৫৯ বর্ষ ৪ সংখ্যা / ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ / ১৭ ভাদ্র, ১৪২৮
সোচ্চার চিন্তা
কাঁউটার-রোখা বিদ্রোহিনী দোপ্দি নয়; বিপন্না, প্রায়-বিবসনা দ্রোপদীই ওদের মনোমতো
পল্লব সেনগুপ্ত
বাঙালি বিয়ের ‘স্ত্রী-আচার’ বলে যে একটি প্রথাগত পর্ব আছে, সেখানে কড়ি খেলা নামে এক অনুষ্ঠান চলার সময়ে নতুন বউকে দিয়ে বলানো হয় (বরের) ‘‘দোষ ঢাকব, গুণ রাখব!’’ আবার বরকে দিয়েও বলানো হয়, (বউয়ের) ‘‘দোষ ঢাকব, গুণ রাখব!’’...ভাবছেন তো, ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ গাইছি? না ভাই, প্রসঙ্গটা তুলেছি উপমা হিসেবে! সর্বত্রই শাসক গোষ্ঠী তাদের পেটোয়া কিছু বুদ্ধিজীবীর সাহায্যে তরুণ ছাত্রছাত্রীদের ‘ব্রেন ওয়াশ’ করার তাগিদে সিলেবাসে ছাঁটাকাটা, জোড়াতাপ্পির মাধ্যমে যা-যা করে, তা প্রায়শই হয় ‘‘সত্যি ঢাকব, মিথ্যে রাখব’’ - মুখে না বললেও ব্যাপারটা আসলে তাই-ই দাঁড়ায়। গত সাড়ে সাত বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে যে গৈরিক পতাকার আস্ফালন চলছে, তারও মূল অভিপ্রায় সেটাই। এবং এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হলো দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ ক্লাসের সিলেবাসে নির্বোধ-শয়তানিতে টইটম্বুর কিছু ক্রিয়াকলাপ।
স্পষ্টতই কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রকের অলক্ষ্য অঙ্গুলি সঙ্কেতে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ ‘ওভারসাইট কমিটি’ নামে (অর্থাৎ, খবরদারি সমিতি!) যে একটি গোষ্ঠী তৈরি করেছেন (বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাটুট কিংবা ইউজিসি-র গাইড লাইন, কোথাওই এমন করার কোনো বিধিবিধান নেই) - তাঁরা পয়লা রাত্তিরেই ‘মার্জার বধ’ করেছেন ইংরেজি সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান - এই চারটে বিষয়ের সিলেবাসে ঝট্পট্ কাঁচি চালিয়ে, আঠা সেঁটে! এখানে একটা কথা জানা খুব দরকার যে, ওই তথাকথিত খবরদারি-সমিতিতে কিন্তু এই চার বিষয়ের একজনও বিশেষজ্ঞ নেই! অর্থাৎ, এককথায় এঁরা অনধিকার চর্চা করেছেন - নিয়মগত এবং শিক্ষাগত - দু’দিকেই।
অন্য বিষয়গুলিতে কি কি কারিকুরি করা হয়েছে, তা অবশ্য এখনও প্রকাশ্যে আসেনি, তবে ইংরেজি নিয়েই যা ঘটেছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অন্যগুলি ক্ষেত্রেও ভিন্ন কিছু ধরনের ব্যাপার হয়েছে, সেটা ভাবার কারণ নেই।... দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি অনার্সের সিলেবাসে ইংরেজি অনুবাদে প্রাক-ঔপনিবেশিক এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক আমলের ভারতের সাহিত্য পড়ানোর ব্যবস্থা আছে। ‘প্রাক’-পর্বের পাঠ্যক্রম থেকে ‘চন্দ্রবতী রামায়ণ’-এর বদলে আনা হয়েছে তুলসীদাসের ‘রামচরিত মানস’-এর কিছু অংশ। আর ‘উত্তর’-পর্বে বাদ দেওয়া হয়েছে মহাশ্বেতা দেবীর ‘দ্রৌপদী’ এবং তামিলভাষী দলিত বর্গের দুই লেখক সুকৃথরনির ‘ঋণ ও আমার দেহ’ ও বামা-র ‘আত্মকথা’-র দু’টি অংশ (দু’টি মাত্রই পাঠ্যক্রমে ছিল)। ‘দ্রৌপদী’-র বদলে কিছুই নতুন আসেনি, তবে দুই দলিত বর্গীয়ের লেখার পরিবর্তে যোগ করা হয়েছে তথাকথিত উচ্চবর্গীয়া রমাবাইয়ের লেখা। এবং এই পরিবর্তন অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল, এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে না যাচিয়েই উপাচার্য পি সি যোশি রাতারাতি তাঁর বিশেষ ক্ষমতাবলে এই ‘খবরদারি’ সিলেবাসকে বৈধতা দিয়ে পরের শিক্ষাবর্ষ থেকে পড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন! স্পষ্টতই, সব ব্যাপারটায় একটা ঢাক-ঢাক, গুড়-গুড় ভঙ্গি দেখা যাচ্ছে কিন্তু!
।। দুই ।।
শুধু ঢাক-ঢাক, গুড়-গুড়ই বা বলি কেন? সমস্ত ছাঁটাই-জোড়াইয়ের মধ্যে একটা সুনির্দিষ্ট চিন্তাও তো সক্রিয় আছে। দুই দলিত লেখকের বদলে আনা হলো এক তথাকথিত উচ্চবর্গীয়াকে। চন্দ্রাবতীর রামায়ণে এমন অনেক অংশ আছে যা ‘নাগপুরিয়া’ মেল-শ্যভিনিজম (ওরফে, পুরষতন্ত্রী আত্মম্ভরিতা) সইতে পারে না। সীতার প্রতি অবিচারকেই চন্দ্রাবতী প্রধান করে দেখিয়েছেন (একালে, মল্লিকা সেনগুপ্তের ‘সীতায়ন’-এর মতোই) - তাই রামের নাম ‘‘সত্ হ্যায়’’ বলে যারা, সেই ভিএইচপি, আরএসএস-এর তো রাম মাহাত্ম্য খর্ব করা বইকে বাদ দিয়ে, তুলসীদাসী রামায়ণকে পাঠ্য করতেই হবে! আর দলিত লেখকদের দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে ফেলতে পারলে ‘‘গরব সে বোলো, হাম হিন্দু হ্যায়’’ - বলনেওয়ালারা মনে-মনে তৃপ্তি পায় এইটে ভেবেই যে, ‘‘যাক, আরও দুই দলিতের প্রতি অবিচার করা গেল! কেয়াবাত!’’
কিন্তু ‘দ্রৌপদী’-র ব্যাপারটা আরও জটিল এবং ব্যাপক। খবরদারি-কমিটির মুখিয়া জনৈক এম কে পণ্ডিত বলেছেন, এই গল্পের সিলেবাসভুক্তি নিয়ে (না-কি!) অনেক আপত্তি উঠেছে! কথাটা যে ভিত্তিহীন, তার প্রমাণ - ‘দ্রৌপদী’ সিলেবাসে আছে ১৯৯৯ থেকে, তো হঠাৎ এই ২২ বছর পরে হঠাৎ করে এর বিরুদ্ধে আপত্তির জোয়ার এসে পড়ল কোথা থেকে? তিন রাজপ্রাসাদ-ওলা বিজেপি-র হেড কোয়ার্টার, না নাগপুর? আপত্তির ছুতো হিসেবে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক কর্মকর্তা বলেছেন, এই গল্পে মিলিটারি এক সাঁওতাল নারীকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করেছে, এমন বর্ণনা করা হয়েছে বলে - এটি ‘‘আমাদের নৈতিক মূল্যবোধ, জাতীয় সংস্কৃতি এবং সামাজিক ভারসাম্যকে আহত করে, তাই বাদ দেওয়াটা যুক্তিযুক্ত!’’ ...২২ বছর ধরে ছেলেমেয়েরা এই গল্প পড়ে এলো, তখন এতসব ‘ভয়ঙ্কর’ প্রভাব পড়েনি তাহলে তাদের ওপর? আজকে প্রায় এক প্রজন্ম পরে - যখন ছেলেমেয়েরাও আরও বেশি মুক্ত চিন্তার অধিকারী হয়েছে যুগের প্রভাবেই, তখন এ-গল্প তাদের নীতিবোধ, মূল্যবোধ নষ্ট করে দেবে? তাহলে, ইউজিসি-র মডেল সিলেবাসেই বা এটা আছে কী করে? ‘ধর্ষণ’ ব্যাপারটা চরম ঘৃণ্য অপরাধ নিঃসন্দেহে, তাই বলে সমাজে যে সেটা নেই, এমন তো নয়! বিএ ক্লাসের ছেলেমেয়েরা সকলেই ‘১৮+’, ভোট দিয়ে সরকার তৈরি করতে সক্ষম - এত কোমলমতি শিশু তো নয় যে, একটা ধর্ষণের কাহিনি পড়তে হলেই তাদের ইহকাল-পরকাল (?) ঝরঝরে হয়ে যাবে!... এই ‘দ্রৌপদী’ গল্পটা আপনাদের অনেকেরই সম্ভবত পড়া। তবু, যাঁরা পড়েননি, তাঁদের সুবিধার জন্যে এখানে একটু বলি খুব সংক্ষেপেঃ
রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ারের মতো সুদখোর মহাজন সুরজ সাহু। দ্রৌপদী মেঝেন আর দুলন মাঝি হতদরিদ্র এক আদিবাসী দম্পতি। কবে কোন্ আদ্যিকালে দুলনের বাবা সামান্য কিছু টাকা ধার করেছিল সাহুর কাছে, আজও তার জেরে দুলনদের বেগার খেটে দিতে হয় তার জন্যে, বাড়ি গিয়ে। শুধু তাই নয়, আরও নানান পীড়ন, লাঞ্ছনা ভোগ করে তারা অন্যান্য সব পড়শি সাঁওতালদের সঙ্গেই। মায়, এই দলিত লোকগুলো গাঁয়ের পুকুর, কুয়ো কিংবা ক্যানেল থেকে তেষ্টার জলটুকুও নিতে পারে না সুরজ মহাজন আর তার চামচাদের দাপটে। একদিন, অসহ্য হয়ে ওঠায় দুলন, দোপ্দি (দ্রৌপদী) আর অন্য দলিতরা ঝাঁপিয়ে পড়ে সাহুর ওপর, সে মারা যায় পরিণামে। ধনী, মহাজন, ‘উঁচু’ জাতের লোক সুরজ সাহু খুন হয়েছে ‘ছোটলোক’ সাঁওতালদের হাতে! কল্যাণব্রতী রাষ্ট্রের পুলিশ, মিলিটারি সবাই লেগে গেল দুলন-দোপ্দি-আর অন্যদের খোঁজে। এক ঝটকা এনকাউন্টার তথা হামলার ফলে দুলন মারা গেলে দোপ্দিরা জঙ্গলে আত্মগোপন করে। ঝাড়খণ্ড অঞ্চলের দুর্গম জঙ্গল জুড়ে মিলিটারিরা চিরুনি তালাসি করতে করতে হঠাৎই পেয়ে যায় দোপ্দি মেঝেনকে। ক্যাম্পে তুলে নিয়ে যায় তাকে দেশের আইন-শৃঙ্খলা-নিরাপত্তার পাহারাদারেরা। জিজ্ঞাসাবাদের নামে শুরু হয় নির্মম প্রহার আর তারপরে বাহিনীর ক্যাপ্টেনের আদেশে ওকে ‘বানানো’ শুরু হয় - পুলিশি পরিভাষায় যা হলো ‘গ্যাং রেপ’-বা-দলবদ্ধ বলাৎকারের প্রতিশব্দ।
সারারাত ধরে দ্রৌপদীকে প্রতিটি রক্ষী বীভৎসভাবে ধর্ষণ করেও তার মুখ থেকে একবারও বার করতে পারেনি ওদের দলের বাকিরা কোথায় আছে। সকালে স্বয়ং ক্যাপ্টেন আসেন অকুস্থলে। না, না - ধর্ষণের বাসনায় নয়! তিনি পদস্থ অফিসার, তিনি কখনো অধস্তন কর্মীদের দ্বারা গণধর্ষিত একটা আধা-বন্য সাঁওতাল বউয়ের বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত শরীরটার ওপর লোভ করতে পারেন! ছি, ছি! তিনি আসেন ওকে ভব্য অফিসারোচিতভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে। আর তখনই অকল্পনীয় এক ক্রোধের, প্রতিবাদের বিস্ফোরণ! নির্বসনা, রক্তাক্ত মুমূর্ষুপ্রায় আদিবাসী বধূ ঝাঁপিয়ে পড়ে সেনাধ্যক্ষের ওপরে...‘‘লেঃ, লেঃ - কাঁউটার করবি তো, কর কত কাঁউটার (অর্থাৎ এনকাউন্টার!) করবি কর... ‘‘ভয়ঙ্করী সেই লাঞ্ছিতা মেয়েটার ক্রোধ এবং প্রতিবাদের আগুনে যেন ঝল্সে যেতে লাগলেন কল্যাণব্রতী রাষ্ট্রবিধানের অন্যতম রক্ষক গ্রুপ ক্যাপ্টেনও। একটা প্রবল আতঙ্কে তিনি শিউরে ওঠেন।... গল্প শেষ।
এ গল্পে তো আপত্তি করবেই এখনকার রাষ্ট্রপরিচালকরা। সুরজ মহাজনরাই তো তাদের আশিসধন্য - কাজে-কাজেই দুলন-দোপ্দিরা তাদের শত্রু হবেই। গল্পটা নিয়ে আগেও, কংগ্রেসি আমলেও ‘‘অ্যাঁ-ওঁ-না’’ মার্কা আপত্তি উঠেছিল, এটাকে নকশালদের প্রচার বলেও জিগির তুলেছিল কেউ-কেউ। ধোপে টেঁকেনি। এর অন্তর্নিহিত যে ভাবনা, তা তো চিরকালের বিদ্রোহী সত্তার উদ্ভাস! উৎপীড়ন এবং উৎপীড়িতের চিরকালীন সংঘাতের এক অনন্য রূপক-কাহিনি। আর সেই জন্যেই দেশ-বিদেশের ১৮-২০টা ভাষায় এ গল্প অনূদিত হয়েছে। নিরপেক্ষ সমালোচক এবং পাঠকদের কাছে সাদরে গৃহীত হয়েছে।... এইখানে যে অনুবাদটি নিয়ে এত সমস্যা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নাচের-পুতুল’ কর্তৃপক্ষের, সেটি করেছেন আমার সহপাঠিনী গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক। অসামান্য সেই অনুবাদ, মূল কাহিনির প্রতিটি স্পন্দন সেখানে প্রতিধ্বনিত করেছেন গায়ত্রী। আর এই কারণেই ইউজিসি-তে বোধবুদ্ধি সম্পন্ন যাঁরা-যাঁরা আছেন - তাঁরা এটিকে মডেল সিলেবাসে রেখেছেন, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত ‘পণ্ডিত’ যাঁরা - খবরদারি সমিতির মুখিয়ার মতো পদবীর সুবাদে ‘পণ্ডিত’ নন, তাঁরাও এত বছর ধরে এটিকে পাঠ্যক্রমে রেখেছেন।
।। তিন ।।
কিন্তু এতকাল পরে এই গল্পের পিছনে আড়ে-হাতে লাগা হলো কেন?... এক-দুই-তিন করে কারণগুলো খুঁজি বরং, আসুনঃ প্রথমত, এক লাঞ্ছিতানারী লাঞ্ছনাকারীদের পাণ্ডার বিরুদ্ধে (নজরুলের ভাষায়) ‘‘ধর্ষিতা নাগিনী’’-র মতো ফুঁসে উঠেছে। এটা কী করে গোলওয়ালকরের চেলারা মেনে নেয় বলুন তো। এই তো সেদিনও মোহন ভাগবতরা ফতোয়া দিয়েছেন, নারীর আসল কাজ ঘরকন্নায়, বাইরের জগতের সংগ্রামের মধ্যে নয়। (এমন কথা অবশ্য হিটলারও বলতো!) তার ওপর এই মেয়ে আবার দলিত গোষ্ঠীর! সুতরাং, গেল-গেল ধর্ম গেল, সমাজ গেল! অতএব, ছাঁটো এই গল্প।
দ্বিতীয়ত, এ গল্পে প্রতীকী হলেও রাষ্ট্রীয় উৎপীড়নের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের রুখে দাঁড়ানো বর্ণিত হয়েছে! রাম, রাম! ছাঁটো এই গল্প।
তৃতীয়ত, মহাশ্বেতাদির কুশলী কলমে কাহিনির পরিসমাপ্তির ঠিক আগে হিন্দু পুরাণবৃত্তের অসুরদলনী দুর্গার সংহার মূর্তি এবং দিগ্বসনা, ঘোরকৃষ্ণা মহাকালীর ভয়ঙ্করীর যৌথরূপসঙ্কেত সৃষ্টি হয়েছে দোপ্দি মেঝেনের বর্ণনার মধ্যে। (গায়ত্রীর অনুবাদেও সেই চিত্রকল্প অনবদ্যভাবে অক্ষুণ্ণ!) এটা কী করে হতে পারে? অতএব, ছাঁটো এই গল্প!
চতুর্থত, এ গল্পে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা বলা হয়েছে - হোক না, একের বিরুদ্ধে এক! - সেটা কী করে এই ‘রামরাজ্যের’ অচ্ছে দিনের সময়ে দেখানো যায়? সুতরাং, বাতিল এ গল্প!
এই গল্পে আসলে যা দেখানো হয়েছে, তাতে রামানুচরদের আঁতে ঘা লেগেছে। তার ওপরে এখানে জঙ্গলমহলের আদিবাসীদের সঙ্গে সাহুকার, পুলিশ, মিলিটারির বিরোধ দেখানো হয়েছে - তাই ৪০-৪২ বছর আগের এই গল্পকে যদি ছেলেমেয়েরা সাম্প্রতিক পরিপ্রেক্ষায় ভেবে নেয়, তাহলেও তো সাড়ে-সব্বোনাশ! ছাঁটো, ছাঁটো মহাশ্বেতাদেবীর এই গল্প!
।। চার ।।
অন্য কথাগুলো যে খোলাখুলি বলা যায় না, তা অবশ্য রামানুচরদেরও যারা অনুচর, তারা বোঝে। সুতরাং, নানা ছুতো বানাতে হয়েছে তাদেরঃ ধর্ষণের ঘটনাটা ‘‘ভার্তীয় পরম্পরা’’-কে হেয় করছেঃ বর্ণবিদ্বেষ, জাতিবিদ্বেষ উস্কে যাচ্ছে; নৈতিক এবং সামাজিক মূল্যবোধকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে - ইত্যাদি ইত্যাদি সব বাহানা দিয়ে তাই দিল্লির বড়োকর্তাদের হাতের পুতুল বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তারা যা বলছেন, তার সারবত্তা শূন্য। এই গল্পের বাস্তব রূপায়ণ দেখা গিয়েছিল অনেক বছর পরে; বিশেষ-নিরাপত্তা-আইন প্রত্যাহারের দাবি নিয়ে এবং সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিতা মণিপুরি মেয়েদের মায়েরা তার প্রতিবাদে বিবসনা হয়ে মিলিটারি ক্যাম্পের সামনে মিছিলে সোচ্চার হন। তাঁদের নেত্রী ছিলেন সাবিত্রী হেইসনাম - যিনি মঞ্চে ওই দ্রৌপদীর ভূমিকাতেই অভিনয় করে ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেছিলেন।... এসব ব্যাপারও গেরুয়া ব্রিগেডের প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য লিডার-ক্যাডার বৃন্দের অজানা নয়। সুতরাং, দাও হিটলারি কায়দায় বিপদের জড়্টাই উপড়ে। একটা নারী ধর্ষণের ঘটনা আছে বলে যদি এই গল্পকে নৈতিক মূল্যবোধের পরিপন্থী বলে মনে করা হয় (যা বলে প্রচার করা হচ্ছে), তাহলে তো রামায়ণ-মহাভারতকেও সেই দায়ে দায়ী না করে থাকা যাবে না। রাবণ কর্তৃক বেদবতী এবং ভাইপো নলকুবরের বউকে ধর্ষণ করা, ধর্ষণের বাসনায় সীতাকে অপহরণ, ইন্দ্র-কর্তৃক অহল্যার ধর্ষণ, রাম-লক্ষণ কর্তৃক শূর্পনখার শারীরিক লাঞ্ছনা - এসব ঘটনাগুলো তাহলে কী? ঋষি এবং রাজার দ্বারা ধীবর কন্যার ধর্ষণ, বড়ো ভাই-কর্তৃক ছোটো ভাইয়ের স্ত্রীদের এবং এক দাসীকে প্রকারান্তরে ধর্ষণ (বংশরক্ষার ছুতোয়!), চার দেবতা কর্তৃক কুন্তীর ধর্ষণ, প্রকাশ্য রাজসভায় যুবতী দ্রৌপদীর কুৎসিতভাবে শ্লীলতাহানি এবং একজন ছাড়া সভাশুদ্ধ সকলের সেটা মেনে নেওয়া - এগুলোই বা কী? করা হবে রামায়ণ-মহাভারতকে বাতিল?
।। পাঁচ ।।
অবশ্য সব দেশে সব কালে একনায়কীরা বই এবং সিলেবাসকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে বাছাই-ছাঁটাই করে। এদেশে তো আবার রাজনীতির সঙ্গে মিশেছে ধর্মান্ধতা! প্রাচীন মিশরের আলহাম্রা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল লাইব্রেরি পুড়িয়ে দিয়েছিল আরব সৈন্যরা - ওইসব কিতাবে কোরান-হাদিসের বন্দনা, মান্যতা নেই অভিযোগে! হিটলার বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানবিজ্ঞানের সাহিত্যের বই পুড়িয়েছিল, তারা নাৎসি আদর্শের পরিপন্থী এই ছুতোয়!... ছুতো ঠিক খুঁজে নেয় এরা! যেমন এখন পশ্চিমবঙ্গের কোভিডের ছুতোয় মাধ্যমিকের সিলেবাস কমানোর সুযোগে বাদ দেওয়া হয়েছে ইতিহাসের পাঠ্যক্রম থেকে (ক) ভারতে শ্রমিক-কৃষক ও বামপন্থী আন্দোলন; (খ) ভারতে নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আন্দোলন; (গ) স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষ! কিসের স্বার্থে এগুলো করেছে রাজ্য সরকার বুঝতেই পারছেন ভাই।
তবে স্রেফ ব্যক্তিগত কারণেও (অবশ্য ছুতো সমেত) সিলেবাস-ছট্কানো হয় না এমন নয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এন্ট্রান্স সিলেবাস থেকে শরৎচন্দ্রের বিখ্যাত ‘মহেশ’ গল্প বাদ দিয়েছিল ‘গো-হত্যা’ আছে এই অজুহাতে! বদলে, সিলেবাস কমিটির একজনের লেখা চৈতন্যজীবনী ‘প্রেমের ঠাকুর’ আসে। বি.এ. সিলেবাসে নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘চেনামহল’ বাদ পড়ে, কমিটি চেয়ারম্যানের জোরাজুরিতে - ওখানে ‘কাজিনদের মধ্যে প্রেম দেখানো আছে’ এই ছুতোয়!... কী, কিছু বলবেন?