৬০ বর্ষ ৫১ সংখ্যা / ৪ আগস্ট, ২০২৩ / ১৮ শ্রাবণ, ১৪৩০
গুরগাঁও থেকে মুম্বই দাঙ্গা ও বিদ্বেষের আগুন জ্বালাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী শক্তি
গুরগাঁওতে দোকানে আগুন।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল ও দুর্গা বাহিনী হরিয়ানাতে গত কয়েকদিন ধরে যে তীব্র সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে তার জেরে হরিয়ানার সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকা নুহ সহ পার্শ্ববর্তী গুরগাঁও, পলওয়াল ও ফরিদাবাদে ব্যাপক হিংসা ও হানাহানির ঘটনা ঘটেছে। এক ধর্মীয় শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত। কুখ্যাত বজরং দল নেতা মনু মানেসার যার বিরুদ্ধে রাজস্থানে নাসিম ও জুনায়েদ নামক দুই যুবককে গো রক্ষার নামে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার অভিযোগ রয়েছে, সেই ব্যক্তি এই ধর্মীয় শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করবেন বলে হিন্দুত্ববাদীদের তরফে পরিকল্পিতভাবে প্রচার চালানো হয়। অতীতেও সংখ্যালঘু নিবিড় নুহ এলাকায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ দুর্গাবাহিনী ধর্মীয় শোভাযাত্রা করেছে, কিন্তু কখনো সংখ্যালঘু মানুষের পক্ষ থেকে কোনো প্ররোচনা সৃষ্টি করা হয়নি। এ বছরে সাম্প্রদায়িক গোলযোগ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষ থেকে হিংসার জন্য উসকানি দেওয়া হয়েছে, যার নেতৃত্বে ছিল মনু মানেসারের অন্যতম সহযোগী বিট্টু বজরঙ্গি। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার ফলে এই হিংসা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলিতে ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে, যার জেরে স্বাভাবিক জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। হিংসাত্মক আক্রমণে মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে পাঁচ। দুজন হোমগার্ডকে দুষ্কৃতীরা গুলি করে হত্যা করেছে। অন্তত ১০ জন পুলিশ অফিসার জখম হয়েছেন। স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ যদি আগে থেকেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিত তাহলে এই ঘটনা ঘটত না।
সিপিআই(এম) পলিটব্যুরোর পক্ষ থেকে এক বার্তায় এই হিংসার ঘটনার তীব্র নিন্দা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, আসন্ন নির্বাচনের দিকে নজর রেখে শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তীব্রতর করার লক্ষ্যেই নুহতে হিংসা ছড়ানো হয়েছে। এর পাশাপাশি বিদ্বেষ ছড়ানো ভাড়াটে বাহিনীকে মদত জোগানো বন্ধ করে অবিলম্বে দোষীদের গ্রেপ্তার করার দাবি জানিয়েছে সিপিআই(এম)। সব থেকে উদ্বেগের বিষয় এই যে, হরিয়ানার মন্ত্রী অনিল বিজ গুজব ছড়িয়ে পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলেছেন। তিনি দাবি করেছিলেন যে, নলহার মহাদেব মন্দিরে কয়েক হাজার হিন্দু নর নারীকে মুসলমান দাঙ্গাবাজরা বন্দি করে রেখেছে। কিন্তু মন্দিরের প্রধান পুরোহিত এই মিথ্যে ফাঁস করে দিয়েছেন। রাজ্যের উপমুখ্যমন্ত্রী দুষ্মন্ত চৌতালা পুরো ঘটনায় প্রশাসনিক ব্যর্থতা স্বীকার করেছেন এবং তার সাথে হিন্দুত্ববাদীদের প্ররোচনামূলক ও ধ্বংসাত্মক ভূমিকার কথাও উল্লেখ করেছেন। হিন্দুত্ববাদী দুষ্কৃতীরা যে গুরগাঁওয়ের মসজিদে আগুন লাগিয়ে এক অল্প বয়সি ইমামকে খুন করেছে সে কথা তিনি জানান। কিন্তু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খাট্টার এই সমস্ত ঘটনায় সঙ্ঘ পরিবারের শাখা সংগঠনগুলি কুৎসিত ভূমিকার কথা স্বীকার না করে উলটে এই হিংসা ও বিশৃঙ্খলার পেছনে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন এবং হিংসার জন্য সংখ্যালঘুদেরই দায়ী করেছেন।
হরিয়ানার এই হিংসাত্মক পরিস্থিতির মধ্যে ২ আগস্ট মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খাট্টার সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেন, সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা পুলিশের পক্ষে সম্ভব নয়। খুন সহ বিভিন্ন অপরাধে মূল অভিযুক্ত বজরঙ দল নেতা মনু মানেসর সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না বলেও জানিয়েছেন।
হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী খাট্টারের এই বক্তব্যকে সরাসরি সমর্থন জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। তিনি এদিনই নবান্নে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁর প্রতিক্রিয়ায় জানান, ‘আই অ্যাপ্রিসিয়েট ইট’। অর্থাৎ হরিয়ানায় হিন্দুত্ববাদীদের তাণ্ডবের দায় নিতে না চাওয়া বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যকে তারিফ করেন তিনি!
হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য নিয়ে যখন গোটা দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে তখন তাৎপর্যপূর্ণভাবে কলকাতা থেকে তাঁর পাশে থাকার বার্তা দিলেন মমতা ব্যানার্জি! এর মধ্য দিয়ে মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে বিজেপি’র গোপন সখ্যের দিকটাই আবারও সামনে চলে এসেছে।
সারাদেশে যে ঘৃণার রাজনীতির চাষ করছে বিজেপি সহ সঙ্ঘ পরিবারের বিভিন্ন শাখা সংগঠন তার পরিণতিতে কখনো গুরগাঁওয়ের মতো শহরে হিংসার আগুন ছড়িয়ে পড়ছে, আবার কখনো নিরীহ মানুষ ট্রেন যাত্রার সময় কেবলমাত্র সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে নিহত হচ্ছেন। নুহ কিংবা গুরগাঁওয়ে যে তাণ্ডব চলেছে তার সাথে মুম্বাইগামী ট্রেনে আরপিএফ জওয়ান চেতন সিংয়ের হাতে তিনজন মুসলমান যাত্রী এবং একজন আদিবাসী আরপিএফ আধিকারিকের খুন হওয়ার ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা। উভয় ক্ষেত্রেই বিদ্বেষের রাজনীতির প্রভাবে সংখ্যালঘু মানুষের জীবন বিপন্ন হয়েছে।
সিপিআই(এম) পলিটব্যুরোর পক্ষ থেকে নরেন্দ্র মোদির সরকারকে সরাসরি দায়ী করে বলা হয়েছে যে, প্রতিনিয়ত যেভাবে ক্ষমতাশালীরা ঘৃণা ভাষণ দিয়ে মুসলিম সমাজকে হেয় প্রতিপন্ন করেন এবং সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির দ্বারা পরিচালিত হয়ে তাদের প্রতি বিভিন্ন অবমাননাকর ও অপমানজনক শব্দ ব্যবহার করেন, তারই প্রভাবে আরপিএফ-এর ওই কনস্টেবল সমগ্র মুসলিম সমাজের প্রতি বিদ্বেষমনোভাবাপন্ন হয়ে এই ঘৃণ্য অপরাধ ঘটিয়েছে। অভিযুক্ত জওয়ানকে কোনোভাবেই মানসিক অবসাদগ্রস্ত বলা যাবে না। যে ভিডিয়োটিতে তার কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে (যদিও ভিডিয়োটির সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি), সেখানে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, বিজেপি নেতাদের ভাষণের প্রতিফলন তার কথার মধ্যে রয়েছে। ভারতে থাকতে গেলে মুসলমানদের মোদি এবং যোগীকে ভোট দিতে হবে বলে স্পষ্ট ভাবে হুমকি দেওয়া হয়েছে ওই ভিডিয়োটিতে।
পলিটব্যুরোর পক্ষ থেকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, সুপ্রিম কোর্ট ঘৃণা ভাষণের বিপদ সম্পর্কে সতর্কবার্তা দেওয়ার পাশাপাশি এর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ইতিমধ্যেই নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু এই নির্দেশ পালন করার ক্ষেত্রে বর্তমান মোদি সরকারের অনীহা স্পষ্ট। অথচ গুরগাঁও থেকে মুম্বাই - একথা আবার প্রমাণিত হলো যে, সাম্প্রদায়িক প্রচার সমাজকে কি ভীষণ অস্থিরতার মধ্যে ঠেলে দিতে পারে এবং মানুষের জীবনকে নিমেষে বিপন্ন করে তুলতে পারে। যত লোকসভা নির্বাচন এগিয়ে আসছে,তত সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ তীব্রতর করার জন্য সংঘ পরিবারের চক্রান্ত বাড়ছে। হরিয়ানা ও মুম্বইয়ের ঘটনা এক অশনি সংকেত যা অগ্রাহ্য করলে দেশবাসীকে চরম মাশুল দিতে হবে।