৬০ বর্ষ ৫১ সংখ্যা / ৪ আগস্ট, ২০২৩ / ১৮ শ্রাবণ, ১৪৩০
অভিন্নতা বনাম সম-অধিকার
বৃন্দা কারাত
মহিলাদের অধিকারের জন্য সমাজ সংস্কার আন্দোলনকে ঐতিহাসিকভাবে লড়াই করতে হয়েছে পুরুষদের প্রাপ্ত সুবিধাগুলির সাথে সমতা আনার জন্য এবং এই আন্দোলনকে একটা নির্দিষ্ট আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রতিটা পদক্ষেপ ফেলে সামনে দিকে এগোতে হয়েছে। এটা অনস্বীকার্য যে, এখনো বৈষম্য, পক্ষপাতিত্ব ও সাংস্কৃতিক পূর্বসংস্কারে আমাদের সমাজ জর্জরিত, তা সত্ত্বেও স্বাধীনতার পর পঁচাত্তর বছরে মহিলাদের অধিকারের জন্য আইনি কাঠামোর অবশ্যই যথেষ্ঠ উন্নতি হয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই যে, এখনো অনেক কিছু করার বাকি আছে। প্রশ্ন হলো, ভারতে ২০২৩ সালে দাঁড়িয়ে ওই লক্ষ্যে পৌঁছনোর সর্বোৎকৃষ্ট পথ কী?
‘এক দেশ এক আইন’ এই স্লোগানের মধ্যদিয়ে মোদি সরকার অভিন্ন দেওয়ানি বিধি-কেই পৃষ্ঠপোষণা করছে। ভারতের প্রেক্ষিতে এক আইন-ব্যবস্থার প্রচলনকে লিঙ্গ নিরপেক্ষ ন্যায় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সাথে সমতুল্য হিসেবে গণ্য করা যাবে না। সমস্ত সম্প্রদায়ের মহিলাদের সমানাধিকার - এই লক্ষ্যে পৌঁছতে সিপিআই(এম) দ্বিমুখী পথের কথা বলে। প্রথমটি হলো, বর্তমানে চালু ধর্মনিরপেক্ষ আইনগুলিকে শক্তিশালী ও সম্প্রসারিত করা যাতে তা সমস্ত সম্প্রদায়ের মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। দ্বিতীয়টি হলো, সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়গুলির পুরুষ ও মহিলা উভয় প্রতিনিধিদের সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে ব্যক্তিগত ও প্রথাগত আইনগুলির সংস্কারের অগ্রগতিকে সুনিশ্চিত করা। একই সম্প্রদায়ের মধ্যে মহিলাদের সমানাধিকারের জন্য যেমন, হিন্দু পুরুষ ও হিন্দু মহিলাদের মধ্যে, মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম মহিলাদের মধ্যে, উপজাতি পুরুষ ও উপজাতি মহিলাদের মধ্যে এবং একইভাবে আন্তঃসম্প্রদায়ের মধ্যে যেমন হিন্দু মুসলিম, উপজাতি,পারসি, খ্রিস্টান, শিখ প্রভৃতির মধ্যেও মহিলাদের সমানাধিকারের জন্য একে রূপান্তরিত করতে হবে। এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে, মোদি সরকার ২০১৬ সালে বিচারপতি বি. এস. চৌহানের নেতৃত্বে যে আইন কমিশন নিয়োগ করেছিল তারাও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার বিশ্লেষণ করে ২০১৮ সালে পারিবারিক আইনসমূহের সংস্কার শীর্ষক আলোচনাপত্রে ওই একই উপসংহারে উপনীত হয়েছিলেন।
আইন কমিশনের রায়
অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বিষয়টির প্রতি নজর দেওয়ার জন্য মোদি সরকারের পক্ষ থেকে আইন কমিশনের কাছে বিশেষভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ‘অপ্রয়োজনীয় এবং অনাকাঙ্ক্ষিত’ বলে আইন কমিশন অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পথকে দ্ব্যর্থহীনভাবে বাতিল করে। প্রথমত, বিশেষ বিবাহ আইন, গার্হস্থ্য হিংসা আইন এবং অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ আইনসমূহকে শক্তিশালী ও সম্প্রসারিত করার বিস্তারিত সুপারিশ করে আইন কমিশন। হিন্দু, মুসলিম (শিয়া ও সুন্নি উভয়ই), খ্রিস্টান, পারসি, শিখ, বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়ের প্রচলিত নানারকম ব্যক্তিগত ও প্রথাগত আইনসমূহের গভীর অধ্যয়নের পর বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, শিশুদের দায়িত্বভার, দত্তক, উত্তরাধিকার প্রভৃতি এধরনের বিষয়গুলিকে সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত আইনসমূহের পরিধির মধ্যে সংস্কারকে লক্ষ্য করার পক্ষে মত দেয় আইন কমিশন।
বহুধাবিস্তৃত পরামর্শ, আলোচনা ও ৭৫,৩১৮টি মতামত গ্রহণ করার পর এব্যাপারে সবচেয়ে উপযোগী একটা নীলনকশা তৈরি করে আইন কমিশন। সম আইন প্রণয়নের জন্য সমস্ত সম্প্রদায়ের মহিলাদের আন্দোলন এটাকে নিশ্চিতভাবেই আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। বর্তমান হিন্দু ব্যক্তিগত আইনগুলিতে হিন্দু মহিলারা যে নানারকম বৈষম্যের মুখোমুখি হচ্ছেন তার বিস্তারিত বিবরণ এই রিপোর্টে দেওয়া হয়েছে। শরিকানা সম্পর্কিত হিন্দু আইনের ধারণাকে অবলুপ্তির সুপারিশ করা হয় এই রিপোর্টে। ২০০৫ সালে এই আইনের সংস্কারের পরও এখনো তা বজায় রাখা মহিলাদের প্রতি অন্যায় বলে বর্ণনা করা হয়েছে। হিন্দু অবিভক্ত পরিবারের ধারণা অনুযায়ী করছাড় পাওয়ার যে ব্যবস্থা আছে তার অবলুপ্তিরও সুপারিশ করা হয়েছে। শুধুমাত্র মুসলিমদের জন্যই ব্যক্তিগত আইনে সংস্কার জরুরি - বিজেপি’র এই ভাষ্যকে আইন কমিশনের সুপারিশগুলি একেবারে অর্থহীন করে দিয়েছে। এই কারণেই কী আইন কমিশনের রিপোর্টকে ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মোদি সরকার দাবি করেছিল যে, তিন তালাকের বিরুদ্ধে আইন করে তারাই একমাত্র “আমাদের মুসলিম কন্যাদের” সাহায্যে কাজ করেছে। এই প্রসঙ্গে আইন কমিশনের রিপোর্ট মোদি সরকারের পক্ষে আরও অস্বস্তিকর, কেননা, সেখানে বলা হয়েছে, তিন তালাক কোনো অত্যাবশ্যকীয় ধর্মীয় আচার নয়, এই কারণ দর্শিয়ে একে বেআইনি করেছে সুপ্রিম কোর্ট। মোদি সরকারের আইনকে সরাসরি সমালোচনা না করেও আইন কমিশন বলেছে, গার্হস্থ্য হিংসা প্রতিরোধে দেওয়ানি আইনে যে ব্যবস্থা আছে, তা প্রয়োগ করে নির্যাতিত মুসলিম মহিলাদের সুরক্ষার বন্দোবস্ত করাটাই জরুরি। এটা এই কারণে বলা হয়েছে যে, মোদি সরকার যে আইন এনেছে তা মুসলিম মহিলাদের কোনো সুরাহা দিতে পারছে না - স্রেফ মুসলিম পুরুষদের জেলে পাঠানোর পথ তৈরি করেছে।
এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে, ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থকে চরিতার্থ করতেই মোদি সরকার অভিন্ন দেওয়ানি বিধির অ্যাজেন্ডাকে নির্ধারিত করেছে। ২০১৮ সালে সরকারকে দেওয়া আইন কমিশনের এই সম্পর্কিত মূল্যবান রিপোর্টটিকে তারা উপেক্ষা করেছে। কোনো আইন প্রণয়ন কিংবা ব্যক্তিগত আইনের সংস্কারের জন্য কোনো সম্প্রদায়ের সাথে আন্তরিক আলোচনা না করেই মোদি সরকার তার দ্বিতীয় দফার প্রায় পুরো সময়টা নষ্ট করল। মোদি সরকার অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে ২১তম আইন কমিশনের ওপর চাপ সৃষ্টি করার পরও তারা এটা বাতিল করে দেয়। সরকার সম্প্রতি বিচারপতি রিতু রাজ অয়স্থি’র সভাপতিত্বে ২২ তম আইন কমিশনকে নিয়োগ করেছে এবং কোনো কারণ ছাড়াই অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বিষয়টির ফের একবার পর্যালোচনার নির্দেশ দিয়েছে। অর্থাৎ আরেকবার মতামত জানতে চাওয়া হয়েছে। এটা জনগণের অর্থ ও সময়ের পরিষ্কার অপচয় এবং কমিশনকে তার নিজস্ব দায়িত্ব পালন ও অগ্রাধিকারসমূহ থেকে বিচ্যুত করা। আসলে মোদি সরকারের আমলেই এমনকী এধরনের অযৌক্তিক কাজকর্মও সম্ভব।
এই মধ্যবর্তী সময়ে, মহিলা সংরক্ষণ বিল, তথাকথিত সম্ভ্রম রক্ষা সম্পর্কিত অপরাধসমূহের বিরুদ্ধে আইন, বিবাহের সময় অর্জিত সমস্ত সম্পদের যৌথ মালিকানা আইন এবং বৈবাহিক ধর্ষণকে ফৌজদারি আইনের আওতায় আনার মতো বকেয়া সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ আইন যা প্রণয়নের দ্বারা সমস্ত মহিলাদের জন্য সমতাকে বৃদ্ধি করতে পারত সেগুলিকে মোদি সরকার হয় উপেক্ষা করেছে, নয়তো বাতিল করে দিয়েছে। মোদি সরকার তার প্রথম কিংবা দ্বিতীয় দফার শাসনে এখনো পর্যন্ত মহিলাদের উপকারে লাগে এমন একটাও আইন প্রণয়ন করেনি।
উপজাতিদের জন্য আইনি ব্যবস্থাকে খর্ব করা হচ্ছে
ভূপালে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার ব্যাপারে তাঁর সরকারের দৃঢ সংকল্পের কথা পুনরায় ঘোষণা করেছেন। আর যাঁরা এর বিরোধিতা করছেন, তাঁরা “তোষণের রাজনীতি” করছেন বলে তিনি অভিযুক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, “একটা বাড়িতে যদি একজনের জন্য একটা আইন এবং অন্যজনের জন্য আরেকটা আইন থাকে, তবে কি সেই বাড়িটা, সেই পরিবারটা চলতে পারে? তাহলে একটা দ্বৈত ব্যবস্থায় দেশ কী করে চলবে?” মোদি তাঁর বক্তব্যে বারবার “আমাদের মুসলিম কন্যারা” কথাটি বলার মধ্যদিয়ে তাঁর বোঝাপড়া অনুযায়ী এটা পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, “দ্বৈত” ব্যবস্থা উল্লেখের মধ্য দিয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত আইনগুলিকেই লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী কি অবগত নন যে, ভারতের সংবিধানই যা কীনা এই দ্বৈত ব্যবস্থার সুযোগ দিয়েছে। এটা ভারতের জন্য দুর্ভাগ্য যে, প্রধানমন্ত্রী ভারতকে সংবিধানের চোখ দিয়ে নয়, দেখছেন সঙ্ঘ পরিবারের রাজনৈতিক চোখ দিয়ে। এই কারণেই মোদি ইচ্ছা করে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁর সাম্প্রদায়িক বদ্ধ সংস্কারের বাইরেও, সামগ্রিকভাবে ভারতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হলে তার পরিণতি কী হবে তাকে উপেক্ষা করেছেন। আইন কমিশনের রিপোর্টে নির্দিষ্টকরে বিবৃত করা হয়েছে, “সংবিধানের ষষ্ঠ তফশিল অনুযায়ী এর (অভিন্ন দেওয়ানি বিধি) সম্পাদনযোগ্যতার সমস্যাগুলি প্রথমেই বোঝা যাচ্ছে।” ২৪৪ ধারার অধীনে ষষ্ঠ তফশিল যা ত্রিপুরা, অসম, মিজোরাম এবং মেঘালয়ের কিছু অঞ্চলে প্রযোজ্য। এই তফশিলের অধীনে সুনির্দিষ্টভাবে জেলা ও আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করে বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সম্পত্তির অধিকারের মতো পারিবারিক আইন সহ অন্যান্য বিষয়ে রাজ্যপালের অনুমতি নিয়ে আইন তৈরির অধিকার দেওয়া হয়েছে। এর সাথে সংবিধানের ৩৭১ এ, বি, সি, এফ, জি এবং এইচ ধারায় বিশেষ অধিকার ও ছাড় দেওয়া হয়েছে উত্তর পূর্ব ভারতের ছয় রাজ্যকে। যেমন, ধর্মীয় ও সামাজিক আচারসমূহ এবং প্রথাগত আইনে দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিচার প্রভৃতিকে সুরক্ষা দিতে ৩৭১ এ-তে নাগা সম্প্রদায়ের এবং ৩৭১ জি-তে মিজো সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। উত্তর পূর্ব ভারতের এই রাজ্যগুলিতে উপজাতি মানুষ এমনিতে বিভিন্ন বিষয়ে অসন্তুষ্ট রয়েছেন, যেমন আমরা এখন দেখছি মণিপুরের পার্বত্য অঞ্চলে। এইসব অঞ্চলে সাংবিধানিকভাবেই যে প্রথাগত আইন চালু আছে তাতে কোনো পরিবর্তন আনলে উপজাতি মানুষের মধ্যে তা প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে? পঞ্চম তফশিলে ‘পঞ্চায়েত এক্সটেনশন টু শিডিউল এরিয়াস অ্যাক্ট’ লাগু হওয়ার মধ্যদিয়ে গ্রামসভাগুলিকে এবং স্বশাসনের মধ্যদিয়ে প্রথাগত ও সামাজিক আচারগুলির সুরক্ষায় আইনি অধিকার দেওয়া হয়েছে। উদার আর্থিক নীতিসমূহের আক্রমণে পূর্ব ও মধ্য ভারতের আদিবাসী মানুষদের জীবনযাত্রা ইতিমধ্যে আক্রান্ত। এই নীতিই তাঁদের অরণ্য ও জমি কেড়ে নিচ্ছে। ভারতজুড়ে উপজাতি মানুষদের জন্য যে সাংবিধানিক ও আইনি ব্যবস্থা রয়েছে একটা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হলে তার সাথে ওই বিধির সরাসরি বিরোধ হবে।
প্রধানমন্ত্রী আপনি জবাব দিনঃ আপনি, আপনার সরকার এবং আপনার পার্টি কী এই দ্বৈত ব্যবস্থা, উপজাতি মানুষদের জন্য বর্তমান এই সাংবিধানিক ও আইনি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে? আপনি কী একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করে এই সুরক্ষাগুলিকে বাতিল করার দিকে অগ্রসর হচ্ছেন? কিংবা তাহলে কী অভিন্ন দেওয়ানি বিধি উপজাতি সম্প্রদায়গুলির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, শুধুমাত্র মুসলিমদের জন্যই এই বিধি হবে? প্রধানমন্ত্রীজি আপনি অবস্থান স্পষ্ট করুন।
বিজেপি’র দ্বৈত ভণ্ডামিঃ নাগাল্যান্ডের অভিজ্ঞতা
যখন প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপি নেতৃত্ব দেশের জন্য এক আইন - এই সমতার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বাগপটুতায় উচ্ছ্বসিত হয়েছেন তখন নাগাল্যান্ডে মহিলাদের অধিকার নিয়ে বিজেপি যে ভূমিকা পালন করেছে তা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে বিজেপি’র এইসব আচরণ ভণ্ডামিতে ভরা। ২০১২ সাল থেকে নাগাল্যান্ডে স্থানীয় সংস্থার কোনো নির্বাচন হচ্ছে না। কেন না বেশ কিছু নাগা গোষ্ঠী স্থানীয় সংস্থার নির্বাচনে এক তৃতীয়াংশ আসনে মহিলাদের সংরক্ষণের বিরুদ্ধে। তারা মহিলাদের এই সাংবিধানিক অধিকারের বিরুদ্ধে এই কারণে যে, এই সংরক্ষণ নাগা প্রথাগত আইনের অনুসারী নয়। সারা দেশের মহিলা সংগঠনগুলির সমর্থনে নাগা মহিলা সমিতির নেতৃত্বে নাগা মহিলারা স্থানীয় সংস্থার নির্বাচনে মহিলাদের সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছে। তাঁরা বলেছে, এটা একটা পুরুষ আধিপত্যবাদী ব্যাখ্যা এবং নাগা প্রথাগত আইনে এই ধরনের সংরক্ষণ সম্পর্কে কিছু বলা নেই। এই সম্পর্কিত একটি পিটিশন সুপ্রিম কোর্ট শুনেছে। এই প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে এফিডেভিট জমা না দেওয়ায় কোর্ট বিরক্তি সহকারে সরকারের সমালোচনা করেছে। প্রধানমন্ত্রী “মুসলিম কন্যাদের” জন্য কতো উদ্বিগ্ন কিন্তু সংরক্ষণের সাংবিধানিক অধিকার থেকে “নাগা কন্যারা” বঞ্চিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি সম্পূর্ণ নীরব। নির্বাচনের মধ্যদিয়ে যে নতুন সরকার নাগাল্যান্ডে গড়ে উঠেছে বিজেপি তার শরিক, উপমুখ্যমন্ত্রীও বিজেপি’র। নির্বাচনের পর এপ্রিল মাসে এই সরকার দ্বারা গৃহীত এক প্রস্তাবে স্থানীয় সংস্থার নির্বাচনে মহিলাদের জন্য এক তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণের অধিকারকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। বিজেপি রাজ্য সম্পাদক টেমজেম ইমনা সরকারের পক্ষে দাঁড়িয়ে বলেছে যে, উপজাতি সংস্থাগুলির সাথে আলোচনার জন্য আরও সময়ের দরকার। যখন বিজেপি’র পক্ষে এটা মানানসই তখন এই “দ্বৈত ব্যবস্থা” দারুণ, কিন্তু যখন একটা বিশেষ সম্প্রদায়কে লক্ষ্যবস্তু করা হবে, তখন বলা হবে এক আইনের কথা!
এই নাগাল্যান্ডের উদাহরণ কী প্রমাণ করে? প্রথমত, মহিলাদের অধিকারের জন্য অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’র তত্ত্বের প্রতি বিজেপি’র পৃষ্ঠপোষকতা চূড়ান্ত ভণ্ডামি ছাড়া কিছু নয়। ‘‘নাগা কন্যাদের” দাবি সত্ত্বেও এক তৃতীয়াংশ আসনে মহিলাদের সংরক্ষণকে অগ্রাহ্য করে নাগাল্যান্ডে মহিলাদের সাপেক্ষে পুরুষদের অধিকারের সমতাকে গ্রহণ করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, নাগাল্যান্ডে বিজেপি মৌলবাদীদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে, যারা কীনা প্রথাগত আইনের এক পিতৃতান্ত্রিক ব্যাখ্যা হাজির করেছে। তৃতীয়ত, এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, এর পরিবর্তনের জন্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলোচনা করাটা দরকারি, এর সাথে সবচেয়ে জরুরি হলো ওই সম্প্রদায়ের মহিলাদের সঙ্গে আলোচনা করা।
পারিবারিক আইন ছাড়াও সাংবিধানিক ব্যবস্থাদি যা উপজাতি সম্প্রদায়গুলিকে বিশেষ সুবিধা প্রদান করেছে তাকে সমর্থনের সাথেই সংস্কারের মধ্যদিয়ে সম্প্রদায়গুলিতে মহিলাদের জন্য সমানাধিকার সুনিশ্চিত করতে যাঁরা সম্প্রদায়গুলির অভ্যন্তরে কাজ করছেন সিপিআই(এম) তাঁদের কাজকে সমর্থন এবং পৃষ্ঠপোষকতা করে। বিতর্কটা প্রথাগত আইনের অবলুপ্তি করা নিয়ে নয়, তার সংস্কার করা নিয়ে।
ব্যক্তিগত আইনে সংস্কার
ব্যক্তিগত ও প্রথাগত আইনে সংস্কার জরুরিভিত্তিতে প্রয়োজন। কিন্তু এই বিজেপি দল এবং তার সরকারগুলি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদেরই সমর্থন করছে যারা ব্যক্তিগত আইনে যেকোনো ধরনের সংস্কারের বিরোধী। নাগাল্যান্ডের ঘটনায় তা দেখা গেল। এমনকী চার্চের সংস্কারের বিষয়েও বিজেপি তাদের পক্ষেই রয়েছে যারা রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। কিন্তু যখন মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রসঙ্গ আসে, তখন বিজেপি দল এবং তার সরকার আগ্রাসীভাবে ওই সম্প্রদায়কে লক্ষ্যবস্তু করে। বিজেপি’র এই কার্যকলাপ সংরক্ষণবাদী শক্তিগুলিকে সম্প্রদায়গুলির অভ্যন্তরে ধর্ম বিপদে পড়েছে এই বলে ধর্মের পতাকা তুলে যেকোনো ধরনের পরিবর্তনের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করার জায়গা করে দিচ্ছে। এটাও সত্য যে, বিজেপি’র সংখ্যাগরিষ্ঠবাদী রাজনৈতিক পরিকাঠামো সম্প্রদায়গুলির অভ্যন্তরের সংস্কারকদের আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরে মৌলবাদীরা মুসলিম মহিলাদের সংস্কারের দাবিকে প্রত্যাখ্যান করার সাথেই যুক্ত। আবার সেইসব রাজনৈতিক শক্তি যারা নিজেদের মুসলিমদের রাজনৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে চিহ্নিত করে তারাও সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে কখনও কথা বলে না, বরঞ্চ বিসদৃশভাবে বিজেপি’র মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী মতবাদকে ব্যবহার করে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষে অবস্থানকেই শক্তিশালী করে। এই ধরনের পশ্চাদমুখী অবস্থান শুধুমাত্র বিজেপি’র অভীষ্ট প্রচারকেই সাহায্য করছে।
সমস্ত সম্প্রদায়ের মহিলাদের সমানাধিকারের অতি বাস্তব ও জরুরি ইস্যুকে বিপথগামী করার বিভিন্ন প্রবণতার মোকাবিলা করা সামগ্রিকভাবে আরও জরুরি। মৌলবাদীদের সাথে কোনো আপস না করে সম্প্রদায়গুলির অভ্যন্তরে এমন কাঠামো গড়ে তুলতে হবে যা সংস্কারের প্রক্রিয়াকে আগে নিয়ে যাওয়াকে সুনিশ্চিত করে। সিপিআই(এম) এই প্রক্রিয়ার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। মুসলিম মহিলাসহ সমস্ত সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত আইনে মহিলা-বিরোধী আচার, রীতিগুলির অবসানের দাবিকে সমর্থন করে সিপিআই(এম)। এইসব আচার-রীতি ব্যক্তিগত আইনের মনুষ্য-নির্মিত ব্যাখ্যায় সৃষ্টি হয়েছে।
গোয়া দেওয়ানি বিধির উদাহরণ
বিজেপি গোয়া দেওয়ানি বিধি নিয়ে খুবই কথা বলছে। সম্প্রতি, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং উত্তরাখণ্ডে এক পাবলিক মিটিং-এ গোয়ায় অভিন্ন দেওয়ানি বিধির খসড়া রচনার উদ্যোগ নেওয়ার জন্য সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে প্রশ্ন তুলেছেনঃ ‘‘যদি গোয়ায় অভিন্ন দেওয়ানি বিধি হয়, তবে বাকি ভারতে তা হবে না কেন?’’ তাঁর এইরকম দাবি করার আগে সমস্ত বিষয়ে গভীর অধ্যয়ন দরকার ছিল। এটা ঘটনা যে, এই ধরনের কোড কেন ভালো কাজ করতে পারে না তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো এই গোয়া দেওয়ানি বিধি। সামগ্রিকভাবে, গোয়া কোডের কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ আইনগুলি প্রযোজ্য হচ্ছে এবং অন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি হলো বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পারিবারিক আইনগুলির সম্মিলিত রূপ, যেগুলি বৈষম্যমূলক। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ক্যাথলিকদের বিবাহ প্রমাণে পৃথক আইন রয়েছে এবং যারা চার্চে বিবাহ করবেন তারা দেওয়ানি বিধি অনুযায়ী বিবাহ বিচ্ছেদের যে সুযোগ রয়েছে তার আওতায় পড়বেন না। এই বিধিতে যেখানে মুসলিমরা বহুবিবাহ করতে পারবে না, সেখানে কিছু ক্ষেত্রে হিন্দু পুরুষদের দ্বিবিবাহে সম্মতি দেওয়া হয়েছে। গোয়া দেওয়ানি বিধিতে একটা পৃথক ধারা আছে যার শিরোনাম ‘‘দ্য জেনটেল হিন্দু কাস্টমস অ্যান্ড ইউজেস কোড’’। এতে যে সুযোগগুলি রাখা হয়েছে তা খুবই পশ্চাৎপদ। একজন হিন্দু মহিলা তাঁর ২৫ বছর বয়স হওয়ার আগে যদি শিশু জন্ম দিতে ব্যর্থ হন কিংবা তাঁর ৩০ বছর বয়স হওয়ার আগে একটা পুত্র সন্তান দিতে ব্যর্থ হন তাহলে তাঁর হিন্দু স্বামী দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে আসতে পারে। যদি একজন হিন্দু মহিলা পরকিয়া সম্পর্কিত ব্যভিচারে লিপ্ত হয় তাহলে এটা বিবাহ বিচ্ছেদের একটা কারণ হতে পারে, কিন্তু একই ঘটনা যদি হিন্দু পুরুষের ক্ষেত্রে ঘটে তবে সেটা বিবাহ বিচ্ছেদের কোনো কারণ হিসেবে গণ্য হবে না। গোয়া দেওয়ানি বিধিতে এইসব ব্যবস্থাদি থাকার জন্যই কী বিজেপি এই বিধিকে উদ্ধৃত করে? বিজেপি সে রাজ্যে সরকার চালাচ্ছে। তাহলে কেন এখনো সেখানে আইনে মহিলা-বিরোধী ব্যবস্থা বজায় রয়েছে। গোয়া বিধি দেখাচ্ছে যে, কখনো কখনো একটা আদর্শ আইনেও মহিলাদের অধিকারের সর্বনিম্ন সাধারণ দিকগুলিই শুধু প্রতিফলিত হয় এবং দ্বিতীয়ত গোয়া দেওয়ানি বিধিও ব্যক্তিগত আইনসমূহকেই বিবেচনায় নিয়েছে।
মহিলাদের বীরত্বপূর্ণ লড়াই, সমস্ত সম্প্রদায় এবং তাদের সংগঠনসমূহের যাঁরা তাঁদের নিজেদের সম্প্রদায়সহ সকল মহিলাদের সামাজিক ও আইনি সংস্কারের জন্য মহান আত্মত্যাগ করেছেন তাঁদের দ্বারা সিপিআই(এম) অনুপ্রাণিত হয়। অভিন্ন দেওয়ানি বিধির নামে সমাজের মেরুকরণ এবং আইনি সমানাধিকারের মতো মহিলাদের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলিকে সাম্প্রদায়িকীকরণ করার বিজেপি’র চেষ্টার বিরোধিতা করে সিপিআই(এম)। সিপিআই(এম)’র কাছে সম্প্রদায় নিরপেক্ষভাবে মহিলাদের সমানাধিকার হলো কেন্দ্রীয় বিষয়। অভিন্নতাকে কখনোই সমতার সাথে এক করা যায় না। ২১তম আইন কমিশনের রিপোর্টই মহিলাদের সমানাধিকারের আন্দোলনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভিত্তি তৈরি করতে পারে। ভারতের জনগণকে বিজেপি সরকারের অবশ্যই জানানো উচিত, কেন তারা এই রিপোর্টের ওপর আলোচনা প্রত্যাখ্যান করে চলেছে।