৬০ বর্ষ ৫১ সংখ্যা / ৪ আগস্ট, ২০২৩ / ১৮ শ্রাবণ, ১৪৩০
বিইএফআই-এর একাদশ সম্মেলনের আহ্বান
দেশের ব্যাঙ্ক ব্যবস্থাকে লুটেরাদের হাত থেকে বাঁচাতে হবে
প্রদীপ বিশ্বাস
জনস্বার্থে দেশের ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা বজায় রাখতে চাই ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের আন্দোলনে দেশের সব অংশের জনসাধারণের সমর্থন। তাই ব্যাঙ্ক কর্মচারী আন্দোলনকে দেশের বৃহত্তর গণআন্দোলনের সাথে যুক্ত করার ডাক দিয়ে আগামী ১১ থেকে ১৪ আগস্ট তামিলনাড়ুর চেন্নাই শহরে হতে চলেছে বিইএফআই-এর একাদশ জাতীয় সম্মেলন। এই সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন সিআইটিইউ’র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তপন সেন। রাজ্যগুলো থেকে পাঁচ শতাধিক প্রতিনিধি ও দর্শক এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবে। সমস্ত শূন্যপদে নিয়োগ, নাবার্ডকে উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বজায় রাখা, গ্রামীণ ব্যাঙ্কের শেয়ার বিক্রির উদ্যোগ বন্ধ করা, প্রান্তিক মানুষদের প্রতি পরিষেবা বজায় রাখতে সমবায় ব্যাঙ্কগুলির ভূমিকা বজায় রাখা, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্বশাসনে হস্তক্ষেপ না করা, সমস্ত অস্থায়ী কর্মীদের স্থায়ীকরণ ইত্যাদি দাবির ভিত্তিতে দেশের ব্যাঙ্কব্যবস্থা ধান্দাবাজ পুঁজিপতিদের কব্জা থেকে রক্ষা করার স্বার্থে ভবিষ্যৎ আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি হবে এই জাতীয় সম্মেলনের মঞ্চ থেকে।
লুটেরাদের সাথে সমঝোতায় সরকারি শিলমোহর
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া ৮ জুন, ২০২৩ এক সারকুলার মারফত অনাদায়ী গ্রহীতাদের সাথে সমঝোতা করার জন্য বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির প্রতি এক নজিরবিহীন নির্দেশিকা জারি করেছে। এই নির্দেশিকা অনুযায়ী বৃহৎ ঋণগ্রহীতা, যারা ইচ্ছাকৃতভাবে বকেয়া শোধ করছে না বা ব্যাঙ্কের সঙ্গে জালিয়াতি করেছে তাদের সঙ্গেও ঋণদাতা ব্যাঙ্কগুলি সমঝোতা করতে পারবে। এই নিয়ে দেশব্যাপী হইচই শুরু হওয়ার পর রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে বলে যে, এই ধরনের সমঝোতা নতুন কিছু নয়, এটা একটা প্রচলিত পদ্ধতি। কিন্তু এই বক্তব্য সঠিক নয়। প্রচলিত নিয়ম, যদি এই ধরনের সমঝোতা করতে হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোকে পুনর্গঠন নামে কখনই পুনরায় ঋণ দেওয়া যাবে না। কিন্তু গত ৮ জুনের নির্দেশিকায় এই ধারা শিথিল করা হয়েছে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রাজনৈতিক চাপের কাছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ তার স্বশাসনের নীতিকে জলাঞ্জলি দিয়েছে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের ধান্দাবাজ পুঁজিপতিরা যাতে করপোরেট বন্ডের মাধ্যমে শাসকদলের নির্বাচনী তহবিল ভরাট করতে পারে তার জন্যই এই নজিরবিহীন নগ্ন পদক্ষেপ।
ইন্দ্রধনুষ
২০১৫ সালের ১৪ আগস্ট কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক ব্যাঙ্কশিল্পের আগামী অভিমুখ সম্পর্কে ইন্দ্রধনুষ দলিল প্রকাশ করে। এই দলিলের সুপারিশগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের প্রতি নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করা। ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকার সংসদে ইনসলভেন্সি অ্যান্ড ব্যাঙ্করাপট্সি কোড (আইবিসি) পেশ করে এবং তার আইনি রূপ দেয়। এই আইন বলে শুরু হয় অনাদায়ী ঋণগ্রহীতাদের ৭০ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ ছাড় দিয়ে বকেয়া ঋণের খাতা পুনর্গঠনের নামে সমঝোতা। এর পাশাপাশি চলতে থাকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির বাণিজ্যিক লাভের বিপুল পরিমাণ অংশ অনাদায়ী ঋণ খাতে বরাদ্দ করা। পরিণতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির বাণিজ্যিক লাভ হওয়া সত্ত্বেও বছরের পর বছর নিট লোকসান হয়। গত অর্থবর্ষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি মোট ২.০৯ লক্ষ কোটি টাকা বকেয়া ঋণগ্রহীতাদের ছাড় দিয়েছে এবং গত ৫ বছরে এই ধরনের মোট ছাড়ের পরিমাণ ১০.৫৭ লক্ষ কোটি টাকা (সূত্র - রিজার্ভ ব্যাঙ্ক)।
বেসরকারিকরণের উদ্যোগ
২০২১ সালে ১ ফেব্রুয়ারি বাজেট পেশ করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ২টি ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের প্রস্তাব পেশ করেন। কোন্ ২টি ব্যাঙ্ক বিক্রি করা হবে অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবে তা নির্দিষ্ট করা না হলেও সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, নীতি আয়োগের পক্ষ থেকে ২টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বিক্রির জন্য নির্দিষ্ট প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রকের কাছে পাঠানো হয়েছে। কোনো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বিক্রি করতে গেলে ব্যাঙ্কিং রেগুলেশন অ্যাক্ট ১৯৪৯, (ব্যাঙ্কিং কোম্পানিজ অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ট্রান্সফার অফ আন্ডারটেকিংস) অ্যাক্ট ১৯৭০ এবং ব্যাঙ্কিং কোম্পানিজ (অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ট্রান্সফার অফ আন্ডারটেকিংস) অ্যাক্ট ১৯৮০ এই ৩টি আইনের সংশোধন প্রয়োজন। এই লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই সংশোধনী প্রস্তাব লোকসভায় পেশ করার জন্য সভার আলোচ্যসূচিতে যুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু ইতিমধ্যে ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের জয় এবং ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের ধারাবাহিক সংগ্রামের চাপে এখনও পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার থমকে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও মাঝেমধ্যেই অর্থমন্ত্রী বিবৃতি দিচ্ছেন যে, ২টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বিক্রির কাজ যথাসময়েই সম্পন্ন করা হবে।
১৯৬৯ সালের ১৯ জুলাই তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকার দেশের ১৪টি বেসরকারি ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ করে। এটা ছিল প্রথম পর্বের ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ। দ্বিতীয় পর্বে ১৯৮০ সালের ১৫ এপ্রিল আরও ৬টি ব্যাঙ্কের জাতীয়করণ করা হয়। নয়া উদারবাদী আর্থিক নীতি চালু হওয়ার পর থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে এপর্যন্ত ব্যাঙ্কশিল্পের কর্মচারী এবং আধিকারিকরা ৭২ দিন দেশব্যাপী ধর্মঘটে শামিল হয়েছেন। এই আন্দোলনের চাপ এবং তার প্রতি দেশের বৃহত্তর গণতান্ত্রিক শক্তির সমর্থনের ফলে এখনও পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের কর্মসূচি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত করতে পারে নি। ১৯৯১ সালে নয়া আর্থিক নীতি চালু হওয়ার পর থেকে ব্যাঙ্ক শিল্পে সংস্কারের নামে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ আইন সংশোধন করে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলোতে সরকারি অংশীদারিত্ব ১০০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫১ শতাংশে নামিয়ে আনার বিধান দেওয়া হয়। সেই অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির শেয়ার বাজারে বিক্রি করা হয়েছে। শূন্য পদগুলিতে নতুন নিয়োগ হচ্ছে না। ব্যাপকহারে ব্যাঙ্কের নিয়মিত কাজ করার জন্য এজেন্সির মাধ্যমে চুক্তি প্রথায় নিয়োগ হচ্ছে। সংযুক্তিকরণের মধ্য দিয়ে বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সংখ্যা ২৭ থেকে কমিয়ে ১২ টি করা হয়েছে। ব্যাঙ্কগুলির এই বড়ো আকারের সংযুক্তির পরে গত ২০২০-২১, ২০২১-২২ অর্থবর্ষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির ৪৮৩৭ টি শাখা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে গ্রাহক পরিষেবার অবনতি হয়েছে।
দেশের ব্যাঙ্ক ব্যবস্থায় মোট আমানতের পরিমাণ ১৮১,১৪,৫৫০ কোটি টাকা (মার্চ ২০২৩)। এই টাকার সিংহভাগ সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত সঞ্চয়। ব্যাঙ্ক কর্মচারী আন্দোলনের দাবি ‘‘মানুষের সঞ্চয় মানুষের স্বার্থেই ব্যবহার করতে হবে।”