E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৪ সংখ্যা / ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ / ১৭ ভাদ্র, ১৪২৮

মালদহে নদী ভাঙন মানুষের জীবনে গভীর সঙ্কট ডেকে আনছে

উৎপল মজুমদার


মালদহের হীরানন্দপুরের গদাইচরের ভাঙন এলাকায় বাম এবং আইএসএফ’র প্রতিনিধি দল।

নদী ভাঙন ও বন্যা পরিস্থিতির ফলে মালদহ জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই মালদহ জেলার মানুষ বন্যা ও ভাঙনের ফলে বিপন্ন হচ্ছেন। জেলার মানিকচক, বৈষ্ণবনগর, রতুয়া, মোথাবাড়ির বিভিন্ন এলাকা গত কয়েকবছর ধরে বারবার ভাঙনের মুখে পড়েছে। গঙ্গার ভাঙন গ্রাস করে নিয়েছে জমিজিরেত, ঘরবাড়ি, জীবিকা, সংসার সব কিছু। গত পাঁচ বছরে বিধ্বংসী ভাঙনের ফলে মালদহ জেলার বারোটি মৌজা সম্পূর্ণরূপে মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। এবারে প্রায় সাড়ে চার হাজার মানুষ তাঁদের আশ্রয়, সহায় সম্বল সব কিছু হারিয়েছেন। মানুষের এই ভয়াবহ বিপন্নতা সত্ত্বেও রাজ্যের তৃণমূল সরকারের কোনো হেলদোল নেই। গত ২৯ আগস্ট জেলার ভাঙন এলাকার পরিস্থিতি সরেজমিনে খতিয়ে দেখার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট এলাকার দুর্গত মানুষদের সঙ্গে কথা বলেন সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম, রাজ্যসভায় সিপিআই(এম) সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য, সংযুক্ত মোর্চার বিধায়ক নৌসাদ সিদ্দিকী, জেলা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক অম্বর মিত্র সহ সিপিআই(এম) এবং বামফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ।

মালদহ জেলা উত্তরবঙ্গের তথা উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যতম প্রবেশ পথ। মালদহের দক্ষিণে মুর্শিদাবাদ জেলা। মালদহ জেলা তথা উত্তরবঙ্গে আসতে গেলে আসতে হয় ফরাক্কা সেতু দিয়ে, যা গঙ্গা নদীর উপর তৈরি হয়েছে। এই সেতু নির্মাণের আগে মালদহ তথা উত্তরবঙ্গে আসতে হলে ট্রেনে করে এসে লঞ্চে নদী পার হয়ে মালদহে এসে ট্রেনে বা বাসে করে আসতে হতো। আবার কখনো ট্রেনে করে এসে মানিকচক ঘাটে নৌকা বা লঞ্চে পার হয়ে মালদহে আসতে হতো। দেশ ভাগ হওয়ার আগে অধুনা বাংলাদেশের উপর দিয়ে আসত ও তা মালদহ কোর্ট স্টেশনে আসত। ওই সময় ওই পথ দিয়ে প্রচুর বিদগ্ধ রাজনৈতিক নেতা মালদহে এসেছেন। তবে গঙ্গাকে কেন্দ্র করে ফরাক্কা ব্যারেজ প্রোজেক্ট ও ফরাক্কা সেতু নির্মাণ যাতায়াত সহ অনেক সুবিধা করে দিলেও সমস্যা তৈরি করেছে অনেক। কেননা ব্যারেজ ও সেতু ফরাক্কায় নির্মাণের বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের আপত্তি অগ্রাহ্য করেই তৎকালীন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার ফরাক্কায় এই প্রকল্প রূপায়ণের সিদ্ধান্ত নেয়। এটি ষাটের দশকের ঘটনা। সত্তরের গোড়াতেই এই প্রকল্প দু’টি চালু হয়ে যায়। মালদহ জেলার বিরাট অংশ নদীবেষ্টিত। মূল নদী গঙ্গা, জাতীয় নদী। এই নদী বিহারের রাজমহল দিয়ে মালদহের মানিকচক হয়ে রাজ্যে ঢুকেছে। এবং তা মালদহের মানিকচক, ইংরেজবাজার, কালিয়াচক-২, কালিয়াচক-৩ ব্লকের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মুর্শিদাবাদের জলঙ্গী দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে, যা ওই দেশে পদ্মা হিসাবে পরিচিত। এছাড়াও মালদহের আরও কিছু নদী রয়েছে মহানন্দা, ফুলহর, কোশী, টাঙ্গন ইত্যাদি। তবে গঙ্গা, ফুলহর, মহানন্দা, কোশী নদীর প্রতি বছরের ভাঙ্গন ও বন্যা মালদহের জনজীবনে চরম সঙ্কট ডেকে আনে।

একইভাবে রয়েছে কালিন্দ্রী নদী। এই সব নদীর ভাঙনের ফলে হরিশ্চন্দ্রপুরের ভাকুরিয়া থেকে রতুয়া-১ ব্লকের মহানন্দটোলা, বিলাইমারি চর এলাকা সহ অন্যান্য এলাকা, মানিকচক ব্লকের গঙ্গা ও ফুলহরের চর এলাকা গদাই, ভুতনীচর, উত্তর ও দক্ষিণ চণ্ডীপুর ও হিরানন্দপুর অঞ্চল ছাড়াও চৌকি-মিরদাদপুর,গোপালপুর অঞ্চল, ইংরেজবাজার ব্লকের একাংশ, কালিয়াচক-২ ও কালিয়াচক-৩ ব্লকের গঙ্গা তীরবর্তী বিরাট এলাকা প্রতি বছর গঙ্গাগর্ভে চলে যায়। যার ফলে প্রতি বছর নদীগর্ভে তলিয়ে যায় জমি-বাড়ি, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সবকিছু। সর্বস্বান্ত হন হাজার হাজার মানুষ।

ভাঙন শুধু ফরাক্কা ব্যারেজের জন্যই হচ্ছে তা নয়। ১৯২২-৩৭ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত ম্যাপ থেকে দেখা যায় রাজমহল থেকে ফরাক্কা পর্যন্ত গঙ্গার গতিপথ মোটামুটি সোজা ছিল। কিন্তু ১৯৪৮ থেকে ১৯৫০ সালে নজরে আসে রাজমহল থেকে গঙ্গা ক্রমশ মালদহের দিকে সরে আসছে। ১৯৭০ থেকে ১৯৭২ সালে দেখা যায় ফরাক্কা ব্যারেজের উজানে বামদিকে দ্রুত ভূমিক্ষয় হচ্ছে। আগে ভূমিক্ষয়ের কোনো সুসংবদ্ধ রেকর্ড না থাকলেও ভাঙন নিয়ে গঠিত কেশকার কমিটির রিপোর্টে বলা হয় ১৯৩১-১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ভূমিক্ষয়ের পরিমাণ ১৪৩৩৫ হেক্টর। তারপর ভাঙন ক্রমশ বেড়েছে। এ বছরও কালিয়াচক-৩ ব্লক ও মানিকচক ব্লকে ভাঙন হয়েছে। এখনও চলছে। প্রতিবছর বর্ষাকাল এলেই এইসব নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। কেননা তারা নিজেরা দেখেছেন কীভাবে অতীতে তাদের বাড়িঘর, জমিজায়গা নদীতে বিলীন হয়েছে। এইসব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য বামফ্রন্ট সরকার সবসময় পাশে থেকেছে, ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন সহ সবরকম সাহায্যের উদ্যোগ নিয়েছে এবং কেন্দ্রের কাছে উপযুক্ত সাহায্যের দাবি জানিয়েছে। ১৯৯৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর আমন্ত্রণে মালদহে এসেছিলেন তৎকলীন কেন্দ্রের যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৌড়া। এর আগে বা পরে কোনো প্রধানমন্ত্রী এভাবে মালদহে আসেন নি। তিনি ভাঙন ও বন্যা কবলিত এলাকা সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করার পাশাপাশি বামফ্রন্ট সহ সমস্ত রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলেন ও তাঁদের দেওয়া দাবি সনদ গ্রহণ করেন। বন্যা দুর্গতদের জন্য সহায়তার ব্যবস্থা করেন। শুধু তাই নয়, ভাঙনরোধে পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য প্রীতম সিং কমিটি গঠন করেন। এই কমিটি মালদহে এসে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে ও মানুষের সাথে কথা বলে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করে। যদিও দেবেগৌড়া সরকার স্থায়ী না হওয়ায় এইসব সুপারিশ খুব বেশি কার্যকর হয়নি। ফলে ভাঙন ও বন্যা আজও অব্যাহত।

এবছরও ভাঙন শুরু হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় বন্যাও হয়েছে। কালিয়াচক-৩ ব্লকের বীরনগর-১ অঞ্চলের গঙ্গা তীরবর্তী বিভিন্ন গ্রাম ভাঙনের কবলে পড়েছে। শত শত বিঘা জমি গঙ্গাগর্ভে। শত শত বাড়িও জলে তলিয়ে গেছে। মানুষ গৃহহীন। সহায় সম্বলহীন। একই ভাবে মানিকচক ব্লকের ভুতনিচরের হিরানন্দপুর অঞ্চলের কেশরপুর গ্রামে ভাঙনে মূল বাঁধ ভেঙে গেছে। তবে রিং বাঁধ থাকার কারণে জল বসতি এলাকায় ঢোকে নি। গোপালপুর অঞ্চলেও বাঁধ ভাঙছে। এছাড়াও রতুয়া-১, মহানন্দাটোলা ও বিলাইমারি জলমগ্ন হয়েছে। হরিশ্চন্দ্রপুর-২ ব্লকের ভাকুরিয়াও জলমগ্ন হয়েছে। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পাশে সবসময় দাঁড়িয়েছে বামফ্রন্ট। বামফ্রন্টের প্রতিনিধিরা ভাঙন কবলিত এলাকা ঘুরে যেমন দেখেছেন, তেমনি ব্লক ও জেলা প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে ভাঙনরোধে স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি ক্ষতিপূরণের দাবিও জানিয়েছে। তবে সবচেয়ে বড়ো আশঙ্কা মানিকচক ব্লকের হিরানন্দপুরে গঙ্গা ও ফুলহরের মধ্যে যে দূরত্ব ছিল তা ভাঙতে ভাঙতে কাছাকাছি চলে আসছে। এখন দূরত্ব মাত্র ১২০০মিটার। জেলায় ভাঙনের যে চরিত্র তাতে এই দূরত্ব এমন কোনো ব্যাপার নয়। যদি এই দূরত্ব মুছে যায় তবে শুধু জেলা বা ব্লক নয়, রাজ্যেও বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। কেননা নদী দু’টি মিশে গেলে নদী কোন্‌ দিক দিয়ে প্রবাহিত হবে তা এখনই বলা কারোর পক্ষেই সম্ভব নয়। গত ২৯ আগস্ট জেলার এই সমস্ত ভাঙন ও বন্যা কবলিত এলাকা দেখতে গিয়েছিলেন মহম্মদ সেলিম, বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য, নওসাদ সিদ্দিকী সহ জেলা বামফ্রন্ট নেতৃত্ব। তাঁরা ভাঙন ও বন্যা কবলিত এলাকায় গিয়ে সবহারা মানুষদের সাথে কথা বলেন ও পাশে থাকার আশ্বাস দেন।

বিকাশ ভট্টাচার্য ভাঙ‍‌নের সমস্যা রাজ্যসভায় তুলে ধরার কথা উল্লেখ করে বলেন, ভাঙন প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় সাহায্যের দাবিতে যৌথ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মহম্মদ সেলিম বলেছেন, ভাঙন রোধে একমাত্র পথ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন।