৫৯ বর্ষ ২৫ সংখ্যা / ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ / ২১ মাঘ, ১৪২৮
আংশিক হলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলতে বাধ্য হলো রাজ্য সরকার
কলেজ স্ট্রিটে এসএফআই’র আন্দোলনের জয় উদ্যাপন।
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ অবশেষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে বাধ্য হলো মমতা ব্যানার্জি সরকার। এসএফআই’র নেতৃত্বে ছাত্রসমাজ, স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ, প্রকৃত শিক্ষাবিদদের ক্রমাগত চাপ এবং যুক্তির কাছে রাজ্য সরকার নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে অষ্টম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত স্কুল শিক্ষা এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠন শুরু হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষক মহল এবং ছাত্রসমাজের স্পষ্ট অভিমত হলো, একেবারেই নিম্ন শ্রেণি থেকে সমস্ত শ্রেণির শিক্ষা এখনই শুরু করতে হবে।
‘অনেক হলো, আওয়াজ তোলো, স্কুল কলেজের দরজা খোলো’ - স্লোগান তুলে ধারাবাহিকভাবে দীর্ঘ প্রায় দেড় বছরের বেশি সময় রাস্তায় থেকেছে এসএফআই। ২০২০-র মার্চে অপরিকল্পিত লকডাউনের সময় যেভাবে সমস্ত স্কুল-কলেজ বন্ধ করে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে রাজ্য তথা দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে, করোনা আতঙ্কের দোহাই দিয়ে আজও তা পুরোপুরি খোলেনি। ফলত রাজ্যের একটা বড়ো অংশের ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন দেখা দিয়েছে।
দীর্ঘ এই সময় স্কুল কলেজ বন্ধ করে রাখা হলেও ধাপে ধাপে খুলে গেছে সবই। রাজ্যে সিনেমা হল খোলা, শপিং মল খোলা, রেস্তোরাঁ খোলা, বার খোলা, পরিবহণ খোলা, বাজার দোকান খোলা, অফিস কাছারি খোলা - বন্ধ শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কোনো এক অজানা কারণে বন্ধ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ সব খুলে গেলেও কেন শুধুমাত্র স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, পঠন পাঠন বন্ধ - তার কোনো উত্তর দেয়নি রাজ্যের তৃণমূল সরকার।
দীর্ঘ ২০ মাস বন্ধ করে রাখার পর ২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর সাময়িকভাবে খুলে গেছিল স্কুল। অবশ্য পুরোপুরি নয়। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। যদিও সংক্রমণ বেড়ে চলার অজুহাতে ফের তা বন্ধ করে দেওয়া হয় গত ৩ জানুয়ারি। এর পরবর্তী সময়ে সংক্রমণ অনেকটাই কমে এলেও স্কুল-কলেজ খোলার কোনো সদর্থক পদক্ষেপ সরকারের পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয়নি। উলটে সরকার অনেক বেশি উৎসাহিত ছিল অনলাইন শিক্ষায় অথবা হালের আমদানি ‘পাড়ায় পাড়ায় শিক্ষা’তে। যাকে অনেকেই ব্যঙ্গ করে বলছেন ‘দুয়ারে শিক্ষা’।
গত বছরের আগস্ট মাসে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান জানিয়েছিলেন, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ড্রপ আউটের সংখ্যা পৌঁছে গেছে ১৫ কোটিতে। দেশে মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কমবেশি প্রায় ৩২ কোটি। এদের মধ্যে প্রায় ৩৭ শতাংশ ছাত্রী হয়তো আর কখনই স্কুলে ফিরতে পারবে না। চরম বিপদের মধ্যে আছে কমপক্ষে ১ কোটি ছাত্রী। প্রাথমিক স্তরের তুলনায় মাধ্যমিক স্তরে ড্রপআউটের হার প্রায় ১৭ শতাংশ বেশি। হয়তো এর বড়ো অংশটাকেই আর স্কুলমুখী করে তোলা যাবে না। ছাত্রীদের মধ্যে দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকার কারণে অনেককেই যৌন নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছে। এইসময়েই দেশে অনেকটাই বেড়ে গেছে নাবালিকা বিয়ের সংখ্যা। সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে, মহামারীর প্রকোপে ছাত্রদের থেকে বেশি বিপদের মুখে ছাত্রীরা। ন্যাশনাল রাইট টু এডুকেশন পলিসির রিপোর্ট অনুসারে প্রায় ১ কোটি ছাত্রী হয়তো আর কখনই স্কুলে ফিরতে পারবে না।
দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকায় দেশজুড়ে চালু হয়ে গেছে অনলাইন শিক্ষা। যদিও শুধুমাত্র ডিজিটাল বৈষম্যের কারণে সেই শিক্ষা সর্বস্তরের ছাত্রছাত্রীর কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়নি। নেটওয়ার্কের সমস্যা, ডিজিটাল ডিভাইস না থাকা প্রভৃতি কারণে মোট ছাত্রছাত্রীদের বড়ো অংশই এই মাধ্যমে শিক্ষালাভে বঞ্চিত হয়েছে। বলা ভালো, কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের ভুল পদক্ষেপের কারণে দেশ এবং রাজ্যের বড়ো অংশের ছাত্রছাত্রীরা দীর্ঘ সময় বইখাতা থেকে দূরে। সমীক্ষা বলছে, এদের একটা বড়ো অংশ প্রাথমিক পড়াশুনো সম্পূর্ণ ভুলে গেছে। লকডাউন এমারজেন্সি রিপোর্ট অফ স্কুল এডুকেশন-এর করা সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, প্রায় ৫০ শতাংশর বেশি ছাত্রছাত্রী অক্ষর ভুলে গেছে। দেশের প্রায় ২.৫ লাখ গ্রামের মাত্র ২.৫ শতাংশ গ্রামে এখনও পর্যন্ত নেটওয়ার্ক ঠিকঠাক পাওয়া যায়।
এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় প্রথম থেকেই রাস্তায় ছিল এসএফআই। বাম ছাত্র সংগঠনগুলি তাদের একাধিক আন্দোলন কর্মসূচির মধ্যে বারবার জোর দিয়েছে স্কুল খোলার। ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে ফেরানোর। ক্লাসরুম খুলে দেবার। যে আন্দোলন করতে গিয়ে বারবার রক্তাক্ত হতে হয়েছে ছাত্র নেতানেত্রীদের। শুধুমাত্র শিক্ষার অধিকারের দাবি তুলে পথে নেমে রাজ্য সরকারের পুলিশের হাতে বারবার গ্রেপ্তার, নিগৃহীত হতে হয়েছে এসএফআই কর্মী-সমর্থ-নেতৃত্বকে। যদিও হাল না ছেড়ে লড়াই চালিয়ে গেছে এসএফআই। সেই লাগাতার আন্দোলনের কাছে অবশেষে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছে রাজ্য প্রশাসন এবং গত ৩১ জানুয়ারি প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে স্কুল খোলার। যদিও এখন শুধুমাত্র অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্তই স্কুল খুলেছে। খুলছে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পলিটেকনিক। পঞ্চম থেকে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের পড়াশুনো করানো হবে পাড়ায় পাড়ায় শিক্ষা প্রকল্পে।
যেদিন প্রশাসন এই ঘোষণা করেছে, সেদিনও রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত উত্তাল হয়েছিল স্কুল-কলেজ-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেবার দাবিতে এসএফআই’র আন্দোলনে। তার আগে বিশ্বভারতী থেকে কলেজ স্ট্রিট, ডোমজুড় থেকে সিউড়ি, এয়ারপোর্ট থেকে ভগবানগোলা, বিধাননগর থেকে জঙ্গলমহল - আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়েছিল এসএফআই। প্রায় প্রতিটি জায়গাতেই অবধারিতভাবে বাধা দিয়েছে রাজ্যের পুলিশ বাহিনী। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ছাত্রনেতাদের। যদিও হাল ছাড়েনি ছাত্ররা। রাজ্য সরকারকে নতি স্বীকার করিয়ে আংশিক জয় ছিনিয়ে নেবার পর এসএফআই জানিয়েছে, আন্দোলনের পথ থেকে তারা সরছে না। যতক্ষণ না রাজ্যের সমস্ত স্কুল খুলছে এবং সমস্ত ছাত্রছাত্রীকে স্কুলে ফেরানো সম্ভব হচ্ছে ততদিন লড়াই জারি থাকবে।