৫৯ বর্ষ ২৫ সংখ্যা / ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ / ২১ মাঘ, ১৪২৮
জনগণের জরুরি দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সংগ্রাম গড়ে তোলো
সিপিআই(এম) হাওড়া জেলা ২৪তম সম্মেলনের আহ্বান
শংকর মুখার্জি
হাওড়া জেলা সম্মেলন উদ্বোধন করছেন রবীন দেব। মঞ্চে হান্নান মোল্লা, সূর্য মিশ্র, শ্রীদীপ ভট্টাচার্য সহ নেতৃবৃন্দ।
“জনগণের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করে জনজীবনের জরুরি দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সংগ্রাম গড়ে তোলো। গড়ে তোলো সংগ্রামীদের সংগঠন” - এই প্রত্যয়ী আহ্বান জানিয়ে সমাপ্ত হলো সিপিআই(এম) হাওড়া জেলা ২৪তম সম্মেলন। সম্মেলনের অভিমত হলোঃ হাওড়া জেলার বুকে হার না মানা লড়াই শুরু করার সময় উপস্থিত । পার্টি ও গণফ্রন্টের বহুবিস্তৃত সংগঠন গড়ে তোলার সুযোগের সদ্ব্যবহার করাই হলো এই সময়ের ডাক।
পার্টির হাওড়া জেলা দপ্তরে গত ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি চিত্তব্রত মজুমদার সভাকক্ষে এই সম্মেলন হয়। সম্মেলন উপলক্ষে সমগ্র অঞ্চলের নামকরণ করা হয় কমরেড নিরুপম সেন নগর। কমরেড পদ্মনিধি ধর-মধু মুখার্জি-সুশীল দিন্দা-দেবী পাঠক-বটকৃষ্ণ দাস মঞ্চে প্রতিনিধি সম্মেলন হয়। প্রতিনিধি ও দর্শক মিলিয়ে সম্মেলনে ৩৩৬ জন উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনের সূচনায় রক্তপতাকা উত্তোলন করেন জেলা পার্টির প্রবীণ নেতা স্বদেশ চক্রবর্তী। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা রবীন দেব সম্মেলন উদ্বোধন করেন।
হাওড়া জেলায় নগরায়ণের হার খুবই বেশি। হাওড়া শহর, বালি ও উলুবেড়িয়া জেলার তিনটি পৌরাঞ্চল। কিন্তু জেলার বহু পঞ্চায়েত এলাকায় আজ আর কোনো গ্রামের চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। জেলায় শহরাঞ্চলই বেশি। গ্রামাঞ্চল ক্রমহ্রাসমান। গ্রামেও কৃষিজমি শিল্পজমিতে পরিণত হচ্ছে। আবার অনেক জায়গায় মাছচাষ হচ্ছে কৃষিজমিতে। হাওড়া জেলার গ্রামে এখন কৃষকের চেয়ে অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা বেশি। এটা একেবারেই নতুন বৈশিষ্ট্য। বহু গ্রাম এখন ‘আরবানাইজড ভিলেজ’। অন্যদিকে, জেলার মধ্যদিয়ে যাওয়া জাতীয় সড়ক ও রাজ্য সড়কের ধারে বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে গড়ে ওঠে অসংখ্য ছোটো বড়ো মাঝারি কারখানা। সেখানে কর্মরতরা এক নতুন শিল্পশ্রমিক। তবে তৃণমূল জমানায় একটাও নতুন কারখানা গড়ে ওঠে নি, বরঞ্চ বন্ধ হয়েছে অনেকগুলি। আর এখন যা তৈরি হচ্ছে তা সবই ওয়ারহাউস। সেখানে মূলত কাজ লোডিং-আনলোডিংয়ের। অন্যদিকে উদারনীতির আঘাতে জেলার পুরনো শিল্পাঞ্চলগুলির ছবি খুবই বিবর্ণ। উভয় শিল্পাঞ্চলেই শ্রমিকশোষণ মারাত্মক আকার নিয়েছে। এই আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটেই আগামীদিনে পার্টি সংগঠন গড়ে তোলার কাজ। তাই প্লেনাম নির্দেশিত পথেই সাংগঠনিক কাজের মূল অভিমুখ হবে গ্রামে শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুরদের নিয়ে শ্রমজীবীদের ফেডারেশন গড়ে তোলা আর শহরাঞ্চলে মেহনতি মানুষ এবং বস্তিবাসীদের সংগঠিত করতে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান। বিশেষ নজর থাকবে সমস্ত গণফ্রন্ট থেকেই তরুণ সম্প্রদায়কে পার্টিতে নিয়ে আসার দিকে।
● ● ●
এই সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনের সাথেই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে খুব সতর্ক ও স্বচ্ছ পদক্ষেপ ফেলতে হবে। উদ্বোধনী ভাষণে সেই কথাই বলেছেন রবীন দেব। তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদি লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে কে শক্র কে মিত্র তা প্রকাশ পায়। প্রতিটি পরিস্থিতিতে, প্রতিটি বাঁকমোড়ে আমাদের মূল শক্রকে চিহ্নিত করতে হয়। দেখতে হবে যাতে কোনো ঐক্য প্রয়াসে ভুল হয়ে শক্র যেন লাভবান না’হয়ে যায়। এই ঐক্য প্রয়াসে বহু দলই হবে অস্থায়ী শরিক। মূল লক্ষ্য থাকবে আমাদের শ্রেণির জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা। পার্টির মধ্যে শুধু সদস্য বৃদ্ধি করলেই চলবে না, সদস্যের গুণগত মান উন্নত করার দিকেও নজর দিতে হবে।
২০১৮ সালের ১৫ থেকে ১৭ জানুয়ারি হাওড়া জেলা ২৩তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। চার বছর পর আবার সম্মেলন। এই দীর্ঘসময়ে জেলায় পার্টির রাজনৈতিক-সাংগঠনিক কার্যধারার প্রতিবেদন পেশ করেন বিদায়ী জেলা সম্পাদক বিপ্লব মজুমদার। বর্তমানে জেলায় ২৭টি এরিয়া কমিটিতে এবং প্রত্যক্ষ শাখা মিলিয়ে মোট শাখা ৬৭৯ টি। মোট পার্টিসদস্য ৬,৪১৯। বিগত চার বছরে পার্টিকে নিষ্ক্রিয় সদস্য মুক্ত করার প্রচেষ্টা জারি ছিল।তবে সব ক্ষেত্রে সমান সাফল্য পাওয়া গেছে একথা বলা যাবে না। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত চার বছরে আড়াই হাজারেরও বেশি জনের সদস্যপদ খারিজ করা হয়েছে। সমসংখ্যক না’হলেও পার্টিতে নতুন অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে দেড় হাজারেরও বেশি। ফলে গত সম্মেলনের পরবর্তী সময়ে জেলা পার্টিতে সদস্য সংখ্যা কিছুটা কমেছে। জেলায় ২৯১ টি শাখায় সহায়ক গ্রুপ থাকলেও এই গ্রুপের সদস্যদের প্রার্থী সদস্য পদে উন্নীত করার ক্ষেত্রে দুর্বলতা আছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রত্যেক শাখায় সম্ভব-সুযোগ অনুযায়ী শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুর, ছাত্র, যুব, মহিলা এবং বস্তি সংগঠন গড়ার ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিতে হবে। জনগণের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে তৈরি করতে হবে স্থায়ী বুথ টিম এবং বুথ সংগ্রাম কমিটি। আশু আদায়যোগ্য দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলতে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে সুনির্দিষ্টভাবে। এছাড়াও মতাদর্শগত সংগ্রাম, রাজনৈতিক শিক্ষা, গণসংগ্রহ, পার্টি পত্রপত্রিকা প্রচার বিষয়েও প্রতিবেদনে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
● ● ●
বর্তমানে রাজ্য ও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, মতাদর্শগত সংগ্রাম, লড়াই-আন্দোলন প্রভৃতি বিষয়ে আলোকপাত করে সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য ও রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র, পলিট ব্যুরো সদস্য হান্নান মোল্লা, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্রীদীপ ভট্টাচার্য ও রাজ্য কমিটির সদস্য দীপক দাশগুপ্ত।
সূর্য মিশ্রের বক্তব্যেও বুথ সংগ্রাম কমিটির প্রসঙ্গ এসেছে। তিনি বলেছেন, বুথ সংগ্রাম কমিটি শুধু ভোটের জন্য নয়। এই কমিটি সক্রিয় থাকবে সারা বছর। সম্মেলন করতে হবে গণফ্রন্টগুলির প্রাথমিক কমিটির। আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে একেবারে নিচের স্তর থেকে। শুধু কর্মসূচি পালনের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ঘিরে রাখতে হবে গ্রাম পঞ্চায়েত ও মিউনিসিপ্যালিটি অফিস। তিনি ফের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, মতাদর্শগতভাব উপযুক্ত না থাকলে রাজনীতি ভুল হয়ে যাবে। মতাদর্শ ও রাজনীতি এই দুয়ের ওপরই নির্ভর করছে সংগঠন এবং সংগ্রাম। এই চারটিই হচ্ছে আমাদের চলার পথে মূল হাতিয়ার।
এক বছর ধরে চলা কৃষক আন্দোলনের নানা দিক তুলে ধরেন হান্নান মোল্লা তাঁর বক্তব্যে। তিনি বলেন, কৃষক আন্দোলন শুধু নরেন্দ্র মোদিকে মাথা নত করায়নি, এই প্রথম সরাসরি করপোরেটকে আঘাত করতে পেরেছে। কৃষক আন্দোলন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ঐক্যের পরিবেশ রচনা করেছে। ভালো সংখ্যক মহিলাকে আন্দোলনে নিয়ে এসেছে। তাঁর মতে,এমন আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে যা শত্রুর বুকে কাঁপন ধরাবে, আশা সঞ্চার করবে মিত্রের মনে। মনে রাখতে হবে কর্মসূচি পালন আর আন্দোলন অভিন্ন নয়। এতো দিন শ্রমিক-কৃষক ঐক্য শুধু খাতায়কলমেই থেকে গিয়েছিল। এই কৃষক আন্দোলনে তার সফল প্রয়োগ ঘটেছে। এই ঐক্য গড়ে তোলায় মূল ভূমিকা পালন করেছে সারা ভারত কৃষক সভা। এখন কৃষক, শ্রমিক এবং খেতমজুর ঐক্যের একটা রোডম্যাপ তৈরি হয়েছে। এই তিন অংশের মানুষকে একসঙ্গে নিয়ে আসতে পারলেই আন্দোলনের বুনিয়াদ তৈরি হবে। হান্নাম মোল্লা পরিশেষে প্রতিনিধিদের উদ্দেশে বলেন, পার্টি নেতা-কর্মীদের কমিউনিস্ট হয়ে ওঠার অনুশীলনে সদা নিয়োজিত থাকতে হবে।
● ● ●
খসড়া রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রতিবেদনের ওপর আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ৪৭ জন প্রতিনিধি। তাঁরা মোট ৪৫৯ মিনিট আলোচনা করেছেন। বিগত চার বছরে জেলায় পার্টির রাজনৈতিক-সাংগঠনিক কার্যধারা, আন্দোলন-সংগ্রাম, নির্বাচনী লড়াইয়ের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন প্রতিনিধিরা। গত প্রায় দুবছরে কোভিড মহামারীর সময়ে কীভাবে পার্টিকর্মী ও রেড ভলান্টিয়াররা কাজ করেছেন সেই কথাও জানিয়েছেন প্রতিনিধিরা। বর্তমানে জেলায় দুটি শ্রমজীবী ক্যান্টিন চলছে। একটি ৫০০ দিন, অন্যটি ২০০ দিন অতিক্রম করেছে। জেলার বিভিন্ন জায়গায় সাময়িকভাবে লঙ্গরখানা, জনতা পরিবহণ, সবজি বাজার চালিয়েছেন পার্টিকর্মীরা। রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছেঃ জেলায় এগারোশোরও বেশি রেড ভলান্টিয়ার কাজ করেছেন। তাঁরা জনগণের কাছ থেকে ৩ কোটি টাকারও বেশি অর্থসাহায্য এবং অক্সিজেন সিলিন্ডার সহ নানাবিধ চিকিৎসা সরঞ্জাম পেয়েছেন। এসময়ে জেলাজুড়ে ৫৭টি রক্তদান শিবির সংগঠিত হয়েছে।
আশু আদায়যোগ্য দাবিতে বেশ কিছু ক্ষেত্রে আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। তবে সবেতেই যে সফলতা মিলেছে সেকথা বলা যাবে না। প্রতিনিধিরা জানিয়েছেনঃ স্কুলের ফি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে বাগনান, ডোমজুড় ও দক্ষিণ হাওড়ায়, জঙ্গলপুর শিল্পাঞ্চলে নিকাশি ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে, মঙ্গলাহাটের জমি বিক্রি করে দেওয়ার বিরুদ্ধে, হাওড়া শহরের কদমতলায় রাস্তা সংস্কারের দাবিতে, উলুবেড়িয়ায় আইওসি’র পাইপলাইনের জন্য নেওয়া জমির ন্যায্য ক্ষতিপূরণের দাবিতে আন্দোলনের মতো বেশকিছু আন্দোলন সংশ্লিষ্ট স্থানে জনমানসে আলোড়ন তৈরি করে। আন্দোলনগুলি দাবি আদায়েও সফল হয়। রূপনারায়ণ নদ বাঁচানোর দাবিতে প্রচার আন্দোলনও ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল।
জেলায় জাতীয় ও রাজ্য সড়কের দুধারে যে অসংখ্য কারখানা হয়েছে সেখানে শ্রমিক শোষণ এক অকল্পনীয় স্তরে পৌঁছেছে। শ্রমিক ফ্রন্টে কর্মরত প্রতিনিধিরা জানিয়েছেনঃ এই কারখানাগুলিতে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তুলতে যথেষ্ট বাধার মুখোমুখি পড়তে হয়। এখানে বহু কারখানায় সাপ্তাহিক ছুটি বলে কিছু নেই। যখন খুশি মালিকরা ছাঁটাই করে। আর যেগুলি লজিস্টিক হাব হয়েছে সেখানে কোনো শ্রমিককেই মালিকরা তিন-চার মাসের বেশি কাজ করায় না। এখানে ১৯ কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলা গেছে। এরকমই একটি কারখানা লাইফ কেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের শ্রমিকরা মালিক এবং তৃণমূলী গুন্ডাদের আক্রমণকে প্রতিহত করেই বিভিন্ন দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালাচ্ছেন।
জেলার বিভিন্ন জায়গায় এখনও বিচ্ছিন্নভাবে সন্ত্রাস আছে। আমতার প্রতিনিধি জানিয়েছেন, এখানকার চন্দ্রপুর অঞ্চলের পার্টি সদস্য ও কর্মীরা তৃণমূলী সন্ত্রাসের কারণে ১২ বছর ঘরছাড়া। এছাড়াও প্রতিনিধিরা তাঁদের বক্তব্যে কীভাবে কৃষকরা কৃষিকাজে উৎসাহ হারাচ্ছেন, গ্রামে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং তাদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে সম্যসা, পঞ্চায়েত-পৌরসভায় তৃণমূলের লাগামছাড়া দুর্নীতি, সমবায়গুলি তৃণমূলের দূর্নীতির আখড়ায় পরিণত হওয়া, নির্বাচনে প্রচার থেকে ভোটগণনা পর্যন্ত প্রতিটা স্তরে তৃণমূলের সন্ত্রাস প্রভৃতি বিষয়ে আলোকপাত করেন।
হাওড়া শহরের ফুসফুস ডুমুরজলা মাঠে সবুজ ও জলাভূমি ধ্বংস করে আবাসন প্রকল্প গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছে রাজ্য সরকার। এর বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই রাস্তায় আন্দোলন এবং আইনি লড়াই শুরু হয়েছে। সম্মেলন এর বিরুদ্ধে ধারাবাহিক ও জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। ডুমুরজলার মাঠকে কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত করার বিরুদ্ধে এবং এই নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে একটি প্রস্তাবও সম্মেলনে গৃহীত হয়েছে।
প্রতিনিধিদের আলোচনার ওপর জবাবী ভাষণ দেন বিদায়ী সম্পাদক বিপ্লব মজুমদার। কিছু সংশোধনী-সংযোজনী সহ রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রতিবেদন সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয়।
● ● ●
সম্মেলনের একেবারে শেষপর্বে বক্তব্য রাখেন শ্রীদীপ ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, দেশের কমিউনিস্ট ও বাম আন্দোলন সবচেয়ে কঠিন সময়ের মধ্যদিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। তবে এর মধ্যেও ইতিবাচক দিক আছে। নয়াউদারবাদের বিরুদ্ধে জীবনজীবিকার লড়াই কিংবা অতিমারীর সময়ে আর্ত-মানুষের পাশে দাঁড়ানো এসবই দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন করেছে মতাদর্শ ও লক্ষপথে অবিচল থেকে। আদর্শহীনতার এই সময়ে কমিউনিস্টরাই একমাত্র নৈতিকতা ও মূল্যবোধ নিয়ে রাজনীতি করছে। কমিউনিস্টরা শুধু সত্যকে প্রতিফলিত করে না, তার মধ্যে নেতিবাচক দিকগুলিকে সংশোধন করার লড়াইতে যুক্ত থাকে। তাই জন্যই কমিউনিস্টরা অন্যদের থেকে আলাদা। তিনি প্রতিনিধিদের স্মরণ করিয়ে দেন, পার্টি সংগঠনকে সময়োপযোগী করতে প্লেনাম নির্দেশিত পাঁচ দফা কাজের ভিত্তিতে পার্টিসদস্যদের মূল্যায়নকে গুরুত্ব দিয়ে করতে হবে। আবার পার্টিসদস্যদের নিজেদের কার্যধারা দ্বারা অন্যদের আকৃষ্ট করতে হবে। পার্টিসদস্যদের মধ্যে বিপ্লবী গুণাবলি বাড়ানো না গেলে গণলাইন সম্পন্ন পার্টি গড়ে তোলা কখনই সম্ভব হবে না।
দু'দিনের জেলা সম্মেলনে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য কল্লোল মজুমদার, দেবব্রত ঘোষ, সুভাষ মুখার্জি, রূপা বাগচি, অতনু সাহা। দিলীপ ঘোষ, অপর্ণা পুরকায়েত, আক্কেল আলি, মঙ্গল বেন বংশী, নিমাই সর্দারকে নিয়ে গঠিত সভাপতিমণ্ডলী সমগ্র সম্মেলন পরিচালনা করেন।
সিপিআই(এম) হাওড়া জেলা ২৪তম সম্মেলন -
নতুন জেলা কমিটি গঠিত
সম্মেলন থেকে সর্বসম্মতিতে ৫০ জনের জেলা কমিটি তৈরি হয়েছে। সম্মেলন মঞ্চে অনুষ্ঠিত নবনির্বাচিত জেলা কমিটির প্রথম বৈঠক থেকে দিলীপ ঘোষ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এই জেলা কমিটিতে ৩ জন বিশেষ আমন্ত্রিত রয়েছেন। এঁরা হলেনঃ বিপ্লব মজুমদার, অরূপ রায় এবং কৃষ্ণস্বপন মিত্র। জেলা সম্পাদকমণ্ডলী ২৩তম পার্টি কংগ্রেসের পর তৈরি হবে। পুরনো জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর যাঁরা নতুন জেলা কমিটিতে নির্বাচিত হয়েছেন তাঁরাই এখন কাজ চালাবেন। জেলা সম্মেলন থেকে রাজ্য ২৬তম সম্মেলনের জন্য ১২ প্রতিনিধি এবং ৫ বিকল্প প্রতিনিধি সর্বসম্মতিতে নির্বাচিত হয়েছেন।
সম্মেলনে গৃহীত ১৫ প্রস্তাব
হাওড়া জেলা ২৪তম সম্মেলনে ১৫ টি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। গৃহীত প্রস্তাবগুলি হলোঃ
১) বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও ভারতকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ছোটো অংশীদারিত্বে পরিণত করার অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে আন্দোলন জারি রাখো এবং সমাজতান্ত্রিক ও বিকল্প নীতির সংগ্রামকে জোরদার করো।
২) দেশব্যাপী রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ ও বিলগ্নিকরণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।
৩) শ্রমিকের অর্জিত অধিকার হরণকারী চারটি শ্রমকোড বাতিল করতে হবে।
৪) চাই কৃষকের স্বার্থবাহী নয়া কৃষিআইন, চাই কৃষকের ফসলের লাভজনক দামের আইনি নিশ্চয়তা।
৫) হাওড়া জেলা সেচ নিকাশি সমস্যার সমাধান, নদী ভাঙন রোধ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে নিম্ন দামোদর সংস্কার প্রকল্প ও রূপনারায়ণ নদের আমূল সংস্কার করতে হবে।
৬) মহিলাদের ওপর ক্রমাগত বেড়ে চলা নিপীড়ন ও আক্রমণের বিরুদ্ধে আন্দোলন জারি রাখো।
৭) সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম জারি রাখো।
৮) উদারীকরণ অবক্ষয়ী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট মতাদর্শ, মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতার রক্ষা করার সংগ্রাম।
৯) দেশ ও রাজ্যে গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক অধিকার, নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষার আন্দোলন জোরদার করো।
১০) শিক্ষার বেসরকারিকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ ও গেরুয়াকরণের বিরুদ্ধে এবং জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ বাতিলের দাবিতে প্রস্তাব।
১১) কর্মসংস্থানের দাবিতে প্রস্তাব।
১২) ডুমুরজলার মাঠকে কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রস্তাব।
১৩) সমবায় ধ্বংস করার চক্রান্ত এবং মাইক্রোফিন্যান্সের বিরুদ্ধে।
১৪) নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রস্তাব।
১৫) শাসকের স্বার্থবাহী গণমাধ্যমের গণতন্ত্র-বিরোধী ভূমিকার বিরুদ্ধে প্রস্তাব।
১৬) পেগাসাস নজরদারির প্রতিবাদে সোচ্চার হোন।
প্রতিনিধি অধিবেশনের সূচনায় সভাপতিমণ্ডলীর পক্ষে শহিদ স্মরণে ও শোকপ্রস্তাব পেশ করেন অর্পণা পুরকায়েত ও দিলীপ ঘোষ।
সম্মেলনে উপস্থিত ৩৩৬ প্রতিনিধি ও দর্শক
সিপিআই(এম) হাওড়া জেলা সম্মেলনে ২৬৯ জন প্রতিনিধি এবং ৮৩ জন দর্শক অংশ নেওয়ার কথা ছিল। সম্মেলনে পেশ করা প্রতিনিধিপত্রের রিপোর্ট থেকে জানা গেছে সম্মেলনে ২৬৭ জন প্রতিনিধি এবং ৬৯ জন দর্শক, মোট ৩৩৬ জন উপস্থিত ছিলেন। এঁদের মধ্যে সর্বক্ষণের কর্মী ছিলেন ৪৬ জন এবং পেশাগত দিকদিয়ে ৮৭ জন শ্রমিক, ৫১ জন কৃষক ও ৩০ খেতমজুর ছিলেন। সবচেয়ে বয়স্ক প্রতিনিধি রবীন্দ্রনাথ মিত্র, বয়স্ক দর্শক প্রদ্যোত হাজরা। দুজনেরই বয়স ৮১ বছর। দুজনেরই পার্টি জীবন পাঁচ দশকের বেশি সময়। প্রতিনিধি ও দর্শকদের মধ্যে নবীন শিল্পা মণ্ডল এবং অঙ্কিত ভট্টাচার্য। জেলজীবনের অভিজ্ঞতা আছে ২৫ প্রতিনিধি ও ২ দর্শকের।আত্মগোপনের অভিজ্ঞতা রয়েছে ৩৬ জন প্রতিনিধি ও ৩ জন দর্শকের। সবচেয়ে বেশি জেলজীবন অসীম চক্রবর্তী এবং আত্মগোপন প্রশান্ত ব্যানার্জি ও সামশুল মিদ্দার। মোট ১১৬ জন প্রতিনিধি-দর্শক গত দশ বছরে তৃণমূলীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন।
দুটি বই প্রকাশ
২৮ জানুয়ারি পার্টির রাজ্য দপ্তরে হাওড়া জেলার পার্টির উদ্যোগে দুটি বই ‘জন্মদ্বিশতবর্ষে এঙ্গেলস প্রবন্ধ সংকলন’ এবং বাংলায় ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস ১৯২০-৬৪’ বই দুটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেন বিমান বসু। ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস ১৯২০-৬৪’ বইটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন পার্টির হাওড়া জেলার নেতা কৃষ্ণস্বপন মিত্র।