৫৯ বর্ষ ৪ সংখ্যা / ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ / ১৭ ভাদ্র, ১৪২৮
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার ভবিষ্যৎ
অমিতাভ সেনগুপ্ত
বিশ্বভারতীতে অন্যায়ভাবে ছাত্র বহিষ্কারের বিরুদ্ধে বোলপুরে এসএফআই’র মিছিল।
কয়েকদিন আগে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র ও এক ছাত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তিন বছরের জন্য বহিস্কার করেছে। এই বিবৃতি শুনে মনে হতেই পারে নিশ্চয়ই তাঁরা বোধহয় এমন কোনো ঘটনা ঘটিয়েছে যে কারণে তাঁদের বহিস্কার করা হয়েছে। চারিদিকে এত হই চই, উপাচার্য মশাইয়ের অঙ্গুলি হেলনেই এই সব ঘটছে। হয়ত অনেকেই এ সব ব্যাপারে উপাচার্যের কোনো ভুল দেখতে পাবেন না।
আসুন তাহলে দেখে নিই আজ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে এবং সেই আঙ্গিকে তুলনা করি আজকের এই ঘটনাকে।
রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন ছাত্ররা মুক্ত বাতাসে, খোলা আকাশের নিচে প্রকৃতির সাথে এক হয়ে লেখাপড়া, খেলাধুলা, হাতের কাজ, গান-বাজনা-নাটক সব শিখবে। তাই ছাত্রদের ভালোবেসে শিক্ষা দান করতে যে শিক্ষকরা আগ্রহী তারাই হবেন এখানকার শিক্ষক। এই আদর্শকে ভিত্তি করেই বিশ্ব মাঝারে শান্তিনিকেতন পরিচিতি লাভ করে। বিশ্বকবি ভেবেছিলেন বা বলা ভালো তিনি তাঁর স্বপ্নের শান্তিনিকেতনকে বিশ্বজনীন করে তুলেছিলেন বিশ্বভারতী নামকরণের মাধ্যমে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁর এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলো। এর পর ১৯৭২ সালে এটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। এখন প্রশ্ন এর আগে কি এখানে ছাত্র বহিস্কৃত হয়নি? দেখি ইতিহাস কী বলছে? আমরা এখানে মূলত ১৯৭২-পরবর্তী সময় ধরেই আলোচনা সীমিত রাখব।
১৯৭২ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল বাম ছাত্র ঐক্য, আর এই ছাত্র ঐক্যকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয় ভারতের ছাত্র ফেডারেশন। স্বাভাবিক সময়ের গতিতে এই ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ব কর্তৃপক্ষের বিষ নজরে পড়ল। পরের বছরের প্রথম দিকে পুরুলিয়া থেকে আগত এক ছাত্র গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে বিশ্বভারতীর হাসপাতালের ডাক্তাররা সাথে সাথে অপারেশন করার নিদান দেন। একজনের অপারেশনে আইনগতভাবে অভিভাবকের সম্মতি দরকার, কিন্তু তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না, ফলে ছাত্ররা দাবি করতে থাকেন তৎকালীন বিদ্যাভবনের অধ্যক্ষ ওই ছেলেটির অভিভাবকের কাজ করুন এবং অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছায় যে ছাত্ররা অধ্যক্ষকে ঘেরাও করেন। এর নেতৃত্ব দেন তদানীন্তন বিশ্বভারতীর এক এস এফ আই নেতা। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে স্নাতক পরীক্ষার ঠিক একদিন আগে ঘোর বাম বিরোধী ‘রাজশক্তি’ সেই ছাত্রনেতাকে পাঁচ বছরের জন্য বহিস্কার করে। পরের বছর ১৯৭৪-এ নকশাল ছাত্র সংগঠনের পাঁচজন ছাত্রকে প্রায় বিনা দোষেই বহিস্কৃত হতে হয়। এরপরের ঘটনা ঘটে ১৯৮১ সালে, যখন কর্তৃপক্ষ আবারো পাঁচজন ছাত্রকে বহিস্কার করে।
তারপর এবার এই ২০২১-এ অর্থনীতি বিভাগের দুই ছাত্রকে (উল্লেখ্য, এদের মধ্যে একজন এসএফআই নেতা, অপরজন বাম মনোভাবাপন্ন) কর্তৃপক্ষের সিল করা এক অধ্যাপকের ঘরের তালা ভেঙেছে - এই অভিযোগে অভিযুক্ত করে তিনবারে মোট নয়মাসের জন্য সাসপেন্ড করা হয়। এই দু'জন ছাত্রের সঙ্গে এর পরবর্তী আন্দোলনে মদত দেওয়ার জন্য এক ছাত্রীকেও একই শাস্তি দেওয়া হয়। পাশাপাশি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন বর্তমানের উপাচার্য, যিনি খোলাখুলি নিজেকে আরএসএস-এর লোক বলতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। তাই তদন্ত কমিটি যে নিরপেক্ষ হবে না তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটিতে কোনো নিয়মের তোয়াক্কা না করেই অবসরপ্রাপ্ত দুই পুলিশ আধিকারিককে রাখা হয়, বাকি তিনজনের মধ্যে একজন এখানকারই অবসরপ্রাপ্ত আরএসএস মনোভাবাপন্ন শিক্ষিকা, যাঁর বিরুদ্ধে একাধিক ক্রিমিনাল কেস চলছে। এর উপরে একজন এমন মানুষকে এই কমিটির কো-অর্ডিনেটর করা হয়েছে যার বিরুদ্ধে বর্তমানের উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর আমলেই দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে এবং অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁকে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন আইন মোতাবেক এই ধরণের একজনকে কীভাবে এই তদন্ত কমিটির সাথে যুক্ত করা হয়? এর থেকে একটা বিষয় আমাদের কাছে দিনের আলোর মতো পরিস্কার উপাচার্য বিদ্যুৎবাবু নিজের ইচ্ছাকে চরিতার্থ করার জন্যই এমন একটা কমিটি গঠন করলেন যেখানে উনিই হবেন শেষ কথা।
।। দুই ।।
কিন্তু এই পর্বের শেষ এখানেই নয়। তদন্তের শেষে যখন তিন ছাত্রছাত্রীকে বহিস্কারের সিদ্ধান্ত জানানো হলো, তখন সেই চিঠিতে কারণ হিসাবে দেখানো হলো গৌর প্রাঙ্গণ ও অন্যত্র ভাঙচুর করা ও নিয়ম না মানা। অর্থাৎ এই ঘটনা যে সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তাতে কোনও দ্বিমত থাকতেই পারে না, ঠিক যেন ১৯৭৩ সালের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি।
তবে এবারে আরো একধাপ এগিয়ে উপাচার্য শুধু ছাত্র নয়, বেছে বেছে সাধারণ কর্মী থেকে শুরু করে অধ্যাপক, আশ্রমিক সকলকেই আক্রমণ করেছেন। ১৮০ জন সাধারণ কর্মীকে কারণ দর্শানোর চিঠি দিয়েছেন, ১৫০ জন সাধারণ কর্মীকে অন্যত্র বদলি করেছেন। এখানকার কর্মীসভা মূলত তৃণমূল দ্বারা পরিচালিত। কিন্তু অধ্যাপকদের সংগঠনে রয়েছেন অনেক বামপন্থী,সুতরাং সেখানে আক্রমণ অন্যরকম। প্রায় বিনাদোষে দু'জন আধ্যাপককে বরখাস্ত করা হয়েছে। ১৪ জনকে সাসপেন্ড করে রাখা হয়েছে। ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপকদের উপাচার্যের বিরুদ্ধে সই সংগ্রহের অভিযোগে নিজের অফিসে ডেকে ফ্যাসিবাদী কায়দায় প্রায় ছয় ঘণ্টা আটক করে রাখা হয়, তাঁদের মোবাইল কেড়ে নেওয়া হয় এবং শেষে পুলিশের হস্তক্ষেপে এই অবস্থার অবসান হয়।
রবীন্দ্রনাথ সৃষ্ট ‘আলাপনি মহিলা সিমিতি’ শান্তিনিকেতনের একটি ঐতিহ্যশালী সংগঠন, সেখানেও উপাচার্য মশাই হস্তক্ষেপ করলেন ও একই কায়দায় তাদের ব্যবহার করা ঘরটি সিল করে দিলেন। ভেঙে দিলেন অত্যন্ত গরিব মানুষদের রোজগারের একটি বাজার। পাশাপাশি নিজের মনের মতো দেওয়াল তুলতে, গেট বানাতে কোটি কোটি টাকা অপচয় করেই চলেছেন।
এবার মূল প্রশ্ন এই সবের পেছনে আসল উদ্যেশ্যটা কী? এখানে দু'টি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা বিশেষ প্রয়োজন। প্রথমটি হলো, রবীন্দ্রনাথের একান্ত প্রিয় পাহাড়ি যায়গা বর্তমান উত্তরাখণ্ড রাজ্যের রামগড়। কেন্দ্রীয় সরকার এখানে বিশ্বভারতীর একটি শাখা খোলার উদ্যোগ নিয়েছে, এই কাজটিকে রূপদান করাই এখন বিদ্যুৎবাবুর প্রথম লক্ষ। প্রসঙ্গত, কোনো একটি স্বয়ংশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা খুলতে গেলে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন কমিটিতে আলোচনা, রূপরেখা প্রস্তুত হওয়াটাই রীতি বা নিয়মের মধ্যে পড়ে। এক্ষেত্রে পরিচালন কমিটি পুরোপুরি অন্ধকারে অথচ রামগড়ে জমি নির্ধারিত হয়েছে,প্রাথমিক স্তরে অর্থ মঞ্জুর হয়েছে, আরএসএস-এর কর্মসূচি অনুযায়ী পঠন পাঠনের বিষয় নির্ধারিত হয়েছে এবং শান্তিনিকেতন থেকে বেশ কিছু বিশেষ বিষয়কে রামগড়ে স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত করা হয়েছে। আসলে শান্তিনিকেতনকে গুরুত্বহীন করে দেবার এ এক গভীর চক্রান্ত। দ্বিতীয়ত, এখানে থাকা দুটি বিদ্যালয় ‘পাঠভবন’ ও ‘শিক্ষাসত্র’কে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় বোর্ডের সাথে যুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মেই ব্রাত্য হয়ে পড়বে এখানকার কাঠামো। ফলে যতটুকু থাকবে তা সরকারের ‘সব বেচে দাও’ নীতির অধীনে বিক্রি করে দেওয়া হবে। মেলা, দোলের মতো ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান তো বিভিন্ন অজুহাতে আগেই বন্ধ করা হয়েছে।
এমত অবস্থায় আমদের করণীয় অবশ্যই বিশ্বভারতী তথা রবীন্দ্রনাথ সৃষ্ট শান্তিনিকেতনকে বাঁচাতে সমস্ত মানুষের কাছে চক্রান্তের বিষয়বস্তুকে তুলে ধরা। এই বিদ্যায়তনকে বাঁচাতে সমস্ত অংশের মানুষকে নিয়ে প্রতিবাদ গড়ে তোলা। এই মুহূর্তে জরুরি আক্রান্ত ছাত্র, শিক্ষক, আশ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানো এবং ফ্যাসিবাদী এই চক্রান্তের চক্রীকে আবিলম্বে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা। আসুন সকলে মিলে এগিয়ে এসে জাতির এই বিপর্যয় রোধ করতে এককাট্টা হয়ে লড়াই করি। বাংলার এই ঐতিহ্যকে কিছুতেই ধ্বংস করতে দেব না - এই হোক প্রতিজ্ঞা।