৫৮ বর্ষ ১৬শ সংখ্যা / ৪ ডিসেম্বর ২০২০ / ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪২৭
চরম দুর্নীতিগ্রস্ত ক্ষমতালোভীদের গোষ্ঠীবিবাদ সংবাদ শিরোনামে
মানুষ কিন্তু সংগ্রামের ময়দানে এগিয়ে চলেছে
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ বঙ্গ রাজনীতিতে এখনকার পরিস্থিতি প্রসঙ্গে এস ওয়াজেদ আলির সেই বিখ্যাত উক্তি একটু অদল বদল করে বলাই যায়, ‘সেই নাটক সমানে চলছে’। দলে কোণঠাসা অবস্থায় তৃণমূল ছেড়ে কে কবে বিজেপিতে যাবেন এবং ক্লিন চিট পাবেন তা নিয়েই এখন মিডিয়ার সৌজন্যে দুই শাসকদল তৃণমূল-বিজেপির যাবতীয় তৎপরতা। নারদা কাণ্ডে ঘুষ খেতে দেখা যাওয়া দুর্নীতিগ্রস্ত শুভেন্দু অধিকারী যার কেন্দ্রীয় চরিত্র। সদ্য টিএমসি ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়া কোচবিহারের মিহির গোস্বামী বা মালদহের মৌসম বেনজির নুরকে নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও তাঁরা কেউ মিডিয়ার কাছে তেমন আমল পাচ্ছেন না এখন। এধরনের নাটক অবশ্য রাজ্যের মানুষের রুটি-রুজির যাবতীয় অনিশ্চয়তার ইস্যুগুলিকে পেছনে ঠেলে দেবার এক বহু পরীক্ষিত নিদান। নাটক জিইয়ে রাখতে তাই চেষ্টার কোনও কসুর করছেন না কেউই। তবে রাজ্যের মানুষ এসব ফিকির যে ধরে ফেলেছেন তা ২৬ নভেম্বরের ধর্মঘট থেকেই স্পষ্ট।
কয়লা কেলেঙ্কারি নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সিবিআইয়ের তৎপরতাকে কেন্দ্র করে প্রমাদ গুনছেন এ রাজ্যের ছোটো-বড়ো নানা মাপের তৃণমূল নেতা। বিজেপিতে ঢুকে পড়লে তাদের কৃতকর্ম ঢাকা চাপা পড়ে যাবে আইনি টানাহ্যাঁচড়া থেকে মুকুল রায়ের মতো এমন ভাবনা থেকেই তারা কেউ কেউ রওনা দিচ্ছেন মোদী-অমিত শাহের দলে। আবার দু’পা এগিয়ে থমকে দাঁড়িয়েও পড়ছেন কেউ কেউ। তাদের এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব এবং কালক্ষেপ থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস বা বিজেপি কোন দলই এককভাবে ক্ষমতায় আসবে এমন আত্মবিশ্বাস তাদের নেই। এসব উপলব্ধি করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি হতাশা গোপন রাখতে পারছেন না। অন্য চমকও আছে। শোনা যাচ্ছে, তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের অন্যতম এক নেতার নাম সিবিআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদের জেরে উঠে এসেছে। তাই জমে উঠেছে পর্দার আড়ালের দর কষাকষি। আপাতত শুভেন্দুকে নিয়ে নাটকের প্রথম অঙ্ক সমাপ্ত। অপেক্ষা দ্বিতীয় অঙ্ক শুরুর। কেন এই নাটকীয়তার আমদানি বারবার? যা সেই মুকুল রায় থেকে শুরু হয়েছে! সেই আলোচনায় ঢোকার আগে দেশের এই মুহূর্তের মূল ইস্যুগুলিতে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক প্রেক্ষিতটুকু বুঝে নেবার জন্য।
সাত দফা দাবিতে ডাকা ২৬ নভেম্বরের সাধারণ ধর্মঘটের অভূতপূর্ব সাফল্য দেশব্যাপী খেটে খাওয়া মানুষের মনে নতুন উদ্দীপনার জোয়ার তৈরি করেছে। সংগঠিত গণ আন্দোলনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতির প্রায় গুনগত পরিবর্তন ঘটে গেছে দ্রুত। তারপরই পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি মোতাবেক দেশের কৃষকরা কৃষি বিলের বিরোধিতায় পৌঁছে গেছেন দিল্লির সীমানায়। আর গোটাদেশ জোটবদ্ধ হয়ে কেন্দ্রের আনা কৃষি বিলসমূহ বাতিলের দাবিতে রাজধানীর সীমান্তে কৃষকদের অবস্থান আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়েছে। ঠিক তখনই রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা হারানো বাংলার শাসক দলের খবরে ভেসে থেকে নজর ঘোরানোর নয়া পালা ‘দলবদল’ শুরু হয়েছে। কারণ কেন্দ্রের ‘কালা কৃষি আইনে’র প্রায় অবিকল কর্পোরেটমুখী জেরক্স কপি তো তৃণমূল সরকার আগেই চালু করেছে এই বাংলায়। বাংলার কৃষকরা তো দীর্ঘদিন ধরেই তার বিরোধিতা করছে। ফসলের ন্যায্য সংগ্রহ মুল্যের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে।
প্রসঙ্গত, এ রাজ্যে সরকার ঘোষিত ফসল কেনার সময়সীমা শুরু হয়ে গিয়েছে। ১৮৬৮ টাকা কুইন্টাল দরে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ধান কেনার কথা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু রাজ্যের চাষিরা তার চেয়ে অনেক কম দামে - প্রায় ১২৭৫ টাকায় তা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। চালু বাজার এবং কৃষকদের বাড়ি থেকে বহুদূরে অবস্থিত মমতা ব্যানার্জির সাধের কিষাণ মান্ডি। সেখানে ধান বেচতে এলে এ রাজ্যের কৃষকদের অভিজ্ঞতা হলো, নগদে সঙ্গে সঙ্গে দাম পাওয়া যায় না। এসব ক্ষোভ ধামাচাপা দিতেই ব্যস্ত সরকার আর মমতাময়ী মিডিয়া। কাজেই যা হবার তাই হচ্ছে। স্থানীয় ফড়েদের পোয়াবারো। অনিশ্চয়তার মুখে তাদের হাতেই কৃষকরা তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন ফসল। আবার বিভিন্ন জেলাতে সহায়ক মূল্যে ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে দিয়েছে সরকার। সব মিলিয়ে কৃষকদরদের নামে কৃষকদের বাধ্য করা হচ্ছে অভাবী বিক্রিতে।
তাই নাটক। তাই নারদা কাণ্ডে ঘুষ খেতে দেখা যাওয়া দুর্নীতিগ্রস্ত শুভেন্দু অধিকারী তার কেন্দ্রীয় চরিত্র। কারণ ভোটের মুখে নারদা-সারদা নিয়ে নড়েচড়ে বসতে পারে সিবিআই-ইডি এমন আশঙ্কাও রয়েছে তৃণমূলীদের। সাম্প্রতিক সময়ে তৃণমুল ছেড়ে বিজেপি-তে গেছেন বটে কোচবিহারে বিধায়ক মিহির গোস্বামী, কিন্তু বাংলার ‘এগিয়ে থাকা’ মিডিয়াকুলের কাছে তিনি মোটেই ততটা গুরুত্বপূর্ণ নন। আবার অভিষেক ব্যানার্জির ডাকা কলকাতার মিটিংয়ে না যাওয়ায় মালদহের তৃণ-সাংসদ মৌসম বেনজির নূরকে ঘিরেও সন্দেহের বাতাবরণ তৃনমূলে। সব মিলিয়ে চিত্রনাট্য ক্রমশ জমে উঠেছে।
অবশ্য নিজের দলে ভাঙনের আশঙ্কা আর চেপে রাখতে না পেরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি হতাশা গোপন রাখতে পারেননি। সম্প্রতি তিনি প্রকাশ্যেই বলে ফেলেন সেসব। তার দলের অনেকেই যে গোপনে বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন সে কথা ২৫ নভেম্বর জঙ্গলমহলে বাঁকুড়ার শুনুকপাহাড়ির সভা মঞ্চ থেকে প্রকাশ্যে জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, গোটা রাজ্যে সব জায়গায় আমি একমাত্র অবজারভার। এখন আমি সব জানি, নজর রাখছি। কে কোথায় যোগাযোগ করছে, কার সঙ্গে কে কন্ট্যাক্ট করছে সব হিসাব আমি রাখছি। সভা মঞ্চ থেকে নাম না করে শুভেন্দু অধিকারীকে ‘ছাগলের তৃতীয় সন্তান’ বলেও সেদিন আক্রমণ শানিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। আবার তাৎপর্যপূর্ণ হলো, শুভেন্দু অধিকারী মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে ইস্তফাপত্র পাঠানোর পাশাপাশি সেই চিঠিটি রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়কেও ইমেল করেছিলেন শুভেন্দু। রাজ্যপাল দেরি না করে সেটি তাঁর টুইটার হ্যান্ডলে প্রকাশ করে দেন।
এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বামফ্রন্ট পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, এতদিন দল ভাঙানোর খেলায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী এখন বিদায় কালে তার দল ভেঙে সবাই পালাচ্ছে। তিনি স্পষ্ট বলে দিয়েছেন শুভেন্দু অধিকারীর দলত্যাগ সংক্রান্ত জল্পনা নিয়ে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই। উনি বিজেপিতে যোগ দেবেন কিনা তা নিয়েও আগ্রহ নেই। মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ে যে আন্দোলন চলছে আমাদের আগ্রহ সেদিকেই। ...আমাদের আগ্রহ কৃষকরা দিল্লিতে গিয়ে হাজির হয়ে কিভাবে মোদীর মুখোমুখি হচ্ছেন তাই নিয়ে। যে মোদী দেশের সর্বনাশ করছেন তার বিরুদ্ধে লড়াই হচ্ছে। আর মমতা ব্যানার্জি রাজ্যের সর্বনাশ করেছেন তার প্রতিবাদে মানুষ কিভাবে রাস্তায় নেমেছেন সেটা ধর্মঘটে দেখা গেছে। ওই পূর্ব মেদিনীপুর জেলাতেও মানুষ লাল ঝান্ডা হাতে নেমেছেন এর কারণ এ রাজ্যে যা বিজেপি তাই তৃণমূল। ফারাক কিছু নেই। তৃণমূলের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভকে ব্যবহার করে বিজেপি বড় হতে চায়, কিন্তু একই অপরাধে বিজেপিও অপরাধী।
তবে রাজ্য বিজেপি নেতারা এখন শুভেন্দু সহ অন্যদের জন্য দরজা খুলে রেখেছেন এমন বার্তা দিলেও কিছুদিন আগেও কিন্তু পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল। বিজেপি এর আগে শুভেন্দু অধিকারীকে কী চোখে দেখত সেটা এর আগে ময়নায় দলের এক সমাবেশে এসে তারা বলে ফেলেছিলেন। তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যের অধুনা প্রাক্তন পরিবহণ মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীকে নিশানা করে বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ যা বলেছিলেন তা থেকেই বিষয়টা পরিস্কার। সেবার পূর্ব মেদিনীপুর থেকে ‘অধিকারী ব্রাদার্স অ্যান্ড সন্স’ কোম্পানি তুলে দেওয়া হবে বলে হুমকিও দিয়েছিলেন তিনি। পাল্টা শুভেন্দু অধিকারী বলেছিলেন, ‘‘ধমকে, চমকে আঙুল দেখিয়ে চোখ দেখিয়ে আমাদের ভয় পাওয়ানো যাবে না। যাদের সার্টিফিকেটটা (শংসাপত্র) পর্যন্ত জাল, ভুয়ো সেইসব লোকের জ্ঞান আমরা শুনব না।’’ বিজেপি নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তব্য থেকে স্পষ্ট প্রাক্তন তৃণমূলীদের ওপর ভরসা না করে তাদের পক্ষে এ রাজ্যকে ‘গুজরাটে’ পরিণত করা সম্ভব নয়। পাল্টা উত্তর এ শুভেন্দু অধিকারীও যা বলেছিলেন তা থেকে পরিষ্কার সাধ করে নয় বাধ্য হয়েই তাঁকে বিজেপিতে যেতে হবে। অর্থাৎ তৃণমূল ছাড়লে নিজের দল গড়ার চেয়ে বিজেপিতে যাওয়া অনেক সস্তার এবং স্বস্তির সওদা হবে। তাঁর অনুগামীরা অবশ্য চাইছেন তিনি নতুন দল গড়লে বেশি ফায়দা।
এসব পুরনো কথা কাটাকাটির পরেও এবার বিজেপির তরফে এ রাজ্যের কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয় জানিয়েছেন, ‘বিজেপির দরজা ওর জন্য খোলা রয়েছে। এখন ওনাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
শোনা যাচ্ছে কাজ করতে বাধা দেওয়ার জন্যই মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করেছেন শুভেন্দু অধিকারী। অবশ্য তাঁর দলের একাংশের বক্তব্য গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে তিনি অভিষেক ব্যানার্জির বিরোধী, তাই তাকে কোণঠাসা করা হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রী হিসেবে তার দারুণ কোনো ভূমিকা নেই। বাসের ভাড়া থেকে বাঁধের দুর্দশা কোন সমস্যার সমাধান করতে পারেননি পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী হিসেবে। গত সাড়ে ৯ বছরে তিনি কোনো বিনিয়োগ আনতে পারেননি হলদিয়াতে। বরং এই সময়কালে হলদিয়ার শিল্প শ্রমিকদের হাল খারাপ হয়েছে। সাংসদ সৌগত রায়কে পাঠিয়ে তার ক্ষোভ নিরসন করতে চেষ্টা করেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। কিন্তু একান্ত ব্যক্তিগত বার্তা ফাঁস করে দেওয়া হয়েছে-সৌগত রায় এর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তুলে আবার বেঁকে বসেছেন শুভেন্দু অধিকারী। তবে ওয়াকিবহাল মহলের একাংশের বক্তব্য হলো, মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি দিল্লির অভিযান সম্পর্কে চুপ করে রয়েছেন সেটা মানুষকে বুঝতে না দিতেই ‘শুভেন্দু কার’ নাটকের জমজমাট জনপ্রিয়তা দেখেই নাকি এই ব্যবস্থা। নাহলে তো বিজেপি-তৃণমুল সখ্যতার আরও এক নজির ফাঁস হয়ে যাবে।