E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৪ সংখ্যা / ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ / ১৭ ভাদ্র, ১৪২৮

সাধারণ বিমা জাতীয়করণের সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষের উপহার - বেসরকারিকরণ

বিশ্বম্ভর মণ্ডল


‘সাধারণ বিমা’ জাতীয়করণের সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষে পদার্পণ ২০২১-র ২৮ আগস্ট। একটা দেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বিমা জাতীয়করণের মতো ঘটনা ‘ডান থেকে বাম’ পথে হাঁটা শুরু করার দিকে একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। অর্থনীতির নিয়মেই একটা দেশের অর্থনীতিতে চড়াই-উতরাই পরিস্থিতি আসে। এদেশেও বারবার এসেছে। অর্থনীতির নানান চড়াই-উতরাই পরিস্থিতিতে দেশকে বারংবার রক্ষা করেছে সরকারের নিয়ন্ত্রিত বিমা ব্যবসায় আর ব্যাঙ্ক। ২০০৮ সালে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে গেলে একের পর এক দেশ অসহায়ভাবে হাবুডুবু খেতে শুরু করেছিল, অনেক দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছিল। কিন্তু এদেশ সেই ধাক্কা সামলে নিতে পেরেছিল শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্ক, বিমা ব্যবস্থার জোরে। তার পরেও ছোটো-বড়ো অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলেছে রাষ্ট্রীয় বিমা-ব্যাঙ্ক জুটি, দেশের গায়ে আঁচ লাগতে দেয় নি বলা যায়। সাধারণ বিমা ব্যবসা (জাতীয়করণ) আইনের সংশোধনী বিল ধ্বনি ভোটে পাশ করে সাধারণ বিমা ব্যবসাতে সরকারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করে দেওয়া হলো। অথচ সাধারণ বিমা ব্যবসার অগ্রগতিতে বারবার লাভবান হয়েছে সরকার। তার অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নের কাজে নিরন্তর টাকা জোগানোর ব্যবস্থা করেছে। সেই রাষ্ট্রীয় ‘সাধারণ বিমা’র বেসরকারিকরণের প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগর মশায়ের কথা মনে পড়ে যায়। তিনি তার শত্রুদের উদ্দেশে বলেছিলেন, খোঁজ নিলেই দেখা যাবে তিনি তাদের উপকার করেছিলেন। সরকারের পক্ষ থেকে যে সহযোগিতা, আনুকূল্য, প্রশ্রয় পাওয়ার কথা মূলত ৯০-র দশক থেকেই তা থেকে বঞ্চিত হয়ে চলেছে ‘সাধারণ বিমা’। তবে বিগত ১০ বছরে ‘সাধারণ বিমা’র অগ্রগতিতে প্রতিকূলতা, অসহযোগিতার পরিবেশ মজবুত হয়েছে। এতদ সত্ত্বেও অর্থাৎ সরকারের যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা না পেয়েও দেশের সাধারণ বিমা ব্যবসার ৪২ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো। অবহেলা সত্ত্বেও রাষ্ট্রায়ত্ত ‘সাধারণ বিমা’ সরকারের জনকল্যাণমূলক, উন্নয়নমূলক কাজের জন্যে প্রয়োজনীয় অর্থের অন্যতম প্রধান জোগানদার হয়ে থেকেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ‘সাধারণ বিমা’ ক্ষেত্রের হাতে এই মুহূর্তে সম্পদের পরিমাণ ২ লাখ কোটি টাকা।

‘সাধারণ বিমা’ ক্ষেত্রকে ‘বেসরকারিকরণের’ পক্ষে সংসদে সরকারের যুক্তি কী দেখা যাক। তাদের মতে - এর ফলে (১) দেশের বাজারে অনেক বিদেশি বিমা কোম্পানি সস্তার বিমা প্রকল্প নিয়ে আসবে। (২) দেশের বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীরা নানান লোভনীয় বিমা প্রকল্প নিয়ে সাধারণ মানুষের সামনে উপস্থিত হবে। (৩) মানুষ অনেক কম পয়সা প্রিমিয়াম দিয়ে অনেক বেশি বিমা ক্রয় করতে পারবে।

‘সাধারণ বিমা’ ক্ষেত্র সরকারের হাতে থাকার প্রাসঙ্গিকতা এতটুকু হারায় নি। তার পক্ষে কয়েকটি যুক্তি ও তথ্য উল্লেখ করছি। প্রথমত, বাস্তবে ‘সাধারণ বিমা’ ক্ষেত্রের বেসরকারি কোম্পানির কাজের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, তাদের ৯১ শতাংশ অফিস শহরকেন্দ্রিক। এক্ষেত্রে একটা সুবিধা আছে রাষ্ট্রায়ত্ত ‘সাধারণ বিমা’ ক্ষেত্রে। আমরা দেখতে পাচ্ছি তাদের ৫৬ শতাংশ অফিস শহরকেন্দ্রিক আর ৪৪ শতাংশ অফিস গ্রামে ও শহরতলিতে। দ্বিতীয়ত, বিমা ক্ষেত্রের আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ‘বিমার দাবি’ মীমাংসা বা বিমার দাবি খারিজ। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে এযাবত ৮৬ শতাংশ দাবির মীমাংসা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে অনেকগুণ পিছিয়ে বেসরকারি কোম্পানিগুলো, যদিও বিমার দাবি খারিজের ক্ষেত্রে বেসরকারি কোম্পানিগুলো এগিয়ে আছে। বিমার দাবি খারিজের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ‘সাধারণ বিমা’ ক্ষেত্রের হার ২-৯ শতাংশ, সেখানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির ক্ষেত্রে এই হার হলো ১৬-৩৪ শতাংশ। তৃতীয়ত, রাজ্য সরকারের ও কেন্দ্রের সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। চতুর্থত, অলাভজনক পলিসি বিক্রিতে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর কোনো আগ্রহ নেই, কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র আর্থিকভাবে পিছিয়ে-থাকা মানুষদের জন্যে কিছু না কিছু পলিসি বিক্রি করে যেগুলোর ক্ষেত্রে মুনাফা প্রধান বিচার্য বিষয় নয়। পঞ্চমত, দেশের পরিকাঠামো উন্নতির জন্যেও রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা ক্ষেত্রের অবদান অনস্বীকার্য। বিগত ৪৯ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা ক্ষেত্র দেশের পরিকাঠামো উন্নতির জন্যে ১,৭৮,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। ষষ্ঠত, সমাজের পিছিয়েপড়া মানুষদের জন্যে দেশের সংবিধানে নির্দিষ্ট শতাংশ চাকরি সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে। এই দায়বদ্ধতা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির নেই। সপ্তমত, উন্নত দেশের অনেক বিমা কোম্পানি এদেশে বিমা ব্যবসা করতে আসবে বলে আহ্লাদিত হবার কোনো কারণ ঘটেনি। কারণ উন্নত দেশগুলোর একের পর এক বেসরকারি বিমা কোম্পানি দেউলিয়া বলে ঘোষিত হয়ে গেছে। কেউ দাবি করতেই পারেন যে, বিমার ব্যবসা ঝুঁকির আর অনিশ্চয়তার ব্যবসা, তাই সেখানে দেউলিয়া হবার সম্ভাবনা থাকতেই পারে। তাদের এটা জানিয়ে দেওয়া দরকার যে, বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলো দেউলিয়া হয়েছে মূলত প্রতারণা ও জাল জুয়াচুরি করতে গিয়ে। তারা ঝুঁকি নিতে গিয়ে দেউলিয়া হয়নি।

সরকারটা আমাদের, দেশটা আমাদের, শাসকদলকে ভোট দিলেও, ভোট না দিলেও। দেশের কল্যাণের জন্যে পরামর্শ দেবার অধিকার, দেশের জন্যে ভালবাসা, দেশের স্বার্থের সাথে একাত্মতাবোধ সংবিধানেও খুব স্বাভাবিকভাবেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। নানা মিডিয়াতে ২৯ আগস্ট প্রকাশিত প্রাসঙ্গিক একটা খবর এই প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য। খবরে জানা যাচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় ‘আওয়ার ট্রুথ ভার্সেস ইওর ট্রুথ’ শীর্ষক একটি বিতর্কে বলেছেন, যা একজনের কাছে সত্য বলে মনে হয়, সেটাই অন্যের কাছে সত্য বলে প্রতিভাত নাও হতে পারে। বুদ্ধিজীবীদের, সংবাদমাধ্যমের উদ্দেশে তিনি প্রকৃত সত্য উদঘাটনের দায়িত্বের কথা স্বরণ করিয়ে দিয়েছেন। ‘প্রকৃত সত্যের’ থেকে যেন ‘আমার সত্য’ গুরুত্বপূর্ণ না হয়ে ওঠে সেই বিষয়ে তিনি সতর্ক করেছেন।

এই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, দেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ রক্ষার প্রধান প্রধান হাতিয়ারের অন্যতম ‘সাধারণ বিমা’ থেকে কেন এই ভয়ংকর অতিমারীর মধ্যে সরকারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ তুলে দিল সরকার - সেই সত্যকে সামনে আনা হোক। এটাই সমাজের অধিকাংশ মানুষের দাবি হয়ে উঠুক সংসদের ভিতরের ও বাইরের মাঠে-ময়দানের লড়াইয়ে। সরকারের উদাসীনতা বা রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেই সাধারণ মানুষের যন্ত্রণার কথা, সাধারণ মানুষের স্বার্থের অসহায়তা আর বিপন্নতার কথা জনসমক্ষে তুলে ধরাটাই এই মূহূর্তে দেশপ্রেমিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য।