৫৯ বর্ষ ৪ সংখ্যা / ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ / ১৭ ভাদ্র, ১৪২৮
পরিবেশ আলোচনা
আমাদের দেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন
তপন মিশ্র
তৃতীয় মেরুর দেশ ভারত। উত্তর আর দক্ষিণ মেরু বাদ দিলে যেখানে পর্যাপ্ত বরফ এখনও জমা আছে সেটি হলো হিমালয়। অবশ্য আরও কয়েকটি দেশ রয়েছে হিমালয়কে ঘিরে। তবে একদিকে ভারত মহাসাগর অন্যদিকে হিমালয় যে ভাবে এ দেশের জলবায়ু নির্ধারণ করে পৃথিবীর অন্য কোথাও এমনটা হয়না। ইদানীংকালে তৃতীয় আর এক গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক আমাদের ভাবাচ্ছে। এটি হলো বায়ুমণ্ডলে কার্বনের ঘনত্ব বৃদ্ধি। আবার এই কারণগুলির জন্যই ভারত উপমহাদেশের বায়ুমণ্ডল পরিবর্তনের সংবেদনশীলতা একটু বেশি।
অনেক বড়ো বড়ো প্রতিশ্রুতি থাকলেও, “যখন হবে তখন দেখা যাবে” - এই মনোভাব নিয়ে ভারত সরকার চলছে। আগেই উল্লেখিত হয়েছে যে (দেশহিতৈষী, ২০ আগস্ট, ২০২১), দ্য ইন্টারগভর্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ - আইপিসিসি’র ষষ্ঠ প্রতিবেদন (Sixth Assessment Report, AR6)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ (physical science basis) প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রতিবেদনে বিপদের ঘণ্টা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। লাগাতারভাবে ইউনাইটেড নেশনস এনভাইরনমেন্টাল প্রোগ্রাম-এর আইপিসিসি তার প্রথম প্রতিবেদন এবং বিশেষ প্রতিবেদনের মধ্যদিয়ে একই কথা বলে চলেছে। শিল্পোন্নত দেশগুলি জলবায়ু পরিবর্তনের আঘাত কিছুটা হলেও কিছু দিনের জন্য সামলে নিতে পারবে। কিন্তু আমরা কী তা পারব?
কার্বনের ঐতিহাসিক নির্গমনের (historical emission) বিচারে ভারত অনেকটা স্বস্তিতে। অর্থাৎ ভারতে শিল্পবিপ্লবের প্রভাব অনেক পরে পড়েছে ফলে এদেশে অতীতে উৎপাদন শিল্প থেকে নির্গমন অনেকটা কম হয়েছে। সেই তুলনায় শিল্পোন্নত দেশ গুলি ঐতিহাসিক নির্গমনের দোষে দুষ্ট। সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে এখনও আমাদের শিল্পোন্নত হওয়ার অধিকার রয়েছে এবং এটাই স্বনির্ভরতার একমাত্র পথ। এই যুক্তি থেকে কিয়োটো চুক্তির সিদ্ধান্ত মতো শিল্পোন্নত দেশগুলিকে (Annex-1 countries) বর্তমানের নির্গমন কমানোর উপর জোর দিতে বলা হয়। কিন্তু তা প্রথমে আমেরিকা এবং পরে অন্যান্য দেশ গ্রাহ্য করেনি। যদি আন্তর্জাতিক স্তরে এই দাবি তুলতে না পারা যায় সর্বনাশ আসন্ন। উদাহরণস্বরূপ আমেরিকা এপর্যন্ত বায়ুমণ্ডলে ৪০ কোটি টন কার্বন ডাই অক্সাইড বা তার সমতুল্য গ্যাস জমা করেছে। ভারতের এই পরিমাণ ৫ কোটি টনেরও কম। বর্তমানে বছরে আমেরিকার মাথাপিছু নির্গমন প্রায় ১৬ টন কিন্তু ভারতে মাথাপিছু নির্গমন ১ থেকে ১.৫ টন (https://ourworldindata.org/co2-and-other-greenhouse-gas-emissions)।
সরকারের প্রতিশ্রুতি
২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তির প্রাক্কালে আমাদের দেশ যে ইনটেনডেড ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশনস (Intended Nationally Determined Contributions) অর্থাৎ দেশে গ্রিনহাউস গ্যাস কমানোর জন্য যে ঘোষণা করেছে তার কয়েকটি হলো -
১) ২০৩০ নাগাদ ২০০৫-র তুলনায় মাথা পিছু ৩৩ থেকে ৩৫ শতাংশ গ্রিন হাউস গ্যাস কমিয়ে ফেলা হবে (দেশে শিল্পের বিকশের পথ রুদ্ধ করে কিনা তা অবশ্য বলা নেই)।
২) ২০৩০ নাগাদ দেশের সমস্ত শক্তির ৪০ শতাংশ উৎস আসবে সৌরশক্তি থেকে।
৩) ২০৩০ নাগাদ অরণ্য সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণের মধ্যদিয়ে বর্তমানে যে কার্বন ভাণ্ডার (carbon sink) আছে তা থেকে ২৫ থেকে ৩০ লক্ষ টন অধিক কার্বন ভাণ্ডার তৈরি করা হবে। এর অর্থ হলো বায়ুমণ্ডলে কার্বনের ভার কমবে।
৪) জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য (adaptation measures) যে সমস্ত ক্ষেত্র সহজেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে যেমন কৃষি, জলসম্পদ, হিমালয় অঞ্চল, সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল, স্বাস্থ্য এবং বিপর্যয় মোকাবিলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকারি ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হবে।
ভারতের উপর কি কি প্রভাব পড়তে পারে?
আইপিসিসি’র ষষ্ঠ রিপোর্ট বলছে যে, ভারতে ২০৩০ নাগাদ, ১৮৫০-এর তুলনায় বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা ১.৭ ডিগ্রি থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি হয়ে যাবে এবং এর মারাত্মক কুপ্রভাব দেখা দেবে। এই অস্বাভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে কী কী হতে পারে -
১। প্রতিবেদনে ভারতের আবহাওয়ার উপর প্রভাব সম্পর্কে বলা হয়ঃ “concurrently the frequency of heavy precipitation events has increased over India, while the frequency of moderate rain events has decreased since 1950”। ১৯৫০ পরবর্তী সময়ে নিম্নচাপের ফলে কম সময়ে অধিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু বর্ষাকাল জুড়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। এর কারণ হিসাবে আইপিসিসি’র বিজ্ঞানীরা বলছেন যে, মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলে বাতাসে ভাসমান কঠিন বা তরল দূষক পদার্থের কণা (aerosol)-র বেশি উপস্থিতি। “the dominant cause of the observed decrease of south and southeast Asian monsoon precipitation since mid-20th century is anthropogenic aerosol forcing”। কেবল ভারতে নয় পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি দেশে একই ঘটনা ঘটছে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছেঃ “...models projected for the 21st century a significant increase in temperature over South Asia (high confidence with robust evidence অর্থাৎ যা অবশ্যই ঘটবে) and in projections of increased summer monsoon precipitation (medium confidence অর্থাৎ ঘটার সম্ভাবনা অনেকটা)”।
২। গ্রীষ্মকালে তাপপ্রবাহ আমরা এখন যা লক্ষ করছি ৬ থেকে ৮ গুণ তা বৃদ্ধি পাবে। ফলে শ্রমজীবী মানুষের কর্মক্ষমতা কমবে এবং বিভিন্ন ধরনের পেশাগত স্বাস্থের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (ILO)-র মতে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে প্রায় দেশের যে উৎপাদন ক্ষমতা কমবে তা হলো প্রায় ৩.৪ কোটি মানুষের কর্মচ্যুতির সমতুল্য। এশিয়া জুড়ে এই ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী করে আইপিসিসি’র প্রতিবেদনে লিখছেঃ “...intensity and frequency of hot extremes, such as warm days, warm nights, and heat waves; and decreases in the intensity and frequency of cold extremes, such as cold days and cold nights...”
৩। কৃষিক্ষেত্রে এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। ২০১৯ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলস্বরূপ দেশের ৪৫শতাংশ অংশে খরা দেখা দেয়। ১২ টি রাজ্যে প্রবল বন্যার ফলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ক্রমবর্ধমান খরা এবং বর্ষার দাপটে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে গাঙ্গেয় সমভূমি, যার মধ্যে পশ্চিমবাংলার এক বড়ো অংশ রয়েছে।
৪। ফসল এবং প্রাণী এমনকী মানুষের রোগ সৃষ্টিকারী পোকা মাকড় এবং জীবাণুর জীবনচক্রে পরিবর্তন ঘটবে। ফলে যদি প্রতিনিয়ত গবেষণার মধ্য দিয়ে এই ক্ষতিকর রোগ জীবাণুর দমন এবং নিয়ন্ত্রণ না করা যায় তাহলে নতুন মহামারী দেখা দেবে।
৫। নির্দিষ্টভাবে আঞ্চলিক কিছু ভয়ঙ্কর প্রভাবের কথাও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে (IPCC regional factsheet)।
(ক) মূলত শহর এলাকায় জমা এরোসলের কারণে মুম্বাই, কলকাতা, চেন্নাই ইত্যাদি শহরে কম সময়ে বেশি বৃষ্টিপাত হবে।
(খ) ১৯৫০ থেকে ২০১৮-র মধ্যে কলকাতার তাপমাত্রা ২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পর আছে তেহরান (২.৩ ডিগ্রি এবং মস্কো ১ডিগ্রি সেলসিয়াস)। ১৮৫০-র তুলনায় ২০৮১ থেকে ২১০০ সালের মধ্যে কলকাতার তাপমাত্রা ৪.৫ ডিগ্রি বৃদ্ধি পাবে। পৃথিবীতে আইপিসিসি’র ফ্যাক্ট শিটে উল্লেখিত সমস্ত শহরের মধ্যে এটি এক নম্বরে।
(গ) কলকাতার খিদিরপুরে উক্ত সময়কালে জলতলের উচ্চতা ০.১৫ মিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। চেন্নাইতে এই পরিমাণ হলো ০.৫৭ এবং মুম্বাইতে ০.৫৮ মিটার। কলকাতার পাশে সুন্দরবনে এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ সমুদ্রতল বৃদ্ধি পাবে ৬০ সেন্টিমিটার।
ঢাল তলোয়ার হীন নিধিরাম সরকার
জলবায়ু পরিবর্তনের দিকদিয়ে দেখলে ভারত এখন অত্যন্ত সংবেদনশীল এক দেশ। এখানকার ক্রান্তিয় জলবায়ু এবং দেশের এক বড়ো অংশের মানুষের দারিদ্র্য এই সংবেদনশীলতার কারণ। ২০০৮ সালে জলবায়ু পরিবর্তনকে সামনে রেখে ন্যাশনাল অ্যাকশন প্লান (কি পরকল্পনা নেওয়া যেতে পারে) এবং তার পরবর্তী সময়ে প্রায় সমস্ত রাজ্যস্তরীয় স্টেট অ্যাকশন প্লান গ্রহণ করে। কিন্তু তার পর ১৩ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও এই পরিকল্পনা পর্যালোচনা করা হয়নি। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের নতুন সমস্যা সামনে এসেছে। জাতীয় পরিকল্পনায় ৮টি মিশনের কথা বলা হয়। এগুলি হলো - কৃষি, বাসস্থান, শক্তি উৎপাদনে দক্ষতা বৃদ্ধি, অরণ্য সৃজন, হিমালয়ের বাস্তুতন্ত্র, সৌর শক্তি এবং এগুলির মোকাবিলা করতে গেলে কৌশলগত জ্ঞান বৃদ্ধি। বলাই বাহুল্য, যেসমস্ত পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল সেগুলির কোনোটাই লক্ষ্য পূরণের দিকে এগোয়নি। ২০১৪-তে বিজেপি সরকার আশার পর এগুলির কোনটাই আলোচনার মধ্যে নেই। যে যে কারণে এই পরিকল্পনা গুরুত্ব পায়নি সেগুলি হলো বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য অর্থ বিনিয়োগে সরকারি সদিচ্ছার অভাব এবং স্বচ্ছতার অভাব। এমনটা নয় যে, গড় তাপমাত্রার বৃদ্ধি মানে কলকাতায় যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি হবে দিল্লি এমন কি উত্তরবঙ্গে ততটা না হতে পারে।
পরিকল্পনাকে কার্যকর করতে বিজ্ঞানীরা বার বার যে যে চাহিদাগুলির কথা বলছেন সেগুলি হলো -
১। জলবায়ু সংক্রান্ত পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহে সরকারি অনীহা। এখন যা পাওয়া যায় তা হলো দেশ বা বড়োজোর রাজ্যস্তরীয় তথ্য। কিন্তু তার নিচে জেলা এমনকী গ্রামস্তরীয় তথ্য না থাকলে ক্লাইমেট মডেলিং করে ভবিষ্যতে কোনো এলাকাতে কি কি প্রভাব পড়তে পারে তা জানা যাবে না এবং সেই মতো প্রস্তুতিও নেওয়া যাবে না। গ্রামে, শহরে স্কুল কলেজের মাধ্যমে সাধারণ কয়েকটি পরিমাপ যেমন বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রার ওঠা নামা ইত্যাদির তথ্য সংগ্রহ করা যায়। মনে রাখতে হবে যে, জলবায়ুর ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের প্রভাব পড়তে পারে।
২। কেন্দ্রীয় সরকারের একটি মন্ত্রকের নামের সাথে ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ কথাটি যুক্ত হয়েছে মাত্র। কেন্দ্র, রাজ্য বা জেলা স্তরে এমন কোনো দপ্তর বা দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশিক্ষিত ব্যক্তি বা দল নেই যারা দীর্ঘ সময় ধরে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে এবং সংরক্ষণ করতে পারে। এই তথ্য থাকলে বিজ্ঞানীরা তার বিশ্লেষণ করতে পারেন।
৩। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবথেকে বড়ো প্রভাব পড়বে যে উৎপাদন ক্ষেত্রের উপর তা হলো কৃষি। এই ক্ষেত্রের সঙ্গে যারা যুক্ত সেই কৃষকদের লাগাতারভাবে পরিবর্তন সম্পর্কে অবহিত করা, কৃষি পরামর্শ দেওয়া এবং দরকার হলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অভিযোজনের জন্য নতুন চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা বা প্রস্তুতি সরকারের নেই।
৪। কম সময়ে অধিক বৃষ্টিপাতের কারণে গ্রাম এবং শহরাঞ্চলে যে সমস্যা হয় যেমন জল জমে যাওয়া, বন্যা, মশাবাহিত রোগের সমস্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি নিয়ে সরকারি ব্যবস্থা তাৎক্ষণিক। আগামী দিনে এই সমস্যা বাড়বে বই কমবে না। এব্যাপারে সরকারের প্রস্তুতি নেই বললে চলে।
বিশেষজ্ঞদের মত, ভারত সহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির রাষ্ট্র নায়করা অতিমারীর পরবর্তীকালে যদি দ্রুত, স্বতঃস্ফূর্ত এবং সক্রিয় উদ্যোগ না নেন তাহলে বিপদ আরও ঘনীভূত হবে। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবেশ দপ্তরের পারিষদরা প্রতিশ্রুতি দিয়ে খালাস। তাই আমরা যদি চুপ থাকি তা হলে পৃথিবী আরও রোগাক্রান্ত হবে।