৫৮ বর্ষ ১৬শ সংখ্যা / ৪ ডিসেম্বর ২০২০ / ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪২৭
সমাজবিপ্লবী রোকেয়া
পিয়াল রায়
বিশ শতকের প্রারম্ভিক পর্যায়ে বেগম রোকেয়া (জন্ম - ১৮৮০, ৯ ডিসেম্বর, প্রয়াণ - ১৯৩২, ৯ ডিসেম্বর) অবিভক্ত বাংলার বুকে যে সমাজবিপ্লবের সূচনা করেছিলেন, তা কেবল বাংলার মানুষ, বিশেষ করে মহিলাসমাজের দিগন্ত প্রসারণে ঐতিহাসিক ভূমিকাই পালন করে নি, নারীর স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে তাঁর অবদান এবং ভূমিকা, গোটা উপমহাদেশে একটা বড়রকমের সামাজিক আন্দোলনের সূচনা ঘটিয়েছিল। নারীর স্বাধিকারের লড়াইয়ে প্রথম উপাদান হলো নারীশিক্ষা - নিজের জীবন দিয়ে রোকেয়া সেটি অনুভব করেছিলেন।সেই অনুভূতি থেকেই স্বামী সৈয়দ শাখাওয়াত হোসেনের অকাল প্রয়াণের পর, বিহারের ভাগলপুরে, সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ পরিবেশে, কার্যত প্রাণ হাতে করে মেয়েদের জন্যে ইস্কুল খুলেছিলেন।
বিশ শতকের প্রারম্ভে একজন বাঙালি নারীর স্বামীর অকাল মৃত্যুর পর, স্বামীর রেখে যাওয়া টাকা পয়সাকে সম্বল করে নিছক বেঁচে থাকার চিন্তাটাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যেত।স্বশিক্ষিতা রোকেয়া কিন্তু সে পথে হাঁটেন নি। বাঙালি মেয়ে, বাংলার পরিবেশে বড়ো হওয়া, পারিবারিক রক্ষণশীলতা সত্ত্বেও বাঙালি সংস্কৃতিতেই অভ্যস্থ। এহেন মানুষকে শ্বশুরকুলের এবাদতে কতোটা অস্বস্তির ভিতরে পড়তে হয়েছিল, তা তাঁর ‘অবরোধবাসিনী’ পড়লেই বোঝা যায়। বিরুদ্ধ পরিবেশ আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল স্বামীর মৃত্যুর পর। সৈয়দ শাখাওয়াত হোসেনের পরলোকগতা স্ত্রী’র সন্তানেরা রোকেয়াকে কপর্দকহীন করে ভাগলপুর থেকে তাড়াতে চেয়েছিল। রোকেয়া চাইলে স্বামীর রেখে যাওয়া অর্থ নিয়ে নিরাপদে বাংলাতে চলেও আসতে পারতেন। কারণ, স্বামীর কর্মসূত্রে কিছু আমলার সাথে তাঁর পরিচয় ছিল।তিনি চাইলে সেই আমলারা তাঁকে সাহায্যও করতেন।
তৎকালীন পূর্ববঙ্গের কুমিল্লাতে নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী প্রতিষ্ঠিত স্কুল।
প্রথমাবস্থায় কিন্তু আত্মসমর্পণ না করে, স্বামীর রেখে যাওয়া টাকাকে সম্বল করেই, ভিন্নভাষী এলাকাতে মেয়েদের জন্যে ইস্কুল খুললেন রোকেয়া। বাংলার সামাজিক পরিবেশ আর বিহারের সামাজিক পরিবেশ কিন্তু এক ছিল না। বাংলায় রামমোহন, বিদ্যাসাগর, ফয়জুন্নেছা, ব্রাহ্মসমাজের প্রভাব, নবাব আবদুল লতিফ প্রমুখের ভূমিকার ফলে স্ত্রীশিক্ষা ঘিরে উনিশ শতকের যে প্রতিবন্ধকতা ছিল, সেই জগদ্দল পাথর বিশ শতকের শুরুতে কিছুটা হলেও শিথিল হয়েছিল। কিন্তু বিহারে স্ত্রীশিক্ষা সেই সময়ে কার্যত অপ্রচলিত একটি ধারণা। নারীমুক্তি নিয়ে সোচ্চার শরৎচন্দ্রের জীবনের একটা অংশ ভাগলপুরে কাটলেও, নিজের চেষ্টায় শিক্ষাঙ্গনে রোকেয়ার যে পদচারণা, সাহিত্য সৃষ্টি, বাঙালির লেখা প্রথম কল্পবিজ্ঞান কাহিনি ‘সুলতানাজ ড্রিম’ রচনা, স্বামীর মৃত্যুর অল্প কয়েকদিনের মাথায় ইস্কুল প্রতিষ্ঠা, এইসব সম্পর্কে কিন্তু শরৎচন্দ্র থেকে বনফুল, যাঁদের জীবনের সঙ্গে ভাগলপুর অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, তাঁরা কখনো একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি।
নবজাগরণের কুশীলবেরা স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারে যে অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, তার শুরুটা ঘটেছিল বাংলার পরিচিত পরিমণ্ডলের ভিতরে। এইদিক থেকে রোকেয়ার ভূমিকা হলো সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী। কেবল বাংলার বাইরেই তিনি নারীর সামাজিক অবরোধমুক্তির প্রয়াস শুরু করেন নি, যেখানে ছিল একদম অচেনা পরিবেশ, অচেনা ভাষা, শ্বশুরকুলের আত্মীয় পরিজন, বিশেষ করে সতীনকন্যাদের চরম বিরুদ্ধাচারণ, যাতে কেবল তাঁর সম্পত্তি সংশয় হয়েছিল - তাই-ই নয়, প্রাণ সংশয়ের আশঙ্কাও ছিল।তবু কিন্তু নিজের সংকল্প থেকে রোকেয়াকে সরানো যায় নি। বিশ শতকের সূচনাপর্বে বাঙালি মুসলমান সমাজের একজন স্বশিক্ষিত রমণীর এই অদম্য সাহসিকতা আমাদের নবজাগরণের ইতিহাসে এক অনন্য নজির।
ভাগলপুরে বেশিদিন ইস্কুল চালাতে পারেন নি রোকেয়া তাঁর আত্মীয়কুলের বিরুদ্ধতাতেই। বোন হোমায়েরা এই সময়ে তাঁর কাছে ছিলেন। বোনকে সাথে নিয়ে স্বামীর এক সহকর্মী সরকারি আমলার সাহায্যকে অবলম্বন করে, একদম প্রাণ হাতে করে রোকেয়াকে ভাগলপুর ছাড়তে হয়েছিল। কেবল বাংলাতেই স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারে নয়, বিহারের অনুন্নত এলাকাতেও স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের যে মানসলোকের উদ্ভাসন রোকেয়া ঘটিয়েছিলেন, তা পরবর্তীতে, আমাদের জাতীয় আন্দোলনের কালে বিহারে জাতপাতের কদর্যতায় দীর্ণ সমাজজীবনে একটা দৃষ্টান্ত হিসেবেই কাজ করেছিল। সতীনাথ ভাদুড়ী বিহারের রাজনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতার নিরিখে ‘জাগরী’ সৃষ্টি করেছিলেন। এই উপন্যাসের ভিতর নারীর স্বাধিকারের যে ছায়া আছে, সেই চিত্রকল্প নির্মাণে, বিশ শতকের সূচনায় ভাগলপুরের রণাঙ্গনে একাকী নিঃসঙ্গ বাঙালি নারী বেগম রোকেয়ার ছায়া গভীর নিরীক্ষণে আমাদের সামনে উঠে আসে।
হতোমনোরথ হয়ে পড়লেন না রোকেয়া কলকাতায় এসে। নতুন উদ্যমে নেমে পড়লেন স্বামীর নামাঙ্কিত ইস্কুলটি মহানগরীর বুকে আবার শুরু করতে। রোকেয়ার ইস্কুল পুনঃপ্রতিষ্ঠার এই যে উদ্যোগ, তা অচিরেই হয়ে উঠেছিল সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করতে মুসলমান সমাজের কাছে এক সঞ্জীবনীমন্ত্র। নবজাগরণের কুশীলবেরা স্ত্রীশিক্ষা প্রসারে ঐতিহাসিক ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু বাংলার নারীসমাজের একটা বড়ো অংশ যে জাতে বাঙালি আর ধর্মে মুসলমান। এই অংশের মেয়েদের জন্যে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের কুমিল্লাতে নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী একটি ইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৮৭৩ সালে। স্যার সৈয়দ আহমদ আলিগড়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি শুরু করেন ১৮৭৫ সালে। এই প্রেক্ষিতে বলতেই হয়, মুসলমান সমাজে আধুনিকতার প্রসার প্রথম এই বাংলা থেকেই সূচিত হয়েছিল এবং সেটি করেছিলেন বাঙালি বিদূষী নারী নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী। কিন্তু তিনি ব্যতীত উনিশ শতকের নবজাগরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষেরা হিন্দু নারীর শিক্ষা নিয়ে সোচ্চার হলেও, মুসলিম নারীর শিক্ষা নিয়ে একটি পদক্ষেপও নেননি।
সৈয়দ আমীর আলি, নবাব আবদুল লতিফেরা আধুনিক শিক্ষাকে মুসলমান সমাজে জনপ্রিয় করতে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু সামাজিক প্রতিক্রিয়াকে অতিক্রম করে মুসলমান সমাজের অন্তঃপুরে স্ত্রীশিক্ষা প্রচলনে তাঁরাও উদ্যোগ নেন নি। এই অসম্ভব সাহসের কাজটি করেছিলেন রোকেয়া। বস্তুত রোকেয়ার এই উদ্যোগের ফলশ্রুতিতেই কেবল বাংলা নয়, গোটা অবিভক্ত ভারতে মুসলমান সমাজের ভিতরে স্ত্রীশিক্ষা প্রচলনে ধীরে ধীরে একটা নয়া-দিগন্ত উদ্ভাসিত হয়। আজ কেবল বাঙালি নারীর ক্ষেত্রেই নয়, বর্তমান পাকিস্তানেও স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারে যতোটুকু অগ্রগতি ঘটেছে, তার প্রাথমিক অগ্নিশলাকাটি জ্বলেছিল কিন্তু রোকেয়ার আলোকবর্তিকা থেকেই।