E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ১৬শ সংখ্যা / ৪ ডিসেম্বর ২০২০ / ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪২৭

ব্যাঙ্ক পরিষেবা ক্ষেত্রে কর্পোরেটের অশুভ ছায়া

অর্ণব ভট্টাচার্য


গ্লোবাল ট্রাস্ট ব্যাঙ্ক ও ইয়েস ব্যাঙ্ক বন্ধ ঘোষণা হওয়ার পর ব্যাঙ্কের সামনে আতঙ্কিত আমানতকারীরা।

গত ২০ নভেম্বর ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ইন্টারনাল ওয়ার্কিং গ্রুপ কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে ব্যাঙ্ক খোলার অনুমতি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। এই বিতর্কিত প্রস্তাব নিয়ে ইতিমধ্যেই অনেক বিশেষজ্ঞ বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেছেন এবং এহেন সিদ্ধান্ত যে ভারতীয় অর্থনীতি এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে তা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন ও প্রাক্তন ডেপুটি গভর্নর বিরল আচার্য দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়েছেন।

ইন্টারনাল ওয়ার্কিং গ্রুপ আরও প্রস্তাব গ্রহণ করেছে যে, ৫০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে এমন নন্-ব্যাঙ্কিং ফিনান্সিয়াল সংস্থা, যাদের দশ বছরের অভিজ্ঞতা আছে তাদেরকেও পুরোদস্তুর ব্যাঙ্কে পরিণত হওয়ার অধিকার দেওয়া হবে। এই সমস্ত নন্-ব্যাঙ্কিং ফিনান্সিয়াল সংস্থার অনেকগুলির মালিকানা কর্পোরেট সংস্থার হাতে রয়েছে। অর্থাৎ এভাবেও পেছনের দরজা দিয়ে ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠার অনুমতি পেতে চলেছে কর্পোরেট সংস্থাগুলি।

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের যুক্তি এই যে, ভারতের ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে আরও বেশি প্রতিযোগিতার স্বার্থে এবং ঋণ পাওয়ার সুবিধা বৃদ্ধি করবার জন্য এরকম পদক্ষেপ ভীষণ জরুরি। ১০০ পাতার এই নথিটি প্রকাশ করবার পর তার উপর মতামত দেবার জন্য মাত্র দুই মাস সময় দিয়েছিল আরবিআই। অথচ অতীতে এ ধরনের রিপোর্ট যখনই তৈরি হয়েছে তখন তা পূর্ণাঙ্গ চেহারা পেতে অন্তত দু’বছর সময় লেগেছে। কেননা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এহেন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তড়িঘড়ি নেওয়া কখনও উচিত নয়। বর্তমানে যখন কোভিড প্যানডেমিক চলছে তখন ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব দেওয়ার সময়ে যে তাড়াহুড়ো করা হলো তা নিঃসন্দেহে এক অশনিসংকেত। অন্যদিকে এই প্রবণতা, বর্তমানে দেশের সরকার যেভাবে একের পর এক জনবিরোধী আইন কার্যত কোনো আলোচনা ছাড়াই পাস করিয়ে নিচ্ছে সেই ধারারই অনুসারী।

দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাঙ্কগুলি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই ব্যাঙ্কের সম্পদ, যা কিনা জনগণের গচ্ছিত কষ্টার্জিত সম্পদ, তার কোনো অপব্যবহার যাতে না ঘটে তা দেখা সরকারের কর্তব্য। ভারতের স্বাধীনতার পর এমন কোনো উদাহরণ নেই যা থেকে বলা যেতে পারে যে, কর্পোরেট সংস্থাগুলি ব্যাঙ্ক পরিচালনার ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। বরং উল্টোটাই আমাদের দেশে ঘটেছে বলে ১৯৬৯ সালে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ করতে হয়। ১৯৪৭-১৯৫৮ সালের মধ্যে ভারতে বিভিন্ন আকারের ৩৬১টি প্রাইভেট ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে যায়। পরে সেগুলির কয়েকটির সংযুক্তিকরণ ঘটিয়ে বিলুপ্তি ঠেকানো গিয়েছিল,বাকিগুলি সম্পূর্ণভাবে উঠে যায়। এর ফলে জনগণের কষ্টার্জিত কোটি কোটি টাকা স্রেফ উবে গিয়েছিল। সর্বস্ব হারিয়ে চরম সঙ্কটের মধ্যে পড়েছিলেন অসংখ্য মানুষ। এই ব্যাঙ্কগুলির মালিক ছিল বড়ো বড়ো বেসরকারি সংস্থা এবং তারা নিজেদের স্বার্থে এই ব্যাঙ্কের আমানতকে ব্যবহার করত। ১৯৫১-৬৭ সালের মধ্যে এই বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলি তাদের আমানতের মাত্র ২.১ শতাংশ কৃষিক্ষেত্রে ঋণ দিতে খরচ করে। অর্থাৎ কৃষিপ্রধান দেশে কৃষকের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি এই সমস্ত বৃহৎ বেসরকারি পুঁজি নিয়ন্ত্রিত ব্যাঙ্ক’কে। সামগ্রিকভাবে দেশের আমজনতার উন্নতির ক্ষেত্রে এই ব্যাঙ্কগুলির কার্যত কোনো ভূমিকা ছিল না।

১৯৬৯ সালে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার দু’দশক পর ১৯৯১ সালে নয়া-উদারনীতি প্রবর্তিত হলে দেশে আবার বেসরকারি ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন করে লাইসেন্স দেওয়া হতে থাকে। বর্তমানে আমাদের দেশে একুশটি বেসরকারি ব্যাঙ্ক রয়েছে, যার মধ্যে বারোটি পুরনো এবং ন’টি ১৯৯১ সালের পর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কর্পোরেট সংস্থাকে ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠার অধিকার দেওয়া হয়নি যা কিনা আগামীদিনে বদলাতে চলেছে।

বিশেষজ্ঞরা মূলত কর্পোরেট সংস্থার ব্যাঙ্ক খোলার প্রশ্নে দুটি বিষয়ে আপত্তির কথা বলেছেন। প্রথমত, কর্পোরেট সংস্থাগুলি ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠিত করলে প্রতিষ্ঠাতা সংস্থাকেই ঋণ দেওয়ার প্রবণতা তৈরি হবে। কর্পোরেট সংস্থাগুলি এভাবে বিনা প্রশ্নে নিজেদের ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পেয়ে যাবে। ইতিহাস প্রমাণ করছে যে, এরকমভাবে ঋণদান অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনে। এই ঋণশোধ করার কোনো তাগিদ অনুভব করবে না সংস্থাগুলি এবং পরবর্তীতে আর্থিক সঙ্কটের সামনে পড়বে সাধারণ আমানতকারীরা। বর্তমানে ভারতে ঋণখেলাপিদের মধ্যে কর্পোরেট সংস্থাগুলি অন্যতম। ২০২০ সালের মার্চ মাসের হিসেব অনুযায়ী ১৩ শতাংশ কর্পোরেট ঋণ ‘নন্-পারফর্মিং অ্যাসেট’ অর্থাৎ এই বিপুল পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করা হয় না। আর প্রতি বছর রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণখেলাপি সংস্থাগুলির বড়ো অঙ্কের ঋণ ‘রাইট অফ’ অর্থাৎ মকুব করায় এই অস্বাস্থ্যকর প্রবণতা আরও বাড়ছে। তাই ক্রমশ বাড়ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ। আর এই ঋণখেলাপি কর্পোরেটকেই ব্যাঙ্ক খোলার অনুমতি দিয়ে আরও লুঠের পথ প্রশস্ত করতে চাইছে সরকার।

দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কর্পোরেট সংস্থা ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করবার জন্য যে লাইসেন্স প্রয়োজন তা হস্তগত করবে। এভাবে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যাপক কেন্দ্রীভবন ঘটবে। যার ফলে দেশে ধান্দার ধনতন্ত্র আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠবে এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্বৈরাচারী প্রবণতা আরও বাড়বে। ভারতীয় রাজনীতিতে কর্পোরেট ও রাজনীতিবিদদের যে অশুভ আঁতাত বিগত কয়েক দশকে ক্রমাগত শক্তিশালী হয়েছে তা আগামীদিনে আরও লাগামছাড়া হয়ে পড়বে এ ধরনের সিদ্ধান্তের পর। বর্তমানে অতিমারী চলাকালীনই আমরা দেখেছি যে, কীভাবে দেশে সম্পদের ব্যাপক কেন্দ্রীভবন ঘটেছে এবং কর্পোরেটগুলি বিপুল মুনাফা অর্জন করেছে। বিপুল সম্পদের অধিকারী এই কর্পোরেট সংস্থা যদি দেশের ব্যাঙ্কিংক্ষেত্রকেও নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে তাহলে পরবর্তীকালে তার ফল হবে অত্যন্ত ভয়ানক।

বিহারের নির্বাচনের আগে আমাদের দেশে ২৮৩ কোটি টাকার ইলেক্টোরাল বন্ড বিক্রি হয়েছে যার ২৭৯টি এক কোটি টাকার বন্ড। অতিমারীর সময়ে অনুষ্ঠিত একটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে ধনীরা কী বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বিশেষ কিছু রাজনৈতিক দলগুলির তহবিলে দিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে চাইছেন তা এই তথ্য থেকে পরিষ্কার। অর্থবলের ব্যবহার করে রাষ্ট্রপরিচালনার নীতিকে নিজস্ব স্বার্থে প্রণয়ন করানোর এই প্রয়াস আরও বৃদ্ধি পাবে যদি আগামীদিনে কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে দেশের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবার এমন সুযোগ করে দেওয়া হয়।

সামগ্রিকভাবে ভারতে নয়া-উদারবাদী আর্থিক নীতি চালু হওয়ার পর থেকেই আর্থিকক্ষেত্রে বিভিন্ন বেনিয়ম বেড়েছে। আর কর্পোরেটকে লাগামহীনভাবে সুযোগ নিতে দিলে কী হয় তার জলজ্যান্ত উদাহরণ নীরব মোদী, মেহুল চোকসি, বিজয় মালিয়া, ছন্দা কোছারের মতো ব্যক্তিরা। তাই সাধু সাবধান!

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ওয়ার্কিং গ্রুপের রিপোর্টে এ কথা স্বীকার করা হয়েছে যে, কর্পোরেট সংস্থাগুলোর পরিচালনব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানের নয়। তা সত্ত্বেও তাদেরকে এহেন সুযোগ কেন দেওয়া হচ্ছে তার কোনো জবাব রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্তাদের কাছে পাওয়া যাচ্ছে না। কার্যত আন্তর্জাতিক মান তো দূরস্থান ভারতের কর্পোরেট সংস্থাগুলোর পরিচালনব্যবস্থা যথেষ্ট নিম্নমানের। কর্পোরেট সংস্থাকে ব্যাঙ্ক খোলার অনুমতি দেওয়ার বিষয়টির সমালোচনা করতে গিয়ে কর্পোরেট সংস্থাগুলির পরিচালনব্যবস্থার ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর ডক্টর রঘুরাম রাজন ও প্রাক্তন ডেপুটি গভর্নর বিরল আচার্য। আমেরিকান ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি এস অ্যান্ড পি গ্লোবাল রেটিংসও ভারতের কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে ব্যাঙ্ক খোলার অনুমতি দেওয়ার প্রস্তাবকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলেছে। বিগত কয়েক বছরে যেভাবে ভারতের কর্পোরেট সংস্থাগুলি ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে এই মার্কিন রেটিং এজেন্সি তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছে।

ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতাকে অনেকে স্বাগত জানালেও অতিরিক্ত প্রতিযোগিতা যে ব্যাঙ্কগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ অর্থনৈতিক লেনদেনের দিকে প্ররোচিত করে তার সবথেকে জ্বলন্ত উদাহরণ ২০০৮-র অর্থনৈতিক সঙ্কট। জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ আর্থিক লেনদেন করে মুনাফা অর্জন করার যে উন্মাদনা সারা পৃথিবীতে এক ভয়ানক অর্থনৈতিক সঙ্কট ডেকে এনেছিল ২০০৮ সালে, তার ভুক্তভোগী অসংখ্য সাধারণ মানুষ। ভারতের মতো দেশ যেখানে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা যথেষ্ট কম সে ক্ষেত্রে এ ধরনের লাগামছাড়া প্রতিযোগিতা যে জনগণকে আরও বিপদের মধ্যে ঠেলে দেবে সে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

১৯৯১ সালের পর ভারতের প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোর মধ্যে গ্লোবাল ট্রাস্ট ব্যাঙ্ক এবং ইয়েস ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে গিয়েছে এবং সেই ব্যাঙ্কগুলির আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষা করবার জন্য এগিয়ে আসতে হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক’কে। অতি সম্প্রতি ভারতের বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোর মধ্যে অন্যতম লক্ষ্মীবিলাস ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এই সমস্ত ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রমাণ করে যে, নয়া-উদারবাদী ব্যবস্থার হাত ধরে ক্রমাগত আর্থিকক্ষেত্রে অনিয়ম বাড়ছে এবং বেসরকারি মালিকানাধীন আর্থিকক্ষেত্র যেখানে সামাজিক পরিষেবার কোনো দায় থাকে না,সবটাই মুনাফা অর্জনের জন্য হয় সেই ক্ষেত্রগুলিতে সর্বাধিক অনিয়মের ঘটনা লক্ষ করা যাচ্ছে। এর মাশুল দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।

নয়া-উদারবাদী আর্থিক সংস্কার কার্যত দেশের মানুষকে আরও বেশি করে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে এবং সম্পদের এক কুৎসিত কেন্দ্রীভবন ঘটিয়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক প্রস্তাব এই আর্থিক সংস্কার প্রক্রিয়ার অঙ্গ।তবে পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদরাও এই প্রস্তাবকে বিধ্বংসী ও বিপজ্জনক আখ্যা দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও সরকার সে কথায় কর্ণপাত করবে কিনা তা নির্ভর করছে দেশের মানুষ এই জনবিরোধী ও কর্পোরেটমুখী সিদ্ধান্তকে পথে নেমে কতটা প্রতিরোধ করতে পারেন তার উপর।