E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ১৬শ সংখ্যা / ৪ ডিসেম্বর ২০২০ / ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪২৭

কর্পোরেট ব্যাঙ্ক

অমিতাভ রায়


এবারের লক্ষ্য ব্যাঙ্ক। লুটেপুটে খাওয়ার নতুন নিশানা। সংক্রমণজনিত অবরোধের অন্তরালে আত্মনির্ভরতার বুলি কপচিয়ে ক্রেতার শর্তে জাতীয় বিমান পরিবহণ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রায়ত্ত খনি, তেল কোম্পানি, রেলব্যবস্থা, টেলিফোন কোম্পানি এককথায় যাবতীয় রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিরাষ্ট্রীয়করণ তথা বিক্রির বন্দোবস্ত করার ধারাবাহিকতায় নতুন সংযোজন কর্পোরেট ব্যাঙ্ক।

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বিশেষ অভ্যন্তরীণ কমিটি সম্প্রতি (অক্টোবর ২০, ২০২০) সুপারিশ করেছে যে -
● বড়ো কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে ব্যাঙ্ক খোলার অনুমতি দেওয়া উচিত।
● ব্যাঙ্ক নয় এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফসি) মালিক কর্পোরেট সংস্থা ও যাদের ৫০ হাজার কোটি টাকা বা তার বেশি সম্পদ আছে, শর্তসাপেক্ষে তাদের ব্যাঙ্কে রূপান্তরিত হতে সায় দেওয়া যায়।
● নতুন ব্যাঙ্ক তৈরির ন্যূনতম মূলধন ৫০০ কোটি থেকে বাড়িয়ে ১০০০ কোটি করা দরকার।
● বেসরকারি ব্যাঙ্কে প্রোমোটারের অংশীদারির সর্বোচ্চ সীমা ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৬ শতাংশ করা উচিত।

কী কারণে হঠাৎ কমিটি তৈরির প্রয়োজন হয়েছিল তার কোনো জবাব নেই। এমন কী পরিস্থিতি তৈরি হলো যে, এখনই কমিটি গঠন করতে হলো? এখনই কেন এইসব প্রস্তাব আনা হলো? এতে যে সব সংস্থার ঘাড়ে বিপুল ঋণের বোঝা এবং ভালো রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে, তারা বেশি করে ব্যাঙ্কস্থাপনের অনুমতি পেতে ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ পাবে। তৈরি হবে স্বার্থের সংঘাত।

সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী সুপারিশপত্রের টিকাতেই বলা হয়েছে, যে ক’জন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে সুপারিশ দেওয়া হয়েছে, একজন বাদে তাঁদের কেউই কর্পোরেট সংস্থার ব্যাঙ্ক খোলার পক্ষে মত দেননি। তবুও সুপারিশ করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে ব্যাঙ্ক খুলতে দিলে আর্থিক কাঠামো ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। কর্পোরেট সংস্থাকে ব্যাঙ্ক খুলতে দেওয়ার অনুমতি দিলে প্রথমত, তারা নিজেরাই নিজেদের ব্যাঙ্ক থেকে যথাযথ নজরদারি ছাড়া ধার নিতে পারবে। দ্বিতীয়ত, এতে অর্থনৈতিক (এবং রাজনৈতিক) ক্ষমতা নির্দিষ্ট কিছু সংস্থার হাতে কুক্ষিগত হবে।

এখনও যে তা হচ্ছে না এমন নয়। তবুও একটা লোকদেখানো চোর-পুলিশ খেলা দীর্ঘদিন ধরে চালানো যায়। ভোটের বাজারে তার দাম কম নয়।

ভারতে কোনো ব্যাঙ্ক যাতে দেউলিয়া হয়ে ব্যবসা না গোটাতে পারে তার জন্যই মূলত ব্যাঙ্ক রাষ্ট্রায়ত্তকরণ হয়েছিল। পরে বিষয়টিকে বিধিবদ্ধ করে দেওয়ায় সাধারণ মানুষ সেখানে টাকা রেখে নিশ্চিন্ত থাকেন। সেইসব আমানত মারফত ব্যাঙ্কগুলিও বিপুল পুঁজি পায়। তা সত্ত্বেও খামতি থাকে। সেই ফাঁক দিয়েই বড়ো বড়ো ঋণখেলাপিরা পালিয়ে যায়। শুধু আইন করেই যদি নিয়ম ও নজরদারি কার্যকর করা যেত, তা হলে অনুৎপাদক সম্পদের সমস্যাও থাকত না।

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক সুপারিশ অনুসারে প্রশ্ন ওঠে, যে কর্পোরেট সংস্থা ঋণ নিচ্ছে, তারাই ব্যাঙ্কের মালিক হলে সেই ব্যাঙ্ক কী করে নিয়মানুগ সিদ্ধান্ত নেবে? চলতি ব্যবস্থাতেই বহু সময়ে যথাযথ নিরীক্ষণ ও মূল্যায়নের অভাবে নানান খুঁটিনাটি বিষয় চোখ এড়িয়ে যায়। ফলে পুরনো ঋণখেলাপির নতুন ঋণ পেতে অসুবিধা হয় না।

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক সুপারিশ অনুসারে আইন করে কর্পোরেট সংস্থাকে ব্যাঙ্ক খোলার সায় দিলে এতে সুবিধা পাবে দেশের সেই সব বড়ো কর্পোরেট সংস্থা, যাদের ইতিমধ্যেই ন্যূনতম মূলধন রয়েছে। তাদের সংখ্যা হাতে গোনা যায়। দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তের মানুষও তাদের নাম জানে। বিপুল ঋণ নেওয়া ও রাজনৈতিক দিক থেকে প্রভাবশালী সংস্থাগুলির সুবিধা হবে বেশি।

ভারতে ব্যাঙ্ক পরিচালনা নিয়ে এমনিতেই হাজারো প্রশ্ন রয়েছে। সংস্কারের নামে একঝাঁক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ককে কয়েকটি নিদিষ্ট ব্যাঙ্কের ছত্রছায়ায় নিয়ে আসা হয়েছে। এর ফলে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার কী হাল হয়েছে তা ওয়াকিবহাল মহল তো বটেই ভুক্তভোগীরাও টের পাচ্ছেন। গত অক্টোবর মাসে সরকারি নির্দেশে একটি বেসরকারি ব্যাঙ্ককে রাতারাতি বিদেশি ব্যাঙ্কের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হলো। আত্মনির্ভরতার প্রচার। একইসঙ্গে বেড়ে চলেছে বিদেশি ব্যাঙ্ক, বেসরকারি ব্যাঙ্কের উপর নির্ভরতা। ব্যাঙ্কিং শিল্পের ঘাড়ে চেপে আছে বিপুল অনুৎপাদক সম্পদের বোঝা। তার উপরে এই প্রস্তাব কার্যকরী হলে আর্থিক ক্ষেত্রের ঝুঁকি আরও অনেক বাড়বে।

বিশেষজ্ঞদের মতে যারা অনুৎপাদক সম্পদ বৃদ্ধির জন্য মূলত দায়ী, তাদেরই ব্যাঙ্কের মালিক বানানোর জন্য তোড়জোড় শুরু হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানির মতো উন্নত দেশেও এই প্রথা চালু নেই। কর্পোরেট শিল্পসংস্থার হাতে ব্যাঙ্কের মালিকানা থাকলে সাধারণের টাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব?

গ্রামীণ পঞ্চায়েত থেকে যাবতীয় রাষ্ট্রীয় সম্পদ কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার পর বাকি ছিল ব্যাঙ্ক। দেশের সমস্ত পরিষেবা, উৎপাদন, বাণিজ্য থেকে শুরু করে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ কর্পোরেটের কাছে সঁপে দেওয়ার পর হাতে রইল শুধুমাত্র সরকার। বেনামে অবিশ্যি কর্পোরেটেরই সরকার চলছে। এখন শুধু ‘কর্পোরেট সরকার’ ঘোষণা করা বাকি আছে। আশার কথা, ভারতের মানুষকে বোকা বানানো অত সহজ নয়। কর্পোরেটের মোকাবিলায় রাস্তায় নেমে ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে জন-আলোড়ন। এই অভিঘাত কর্পোরেট সহ্য করতে পারবে তো?