E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৪ সংখ্যা / ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ / ১৭ ভাদ্র, ১৪২৮

গৌরী ঘোষঃ নম্র, কিন্তু দৃঢ়চেতা

রজত বন্দ্যোপাধ্যায়


গত শতকের ছয়ের দশক থেকে অসংখ্য মঞ্চে, বেতারের তরঙ্গে যিনি আমাদের মুগ্ধ করেছেন তাঁর পরিশীলিত কণ্ঠে - ঋজু, স্নিগ্ধ উচ্চারণে - ২০২১-এর ২৬ আগস্ট তিনি চলে গেলেন। চলে গেলেন গৌরী ঘোষ-পার্থ ঘোষ জুটির এক স্তম্ভ। গৌরী ঘোষের জীবনাবসান হলো। থেকে গেল কবিতা ও গদ্যের ব্যঞ্জনাময় প্রকাশের একটি ধারা।

বারোই মার্চ, উনিশশো নব্বই তাঁকে ঘিরে কলকাতার রবীন্দ্রসদনে যে ‘বৃতিসন্ধ্যা’-র আয়োজন করা হয়েছিল, সেখানে প্রকাশিত স্মারক গ্রন্থের তথ্য অনুযায়ী গৌরী ঘোষের জন্ম অবিভক্ত বাংলার দিনাজপুর জেলার মন্মথপুরে। এ বিষয়ে মতান্তরও আছে। অনেকের মতে, তাঁর জন্ম কাটিহারে। যাই হোক, মুরলীধর গার্লস স্কুল, উইমেন্স কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে জীবিকা হিসেবে তিনি বেছে নিলেন আকাশবাণীর বাংলা ঘোষিকার কাজ। গৌরী ঘোষ ছড়িয়ে পড়লেন বাংলা ও বাঙালির ঘরে ঘরে। ‘‘তাঁর আবেগ নিয়ন্ত্রিত কণ্ঠস্বর, তাঁর যতি বিভাজনের বিচক্ষণতা এবং মার্জিত উচ্চারণে’’ ঋদ্ধ হলো আবৃত্তি শিল্প। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এইভাবেই ভেবেছিলেন। গৌরী ঘোষ-পার্থ ঘোষের ‘কর্ণকুন্তি সংবাদ’ বা ‘বিদায় অভিশাপ’ আমরা কি কখনো ভুলতে পারি! রবীন্দ্রসদনের প্রযোজনায় বিভিন্ন আবৃত্তি শিল্পীদের নিয়ে ক্ষীরোদ প্রসাদের ‘নর-নারায়ণ’ পাঠাভিনয়ে দ্রৌপদীর ভূমিকায় তাঁর অভিনয় আজও ভুলিনি। কী অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে তিনি চরিত্রটিকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন ভাবলে এখনো বিস্ময় জাগে।

গৌরী ঘোষ-পার্থ ঘোষ জুটি যেমন অনেক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত আমাদের উপহার দিয়েছেন, একক আবৃত্তিতেও তাঁরা আমাদের মন জয় করে নিয়েছেন। গৌরী-কণ্ঠে রবীন্দ্রকবিতার আবৃত্তি এক ভিন্ন মাত্রায় উত্তীর্ণ হতো। কীভাবে কোনো শব্দের উপর জোর দিয়ে শ্রোতার কাছে তাঁর কথা পৌঁছে দিতেন গৌরী - তা ভাবা যায় না। শুধু রবীন্দ্রনাথ না, তাঁর গলায় সমস্ত কবির কবিতাই সজীব হয়ে উঠত। বোধহয় সে জন্যই পবিত্র মুখোপাধ্যায় তাঁকে নিয়ে লেখা কবিতার নাম দিয়েছিলেন - ‘তোমার ছোঁয়ায় শব্দও খোলে পাপড়ি’।

এই প্রসঙ্গে একটি কথা বলতেই হয়। শম্ভু মিত্র-তৃপ্তি মিত্র-র দ্বৈতকণ্ঠে আবৃত্তি ধারার পাশে দাঁড়িয়ে গৌরী ঘোষ-পার্থ ঘোষ নিজস্ব একটা শৈলী গড়ে তুলেছিলেন। একথা বললেও অত্যুক্তি হয় না যে, গৌরী ঘোষ মেয়েদের মধ্যে আবৃত্তির প্রসারে এক বিশাল ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর আবৃত্তি ও পাঠ শুনে দূর দূরান্তরের মেয়েরা এই শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। মোবাইলের চল ছিল না, তা-ও।

একটি কথা এখানে বলা প্রয়োজন বলে মনে করি। ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘অসুখ’, অপর্ণা সেনের ‘পরমা’ এবং নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের ‘আত্মজা’ ছবিতে তিনি অভিনয়ও করেছেন।

গৌরী ঘোষ কখনো কাউকে আঘাত দিয়ে কথা বলতেন না, কিন্তু প্রযোজনার ক্ষেত্রে মানের সঙ্গে আপস করতেন না। ২০১৩-র ২৫ জানুয়ারি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর নিজস্ব সংস্থা ‘উপমা’ মেঘনাদ বধ কাব্য পাঠের আয়োজন করেছিল মধুসূদন মঞ্চে। নিয়ন্ত্রণে বিজয়লক্ষ্মী বর্মণের সঙ্গে আমিও ছিলাম। কোথায় কীরকম উচ্চারণ করতে হবে - কুশীলবদের নির্দেশ দিচ্ছি, গৌরী ঘোষ পাশে বসে শুনছেন। হঠাৎ একটি জায়গায় আমাকে থামতে বলে কানে কানে বললেন, এটা এরকমভাবে বললে কেমন হয়! আরও ভালো করার তাগিদ থেকেই তাঁর এই পরামর্শ। কিন্তু কাউকে সেটা বুঝতেই দিলেন না। এই হচ্ছেন গৌরী ঘোষ।

আটপৌরে বাঙালির মতো আজীবন যাপন করা এই শিল্পী নিজের বিশ্বাসে অটল থাকতেন। ২০১১-তে পশ্চিমবঙ্গে নতুন সরকার আসার পরপরই একদিন দেখি উনি রবীন্দ্রসদন চত্বরে কাউকে খুঁজছেন। জিজ্ঞেস করাতে বললেন, আমি কর্মসমিতি থেকে পদত্যাগ করার চিঠি দেব, আধিকারিককে খুঁজছি। পাশ থেকে কেউ বললেন, আপনি পদত্যগ করবেন কেন? আগের সরকারের সময় আমি মনোনীত হয়েছি, তাই নৈতিকভাবে আমার পদত্যাগ করা উচিত। নম্র, কিন্তু দৃঢ় উচ্চারণ। এ-এক অন্য গৌরী।

পঁচিশে বৈশাখ ভোরবেলায় রবীন্দ্রসদনের প্রভাতী অনুষ্ঠান নতুন সরকার বন্ধ করে দিল। প্রতিবাদে ওইদিন সকালে সদনের পাশের রাস্তায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। গৌরী ঘোষ লরির উপর উঠতে গিয়ে হোঁচট খেলেন, কিন্তু থামলেন না। কবিতা বললেন প্রতিবাদী উচ্চারণে। রামনবমী নিয়ে সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে - মিছিল বেরোবে। অন্যতম আহ্বায়ক হতে এক কথায় রাজি। যখনই কোনো প্রতিবাদী অনুষ্ঠানে তাঁর নাম রাখব কিনা জানতে চাইতাম - বলতেন, জিজ্ঞেস করার কী আছে - দিয়ে দিবি সবসময়, পরে জানাস। রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী ভূমিকার বিরুদ্ধে যখনই কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে, তাঁর নিঃশর্ত সমর্থন আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।

তাঁর মরদেহ আকাদেমি অফ ফাইন আর্টস চত্বরে রাখা হয়েছিল, সাধারণ মানুষ সেখানেই তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। ভেবেছিলাম, যাঁর প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ - তাঁর শেষযাত্রায় তিনি ছুঁয়ে যাবেন রবীন্দ্রসদন। কিন্তু অনুমতি পাওয়া গেল না। নিয়মকানুন মেনে অনুমতি দেওয়া কি সত্যিই কঠিন কাজ ছিল!