৬০ বর্ষ ৫১ সংখ্যা / ৪ আগস্ট, ২০২৩ / ১৮ শ্রাবণ, ১৪৩০
ভারতীয় দর্শন প্রসঙ্গে (বাইশ)
শ্রীদীপ ভট্টাচার্য
রবীন্দ্রনাথকে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি বলেও অভিহিত করা হয়। সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর সৃষ্টি পৃথিবীর বহু দেশে অনূদিত হয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা কিশোর পাঠ্য বিজ্ঞান রচনায় আগ্রহী করে তোলে। তিনি প্রকৃতির অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বের কথা অনুধাবন করতে চেষ্টা করেন, যা তাঁর সাহিত্যকর্মে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর উপন্যাস ও অন্য রচনাবলীতে প্রকাশিত হয়েছে। প্রকৃতির কার্যকারণ সম্পর্ক দিয়ে বাধা বিষয়টি রবীন্দ্রনাথের কাছে শেকলের মতো বিবেচিত হয়নি, তা কবির কাছে সঙ্গীতের ভাষায় ধরা দিয়েছে। ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ - এই শ্লোকের তিনি তীব্র বিরোধী ছিলেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন যে, শিল্পের উদ্দেশ্য হলো মানবতার চাহিদা পূরণ ও মানবতার উন্নয়নে অবদান রাখা। ১৯৩০ সালে তিনি সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন এবং তৎকালীন সময়ে সমাজতন্ত্রের সাফল্যকে তিনি প্রশংসা করেন।
● একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন, তিনি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যে আন্তর্জাতিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছিলেন। সমাজ, বিশেষকরে দরিদ্র মানুষের উন্নয়নে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তিনি শুধুমাত্র তুলেই ধরেননি, হাতে-কলমে এই কাজে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন।
মহাত্মা গান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮)
জাতীয় আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধী এখনও পর্যন্ত আমাদের দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী জননেতা। সুতরাং সবাই তাঁর উত্তরাধিকারের দাবিদার, এমনকী আরএসএস, যারা গান্ধী হত্যাকারী গডসের প্রশংসা করে চলেছে (এখনও) তারাও নিজেদের গান্ধী দর্শনের উত্তরাধিকারী হিসাবে দাবি করে। ইএমশএস নাম্বুদিরিপাদ, ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক বিশিষ্ট নেতা, তাঁর ‘‘মহাত্মা এবং মতবাদ’’ বইয়ে ভারতের জাতীয় আন্দোলনে গান্ধীর ভূমিকা ও তাঁর দর্শন নিয়ে চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন। গান্ধী সম্পর্কে ইএমএস-এর বিশ্লেষণ সকলের পড়া উচিত। মহাত্মা গান্ধীর বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলি চিহ্নিত করতে পারলে তাঁর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুধাবন করা কঠিন নয়। গান্ধীর দর্শনের প্রতিফলন ঘটেছে যে বৈশিষ্ট্যের মধ্যে, সেগুলি হলো -
(১) তাঁর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বস্তুবাদ-বিরোধী, তিনি বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি হিসাবে বস্তুবাদের বিরোধী ছিলেন, তিনি দর্শনের ক্ষেত্রে ছিলেন ভাববাদী, সমসাময়িক বিশ্বে জনপ্রিয় যুক্তিবাদী সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের পরিবর্তে রক্ষণশীল সনাতন ধর্মে আস্থাজ্ঞাপন করেছিলেন।
(২) তিনি সনাতন ধর্মে বিশ্বস্ত থেকেও কৃষক-শ্রমজীবী এবং সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের গণজাগরণে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। ভারতের গরিব মানুষের এক বিশাল অংশের মানুষ গান্ধীজির মধ্যে একজন রক্ষাকর্তা, যিনি তাদের মুক্তি দেবেন, তাঁকে খুঁজে পেয়েছিলেন।
(৩) তিনি বহু সংখ্যায় ও বহু ধরনের গণ-আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
(৪) কৃষক ছাড়াও গ্রামের অসংগঠিত গরিব মানুষের এক বিশাল অংশকে আন্দোলনে টেনে নিয়ে এসে জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে প্রকৃত পথে জাতীয় ও সমস্ত শ্রেণির আন্দোলনে পরিণত করা; তার মধ্য দিয়ে এই আন্দোলনের এক বড়ো দুর্বলতাকে দূর করার ক্ষেত্রে গান্ধীজির ভূমিকা প্রশংসাযোগ্য। তবে গ্রামের দরিদ্র মানুষ স্বাধীন শক্তি হিসাবে আন্দোলন গড়ে তুলছেন, তিনি ভীত ছিলেন এই ভাবনায়।
(৫) শ্রমিক, কৃষক সহ সমস্ত গরিব মানুষের ক্ষেত্রে গান্ধীজির কাজের যে ধারা ছিল, তা ভারতের পুঁজিপতি শ্রেণিকেই সাহায্য করেছিল। তাঁর কার্যধারার মূল মর্মবস্তু ছিল দুটি -
(১) সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে জনগণকে জাগ্রত করা;
(২) সেই জাগ্রত জনগণকে নিজেদের স্বেচ্ছাধীন গণআন্দোলন থেকে বিরত রাখা।
● গান্ধী বেদ-এর সম্মান করলেও তা ঈশ্বরের বাণী বলে স্বীকার করেননি। তিনি ধর্মীয় ভাষ্যগুলি বিশ্বাস করলেও এর অযৌক্তিক ও অনৈতিক ধারণাগুলির বিরোধিতা করেন। তিনি অস্পৃশ্যতার চরম বিরোধী ছিলেন এবং তাঁর মতো করে বর্ণবাদী ব্যবস্থার (caste system) পরিচ্ছন্ন সংস্করণের কথা ভেবেছিলেন। গোরু-উপাসনা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন যে, আমাদের প্রতিবেশীকে অস্পৃশ্য রেখে স্বাধীনতার দাবি অন্যায্য। গান্ধীর রাম চরিত্র ও রামায়ণের রামের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য।
গান্ধীর দর্শন ও তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে ইএমএস নাম্বুদিরিপাদের মূল্যায়ন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থিত হয়েছে। ইএমএস-এর মতে -
● দার্শনিক ভাবনায় গান্ধী ছিলেন একজন ভাববাদী। বস্তুবাদের বিরোধী হলেও তিনি সত্য, অহিংসা, আত্মত্যাগের মতো নৈতিক মূল্যবোধের পক্ষে এবং রাজনৈতিক মতাদর্শে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও শান্তির পূজারী ছিলেন। বর্ণবৈষম্য দূরীকরণ, নারী সমানাধিকার, ধর্মীয় সম্প্রীতি ইত্যাদি সামাজিক মূল্যবোধগুলি ব্যক্তিগত অনুশীলনের মধ্য দিয়ে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন।
● অনাড়ম্বর জীবনযাপন ও নৈতিক মূল্যবোধের অনুশীলন তাঁকে জনসাধারণের আরও নিকটে নিয়ে এসেছিল। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বুর্জোয়া শ্রেণি, যাদের সামন্ততন্ত্রের সাথে অতি-ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, তাদের শ্রেণিস্বার্থ বজায় রেখেই নেতৃত্ব দিয়েছিল। একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, মহাত্মা গান্ধীর উপস্থিতি সর্বস্তরের জনগণকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
● বর্তমান সময়ে হিন্দুত্ববাদী শক্তি যখন সমগ্র দেশে বিভাজনের রাজনীতির প্রসার ঘটাচ্ছে, ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার দিকে ভারতকে নিয়ে যেতে চাইছে, ধর্মের নামে ঘৃণার পরিবেশ তৈরি করতে তৎপর, যখন সাম্রাজ্যবাদী করপোরেট দুনিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করতে চাইছে, তখন গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধগুলির আন্তরিক অনুশীলন ও প্রসার গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলিকে অনেক সাহায্য করবে।
দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির দ্বন্দ্বঃ জাতীয় আন্দোলনে প্রতিফলিত
● ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যেও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য প্রতিফলিত হয়েছে।
(১) ভাববাদী দর্শনের দ্বারা পরিচালিত হলেও, জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে জাতীয় আন্দোলনের শক্তিশালী ধারা গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ ভারত গড়ে তুলতে প্রয়াসী ছিল।
(২) কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি ধারা গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক (অর্থাৎ শোষণহীন) ভারত গড়ে তুলতে প্রয়াসী ছিল। এই ধারা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দর্শনের দ্বারা পরিচালিত ছিল।
(৩) ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদীদের নেতৃত্বে একটি ধারা যারা রাষ্ট্রকে ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
স্বাধীন ভারত - বৃহৎ বুর্জোয়া-জমিদারির শাসন
● স্বাধীন ভারতে প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু (১৮৯০-১৯৬৪)-র ভাবনা ছিল যে, ভারতীয় দর্শন অতি প্রাকৃত ধারণা ও অলীক বিশ্বের ভাবনা থেকে মুক্ত হবে এবং দৃঢ়তার সাথে বাস্তবের মাটিতে উঠে দাঁড়াবে। তিনি মনে করতেন, ভারত বিজ্ঞানের বলে বলীয়ান হয়ে বাস্তব সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হবে। কুসংস্কার ও কূপমণ্ডুকতা থেকে মুক্ত হয়ে ‘বিজ্ঞান-মনস্কতা’ (Scientific temper) সমস্ত ভারতবাসীর মধ্যে গড়ে উঠবে। ইতিহাস পিছন দিকে হাঁটে না, তাই বৈদিক শাসন বা ইসলামি শাসনের যুগে ফিরে যাওয়ার আর কোনো প্রশ্ন নেই। সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা (দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দর্শনের উপর এই মতবাদ প্রতিষ্ঠিত) ও দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা নেহরু প্রভাবিত ছিলেন। যদিও ভারতে পুঁজিবাদের বিকাশ ধারায় তাঁর অবদান কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না।
ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ (১৮৮৮-১৯৭৫)
● ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ ছিলেন একজন প্রখ্যাত দার্শনিক। তিনি অদ্বৈত দর্শনের আদর্শে সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। উপনিষদের দর্শনের আদর্শের অনুসারী ছিলেন তিনি। তবে আধুনিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে ভারতের অগ্রগতি সম্ভব - একথা তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন। এই দেশে আধুনিক শিক্ষার একটি সুবিন্যস্ত ধারা প্রচলনের পক্ষে তিনি বলিষ্ঠ প্রবক্তা ছিলেন। উপনিষদ ও ভাববাদী দর্শনের অনুসারী হলেও বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ও গবেষণার সমর্থনে অবস্থান গ্রহণ করতে দর্শন তাঁর ক্ষেত্রে বাধা হয়নি।
● বৃহৎ বুর্জোয়ার নেতৃত্বে বুর্জোয়া জমিদার ভারত সরকার কখনও দেশের জনসাধারণকে বৈজ্ঞানিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেয়নি। জাতীয় আন্দোলনের ধারার মধ্যে বহু খ্যাতনামা বিজ্ঞানীদের আমরা পেয়েছিলাম। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন বসু, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ, সি ভি রমনের মতো বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের নাম প্রথমেই উচ্চারণ করতে হয়। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স, বোস ইন্সস্টিটিউট-এর মতো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছিল। কিন্তু জনগণের মধ্যে বিজ্ঞান মনস্কতার প্রসার ঘটানোর লক্ষ্যে এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সুফল জনগণের মধ্যে পৌঁছে দিতে কোনো কার্যকর ও ধারাবাহিক ব্যবস্থা ভারতের শাসকশ্রেণি গ্রহণ করতে পারেনি।
● উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ সহজসাধ্য করার জন্য যে স্পষ্ট বস্তুবাদী দর্শনের দ্বারা তাদের পরিচালিত হওয়া উচিত ছিল, সেখানে সীমাবদ্ধতা তৈরি করেছিল তাদের শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি। স্বাধীন ভারতে সামন্ততান্ত্রিক ভূমিব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়নি। কুসংস্কার যেমন ভারতীয় সমাজে বিরাজ করছে, ঠিক তেমনি কূপমণ্ডুক চিন্তা-চেতনা যথেষ্ট শক্তি নিয়ে ভারতীয় সমাজে তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বিষ্ময়কর অগ্রগতির যুগেও বৈজ্ঞানিক ভাবনার বিকাশে প্রধান বাধা হিসাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে বুর্জোয়া-জমিদার পরিচালিত শাসনব্যবস্থা।
(ক্রমশ)