E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ১৬শ সংখ্যা / ৪ ডিসেম্বর ২০২০ / ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪২৭

ভিন্নমতের পরিসর সম্পর্কে সহিষ্ণুতার নজির গড়ল কেরালা সরকার

ভিন্‌ধর্মে বিবাহ রুখতে আইন নিয়ে অনড় বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ দেশে ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষার প্রশ্নে বামপন্থীরা যে মতাদর্শগতভাবে চিরকাল অগ্রণী তা আবার প্রমাণ করল কেরালার পিনারাই বিজয়নের নেতৃত্বাধীন এলডিএফ সরকার। এই প্রশ্নে তারা পিছনে ফেলল বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলিকে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রশ্নে দেশের দু’টি রাজ্যের সাম্প্রতিক দুটি ঘটনা গত দু-এক সপ্তাহ ধরে সংবাদমাধ্যমের অন্যতম শিরোনাম। প্রথমটি হলো কেরালার সাম্প্রতিক পুলিশ আইন ১১৮এ সংশোধন সংক্রান্ত অর্ডিন্যান্স প্রত্যাহার এবং অপরটি হলো উত্তরপ্রদেশের ভিন ধর্মে বিবাহ রদ করতে আনা আইন। সম্প্রতি ‘লাভ-জিহাদ’ এর মতো বিধি বহির্ভূত শব্দ উচ্চারণ করে যেভাবে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানার মতো রাজ্য সরকারের প্রধানরা সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে ব্যবহার করতে চাইছে, এই আইন তারই হাতিয়ার। দেশের ব্যাপক অংশের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও আরএসএস-এর এই রাজনৈতিক কর্মসূচি সফল করতে উত্তরপ্রদেশের সঙ্গে মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানার রাজ্য সরকারগুলির এক রা। এ প্রসঙ্গে কোনোরকম ভিন্ন মতকে প্রশ্রয় দিতে নারাজ তারা। আইন নিয়ে বিরোধী মত শুনতে বিধানসভায় আলোচনায় বসার মতো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যেও যেতে চায় না এই সরকারগুলি। যদিও আদালতের রায়ে প্রশ্ন উঠছে আইনের সারবত্তা নিয়ে।

কেরালার আইন পরিবর্তন প্রসঙ্গে এলডিএফ সরকারের ভূমিকা ইতিবাচক। রাজ্যপাল কর্তৃক অর্ডিন্যান্স জারির পরের দিন ২৩ নভেম্বর কেরালার মুখ্যমন্ত্রী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন কেরালা পুলিশ আইন ১১৮এ (২০১১) সংশোধন কার্যকর করা হবে না কারণ এ প্রসঙ্গে রাজ্যের এবং দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে বিভিন্ন ধরনের মতামত আসছে। সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি জানিয়েছেন, এই আইনটি কেরালার সরকারের পক্ষ থেকে বাতিল করা হয়েছে। তিনি বলেন, পার্টির পক্ষ থেকে কেরালা সরকারকে আইন পুনর্বিবেচনা করার কথা বলা হয়েছিল।

এই আইনের সংশোধনের প্রেক্ষিত সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের বক্তব্যে উঠে এসেছে সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে মানহানিকর মিথ্যা এবং কুরুচিকর প্রচারে বিরুদ্ধে সমালোচনা এবং অভিযোগ আসার কথা। উঠে আসে ইউটিউব চ্যানেল ব্যবহার করে মহিলা এবং রূপান্তরকামীদের বিরুদ্ধে ক্ষমার অযোগ্য আক্রমণের প্রসঙ্গ।

তিনি জানান, বেশ কিছু এ ধরনের ঘটনার প্রেক্ষিতে পরিবার থেকে কোনও কোনও সদস্যকে বের করে দেওয়া হয় এবং কিছু ক্ষেত্রে ঘটনার শিকার মানুষেরা এমনকি আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছে। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌছেছে যে বেশ কিছু মিডিয়ার প্রধান সহ বহু মানুষ এই ধরনের হেনস্থার বিরুদ্ধে আইনি পথ প্রণয়নের দাবি করেন। এই সমস্ত প্রেক্ষিতে পুরনো পুলিশ আইনে সংশোধন আনার বিষয়টি বিবেচিত হয়, কারও কণ্ঠরোধের জন্য নয়।

আইনে সংশোধনী আনার কথা ঘোষিত হবার পর অনেকেই যাদের মধ্যে বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টকে সমর্থন করেন এমন মানুষ সহ যারা গণতন্ত্র রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তাঁরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সামগ্রিকভাবে বিষয়সমুহ পর্যালোচনা করে সরকার দ্রুত স্থির করে যে এই পরিস্থিতিতে আইনে প্রস্তাবিত সংশোধনী কার্যকর করা হবে না। বিধানসভায় পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করার পরই এবং সর্বস্তর থেকেই মতামত শোনার পর পরবর্তী পদক্ষেপ করা হবে।

কেরালার আইন পরিবর্তন প্রসঙ্গে এলডিএফ সরকারের ভূমিকা ইতিবাচক। রাজ্যপাল কর্তৃক অর্ডিন্যান্স জারির পরের দিন ২৩ নভেম্বর কেরালার মুখ্যমন্ত্রী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন কেরালা পুলিশ আইন ১১৮এ (২০১১) সংশোধন কার্যকর করা হবে না কারণ এ প্রসঙ্গে রাজ্যের এবং দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে বিভিন্ন ধরনের মতামত আসছে। সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি জানিয়েছেন, এই আইনটি কেরালার সরকারের পক্ষ থেকে বাতিল করা হয়েছে। তিনি বলেন, পার্টির পক্ষ থেকে কেরালা সরকারকে আইন পুনর্বিবেচনা করার কথা বলা হয়েছিল।

যাঁরা ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং মানবিকতার নির্যাস মাথায় না রেখে সোশ্যাল মিডিয়া এবং অন্য কোনভাবে যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমের সাহায্যে কুৎসা ইত্যাদি প্রচারে অংশ নিচ্ছেন তাদের তা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন বলেছেন গোটা সমাজকে এ সম্পর্কে সতর্ক নজরদারি করতে হবে।

বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট শাসিত কেরালা এবং উগ্র দক্ষিণপন্থী বিজেপি আরএসএস পরিচালিত উত্তরপ্রদেশ সরকার যে দুটি আইন প্রণয়ন করেছে সে সম্পর্কে সমালোচনা শুরু হওয়ার প্রেক্ষিতে রাজ্যের সরকারগুলির অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পর্কে তাদের নমনীয়তার বিষয়টিকে। যেখানে কেরালা সরকার পুলিশ আইনে যে সংশোধনী আনা হয়েছিল তা প্রথমে রোধ করে এবং পরে তা প্রত্যাহার করে। কিন্তু উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথের সরকার সংবিধানের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে - এমন অভিযোগ আসার পরে অনড় থেকে গেছে।

২৩ নভেম্বর উত্তরপ্রদেশে বিবাহের জন্য ধর্ম পরিবর্তন সংক্রান্ত অর্ডিন্যান্স ঘোষিত হয়। এই অর্ডিন্যান্সটিতে উল্লেখ করা আছে শুধুমাত্র বিবাহের জন্য যদি কেউ ধর্ম পরিবর্তন করেন তবে তা আইনসিদ্ধ হবে না। যোগী আদিত্যনাথ সরকারের এই নতুন আইনের বয়ানে বলা হয়েছে, যদি প্রমাণ হয় যে বিবাহজনিত কারণেই কেউ তার ধর্ম পরিবর্তন করেছেন তাহলে তার জেল এবং জরিমানা হবে। বিবাহ বাতিল হবে। তবে যদি কেউ ধর্ম পরিবর্তন করে তারপর বিবাহ করতে চান সেক্ষেত্রে উত্তরপ্রদেশের যে জেলার তিনি অধিবাসী সেই জেলার ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যেতে হবে এবং সেখান থেকে অনুমতি নিতে হবে। তবেই তিনি বিবাহ করতে পারবেন। অন্যথায় শাস্তি হবে।

প্রসঙ্গত এই আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের পরিচিত লব্জ 'লাভ জিহাদ' অর্থাৎ হিন্দু বা মুসলিম সহ অন্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বিবাহের ক্ষেত্রে হিন্দু মহিলাদের ধর্মান্তরনের ইস্যুটিকে খুঁচিয়ে তুলে বিভাজনের রাজনীতির এজেন্ডাকেই সামনে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে এ ঘটনা শুধুমাত্র উত্তরপ্রদেশের ক্ষেত্রেই ঘটেনি, বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশে এবং হরিয়ানাতেও এই ধরনের আইন আনার কথা বলা হয়েছে। আসাম সরকার একটু অন্যভাবে বিবাহ সংক্রান্ত কিছু বিধি জারি করার বিষয় প্রকাশ্যে এনেছে। তারা বিবাহেচ্ছুকদের আর্থিক সক্ষমতার হিসেব দাখিল করার কথা বলেছে সম্প্রতি। প্রসঙ্গত, হিন্দুত্ববাদীরা সাম্প্রদায়িক বিভাজনের লক্ষ্যে উস্কানি দিতেই প্রচার করে যে মুসলিম যুবকেরা ভালোবাসার বিয়ের নামে জোর করে হিন্দু মহিলাদের ধর্মান্তরিত করে জনবিন্যাসে পরিবর্তন আনতে, যা অবাস্তব।

দল ভাঙ্গিয়ে সরকার গড়ার পর মধ্যপ্রদেশের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান এবং হরিয়ানার মনোহর লাল খাট্টার যোগী আদিত্যনাথের পথে এগোলেও উত্তরপ্রদেশেরই এলাহাবাদ হাইকোর্টের দুই বিচারপতির বেঞ্চ ভিন্ ধর্মে বিবাহ সম্পর্কে একটি মামলায় দেওয়া রায়ে অবশ্য তুলে ধরেছে ভারতীয় সংবিধানে বর্ণিত ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকারের কথাই। সম্প্রতি এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি পঙ্কজ সাকেত এবং বিবেক আগরওয়ালের বেঞ্চ একটি মামলার তাদের রায়ে বলেছেন, যে কোন ধর্মের জীবনসঙ্গী খোঁজার অধিকার সংবিধানে বর্ণিত জীবনের অধিকার এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে। পছন্দের স্বাধীনতা সংক্রান্ত বিষয়টি অলঙ্ঘনীয়। এ প্রসঙ্গে স্পষ্টভাবে তাঁরা তাদের রায়ে উল্লেখ করেছেন ব্যক্তিগত সম্পর্কের অধিকারে হস্তক্ষেপ বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের যে ধারণা তার প্রতি হুমকি স্বরূপ।

এসবে যোগী আদিত্যনাথ এবং বিজেপি’র অন্য মুখ্যমন্ত্রিদের অবশ্য এই আইনের প্রক্রিয়া থেকে পিছু হটার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তারা হিন্দুত্বের কর্মসূচিকে প্রতিষ্ঠা করতেই বদ্ধপরিকর। তাই উস্কানিমূলকভাবে বলেছেন, ‘সম্মান’ নিয়ে খেললে মৃত্যুর হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন। কার্যত খাপ পঞ্চায়েতের বিষয়টিকে মাথায় রেখেও এই আইন প্রণয়নের বিষয়টি নিয়ে এগিয়েছেন তারা বলে অভিমত। দলিত এবং উচ্চ বর্ণের সন্তানদের নিজ ইচ্ছায় বিয়ে রুখতেও যে এই পদক্ষেপ এটা এখন স্পষ্ট। দুই সরকারের অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রটি এর থেকে পরিষ্কার।