৫৮ বর্ষ ১৬শ সংখ্যা / ৪ ডিসেম্বর ২০২০ / ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪২৭
২৬শে’র ধর্মঘটে ভারতের শ্রমিকশ্রেণির পক্ষে ছিল গোটা বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষ
ধর্মঘটের দিন বিশাখাপত্তনমে।
২৬ নভেম্বর দেশজুড়ে প্রায় সর্বত্র বন্ধ ছিল কলের চাকা। মোদী সরকারের বেহায়া কর্পোরেট-তোষণ এবং দেশের শ্রমজীবী তথা সাধারণ মানুষের ওপর যে নজিরবিহীন আক্রমণ নামিয়ে এনেছে - উভয়ের বিরুদ্ধেই প্রতিস্পর্ধী লড়াইয়ে আছে এদেশের শ্রমিকশ্রেণি; সেই লড়াইয়ে একটি উত্তরণ ঘটল ২৬শে’র সাধারণ ধর্মঘটের মধ্যে দিয়ে।
এ লড়াইয়ে ভারতের শ্রমিকশ্রেণি একা নয়, তার পাশে ছিল অন্যান্য দেশের শ্রমিকশ্রেণিও। দেশব্যাপী এই সাধারণ ধর্মঘটের প্রতি সংহতি জানিয়েছে বিশ্বের বহু দেশের ট্রেড ইউনিয়ন, যাদের মধ্যে অনেকেই হলো ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ ট্রেড ইউনিয়নসের সংগঠক-সংগঠন। সংহতি জানিয়ে লিখিত বক্তব্য জানিয়েছে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ ট্রেড ইউনিয়নস এবং তার মহাসচিব জর্জ ম্যাভরিকস নিজের ফেসবুকে লিখেছেন একটি উদ্দীপক বার্তা।
প্যান-সাইপ্রাস ফেডারেশন অফ লেবার (পিইও) ভারতের শ্রমিকদের প্রতি শ্রেণি-সংহতি জানিয়ে ধর্মঘটকে সমর্থন করে এক বার্তায় বলেছেঃ ‘‘একটা ঐক্যের মেজাজে, বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই (প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র) মোদী সরকারের নয়া-উদারবাদী নীতিগুলির বিরুদ্ধে ব্যাপক চেহারায় জঙ্গি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, গণজমায়েতের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে ভারতের শ্রমিকশ্রেণি। ভারতের জনগণের বেকারত্ব, গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকা দুর্দশা, ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিকদের অধিকারের ওপর আক্রমণ; বিদ্যুৎ, কয়লা, ব্যাঙ্ক, যোগাযোগ, রেলওয়ের মতো ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ - এই সমস্ত কিছুর কারণ যে শ্রমিকবিরোধী, কৃষকবিরোধী, জনবিরোধী নীতিগুলি তার বিরুদ্ধে ধারাবাহিক লড়াই চালাচ্ছে ভারতের শ্রমিকশ্রেণি। আর সেই লড়াইগুলির ধারাবাহিকতাতেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই ধর্মঘট।’’ তারা আরও বলেছে, আজকে পুঁজিবাদের অব্যাহত গতির কারণে বিশ্বজুড়েই শ্রমজীবী মানুষের সামনে তৈরি হচ্ছে বেকারত্ব, দারিদ্র্য, অভিবাসন ও সামাজিক অসাম্যের সমস্যাগুলি। বিশ্ব মহামারীর প্রকোপে গোটা বিশ্ব যখন জর্জরিত, তখন বৃহৎ পুঁজি ও নয়া-উদারবাদী নীতির প্রবক্তারা এই সঙ্কটকে শ্রমজীবী মানুষের ঘাড়ে চালান করে দেওয়ার লক্ষ্যে চেষ্টা চালাচ্ছে বলে তারা একইসাথে জানিয়েছে। এর বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষের একমাত্র উপায় শ্রেণিসংগ্রামের পথে হাঁটা এবং এই লড়াইয়ে সাইপ্রাসের শ্রমিকশ্রেণির সমর্থন ও সংহতি আপনারা সর্বদা পাবেন। পিইও বিবৃতি দিয়েছেঃ ‘‘শ্রমিকবিরোধী লেবার কোড প্রত্যাহার করা, অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলির বেসরকারিকরণ বন্ধ করা, ন্যূনতম বেতন ও পেনশনের, প্রতিটি পরিবারের জন্য ন্যূনতম নিশ্চিত সহায়তা, ভদ্রস্থ আয় ও খাদ্যের পক্ষে আপনাদের যে যে দাবি আছে - সেইগুলি আমরা সর্বান্তকরণে সমর্থন করি। ট্রেড ইউনিয়নগুলির আন্তর্জাতিক সংগঠন, আমরা যার শাখা, ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ ট্রেড ইউনিয়নসের সৈনিক হিসাবে আমাদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমরা একসাথে কাজ করছি একটি সুন্দর পৃথিবীর জন্য, যেখানে অসাম্য ও শোষণ থাকবে না। আমরা আপনাদের সাথে কণ্ঠ মেলাচ্ছি এবং আপনাদের লড়াইগুলির সর্বাঙ্গীণ সাফল্য কামনা করছি।’’
ধর্মঘটের অনতিপূর্বে ফেসবুক পোস্টে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ ট্রেড ইউনিয়নসের মহাসচিব বলেছেনঃ ‘‘দুনিয়ার সর্বহারা শ্রেণি ঐক্যবদ্ধ হও! গত জানুয়ারিতেই ভারতের শ্রমজীবী মানুষ একটি বিশাল ধর্মঘট পালন করেছিলেন। ২৫কোটি শ্রমিক রাস্তায় নেমেছিলেন। এখন তাঁরা ২৬ নভেম্বরে আরও একটি বড়ো মাপের ধর্মঘটের প্রস্তুতিতে। আমার ব্যক্তিগত ভাবনা বলছে, এটা একটি ব্যাপক চেহারার প্রতিরোধী ধর্মঘট হতে চলেছে। ভারতে আমাদের যত নেতা আছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই ধর্মঘটের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে প্রথম সারিতে থাকছেন। তাঁরা দিন-রাত কাজ করছেন। বিশাল মাপের একটি নতুন সর্বভারতীয় ধর্মঘটের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাঁদের বিজয় আমাদের সকলের পক্ষে একটি জয়। এই পৃথিবীর প্রতিটি কোণায় আশা সঞ্চার করবে ও উৎসাহ জোগাবে তাঁদের বিজয়। আসুন, ওঁদের সমর্থন করি! এই লড়াইয়ে কাউকে একা বোধ করতে দেব না!’’
গ্রিস, শ্রীলঙ্কা, ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া, নেপাল, মরক্কো, সেনেগাল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, রাশিয়া, লিবিয়া, লেবানন, পেরু ও বাংলাদেশ - এই সমস্ত দেশের যে যে ট্রেড ইউনিয়ন ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ ট্রেড ইউনিয়নসের অন্তর্ভুক্ত, প্রত্যেকেই ভারতের শ্রমিকশ্রেণির প্রতি তাদের সংহতি জানিয়েছে।
তুর্কির জমি, বিমানপথ ও রেলপথের শ্রমিকদের সংগঠন ট্রেড ইউনিয়ন অফ রেভেলিউশনারি ওয়ার্কার্স জানিয়েছেঃ ‘‘ডব্লিউএফটিইউ’র জঙ্গি সদস্য সংগঠনগুলির নেতৃত্বে ২৬ নভেম্বর ভারতের শ্রমিকশ্রেণি যে বিশাল ধর্মঘট পালন করবে, তার সংহতিতে সেইদিন ইস্তাম্বুলে ভারতীয় দূতাবাসের সামনে কর্মসূচি পালন করা হবে। আমরা ভারতীয় দূতাবাসের হাতে একটি চিঠিও তুলে দেব যেখানে বলা হবে, ভারতের শ্রমিকশ্রেণি ও তাদের ন্যায্য দাবিগুলির প্রতি আমরা দৃঢ়ভাবে অবস্থান করছি।’’
কনফেডারেশন অফ কংগ্রেস অফ ইন্দোনেশিয়া ইউনিয়নস অ্যালায়েন্স (কাসবি) ভারতের শ্রমজীবী মানুষের প্রতি সংহতি ও দৃঢ় সমর্থন জানিয়েছে। তারা বলেছেঃ ‘‘আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এই সাধারণ ধর্মঘট হবে ভারতের শ্রমিকআন্দোলনের ইতিহাসে, বিশ্বের শ্রমিকআন্দোলনের ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জ্বল মুহূর্ত। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, পুঁজিবাদ ও নয়া-উদারবাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় শ্রমিকদের সাহসী ও জঙ্গি আন্দোলন গোটা বিশ্বকেই উৎসাহ জোগাবে।’’
সর্বভারতীয় ধর্মঘটের প্রতি ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ ট্রেড ইউনিয়নস-এর পক্ষ থেকে সংহতিজ্ঞাপন
২৫ নভেম্বর, ডব্লিউএফটিইউ একটি বিবৃতি জারি করেছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, তারা লক্ষ করছে - গত ৬ বছর ধরে মোদী সরকার যে সমস্ত নীতি কার্যকর করেছে সেইগুলি দেশের শ্রমিক, কৃষক ও সাধারণ মানুষের অধিকারগুলিকে ধ্বংস করেছে ও জীবনযাত্রার মানকে সঙ্কুচিত করেছে।
পুঁজিপতিদের নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে ভারতীয় বুর্জোয়াশ্রেণি নিজেদের অবস্থানকে মজবুত করতে যে সমস্ত সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে শ্রমশক্তির গুরুত্ব আরও হ্রাস করা, রাষ্ট্রের সহায়তা কর্মসূচি ও পেনশন ব্যবস্থা সঙ্কুচিত করা, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ও অন্যান্য ক্ষেত্রগুলির বেসরকারিকরণ করা ও সেইগুলিকে কর্পোরেটে পরিণত করা, শ্রম ও কৃষির ক্ষেত্রে আইন ও কোডগুলির প্রতিক্রিয়াশীল পরিবর্তন করা। আরও বলার বিষয় হলো, বিশ্ব মহামারীর আঘাত থেকে জনগণের বিভিন্ন অংশকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে ভারত সরকারের যে সম্পূর্ণ উদাসীন মনোভাব, তা বেকারি, ক্ষুধা ও দুর্দশাগ্রস্ত সাধারণ মানুষের পক্ষে একটি দমবন্ধ করা পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
গ্রেপ্তার হওয়া ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী ও নেতৃত্বের সকলকে মুক্তির দাবি জানিয়েছে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন। সর্বভারতীয় ধর্মঘটের প্রস্তুতি পর্বে ক্ষেত্রীয় ও আঞ্চলিক স্তরে অসংখ্য কর্মসূচি চলাকালীন কমপক্ষে ৫০জন ট্রেড ইউনিয়ন নেতাকে যে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, ফেডারেশন একইসাথে তারও নিন্দা করেছে। এই ধর্মঘটকে বানচাল করার জন্য মোদী সরকারের অন্তর্ঘাত কোনো কাজে আসবে না বলেও তারা জানিয়েছিল। ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার ও স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার পক্ষে প্ররোচনা সৃষ্টি বন্ধ করার জন্য তারা দাবি জানিয়েছে।
বিশ্বজুড়ে শ্রমজীবী মানুষের লড়াই-সংগ্রামের প্রতি ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ ট্রেড ইউনিয়নসের নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন জানানোর অংশ হিসাবেই তারা আন্তর্জাতিক সৌভ্রাতৃত্ব জ্ঞাপন করেছে ২৬ নভেম্বরের দেশব্যাপী এই ধর্মঘটের প্রতি। ভারত সরকারের শ্রমিকবিরোধী, কৃষকবিরোধী, দেশবিরোধী নীতিগুলির বিরুদ্ধে যে প্রতিস্পর্ধী দাবিগুলিকে উত্থাপন করা হয়েছে, তাদের প্রত্যেকটিকে তারা সমর্থন করেছে।