E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ১৬শ সংখ্যা / ৪ ডিসেম্বর ২০২০ / ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪২৭

সোচ্চার চিন্তা

প্রটোকল লিস্টের ১৪৩ নম্বর কী আরও নেমেছে এখন?

পল্লব সেনগুপ্ত


অনেকদিন আগে আকৈশোর সুহৃদ পবিত্র - অধ্যাপক পবিত্র সরকার হাসতে হাসতে আমাকে একটা তথ্য জানিয়েছিলেন। পবিত্র বলেছিলেন যে, ভারত সরকারের প্রটোকল লিস্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নম্বর হলো ১৪৩। অর্থাৎ তাঁর আগে যে ১৪২ নম্বরে আছেন, তাঁদের সকলেই প্রায় কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের সঙ্গে যুক্ত-রাষ্ট্রপ‍‌তি, উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, রাজ্যপাল, মুখ্যমন্ত্রী থেকে ক্রমান্বিত পর্যায়ে নামতে নামতে আধুলি-মন্ত্রী, সিকিমন্ত্রী, দুয়ানি অফিসার, একআনি অফিসার গয়রহ, গয়রহ পেরিয়ে গেলে তবে বেচারি উপাচার্য সরকারি কেতানুযায়ী খাতিরের ছিঁটেফোঁটা পাবার অধিকার পাবেন! পবিত্র নিজে দীর্ঘদিন উপাচার্যের পদে ছিলেন, তাই এই ব্যাপারে তাঁর সাক্ষ্য তো এক্কেবারে পাক্কা! অথেনটিক।

শুধোচ্ছেন তো, হঠাৎ এমন কী ঘটল যে বেচারি উপাচার্যদের পোজিশ্যন নিয়ে এই সাত-সকালে কলমবাজি করছি কেন?... বলছি।... কয়েকদিন আগে ওডিশার ৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদের জন্য ১৬জন প্রবীণ অধ্যাপককে সেই রাজ্যের রাজভবনে গিয়ে আচার্যের (অর্থাৎ, শ্রীমদ রাজ্যপালের) কাছে ইন্টারভিউ দিতে ডাকা হয়। একেই তো ইন্টারভিউ ব্যাপারটাই যথেষ্ট পরিমাণে ‘প্যান্তাখ্যাচাং’ (এই অভাজনেরও এক্ষেত্রে বেশকিছু ‘খিট্‌কেল’ অভিজ্ঞতা আছে, সুযোগ হলে কোনো সময়ে বলা যাবে) তার ওপরে ওডিশার রাজভবনে সেদিন যেটা হয়েছে, সেটা একইসঙ্গে হাস্যকর, বিরক্তিকর এবং অসম্মানজনকও বটে - শুধু সংশ্লিষ্ট উপাচার্যদের ক্ষেত্রেই নয়, উচ্চশিক্ষার সঙ্গে কমবেশিজড়িত সকলের পক্ষেই। অবশ্য কেন্দ্রে বিজেপি এবং এরাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস গদিতে বসার পর থেকেই যৌথভাবে উচ্চশিক্ষার যেভাবে মান এবং শিক্ষাদাতাদের সস্মান নষ্ট হচ্ছে, তাতে সেদিন ঘটে যাওয়া ব্যাপারটা অপ্রত্যাশিত হলেও অভাবনীয় বলতে পারছি নে।

কী ঘটেছিল সেদিন, সেটা বলি এবারে। হাস্যকর একটি নিয়ম অনুযায়ী রাজ্যপালরা সংশ্লিষ্ট রাজ্যের সমস্ত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান আচার্য। সুতরাং উপাচার্যরা তিনি ডে‍‌কে পাঠালে যাবেন - এটাই প্রত্যাশিত। উপাচার্যের নিয়োগেও তাঁর আনুষ্ঠানিক একটি সম্মতি লাগে। সমস্ত ব্যাপারটাই একটা ঔপনিবেশিক-আনুগত্যের উত্তরাধিকার ছাড়া আর কিছুই নয়; এমনকি খোদ রাজ্যপালের পদটাও তাই-ই। কিন্তু চিরকাল বিভিন্ন রাজ্যের রাজ্যপালরা সেই আনুষ্ঠানিকতাকে সম্মানই করতেন। কখনও অবশ্য কোনো রাজ্যপাল প্রত্যক্ষভাবে রাজ্যের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছেন কেন্দ্রের অঙ্গুলিহেলনে - এই রাজ্যেই দু’দুবার তেমনটা দেখার স্মৃতি আমাদের আছে। কিন্তু সাধারণভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা বা পঠনপাঠন নিয়ে তাঁরা নাসিকানুপ্রবেশ করাতেন না। কিন্তু বর্তমানে বিজেপি শাসনে প্রায় সর্বত্রই যাঁরা রাজ্যপাল হয়ে এসেছেন, তাঁরা প্রত্যক্ষ/অপ্রত্যক্ষভাবে আরএসএস কর্মী এবং কেন্দ্রীয় অঙ্গুলি নির্দেশেই রাজ্যের রাজনীতির সঙ্গে শিক্ষার ব্যাপারেও সক্রিয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এঁরা পর্যাপ্তভাবে উচ্চশিক্ষিত নন। অবশ্য সেটা অস্বাভাবিক নয়ও, কারণ যে দেশে বারো ক্লাস অবধি পড়া কেউ কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী হতে পারেন, যদি সেখানে রাজ্যপাল - যা বস্তুত আলঙ্কারিক পদ - যদি তেমন শিক্ষিত না হন, তাহলে কী-ই বা বলার আর থাকে!

।। দুই ।।

যাক সেসব কথা। যে উপলক্ষে এই লেখা - তাতেই ফিরি আবার। নির্দিষ্ট ১৬জন প্রবীণ অধ্যাপক, যাঁদের নাম মনোনীত করেছে সবদিক খুঁটিয়ে সার্চ কমিটিগুলি (এ নিয়েও কিছু বলার আছে অবশ্য, পরে বলছি) - তাঁরা যথাসময়ে রাজভবনে গিয়ে জানলেন যে, আচার্য তথা গভর্নর নিজে ইন্টারভিউ নেবেন না। নেবেন তাঁর সচিব, লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে। কারণ বলা হয় যে, আগের দিন গভর্নরের স্ত্রী প্রয়াত হয়েছেন, তাই তাঁর পক্ষে আসা সম্ভব নয়। ব্যাপারটা খুবই অবশ্য দুঃখের - কিন্তু এমন ক্ষেত্রে সমস্ত ব্যাপারটাই ক’দিনের জন্য তো মুলতবি রাখাই তো যেতো। কিন্তু তা না করে শোকার্ত অবস্থাতেও রাজ্যপাল মহোদয়, ১৬ জন প্রবীণ অধ্যাপকের ওপর খবরদারি করার জন্য নিজের সেক্রেটারিকে তিনজন সাগরেদ সহ পাঠিয়ে দিলেন চারটি প্রশ্নসমেত একখানি প্রশ্নপত্র এবং ১৬ পিস কাগজের সঙ্গে!

সেক্রেটারি সাহেব এসে সম্ভাব্য উপাচার্যদের হাতে কাগজ এবং প্রশ্ন ধরিয়ে দিলেন এবং গম্ভীর গলায় জানালেন ৪৫ মিনিটের মধ্যে উত্তরসমেত প্রশ্নপত্র ফেরত দিতে হবে। তারপরে সেই উত্তরগুলো পরীক্ষা করা হবে এবং পরীক্ষায় পাওয়া নম্বর অনুসারে উপাচার্য নিয়োগ হবে ৬টা ইউনিভার্সিটির। অর্থাৎ সেটা পুরোদস্তুর একখানা পরীক্ষা - যাতে পাশ-ফেলের ওপর চাকরি নির্ভর করছে!! সম্ভাব্য ভাইস চ্যান্সেলররা ঘাড় গুঁজে তিন ইনভিজিলেটরের কড়া ‘গার্ড’ দেওয়ার মধ্যে পরীক্ষা দিলেন। ৪৫ মিনিট পরে গার্ডবাবুরা ‘‘স্টপ রাইটিং’’ বলে গম্ভীর গলায় ফতোয়া দিয়ে উত্তরপত্রগুলি নিয়ে নিলেন। ওঁরা কড়া নজর রেখেছিলেন, যাতে সম্ভাব্য ভিসিরা যেন টোকাটুকি না করেন, কথাবার্তা না বলেন!! মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন নিশ্চয়ই?

।। তিন ।।

এবারে আসি ‘ভিসি মেরিট টেস্ট’ নামক ওই হাস্যকর এবং লজ্জাজনক খবরদারির প্রশ্নপত্রের বিষয়ে। ৪৫ ‍‌ মিনিটের মধ্যে এই চারটি প্রশ্নের জবাব চাওয়া হয়েছিলঃ
১. এই বিশ্বজগৎ নির্মিত হয়েছে... (কীভাবে, বলতে হবে)।
২. বিশ্বজগতের নির্মাণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা কী?
৩. আপনার অনেক অভিজ্ঞতা আছে। আপনার কর্মধারার পদ্ধতি কী?
৪. যদি ঈশ্বর আপনার সামনে উপস্থিত হয়ে কোনো বর দিতে চান, আপনি কী চাইবেন?

স্পষ্টতই প্রশ্নগুলির মধ্যে তৃতীয়টি ছাড়া আর কোনোটিই প্রাসঙ্গিক নয় এই ক্ষেত্রে। দ্বিতীয়টিও খুব অস্বচ্ছ। এবং চতুর্থটি তো সরাসরি আপত্তিকর। প্রথম প্রশ্নটির পরিপ্রেক্ষাও অস্পষ্ট। কী চাওয়া হয়েছে? বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আলোচনা? না কি, আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণের উপলব্ধি?

এই সমস্ত বিষয়টা নিয়ে একটা সামগ্রিক পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, কেবলমাত্র খবরদারি করার মানসেই রাজ্যপাল তাঁর গভীর শোকের কালেও এই ব্যাপারটা ঘটিয়েছেন প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক প্রণোদনা থেকেই। বিজেপি যেভাবে উচ্চশিক্ষাকে ধর্মায়িত করতে উদ্‌যোগী হয়েছে, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর দৃঢ়মুষ্টিকে উত্তরোত্তর দৃঢ়তর করে চলেছে, এই ঘটনা সে সবেরই সাম্প্রতিকতম একটি নিদর্শন। সম্ভাব্য উপাচার্যদেরকে ওইভাবে ফাঁকিবাজি, অস্থিরমতি ‘ইস্কুলের ছাত্তর’দের মতো কড়াশাসনে পরীক্ষা দিতে বাধ্য করাটা তো খুবই আপত্তিকর। এবং সমান আপত্তিকর হচ্ছে রাজ্যপালের সেক্রেটারি (যিনি পদমর্যাদায় উপাচার্যদেরও অনেক নিচে) এবং অন্যান্য করণিকস্তরের সহকারীদের দ্বারা ‘শাসিত’ হয়ে তাঁদের সেখানে ঘাড় গুঁজে বসে কলম চালানো! পদ এবং অর্থের (সম্মানের কথা চুলোয় যাক!) হাতছানি কী এতই লোভানিময় যে, ওই ১৬জন বিদ্বান বয়স্ক মানুষ এমনটায় সম্মত হলেন? ওঁরা ওই অসম্মানের পরীক্ষা-প্রহসন তো বয়কটও করতে পারতেন! নাকি তাতে পরে তাঁদের শারীরিক কিংবা জীবিকাকেন্দ্রিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবার ভয় ছিল?

।। চার ।।

কিছু কিছু স্মৃতি মনে আসছে। ১৯৫৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর তারিখে উত্তাল খাদ্য আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যাল‍‌য় থেকে বিশাল ছাত্র মিছিল বেরোবার মুখে কংগ্রেসি সরকারের পুলিশবাহিনী তার ওপর হামলা চালালে, সাময়িকভাবে ছাত্রীদের নিরাপত্তা রক্ষার্থে মিছিলটা গেটের ভিতর দিকে দাঁড়িয়ে যায়। প্রায় তৎক্ষণাৎই উপাচার্য নির্মলকুমার সিদ্ধান্ত নিজে নেমে এসে আক্রমণোদ্যত পুলিশবাহিনীকে প্রবল ধমকে পিছিয়ে যেতে বাধ্য করেন। শুধু তাই নয়, তখনই ঘরে ফিরে মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বি সি রায়কে ফোন করে বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘেরাও করে-রাখা পুলিশের বিশাল বাহিনীকে প্রত্যাহার করে নিতে বলেন। কলকাতা পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার মিঃ দত্ত (পুরো নামটা এই ৬১ বছর পরে আর মনে পড়ছে না) যিনি ওই ‘অপারেশন’-এর দায়িত্বে ছিলেন - তাঁকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠিয়ে রীতিমতো ধমক দেন উপাচার্য নির্মলকুমার - কেন তাঁর অনুমতি না নিয়ে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে পা রাখার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে, তার জন্য। মাথা নিচু করে সেদিন দাঁড়িয়েছিলেন সেই দাপুটে অফিসার! তেহি নো দিবসো গতা! ওই ঘটনার কয়েক মাস পরেই আমাদের কনভোকেশ্যন হয়েছিল। এখন যেখানে লেক স্টেডিয়াম, সেখানে খোলা মাঠে বিশাল প্যান্ডেল বেঁধে হয় সেই সমাবর্তন। সেখানে আচার্য হিসাবে তখনকার রাজ্যপাল শ্রীমতী পদ্মজা নাইডু যে ভাষণ দেন, তার একটা কথা আজও মনে পড়ে! উনি ভাষণ শুরুই করেছিলেন এই বলেঃ ‘‘আমি এখানে তোমাদের উদ্দেশে কিছু বলতে বড়োই সংকোচবোধ করছি। আমি যাঁদেরকে ডক্টরেট ডিগ্রি দিলাম, হাতে করে, এমএ, বিএ ডিগ্রি দিলাম - তাঁদের সকলের চেয়েই আমার লেখাপড়া অনেক কম - আমি তো কলেজেই পড়িনি! তাই সবিনয়ে এবং সঙ্কুচিতভাবেই কয়েকটা কথা বলব তোমাদেরকে...’’ এই মর্যাদাবোধ, এই নম্রতা, বিনয়, ভদ্রতা, শুভবুদ্ধি এখনকার গভর্নরদের কাছে কতটা প্রত্যাশিত জানি না! আর এখনকার যাঁরা উপাচার্য, তাঁদের কথা আর কী বলব? এই কলকাতারই একটি অতি-বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়াকে তো ‘মহামানা’ মুখ্যমন্ত্রীকে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করার ছবিও তো সংবাদপত্রে দেখার সুযোগ হয়েছে সকলের!! সুতরাং, আসুন একযোগে সবাই বলিল, ‘তেহি নো দিবসো গতা’।