E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬১ বর্ষ ১২ সংখ্যা / ৩ নভেম্বর, ২০২৩ / ১৬ কার্তিক, ১৪৩০

নভেম্বর বিপ্লব আজও আলোকবর্তিকা

অভয় মুখোপাধ্যায়


সারা দুনিয়ার যে প্রবহমান ধারা তার মধ্যে নভেম্বর বিপ্লব একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

১৯১৭ সালে ৭ থেকে ১৭ নভেম্বর সেই দুনিয়া কাঁপানো দশদিনে সোভিয়েত রাশিয়ায় পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে। দুনিয়া দেখেছিল মানব মুক্তির সংগ্রাম কীভাবে বিজয়ী হতে পারে। সোভিয়েতের লোকেরা এই মহান বিপ্লবকে অক্টোবর বিপ্লব বলে থাকে। কারণ পুরোনো ক্যালেন্ডার হিসেবে এই বিপ্লব আরম্ভ হয়েছিল অক্টোবর মাসের ২৫ তারিখ। আবার নতুন ক্যালেন্ডারের হিসেবে এই বিপ্লব আরম্ভ হয়েছিল নভেম্বর মাসের ৭ তারিখে। সেই কারণে আমরা এবং অনেকেই একে নভেম্বর বিপ্লব বলে থাকি।

এই বছর পৃথিবী জুড়ে নভেম্বর বিপ্লবের ১০৬ তম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে। আমরা সকলেই জানি নানা কারণে সোভিয়েতের সমাজতন্ত্রের পতন ঘটেছে। সোভিয়েতের পতনে উল্লসিত হয়েছে গোটা দুনিয়ার পুঁজিবাদী শিবির। শোষণহীন সমাজের পতনে শোষকদের উল্লাস স্বাভাবিক। কিন্তু সোভিয়েতের সমাজতন্ত্রের সমস্ত ক্ষেত্রে সাফল্য, অগ্ৰগতি, মাথা উঁচু করে বাঁচা ও লড়াই সংগ্ৰামের যে আলো দেখিয়ে গেছে তা আজও সমস্ত শোষিত বঞ্চিত মানুষের কাছে শ্রেষ্ঠ প্রেরণা। তাই আজও নভেম্বর বিপ্লব ও তার শিক্ষা আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক শুধু নয়, আগামীর পথ চলার দিশারি।

আমি এই লেখায় খুব অল্প পরিসরে নভেম্বর বিপ্লবের অসামান্য সাফল্যগুলিকে তুলে ধরার চেষ্টা করব। কারণ এই ছোট্ট পরিসরে নভেম্বর বিপ্লবের বিশাল সাফল্যকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।

আমরা সকলেই জানি কমিউনিস্ট মতাদর্শকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ১৮৬৪ সালে প্রথম ইন্টারন্যাশনাল ও ১৮৮৯ সালে দ্বিতীয় ইন্টারন্যাশনাল অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নভেম্বর বিপ্লবের সাফল্যের পরে ১৯১৯ সালে কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হলো তৃতীয় ইন্টারন্যাশনাল। তাতে সারা পৃথিবীর দেশে দেশে কমিউনিস্ট পার্টি ও তার সংগঠন গড়ে তোলার ব্যাপারে ব্যাপক চর্চা শুরু হলো। তারপর ১৯২০ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে ইয়োরোপের বাইরেও সব মহাদেশে কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি হলো। যেমন ১৯২০ সালে তাসখন্দে গঠিত হলো ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, ১৯২১ সালে চায়না ও ইন্দোনেশিয়াতে এবং ১৯২৫ সালে কিউবা, মেক্সিকোতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হলো। এক কথায় নভেম্বর বিপ্লবের আলো ছড়িয়ে পড়লো বিশ্বের নানা দেশে, নানা প্রান্তে।

আক্ষরিক অর্থে গণতন্ত্রকে বিকশিত করা হয়েছিল এই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে। গণতন্ত্র ছিল নিচের তলা পর্যন্ত প্রসারিত। শ্রেণি বৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিভাজন ঘটানোর একটাই রাস্তা তা হলো বিপ্লব। সোভিয়েত বিপ্লব সেই শিক্ষা আমাদেরকে দিয়ে গেছে। কৃষকের অধিকার, ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার শুধু নয়, সমাজগড়ার কাজে কৃষক শ্রমিকদের প্রধান ভূমিকা আর প্রকৃত অর্থে নারীর স্বাধীনতা ও সমানাধিকার - এই শিক্ষাও দিয়েছে নভেম্বর বিপ্লব।

বিপ্লবের পরে কেমন পরিবর্তন হলো সোভিয়েতের এখানে তার কোনো ব্যাখার প্রয়োজন নেই। যিনি আমাদের জীবনে মননে সবসময় আছেন সেই রবীন্দ্রনাথ ১৯৩০ সালে সোভিয়েত ভ্রমণে গিয়েছিলেন তাদের আমন্ত্রণে। পরে ফিরে এসে তাঁর ‘রাশিয়ার চিঠি' গ্ৰন্থে তিনি লিখলেন - ‘‘...আপাতত রাশিয়ায় এসেছি - না এলে এ জন্মের তীর্থ দর্শন অত্যন্ত অসমাপ্ত থাকত।’’ সমাজতন্ত্রের বিপুল কর্মকাণ্ড দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। সারা দেশের মানুষ নেমে পড়েছে দেশ গড়তে। বিপ্লবের পরে অভাবনীয় উন্নতি হলো শিক্ষাক্ষেত্রে। বিপ্লবের আগে জার শাসনে দেশের ৭৯ ভাগ মানুষ লেখাপড়া জানতো না‌। ১৮৯৭ সালে সেনসাস রিপোর্ট অনুযায়ী জনসংখ্যার মাত্র ২১ শতাংশ লেখাপড়া জানতো। বিপ্লবের পরে কমরেড লেনিন শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি মনে করতেন শিক্ষা ছাড়া কোনো দেশ এগিয়ে যেতে পারেনা। সোভিয়েত বিপ্লবের অন্যতম সাফল্য ছিল সর্বজনীন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করা। এই প্রসঙ্গেও কবিগুরু রাশিয়া থেকে ফিরে এসে লিখলেন - ‘‘এখানে এসে দেখলুম, এরা শিক্ষাটাকে প্রাণবান করে তুলেছে। তার কারণ এরা সংসারের সীমা থেকে ইস্কুলের সীমাকে সরিয়ে রাখেনি। এরা পাস করাবার কিম্বা পণ্ডিত করবার জন্যে শেখায় না - সর্বতোভাবে মানুষ করার জন্যে শেখায়।’’ যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্যাসিবাদী আক্রমণে সোভিয়েতের বিরাশি হাজার স্কুল, তিনশো চৌত্রিশটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এগারশোর মতো গ্ৰন্থাগার ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। তারপরেও ১৯৭০ সালে সেনসাস রিপোর্ট অনুযায়ী সোভিয়েতে পুরুষদের সাক্ষরতার হার ছিল ৯৯.৮ শতাংশ ও মহিলাদের ৯৯.৭ শতাংশ। যা তৎকালীন পৃথিবীতে ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ।

শুধু সাধারণ শিক্ষাই নয়। বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, পরিবেশ শিক্ষা, শিল্পকলা, শারীরশিক্ষা, গবেষণা, মহাকাশ বিজ্ঞান এইসব নানা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছিল নভেম্বর বিপ্লব-পরবর্তী সোভিয়েত। সেইসময় সারা বিশ্বের চারভাগের একভাগ ডাক্তার ছিল সোভিয়েতের। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সর্বজনীন করে তোলা হয়েছিল। সারা বিশ্বের তিনভাগের একভাগ গবেষণাবিদ ছিল সোভিয়েতের। সেইসময় মস্কো থিয়েটারে প্রতিদিন যে নাটকগুলি পরিবেশিত হতো গুণমানে তা ছিল শ্রেষ্ঠ।

নভেম্বর বিপ্লবের সাফল্য মানে সব অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলা। সবাইকে দ্বিতীয় করে নিজে প্রথম হওয়া। যেখানে সারা দুনিয়া বেকারত্ব ও ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করছে সেখানে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছিল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত। ১৯১৭ সালে সমাজতন্ত্র, ১৯৩৬ সালে সোভিয়েত তাদের এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে তালা লাগিয়ে দিল। কমরেড স্তালিন ঘোষণা করলেন - ‘‘আমাদের দেশে একজনও বেকার নেই’’। ১৯১৭ সালে সমাজতন্ত্র, ৬০দশকে প্রথম যে মানুষ মহাকাশে গেলেন ইউরি গ্যাগারিন তিনি ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের। আবার ১৯৬১ সালে প্রথম মহিলা মহাকাশচারীও সোভিয়েতের ভ্যালেনটিনা তেরেস্কোভা। ১৯১৭ সালে সমাজতন্ত্র, ১৯৫৪ সালে অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে সব দেশকে পেছনে ফেলে সর্বাধিক পদক জিতলো যে দেশটা তার নামও সোভিয়েত ইউনিয়ন। এটাই শোষণযুক্ত সমাজের সাথে শোষণমুক্ত সমাজের পার্থক্য। বাংলার বিখ্যাত কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একবার রাশিয়ায় গিয়েছিলেন। সেখানের অভিজ্ঞতায় তিনি লিখেছিলেন - ‘‘আমি যখন মস্কোতে পাতাল রেলে ভ্রমণ করছি, শুনছি সব স্টেশনে রাশিয়ান ভাষায় একটি ঘোষণা হচ্ছে। আমি তো রাশিয়ান ভাষা জানিনা, তাই আমার দোভাষীকে জিজ্ঞেস করলাম স্টেশনগুলিতে কী ঘোষণা হচ্ছে। তার উত্তরে আমার দোভাষী যা বললেন তাতে আমি বিস্মিত হলাম। দোভাষী বললেন, ঘোষণা হচ্ছে আমাদের পাতাল রেলে কিছু শূন্যপদ খালি আছে, যদি কোনো যাত্রী কাজ করতে ইচ্ছুক থাকেন তাহলে স্টেশন ম্যানেজারের সাথে যোগাযোগ করুন’’। এই বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছিল সোভিয়েত।

তবে সমস্ত সাফল্যের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের শ্রেষ্ঠ সাফল্য ছিল ভয়ঙ্কর ফ্যাসিবাদের হাত থেকে সারা পৃথিবীকে রক্ষা করা। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত না থাকলে এই পৃথিবী বাঁচতো না। সোভিয়েত ইউনিয়নকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের পরাজয় ঘটানো কোনোভাবে সম্ভব ছিল না। সোভিয়েতের প্রায় পৌনে দু’কোটি মানুষের প্রাণের বিনিময়ে এই জয় অর্জিত হয়েছিলো। যা শত চেষ্টা করেও ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়।

এই মহাযুদ্ধে সোভিয়েতের জয়লাভ বিশ্ব জুড়ে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে জোয়ার এনেছিল। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা যারা সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ শাসনাধীন ঔপনিবেশিক দেশ, সেখানে স্বাধীনতার লড়াইয়ে গতি পেল। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হলো আমাদের দেশ। ১৯৪৬ সালে ভিয়েতনামে অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠিত হলো কমরেড হো চি মিন-এর নেতৃত্বে। একইভাবে ১৯৪৯ সালে চীনে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতা অর্জন করলো। কিউবাতে মহান বিপ্লব সংগঠিত হলো, মুক্ত হলো উত্তর কোরিয়া। নভেম্বর বিপ্লব ও তার পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয় - সমাজতন্ত্রের অগ্ৰগতি ও তার আলো ছড়িয়ে পড়লো পৃথিবীর দেশে দেশে।

তাই আজও ১০৬ বছর পরেও নভেম্বর বিপ্লবের সাফল্য অমলিন‌। আমাদের দেশে এবং সারা বিশ্বে আজও নভেম্বর বিপ্লব শোষিত মানুষের লড়াইয়ের প্রেরণা। আমাদের দেশের দিকে তাকান। স্বাধীনতার ৭৬ বছর অতিক্রান্ত। বর্তমান সময়ে দেশে বেকারত্বের হার গত ৭৬ বছরে সর্বোচ্চ। চারিদিকে কাজের হাহাকার। শিক্ষাব্যবস্থাকে বেসরকারিকরণ ও সাম্প্রদায়িকীকরণ করার চেষ্টা চলছে। যেখানে এখনও আমাদের দেশে মোট জিডিপি’র মাত্র ৬ শতাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করার দাবিতে আন্দোলন করতে হচ্ছে, সেখানে সোভিয়েতে ১৯৭০ সালে মোট জিডিপি’র ১২ শতাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করা হতো। আমাদের দেশে কৃষকদের উপর আক্রমণের ঘটনা বাড়ছে‌। শ্রমিকদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। নারীদের সমানাধিকার তো দূরের কথা মনুবাদের কথা বলে নারীদের ঘরে বন্দি করে রাখার ফন্দি আঁটছে আমাদের দেশের সরকার। গণতন্ত্রকে প্রসারিত করার বদলে গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরা হচ্ছে। প্রতিদিন খর্ব হচ্ছে গণতান্ত্রিক অধিকার। বাড়ছে ক্ষুধা, অসাম্য। ধর্মনিরপেক্ষতার মহান ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে দেশজুড়ে আজ ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি। একটা ভয়ের পরিবেশ কায়েম করার চেষ্টা চলছে সর্বত্র।

আর এখানেই নভেম্বর বিপ্লবের প্রাসঙ্গিকতা। নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষা হলো - পুঁজিবাদের গর্ভে ফ্যাসিবাদের জন্ম আর সমাজতন্ত্রের হাতেই তার মৃত্যু। ইতিহাসের এই চিরন্তন সত্যকে মুছে ফেলা যায় না। নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষা হলো সবার জন্য কাজ, শিক্ষা, খাবার, চিকিৎসা ও বাসস্থান। নভেম্বর বিপ্লব মানে প্রসারিত গণতন্ত্র, নারীমুক্তি, শ্রেণিহীন শোষণহীন সমাজ। নভেম্বর বিপ্লব মানে সবার হাসিমুখে বেঁচে থাকা।

তাই যতদিন এই বিশ্বে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বৈষম্য, অশিক্ষা, বেকারত্ব থাকবে ততদিন বেঁচে থাকবে নভেম্বর বিপ্লব। নভেম্বর বিপ্লব আমাদের কাছে আলোকবর্তিকা। সোভিয়েত আজ নেই, কিন্তু নভেম্বর বিপ্লব তো আছে। আছে তার শিক্ষা। সেই শিক্ষাকে পাথেয় করে আসুন আমরাও লড়াই চালিয়ে যাই একটা স্বপ্নের দেশ গড়ার জন্য।