E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৫১ সংখ্যা / ৪ আগস্ট, ২০২৩ / ১৮ শ্রাবণ, ১৪৩০

মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা এবং কাকাবাবু

শংকর মুখার্জি


দেশে কমিউনিস্ট পার্টির কাজকর্ম শুরু হয়েছে তখন একদশকও হয়নি। পার্টির কাজকর্ম যে সারা দেশে বিরাটভাবে ছড়িয়ে পড়েছে তাও নয়। কিছুটা প্রভাব তৈরি হয়েছে কলকাতা, মাদ্রাজ, বোম্বাই, লাহোর, যুক্তপ্রদেশে শ্রমিকদের মধ্যে। তাতেই চিন্তিত ব্রিটিশ সামাজ্যবাদ, তারা রুশ বিপ্লবের অভিজ্ঞতায় কিছুটা আতঙ্কিতও। সময়টা গত শতাব্দীর বিশের দশক। এই ক্ষুদ্র সময়েই পার্টির বিরুদ্ধে তিন-তিনটে ষড়যন্ত্র মামলা। পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলা (১৯২২-২৩), কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা (১৯২৪) এবং মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা (১৯২৯)। উদ্দেশ্য একটাই, অঙ্কুরেই ধ্বংস করে দিতে হবে কমিউনিস্ট পার্টিকে।

পেশোয়ার এবং কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে সে কাজে সফল হলো না ভারত সরকার। পেশোয়ার মামলার খবর বাইরে প্রচার হোক সরকার তা চায়নি। তাই ইংরেজি দৈনিকগুলিতে এ সম্পর্কিত খবর খুব কম বেরিয়েছিল। তবে কানপুর ষড়যন্ত্র মামলার বিবরণ যাতে ফলাও করে প্রচার হয় তার ব্যবস্থা সরকার নিজেই করেছিল।লক্ষ্য ছিল, দেশের জনগণকে বোঝানো কমিউনিস্ট পার্টি কত বিপজ্জনক। কিন্তু বাস্তবে ফল হয়েছিল বিপরীত। কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা ব্যাপক প্রচার পেয়েছিল। এই মামলার ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে সম্পাদকীয় লিখেছিল কলকাতা থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’। কানপুর ষড়যন্ত্র মামলায় মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ (কাকাবাবু) সহ আটজন আসামি ছিলেন। গ্রেপ্তার হন মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ, শওকত উসমানী, শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে এবং নলিনী দাশগুপ্ত। এই চারজনেরই চার বছরের জেল হয়। কিন্তু কাকাবাবু যক্ষায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে ১৯২৫ সালের সেপ্টেম্বরে জেল থেকে ছাড়া পান। আসামিরা জেলে থাকা অবস্থায় ১৯২৫ সালের ডিসেম্বরে ভারতের কমিউনিস্টদের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ওই কানপুরেই। এই সম্মেলনেই তৈরি হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ায় কাকাবাবু এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন, এবং কমিটিতে নির্বাচিতও হয়েছিলেন। তাই বোঝা যাচ্ছে, পার্টি ছোটো হলেও, একেবারে বিনাশ করে দেওয়ার ব্রিটিশদের লক্ষ্য সফল হয়নি।

●   ●   ●

কানপুর ষড়যন্ত্র মামলার পর থেকে মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার আগে পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯২৫-২৯ এই সময়টা দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশের নানাস্থানে এই সময়ে ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজান্টস পার্টি গড়ে ওঠে। এই সকল পার্টিতে নেতৃত্বে ছিল কমিউনিস্টরা। বাংলায় এই পার্টি গড়ে ওঠে কানপুর সম্মেলনের আগেই, ১৯২৫ সালের নভেম্বর মাসে। প্রথমদিকে পার্টির নামটা সামান্য আলাদা ছিল। কবি নজরুল ইসলাম ছিলেন এই পার্টি প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম। এই পার্টি একটা সর্বভারতীয় রূপ পায় ১৯২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতার সম্মেলনে।

১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠা হয় ভারতের প্রথম সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন সারা ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (এআইটিইউসি।)। প্রতিষ্ঠার পর প্রথম কয়েক বছরে এআইটিইউসি-তে কমিউনিস্টরা খুব একটা জায়গা নিতে পারেননি। এআইটিইউসি-তে কমিউনিস্টরা বড়ো শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে ১৯২৭ সাল থেকে। ওই বছরেই শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে এআইটিইউসি’র সহ সম্পাদক নির্বাচিত হন। কোনো কমিউনিস্ট হিসেবে যা ছিল প্রথম। আবার অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটিতেও কমিউনিস্টদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। কমিউনিস্ট আর এস নিম্বকার বোম্বে প্রাদেশিক কমিটির সম্পাদক হয়ে যান। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছিল শ্রমিক আন্দোলনে। কলকাতা, বোম্বে প্রভৃতি শিল্পাঞ্চলগুলিতে শ্রমিক ও শ্রমিক আন্দোলনের ওপর কমিউনিস্টদের প্রভাব বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। কাকাবাবু এটাকেই মীরাট মামলা দায়েরের “মোক্ষম অজুহাত” হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।তাঁর কথায় “১৯২৭ সাল হতে, বিশেষকরে ১৯২৭ সালের শেষার্ধ হতে ভারতে মজুরদের তীব্র সংগ্রাম।পুরা ১৯২৮ সাল এই সংগ্রাম চলতে থাকে। বোম্বে ও বাংলায় মজুরদের এক-একটি ধর্মঘট চলে মাসের পর মাস। এই সকল সংগ্রামেই কমিউনিস্ট পার্টি ও ওয়ার্কার্স অ্যাণ্ড পেজান্টস পার্টি একান্তভাবে যোগ দেয়। তার ফলে ভারতের মজুর আন্দোলন সংগ্রামশীল রূপ ধারণ করে। তার আগে আন্দোলনের এই রূপ ছিল না। ১৯২৮ সালে বোম্বেতে সুতোকলের মজুরেরা বহু মাস ধর্মঘট করে থাকে, এই ধর্মঘটের পরিচালনার সঙ্গে কমিউনিস্টরা একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। ধর্মঘট শেষ হওয়ার পরে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে ‘গিরনি কামগার ইউনিয়ন’ গড়ে ওঠে।” প্রসঙ্গত, ১৯২৮ এবং ১৯২৯ সাল - এই দুবছরে সারা দেশে বিভিন্ন শিল্পে সম্মিলিতভবে ধর্মঘটী শ্রমিকের সংখ্যা ৫ লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। শ্রমদিবস নষ্টের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩ কোটি ১০ লক্ষ এবং ১ কোটি ১০ লক্ষ।

●   ●   ●

শ্রমিকদের এই সংগ্রামের মধ্যেই সরকার বিপদের আঁচ পেল। এই শ্রমিক আন্দোলন দমন করতে সরকার নিয়ে এল ‘পাবলিক সেফটি বিল’ (জন নিরাপত্তা বিল)। কেন্দ্রীয় আইনসভায় এই বিলের খসড়া পেশ হয় ১৯২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে। এই বিলের খসড়ায় এও লেখা ছিল, কোনো অ-ভারতীয় ব্রিটিশ প্রজা ভারতে রাষ্ট্রবিরোধী কাজে যুক্ত থাকলে তাকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হবে। খসড়ায় এই ধারার লক্ষ্য ছিল, ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা বেন ব্রাডলে এবং ফিলিপ স্প্রাট। তাঁরা সেসময়ে এদেশে থেকে দেশের শ্রমিক আন্দোলনকে সাহায্য করছিলেন।

মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।

১৯২৯ সালের ১৫ মার্চ মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে ভারত সরকার। এর কিছুদিন আগেই বড়লাট পাবলিক সেফটি বিলকে অর্ডিন্যান্স রূপে পাশ করিয়ে নেন। যদিও কংগ্রেস সেসময়ে পাবলিক সেফটি বিলের বিরোধিতা করেছিল। মোতিলাল নেহরু, বিঠলভাই প্যাটেলরা যাতে এই বিল পাশ না হয় তারজন্য আইনসভায় উদ্যোগ নিয়েছিলেন। শেষমেশ পাবলিক সেফটি বিল আইনসভায় আর পাশ হয়নি।

মীরাটের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যেদিন মামলা দায়ের করা হলো সেদিনই জারি হলো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। সবটাই গোপনে। ২০ মার্চ থেকে সারা দেশে গ্রেপ্তার শুরু হলো। এই মামলায় আসামি করা হয় ৩১ জনকে।এঁদের মধ্যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেন ১৩ জন এবং গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেন ২ জন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যরা হলেন মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ, এস. এ. ডাঙ্গে, এস. ভি. ঘাটে, শৌকত উসমানি, এস. এস. মিরাজকর, পি. সি. যোশী, গঙ্গাধর অধিকারী, অযোধ্যা প্রসাদ, আর. এস. নিম্বকর, শামসুল হুদা প্রমুখ। দুই ব্রিটিশ কমিউনিস্ট হলেন, বি. এফ. ব্রাডলে এবং ফিলিপ স্প্র্যাট। এছাড়াও ছিলেন একজন ব্রিটিশ সাংবাদিক, কমিউনিস্ট মতবাদকে সমর্থন করেন এমনজন এবং এমনকী কমিউনিস্ট বিরোধী কয়েকজনকেও গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ।

আগেই জেনেছি, কংগ্রেস আইনসভায় পাবলিক সেফটি বিলের বিরোধিতা করেছিল। সেই কারণের জন্যই মনে হয় মীরাট মামলার জন্য কংগ্রেস একটা ডিফেন্স কমিটি গড়ে। এই কমিটিতে মোতিলাল নেহরু, জওহরলাল নেহরু প্রমুখরা ছিলেন। তবে গান্ধীজি সংবাদপত্রে একটা বিবৃতি দিয়েছিলেন, সেটা আাসামিদের অনুকূলে একেবারেই ছিল না। প্রথম ডিফেন্স কমিটি আসামিদের হয়ে আদালতে গেলেও, পরে ডিফেন্স কমিটিই উঠে যায়।এবং কংগ্রেসের তরফ থেকে এ প্রস্তাবও আসামিদের দেওয়া হয়েছিল, তারা অপরাধ মেনে নিলে মামলা উঠে যাবে। তবে আসামিরা সে প্রস্তাব তৎক্ষণাৎ প্রত্যাখ্যান করেন।

●   ●   ●

কমিউনিস্ট বন্দিরা ঠিক করলেন তাঁরা নিজেরাই আদালতে নিজেদের কথা বলবেন। কাকাবাবু লিখছেনঃ “কমিউনিস্ট আসামীরা সুদীর্ঘ বিবৃতি দেবেন বলে স্থির করলেন, আর স্থির করলেন যে, এই বিবৃতি মারফতে তাঁরা দেশময় কমিউনিস্ট ভাবধারা প্রচার করবেন। তাতে তাঁদের সাজা বেশি হবে, না কম হবে, সে বিষয়ে তাঁরা ভাবলেন না। এইরকম বিবৃতিই কমিউনিস্টরা দিয়েছিলেন। দেশের সর্বত্র সংবাদপত্রে তাঁদের বিবৃতি স্থান পেয়েছিল। প্রত্যেক বন্দি পৃথক পৃথক বিবৃতি দিয়েছিলেন। উনিশ জন বন্দি একটি যুক্ত বিবৃতিও দিয়েছিলেন।”

এই যুক্ত বিবৃতিতে পৃথক পৃথক শিরোনামে আটটা ভাগ ছিল। ভাগগুলির শিরোনাম ছিলঃ আমাদের সমাজতন্ত্র, ধনবাদ, সোশ্যালিজম ও সোভিয়েত ইউনিয়ন, জাতীয় বিপ্লব, কৃষি সমস্য, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন, কৌশল এবং কমিউনিস্ট ও বুর্জোয়া সামাজিক ব্যবস্থাসমূহ।

১৯২৯ সালের ২০ মার্চ থেকে ১৯৩৩ সালের ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত - চার বছর মামলা চলে। সেশন কোর্ট মূল আসামি মুজফ্‌ফর আহ্‌মদকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অন্যান্যদের তিন থেকে বারো বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়। পরে এলাহাবাদ হাইকোর্টে আপিল করলে সবারই সাজা কমে যায়। কাকাবাবুর জেল হয় তিন বছর।

●   ●   ●

এই মামলায় কমিউনিস্টদের দোষী প্রমাণ করতে ভারত সরকার বিরাট টাকা ব্যয় করেছিল। তবে মামলায় সরকারের ঠিক কতো টাকা খরচ হয়েছিল সেটা এখনও জানা যায়নি। কাকাবাবুর মতে “কমপক্ষে ৪০ থেকে ৫০ লক্ষ টাকা এই মোকদ্দমার পেছনে গভর্নমেন্ট খরচ করেছিল”।

বিদেশেও এই মামলা তুলে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে ব্রিটিশ সরকারের ওপর চাপ এসেছিল। যারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, মীরাট মামলা তুলে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রামসে ম্যাকডোনাল্ডকে লেখা চিঠি।

সারা দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেপ্তার নিঃসন্দেহে পার্টির ওপর বিরাট ধাক্কা ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের এই আক্রমণ পার্টির কাজকর্মকে স্তব্ধ করে দিতে পারেনি। ১৯৩৩ সালের শেষদিকে আবার পার্টি পুনর্গঠনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কলকাতায় সারা দেশের কমিউনিস্টরা মিলিত হন। নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। পার্টির নতুন কর্মসূচি ও গঠনতন্ত্রের খসড়া রচনা করা হয়। তবে ভারত সরকার হাল ছেড়ে দেয়নি। মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা চলার সময়েই পার্টি কার্যত বেআইনিই ছিল। সেটাই আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার ঘোষণা করল ১৯৩৪ সালের ২৭ জুলাই। আবার শুরু হলো কমিউনিস্ট পার্টির নতুন লড়াই।

হাইকোর্টের রায় বেরোনোর পর এলাহাবাদ ও কানপুর জেলে রাখা হয় কাকাবাবুকে। সেখান থেকে তাঁকে বাংলার দার্জিলিং, বর্ধমান ও ফরিদপুর জেলে নিয়ে আসা হয়। ফরিদপুর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর কাকাবাবুকে বঙ্গীয় ফৌজদারি আইনে নিজের বাড়ি মুসাপুরে (সন্দ্বীপ) এবং এর পরে মেদিনীপুর জেলার সুতাহাটা থানায় সর্বমোট প্রায় বছরখানেক অন্তরীণ রাখে সরকার। শেষে ১৯৩৬ সালের ২৪ জুন কাকাবাবু মুক্তি পান।