাংলার ওই সময়ের পটভূমিতে ব্রিটিশশাসিত ভারতে একাধারে অভিজাত উচ্চবর্ণ মানুষের অবহেলা, ঘৃণা, নিপীড়নে বাংলার বিশাল জনগোষ্ঠীর নাভিশ্বাস উঠেছে। তখন পরিত্রাণহীন নিরুপায় হয়ে খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রলোভন ও মোল্লা মৌলবিদের চাপে অন্ত্যজ সমাজের হিন্দুরা ব্যাপকহারে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছিল। বৈষ্ণব ধর্মেও অনুপ্রবেশ ঘটেছিল নানা "কুটিনাটি" ও অনাচার, ব্যভিচার। ফলে প্রকৃতপথ থেকে বিপথগামী হয়, তখন প্রকৃতপক্ষে এই লোকায়ত সম্প্রদায়গুলি ধ্বংসোম্মুখ হিন্দুদের রক্ষা করে। অবশ্য এই সম্প্রদায়গুলি প্রবর্তক কেন্দ্রিক হলেও উচ্চবর্ণের ঘৃণাহত হয়ে দুর্জয় প্রতিবাদী ও প্রতিরোধী চরিত্র নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে।
বাংলার দলিত জনজাতির মধ্যে অন্যতম প্রধান ধর্মসম্প্রদায় 'মতুয়া'। দক্ষিণ নিম্নবঙ্গের বৃহৎ দলিত নমশূদ্র জনগোষ্ঠীকে অবলম্বন করেই উনিশ শতকের প্রথমার্ধে মতুয়া ধর্মআন্দোলনের উদ্ভব ও বিকাশ।
ধর্ম সাধনার এই ধারাতেই বুদ্ধ, মহাবীর, নানক, চৈতন্য ও নানা ধারার সন্ত-সাধুকুলের আবির্ভাব ঘটেছে। ভক্তিবাদী ধর্মাদর্শের মধ্যেই উদার লোকায়ত ঐতিহ্যের মূল প্রেক্ষাপটে হরিচাঁদ-গুরুচাঁদের আদর্শে মতুয়া ধর্মআন্দোলনের সৃষ্টি ও বিকাশ - "মতুয়ার সার, বেদ বিধি পার"।
জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে প্রাজ্ঞ গুরুচাঁদ এই উপলব্ধিতে উপনীত হয়েছিলেন উচ্চবর্ণের মানুষগণ শিক্ষা-দীক্ষা ও আর্থিক দিক থেকে ছিল অগ্রসর এবং তারা নিম্নবর্ণের মানুষদের নানাভাবে হেয় ও উৎপীড়ন করত। তাই এ বিষয়ে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, দলিত সমাজের এই অপমান, ঘৃণা, পীড়নের পরিপ্রেক্ষিতে উনিশ শতকে হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের আবির্ভাব ও বাংলায় জনজাতির অবস্থান সঠিক অভিমুখী করার প্রয়োজনে দলিত সমাজের অন্যতম বৃহত্তর নমশূদ্র জাতির মধ্যে আবির্ভাব এক ঐতিহাসিক চাহিদার অনুসারী ঘটনা।
এইভাবে বাংলার সমগ্র দলিত জনজাতি বিশেষকরে নমশূদ্র সমাজ মতুয়াধর্মের অনুসারী হয়ে সমবেত হন। তার প্রভাব বাংলার গণ্ডি ছাড়িয়ে ভারতবর্ষব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এই মতুয়া ধর্মমত কেবল তথাকথিত ধর্মআন্দোলন নয় - গণজাগরণের আন্দোলন। এই আন্দোলন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সময়োচিত আন্দোলন।
এই মতুয়া ধর্মমত উচ্চবর্ণ প্রভাবিত ব্রাহ্মণ্যবাদ ও জমিদার-ভূস্বামীদের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে নিম্নবর্ণ মানুষজনের সমানাধিকার অর্জনের সংগ্রামী ইতিহাস। মতুয়া ধর্ম লোকায়ত ধর্মআন্দোলনের মধ্যদিয়ে প্রকৃত আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করেছে। স্মরণ করা যেতে পারে, বাংলার দলিত সমাজের স্বদেশি অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করার জন্য দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মাধ্যমে গান্ধীজি গুরুচাঁদ ঠাকুরের যে অনুরোধ পাঠান তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর যুক্তিতে উচ্চবর্ণের মানুষ নিম্নবর্ণের দলিত মানুষের বন্ধু হতে পারে কীনা - যেখানে অস্পৃশ্যতার বিষাক্ত বিষ সমগ্র জাতিকে সর্বদিক দিয়ে বিভক্ত করে রেখেছে -
"আর এক মহাদুঃখ ইহাদের মনে
উচ্চ হিন্দু ইহাদিগে অস্পৃশ্য মানে।"
দেশের স্বাধীনতা মানে কেবল উচ্চবর্ণের ধনবাদী মানুষের স্বাধীনতা নয়, সমগ্র জাতির স্বাধীনতা। অথচ নীলবিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, ঋণ সালিশি আন্দোলন, সমগ্র কৃষক সমাজের অধিকার রক্ষার আন্দোলনে নমশূদ্র সমাজের ছিল এক অতি গৌরবোজ্জল ভূমিকা।
মতুয়া ধর্মমতের মূলবাণী 'হাতে কাম, মুখে নাম'- এর মন্ত্র এক বস্তুনিষ্ঠ ভক্তিনির্ভর মুক্তির পথ দেখিয়েছিল। আর তাই স্বদেশি আন্দোলনে তাদের যুক্ত করতে হলে আগে তাদের ভাই বলে মেনে নিতে হবে -
"সম্পদে বিপদে সুখ সমভাবে বাঁটি।
ভাই বলে ভাই হয়ে দিতে হবে খাঁটি।।
এই কার্য আমি দেখি আগে প্রয়োজন।
নচেৎ হইবে ব্যর্থ সব আন্দোলন।।"
হরিচাঁদ পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর সামাজিক ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সুদৃঢ় হয়েছিলেন। সুখের কথা আর্ত মানবতার প্রতীক গুরুচাঁদ ঠাকুরের এই সঠিক নেতৃত্বে যথাযোগ্য মূল্যায়ন ও মর্যাদা প্রদান করেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ প্রমুখ।
নমশূদ্র সমাজের এই বলিষ্ঠ সংগ্রামের ঐতিহ্য ও শ্রেণি সচেতনতা দেশ বিভাগোত্তর বাস্তুহারা আন্দোলন, জাতীয়তাবাদী, সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পটভূমিতে আজও সতত সক্রিয়। একথা স্বীকার করতে হবে যে, মতুয়া আন্দোলনের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে সমানাধিকার ও সাম্যের আন্দোলনে সমগ্র দলিত জনজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস অনস্বীকার্য।
আমাদের বহু কাঙ্ক্ষিত স্বাধীন হলো দেশ। কিন্তু এক মর্মন্তুদ অবস্থার মধ্য দিয়ে। বাংলা দুখণ্ডে ভাগ হয়ে। পূর্বখণ্ড হলো পূর্ব পকিস্তান আর পশ্চিম খণ্ড ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। নমশূদ্র সমাজ প্রধানত পড়ল পূর্ব পাকিস্তানে। স্বাধীনতার প্রাক্কালেই নিজেদের অস্তিত্ব ও আত্মসম্মান রক্ষার তাগিদেই শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত প্রধানত উচ্চবর্ণের মানুষেরা, যাদের বিকল্প ও রসদ দুইই আছে, ওপার বাংলা থেকে এপার বাংলায় চলে আসেন এবং উদ্বাস্তু হিসাবে পুনর্বাসিত হন। কিন্তু মূলত কৃষিজীবী নমশূদ্র জনজাতির একটি অংশ চলে এলেও বেশিরভাগ অংশই থেকে গেলেন মাটির টানে, আর্থিক কারণে, বা নিরাপত্তার আশঙ্কায়। কিন্তু পঞ্চাশের ভয়ঙ্করী দাঙ্গা সব ওলট-পালট করে দিল। একই দেশের জনজাতির দুই ধর্মের মানুষের হিংসাশ্রয়ী দাঙ্গা প্রতিক্রিয়াশীলদের চক্রান্তে লাল করল বাংলার মাটি। ফলে লাখে-লাখে কাতারে-কাতারে ওপারের হিন্দু প্রধানত দরিদ্র, দলিত নমশূদ্র সম্প্রদায়ের সহায় সম্বলহীন মানুষ চলে আসতে বাধ্য হলেন এপার বাংলায় 'উদ্বাস্তু' হিসাবে।
বঙ্গ জনজাতি - অবহেলিত
তারপর এক নরক যন্ত্রণার মর্মান্তিক কাহিনি - যা এখানে আলোচনায় আনছি না। তবে এতটা হতো না যদি তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের বিমাতৃসুলভ আচরণ না হতো। স্বাধীনতার সময়ে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের জন্য পরোপুরি রক্ষা করলেও পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের কিছু তাৎক্ষণিক রিলিফ, ক্যাম্পে পাঠানো ও সেখান থেকে রাজ্যের অনুর্বর পতিত এলাকা, রাজ্যের বাইরে দণ্ডকারণ্য, আন্দামান, নৈনিতাল ইত্যাদি বাসের অযোগ্য স্থানকে বাসযোগ্য, অচাষযোগ্য জমিকে চাষযোগ্য করার দায় চাপিয়ে পুনর্বাসন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। তারপর রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার উদ্বাস্তু সমস্যার দায় দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলল।
তবু - 'মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারি নিয়ে ঘর করি'।
ভারতের যে রাজ্যে দেশ বিভাজনজনিত কারণে উদ্বাস্তুদের পুনার্বাসনের জন্য পাঠানো হয়েছিল তারা সেই রাজ্যের কৃষি ও অন্যান্য বিষয়ে উন্নয়নের স্বার্থে ভূমিকা পালন করেছেন। কাজ করেছেন দেশের উন্নয়নে মানবসম্পদ বিকাশে অন্যতম কারিগর হিসাবে। তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও বাংলার উদ্বাস্তুদের প্রতি যে বিমাতৃসুলভ ভূমিকা নিয়েছিল তার দায় থেকে তারা নিজেদের সরিয়ে নিল। বেশ চলছিল। ধীরে ধীরে আগত উদ্বাস্তুরা যে যেখানেই পুনর্বাসন পেয়েছেন সেখানেই কঠোর পরিশ্রমে অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে নিজেরাই নিজেদের বসত বানিয়ে স্থায়ী ঠিকানা করে নিলেন। এদেশ হলো তাদেরই দেশ।
২০০৩ সালের আইন আবার অশনিসংকেত হিসাবে দেখা দিল। আজ যারা কাঁদুনি গাইছেন তারা কেউই আইনসভায় প্রস্তাবিত বিলের বিরোধিতা করেননি (কেবলমাত্র দুই জন বিশিষ্ট সদস্য ব্যতিরেকে)। যেখানে 'ইললিগাল মাইগ্রান্ট' ('Illigal Migrant') বলে একটি কথা যুক্ত হলো। আইনটি হলো এনআরসি (ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস)। এই আইনে বলা হয় - বৈধ অনুমতি পত্র বা ভিসা নিয়ে যারা প্রবেশ করেননি তারা সকলেই অনুপ্রবেশকারী। তারা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার যোগ্য হবেন না। এমনকী তাদের সন্তানরা এদেশে জন্মালেও নাগরিকত্ব পাবে না। আইনানুসারে ১৯৪৮সালের ১৯ জুলাইয়ের পর আসা সকলেই এর আওতাভুক্ত। কেন্দ্রের বর্তমান বিজেপি সরকার ক্ষমতায় এসে ২০১৯ সালে পাশ করাল সি এ এ সংশোধিত আইন।
উদ্বাস্তুরা ভারত রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে ভূমিকা পালন করেছেন, করছেন। এদেশের ভোটার অর্থাৎ নাগরিক হয়েছেন। স্কুলে, কলেজে পড়াশোনা করে সার্টিফিকেট অর্জন করেছেন, কর্মরত অবস্থায় দেশের সেবা করছেন। লোকসভা, বিধানসভায় নির্বাচিত হয়েছেন কিংবা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। মানব সম্পদ বিকাশে অবদান রাখছেন। তাদের নাগরিত্বের পরীক্ষা দিতে হবে! কেন? উদ্বাস্তু কেন? কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্বাস্তু দপ্তরটাই তো তুলে দেওয়া হয়েছে। এতদিন পরে তারা 'পরবাসী'!
সংবিধানের মূল সুরকে নস্যাৎ করে ২০১৯ সালে ভারতের লোকসভায়ে বিল আনা হয় এবং যা ওই সালের ১২ ডিসেম্বর মহামান্য রাষ্ট্রপতি সাক্ষর করেন তার মূল বক্তব্য - "The Citizen Amendment Act,2019 seeks to provide Indian Citizenship to illegal refugees from six communities coming from Pakistan, Bangladesh, and Afganistan, these six communities include; Hindu, Buddhist, Sikh, Jain, and Parsi" - কিন্তু মুসলিম - নৈব নৈব চ।
সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িক মানসিকতায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর চাপানো এক আইন এবং এই আইনের দ্বারা দেশবিভাগের কারণে ওপার বাংলা থেকে পুনর্বাসিত জনসাধারণের একাংশকে বাংলাদেশি তকমা দিয়ে যদি রাষ্ট্র বহির্ভূত বলে চিহ্নিত করা দেশের সব রাজ্যের সবাইকে নতুন করে কাগজপত্র, দলিল দস্তাবেদ নিয়ে পরীক্ষা দিতে হবে - তারা এদেশের প্রকৃত নাগরিক কীনা, না হলে পরবাসী।
ধর্মীয় বিভেদ, জাতপাতের বিভেদকে পরাস্ত করে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা, সার্বভৌমত্ব, সৌভ্রাতৃত্ব, সম্প্রীতি বিবিধের মধ্যে মিলনের সুরকে রক্ষা করার সংগ্রামে বাংলাকেই সারা দেশের নেতৃত্ব দিতে হবে। সন্দেহ নেই, মাঝে মাঝেই বিচ্যুতি ঘটেছে, নীতিগত ভুলও হয়েছে। তবুও একথা দৃঢ়তার সাথে বলা যায় যারা মেরুকরণের রাজনীতি, ঘৃণা ছড়ানোর সংকীর্ণ কারবারি, বাংলা বলতে যা বোঝায় সেখানে ঘাঁটি গাড়তে চায়, তারা কোনো অবস্থায় তা পারবে না। ভারতের সাংস্কৃতিক ও বিজ্ঞানকেন্দ্রিক ভাবনার জগতে বাংলা চিরকাল প্রথম সারিতে থেকেছে।সম্প্রতি মাননীয় গোপাল কৃষ্ণ গান্ধী এক সংবাদপত্রে একটি নিবন্ধে ভারতের পাঠকদের মনে করিয়ে দিয়েছেন ভারতের প্রগতিবাদী ভাবনায় স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সুভাষ চন্দ্র বসুর অবদান কতখানি। ইতিহাস যে বাংলাকে ভারতের চিন্তা ও অনুভবের জগতে শিরোমণি করেছে তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সাম্প্রদায়িকতা, জাতপাতের রাজনীতি, মুসলমান ও খ্রিস্টানদের মতো সংখ্যালঘুদের প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ, যে আচরণ সারা দেশ জুড়ে ঘটছে, পশ্চিমবঙ্গেও কিছু কিছু ঘটতে আরম্ভ করেছে যা খুবই উদ্বেগের ও বেদনার। কিন্তু মোটামুটি বাংলার গতিশীল ঐতিহ্য বজায় থেকেছে।
উগ্র হিন্দুত্ববাদী সুড়সুড়ি দিয়ে ধর্মীয় প্রভুত্ব স্থাপন করা, শিক্ষা - সংস্কৃতিসহ সর্বত্র উগ্র ধর্মীয় মতবাদের প্রভুত্ব - কিন্তু বাংলার মূলসুর যে অন্য তারে বাঁধা।
সেটাই হোক আগামী দিনে সারা দেশের পাথেয় - এদেশে আমরা যারা বাস করি এদেশ তাদের সবার - "কেউ নয় পরবাসী"।