৬০ বর্ষ ৫১ সংখ্যা / ৪ আগস্ট, ২০২৩ / ১৮ শ্রাবণ, ১৪৩০
অতিরিক্ত মুনাফার কারণে মুদ্রাস্ফীতি?
ভারতে বিশ্ব পুঁজিবাদের ছায়া
ঈশিতা মুখার্জি
বিশ্বজুড়ে মুদ্রাস্ফীতি। জিনিসপত্রের দাম ধরাছোঁয়ার বাইরে। উন্নত পুঁজিবাদী দেশ যেমন ব্রিটেন, ইয়োরোপ, মার্কিন যুক্তিরাষ্ট্র - সর্বত্র চোখে পড়ছে মুদ্রাস্ফীতি। ভারতে তো দিনে দিনে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। কেন বাড়ছে দাম? বিশ্ব পুঁজিবাদ তো সংকটে জরাজীর্ণ। কোভিডের আগে থেকেই এই সংকট চোখে পড়েছে। মুখ থুবড়ে পড়েছে নয়া উদারীকরণ। কোভিড এই মুখ থুবড়ে পড়া সকলের চোখের সামনে এনে দিয়েছিল। আমাদের দেশে নয়া উদারীকরণের ধাক্কায় রেকর্ড বেকারি, রেকর্ড দারিদ্র্য, রেকর্ড পরিযায়ী শ্রমিকের ঢল - এ সব কিছুতেই সাধারণ মানুষের চোখ সয়ে গেল। কিন্তু উন্নত পুঁজিবাদী দেশ সহ আমাদের দেশের শাসক গোষ্ঠী সম্পূর্ণ অস্বীকার করল পুঁজিবাদের সংকট। বাস্তব অর্থে নয়া উদারীকরণকে টিকিয়ে রাখতে সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ প্রকাশ্যে চলে এলো। তাই প্রকাশ্যে চলে এলো ক্রমাগত বেড়ে যাওয়া আর্থিক বৈষম্য। তাই প্রকাশ্যে চলে এলো হাতে গোনা মুষ্টিমেয় করপোরেট পুঁজিপতির দেশের চরম আর্থিক দুঃসময়ের মধ্যেও মারাত্মক রকম সম্পত্তি বৃদ্ধি পাওয়া। এখানেই রাজনৈতিক অর্থনীতির তাত্ত্বিকেরা ধন্দে আছেন এই পরিস্থিতিতে মুদ্রাস্ফীতির আসল কারণ কী? জিনিসপত্রের মূল্য এবং বাজারে দামের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করেছিলেন মার্কস। তথাকথিত অর্থনীতি জানিয়েছে যে, জিনিসপত্রের দাম বাড়তে পারে উৎপাদনের খরচ বাড়লে। উৎপাদনের খরচ এতই বাড়ছে যে, জিনিসপত্রের দাম বাধ্য হয়ে উৎপাদকেরা বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদনের খরচ বাড়ার সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্ক স্বাভাবিক। কিন্তু পুঁজিবাদের বর্তমান ব্যবস্থায় তো করপোরেট পুঁজির একাধিপত্য। এই অবস্থাতে মুদ্রাস্ফীতির কারণ কি বদলে যাবে?
এই প্রশ্ন উঠছে কারণ, এই মুদ্রাস্ফীতিতে শ্রমিক শ্রেণি যেভাবে আক্রান্ত, ঠিক ততটাই উৎফুল্ল করপোরেট পুঁজিপতি। শ্রমিক শ্রেণির মজুরি যে হারে কমেছে, তার চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে করপোরেটের মুনাফা। এই মুনাফা কি আপনা আপনি বেড়েছে, না তা জোর করে বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলেছে? অর্থনীতি সংকটে, ডুবন্ত অর্থনীতি থেকে যতটা পারা যায় মুনাফা গ্রাস করা - এটাই কি উৎপাদনের পদ্ধতি হয়ে দাঁড়িয়েছে? বিদেশি সাংবাদিকদের ভাষায় এই ধরনের ঘটনা হলো “গ্রিডফ্লেশন” বা লোভজনিত মুদ্রাস্ফীতি। মার্কিনি পত্রিকাগুলি একনাগাড়ে বলছে এই তত্ত্ব ভুয়ো। কিন্তু এই তত্ত্বের পক্ষে যুক্তি একটাই - মুনাফা, অতিরিক্ত মুনাফা কিন্তু বাস্তব। কোটিপতি করপোরেট গোষ্ঠী আরও কোটিপতি হয়েছে। ব্রিটেন সহ ইয়োরোপের দেশগুলিতে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে চলেছে। শ্রমিকশ্রেণির পক্ষে বেঁচে থাকা কষ্টকর হয়ে উঠেছে। ব্রিটেনে রান্নার গ্যাসের দাম বেড়েছে ১২৯শতাংশ এবং বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৬৭শতাংশ। ব্রিটেনে তেল কোম্পানির মুনাফা কিন্তু দ্বিগুণ হয়েছে। ক্ষুধা বেড়েছে বিশ্বে, কিন্তু বীজ কোম্পানির মুনাফা বেড়ে গেছে। তাই দক্ষিণপন্থীদের মুদ্রাস্ফীতির ব্যাখ্যা যে মজুরি এবং পণ্য উৎপাদনের খরচ বৃদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না তা স্পষ্ট। গোল্ডম্যান স্যাক্সের মতো সংস্থা জানিয়েছে যে, অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে শ্রমিকের মজুরির অংশ এক তৃতীয়াংশেরও কম; কিন্তু অতিরিক্ত মুনাফার অংশ ৫০শতাংশ । গোল্ডম্যান স্যাক্স কোনোমতেই শ্রমিক শ্রেণির মুখপাত্র নয়; কিন্তু হিসেব এইরকমই। অর্থাৎ করপোরেট শ্রেণির অতিরিক্ত মুনাফার লোভ এই অবস্থার জন্ম দিয়েছে। কীভাবে করপোরেট গোটা অর্থনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করলো?
নয়া উদারীকরণ তো করপোরেটের আধিপত্য বিস্তারের জন্ম দিয়েছে। আমাদের দেশেও করপোরেটের এই আধিপত্য তো চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে। দেশের প্রাকৃতিক থেকে সঞ্চিত সব সম্পদ কীভাবে দেশের সরকার আম্বানি-আদানির হাতে তুলে দিয়েছে, তার কথা আজ প্রকাশ্যে আলোচিত হচ্ছে। ভারতেও কোভিড অতিমারীর সুযোগ নিয়ে করপোরেটের মুনাফা কী পরিমাণে বেড়েছে এটা সকলের জানা তথ্য। করপোরেটের অতিরিক্ত লোভ, লালসা চরিতার্থ করার জন্যই দেশের সংকট মোকাবিলা করার কোনো চেষ্টা সরকার করেনি। আমাদের দেশেও সরকার কোনোভাবেই মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে নি। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য রিজার্ভ ব্যাংক বারে বারে সুদের হার পরিবর্তন করেছে। এর ফলে উৎপাদনের উপাদানের খরচজনিত যে মুদ্রাস্ফীতি তা কিছুটা কমা হয়ত সম্ভব ছিল। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতি যদি পুঁজিপতির অতিরিক্ত মুনাফা আহরণের লোভজনিত হয়, তাহলে এই নীতি মুদ্রাস্ফীতি কমাতে পারবে না। তাই ভারতেও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম প্রতিদিন বেড়েই চলেছে; কোনো অবস্থাতেই তা কমানো যাচ্ছে না। শ্রমজীবী মানুষের মজুরি এই দামের সাথে পাল্লা দিয়ে পেরে উঠছে না। কিন্তু অন্যদিকে কোটিপতির আয় বাড়ছে; কোটিপতির সংখ্যাও বাড়ছে এ দেশে। অতিরিক্ত মুনাফার লোভজনিত মুদ্রাস্ফীতির চেহারা এরকম হয়; তা বিশ্বের উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির বর্তমান চেহারা দেখে বোঝা যায়।আমাদের দেশের কোটিপতি করপোরেটের প্রকৃতি ভিন্ন হওয়ার কথা নয়; তাই একই ধরনের অর্থনৈতিক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। লেনিনের সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র ব্যাখ্যায় তো লগ্নিপুজির দাপট এবং একাধিপত্যের কথা বলাই আছে।একচেটিয়া পুঁজিপতির বদলে এখন আমাদের সামনে কয়েকটি বৃহৎ,অতি বৃহৎ পুঁজিপতির সমগ্র অর্থনীতির উপর নিয়ন্ত্রণ লক্ষ করা যায় - এই অলিগোপলি আজ সারা বিশ্ব জুড়ে পুঁজির বাজারে বিস্তৃত। তার কোনো রাষ্ট্রীয় চরিত্র নেই। এই পুঁজি নমনীয় - তা অতিরিক্ত মুনাফার খোঁজে যত্র তত্র বিশ্বে ঘুরে বেড়ায়। বিভিন্ন রাষ্ট্রকে তারা নিয়ন্ত্রণ করে অতিরিক্ত মুনাফা বজায় রাখার জন্য। আমাদের দেশে যেমন মোদিকে গদিতে টিকিয়ে রাখার জন্য আদানির আম্বানি প্রচেষ্টা আমরা দেখেছি। এই অতিরিক্ত মুনাফার লোভকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে লুঠেরা বা ধান্দার পুঁজিবাদ। দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি এর জন্যই সামলানো যাচ্ছে না। নির্বাচিত সরকারের সদিচ্ছা বা ক্ষমতা নেই এই ঊর্ধ্বমুখী দামকে নিয়ন্ত্রণ করার।