E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৫১ সংখ্যা / ৪ আগস্ট, ২০২৩ / ১৮ শ্রাবণ, ১৪৩০

তৃণমূলের দুর্নীতির ঝাঁপি খুলেই চলেছে

চার্জশিটে নাম এলো ভাইপো সাংসদের


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্নীতির খবর যত প্রকাশ্যে আসছে ততই একটা বিষয় মানুষের কাছে পরিষ্কার হচ্ছে, কেলেঙ্কারিতে যুক্ত তৃণমূল কংগ্রেসের প্রথম প্রজন্মের নেতাদের নিখুঁত অনুসরণ করেই বেড়ে উঠছে পরবর্তী প্রজন্ম। অভিযুক্ত ভাইপো সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জি, কুন্তল ঘোষ, সায়নী ঘোষ হয়ে এই তালিকায় এখন নবতম সংযোজন বসিরহাটের অভিনেত্রী সাংসদ নুসরত জাহান। আর এই নিয়োগ দুর্নীতির প্রচুর মামলার জেরে বিস্মিত সুপ্রিম কোর্ট।

ভাইপো সাংসদ সস্ত্রীক দুবাই হয়ে আমেরিকা চলে যাওয়ার ঠিক পরেই নিয়োগ দুর্নীতির একটি চার্জশিটে উল্লিখিত হয়েছে তার নাম। খবরে প্রকাশ, ‘কালীঘাটের কাকু’ সুজয় কৃষ্ণ ভদ্র অভিষেকের ‘বার্তা’ পৌঁছে দিতেন প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যের কাছে। সে প্রসঙ্গে ঢোকার আগে তৃণমূল সাংসদ নুসরত জাহান কোন অভিযোগে অভিযুক্ত সেটা একটু দেখে নেওয়া যাক।

৯ বছর আগে অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মীদের থেকে রাজারহাটে হিডকোর জমি কিনে ফ্ল্যাট বানিয়ে দেওয়ার নাম করে কোটি কোটি টাকা তুলেছে সেভেন সেন্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রাইভেট লিমিটেড নামক একটি রিয়েল এস্টেট সংস্থা। ওই অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মীরা এখনও ফ্ল্যাট পান নি। ওই সংস্থা টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে অভিযোগ। প্রায় ২৪ কোটি টাকার প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। এই সংস্থার বোর্ড অফ ডিরেক্টরস-এর অন্যতম সদস্য ছিলেন তৃণমূল সাংসদ নুসরত জাহান। প্রতারিতরা কলকাতা পুলিশের গড়িয়াহাট থানায় লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। পুলিশ তদন্তে খুব একটা গা করে নি। এরপর আলিপুর আদালতে মামলা দায়ের হয়। আলিপুর আদালত লালবাজারকে তদন্তের সত্যতা খতিয়ে দেখতে বলার পর আদালতের নির্দেশেই পুলিশ সংস্থাটির অন্যতম অভিযুক্ত রাকেশ সিংকে গ্রেফতার করে। ইতিমধ্যে তার জামিন হয়ে গেছে। এই মামলায় নুসরত জাহান সহ অভিযুক্ত সংস্থার ৮জনকে আদালতে সশরীরে হাজিরার নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই নির্দেশ এড়িয়ে যান নুসরত জাহান। ওই প্রতারিত ব্যাংক কর্মচারীদের আরও অভিযোগ, যে টাকা অবসরপ্রাপ্তরা দিয়েছিলেন সেই টাকায় নুসরত জাহান সহ সংস্থার অভিযুক্তরা নিজেরাই ফ্ল্যাট কিনে নেন। নুসরত জাহান অবশ্য জানিয়েছেন তিনি ফ্ল্যাট কিনেছেন ওই রিয়েল এস্টেট সংস্থা থেকেই টাকা ‘ঋণ’ হিসেবে নিয়ে। নিজেরই ডাকা সাংবাদিক সম্মেলনে প্রতারণার নানা অভিযোগও এড়িয়ে গেছেন তিনি।

এদিকে নিয়োগ দুর্নীতির সাম্প্রতিক তথ্য চমকে দেবার মতো। নতুন কী অভিযোগ সামনে এসেছে তদন্তে? কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা ইডি তাদের চার্জশিটে উল্লেখ করেছে, নিয়োগ দুর্নীতির টাকা ঘুরপথে এবং সরাসরি ঢুকেছে মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জির পারিবারিক সংস্থায়। সুজয় কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে ‘কালীঘাটের কাকু’র মাধ্যমে সেই টাকা ঢুকেছে ব্যানার্জি পরিবারের পারিবারিক সংস্থা লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেড নামক সংস্থায়। যেখানে একসময় যুক্ত ছিলেন অভিষেক ব্যানার্জি এবং তাঁর স্ত্রী রুজিরা ব্যানার্জিও। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২১ সালের জানুয়ারির মধ্যে সেই টাকা ঢুকেছিল ব্যানার্জি পরিবারের ওই পারিবারিক সংস্থায়। এর আগে কয়লা পাচার কাণ্ডেও মানি লন্ডারিংয়ের তদন্তে এই লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেড নামক সংস্থায় কয়লা পাচারের টাকা ঢুকেছে বলে নির্দিষ্ট অভিযোগ এনেছিল ইডি। তিন দফায় কীভাবে ৯৫ লক্ষ টাকা স্রেফ ‘কনসালটেন্সি’র নামে সংস্থার আকাউন্টে বেমালুম ঢুকেছিল তা নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন তদন্তকারী আধিকারিকরা। সংবাদ মাধ্যমে আরও একটি অভিযোগ এসেছে জনৈক তৃণমূল শীর্ষনেতার রাশিয়ান বান্ধবীর অ্যাকাউন্টে নাকি এই দুর্নীতির টাকা ঢুকেছে।

২০১২ সালের ১৯ এপ্রিল এই লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেড নামক সংস্থায় বোর্ড অফ ডিরেক্টর্সের অন্যতম সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ‘কালীঘাটের কাকু’ও। অভিষেক ব্যানার্জির পদত্যাগের পর তিনিও ছেড়ে দেন বোর্ড অফ ডিরেক্টরস-এর পদ। তারপর ওই সংস্থারই কর্মচারী হয়ে যান। এখন অভিষেক ব্যানার্জির বাবা এবং মা এই সংস্থার অন্যতম দুই ডিরেক্টর।

কালীঘাটের কাকু সুজয় ভদ্র এই গোটা ঘটনায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় থেকেছেন আগাগোড়া, দুর্নীতির তদন্তে সুজয় ভদ্রের পাশাপাশি তারই দুটি সংস্থা এসডি কনসালটেন্সি প্রাইভেট এবং মেসার্স ওয়েলথ উইজার্ড প্রাইভেট লিমিটেড নামক সংস্থার বিরুদ্ধেও অতিরিক্ত চার্জশিট পেশ করেছে ইডি। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া অভিযোগ, কালীঘাটের তৃণমূলের দলীয় দপ্তরে বসে চাকরি বিক্রির চক্র চালাতেন এই সুজয় কৃষ্ণ ভদ্র। অভিষেক ঘনিষ্ঠ তৃণমূল নেতা কুন্তল ঘোষ, শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়, বেসরকারি কলেজ সংগঠনের নেতা তাপস মণ্ডল এদের সবাইকে নিয়ে মুখোমুখি বৈঠক হতো। তারপর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ‘বার্তা’ মানিক ভট্টাচার্যের কাছে নিয়ে যেতেন সুজয়। এই বার্তার মধ্যে ‘ভয়েস মেসেজ’ ছিল। সুজয় ভদ্রর কণ্ঠস্বরের নমুনা সংগ্রহের চেষ্টা করতেই তাঁর ‘অসুস্থতা’ লেগেই আছে।

কিন্তু এই সমস্ত ছাপিয়ে উঠে আসছে সুজয় ভদ্রর টিভি ক্যামেরার সামনে দেওয়া বয়ান। সেখানে তিনি বলেছিলেন তার ‘বস’ অভিষেক ব্যানার্জি। ২০ মে সিবিআই’র জিজ্ঞাসাবাদের পর বাইরে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সুজয় ভদ্র-যোগ সম্পর্কে পাশ কাটানো উত্তর দিয়েছিলেন অভিষেক ব্যানার্জি। তাই কালীঘাটের কাকু যেভাবে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমার বসকে কেউ ছুঁতে পারবেনা’, অভিষেকের বিদেশ যাত্রার প্রেক্ষিতে তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে, অভিষেক ব্যানার্জি আদৌ ফিরবেন তো?