৫৯ বর্ষ ২৫ সংখ্যা / ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ / ২১ মাঘ, ১৪২৮
সিপিআই(এম) তেলেঙ্গানা রাজ্য তৃতীয় সম্মেলন
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ রাজ্যের টিআরএস সরকার এবং কেন্দ্রের আরএসএস-বিজেপি পরিচালিত সরকারের জনবিরোধী নীতি সমূহের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এটাই এই মুহূর্তের প্রধান কাজ। ২২ থেকে ২৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত তেলেঙ্গানা রাজ্য সম্মেলন থেকে এই আহ্বান জানানো হয়।
অনলাইন সভার মধ্য দিয়ে তেলেঙ্গানা রাজ্য সম্মেলন শুরু হয় ২২ জানুয়ারি। এই সভায় বক্তব্য রাখেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি, পলিট ব্যুরো সদস্য বৃন্দা কারাত এবং বিভি রাঘভুলু, রাজ্য সম্পাদক তাম্মিনেনি বীরভদ্রম সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। ব্যাপক সংখ্যায় রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এই অনলাইন সভায় যুক্ত হন। রাজ্যের ১৫৫ টি জায়গায় জনগণের জন্য বড়ো স্ক্রিন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
সম্মেলন থেকে ৬০ সদস্যের নতুন রাজ্য কমিটি গঠিত হয়। নবগঠিত রাজ্য কমিটির প্রথম বৈঠক থেকে ১৫ সদস্যের সম্পাদকমণ্ডলী তৈরি হয়। থাম্মিনেনি বীরভদ্রম সম্পাদক হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হন। নবগঠিত রাজ্য কমিটিতে আটজন মহিলা সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। সম্পাদকমণ্ডলীতে মহিলা সদস্য রয়েছেন দু’জন। প্রতিনিধি অধিবেশন পর্ব শুরু হয় ২৩ জানুয়ারি। এদিন রক্ত পতাকা উত্তোলন করেন প্রবীণ সিপিআই(এম) নেতা সারামপাল্লি মাল্লা রেড্ডি। এই পর্বের উদ্বোধন করেন সীতারাম ইয়েচুরি। তিনি তাঁর বক্তৃতায় জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করে কমিউনিস্ট আন্দোলনের আগামী লড়াই আন্দোলনের বিষয় তুলে ধরেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে পার্টির সামনে থাকা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বিজেপি-কে সরকার থেকে উৎখাত করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, দেশ এবং দেশের জনগণের ওপর সার্বিক আক্রমণ নামিয়ে এনেছে বিজেপি এবং সংঘ পরিবার।
এই পর্বে সিপিআই’র তেলেঙ্গানা রাজ্য সম্পাদক চাডা রেড্ডি, সিপিআই(এম) অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ্য সম্পাদক শ্রীনিবাস রাও প্রতিনিধি এবং দর্শকদের অভিনন্দন জানান।
যে সমস্ত প্রতিনিধি সম্মেলনে সশরীরে যোগ দিয়েছেন তাঁদের প্রত্যেকের কোভিড আরটিপিসিআর টেস্ট করা হয় এবং ফলাফল নেতিবাচক এলে তবেই সম্মেলনে যোগ দিতে দেওয়া হয়। যাঁরা সরাসরি যোগ দিতে পারেননি তাদের জন্য অনলাইনে যোগ দেবার ব্যবস্থা করা হয়।
সম্মেলনে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করেন বিদায়ী রাজ্য সম্পাদক তাম্মিনেনি বীরভদ্রম।
খসড়া রিপোর্টে আত্মসমালোচনামূলকভাবে পার্টির সাফল্য এবং দুর্বলতার দিকগুলি তুলে ধরা হয়েছে। পার্টিকে কাজ করবার সময় কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে এবং তার মূল্যায়ন, পার্টি সংগঠনের আগামী দিনের কাজ সহ একাধিক বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। আগামী দিনের কাজ হিসেবে ১৯ টি বিষয়কে চিহ্নিত করে তুলে ধরা হয়েছে।
রিপোর্টে বিগত পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক-রণনীতিগত লাইন অনুযায়ী রাজ্য পার্টির পরিচালনা এবং তার অভিজ্ঞতার কথা এবং কলকাতা প্লেনামের নির্দেশিকা অনুযায়ী গণলাইন সম্পন্ন বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিগত চার বছরের রাজ্য পার্টির আন্দোলন-সংগ্রাম বিষয়ক পরিস্থিতির নানা দিক বিবৃত করা হয়েছে। এর পাশাপাশি বিগত দু’বছরে অতিমারীজনিত পরিস্থিতি যা মানুষের জীবন-জীবিকা সহ পার্টির পরিকল্পিত বিভিন্ন কার্যক্রমের ক্ষেত্রে কিভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে উঠে এসেছে সেই বিষয়গুলিও।
রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে, অতিমারী পর্বে সব ধরনের রাজনৈতিক বা সামাজিক কার্যক্রম প্রবল সীমাবদ্ধতার মুখে পড়েছিল। সেই সময় রাজনৈতিক শিক্ষার ক্লাস পার্টির পক্ষ থেকে সংগঠিত করা হয়। অনলাইনে পার্টি ক্লাস সহ স্টাডি সার্কেল নিয়মিতভাবে আয়োজিত হয়েছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন পার্টি সংগঠন এবং গণ সংগঠনের পক্ষ থেকে একই সঙ্গে অনলাইনে সেমিনার সহ বিভিন্ন ধরনের আলোচনা সভা ঘিরে পার্টির সদস্য এবং পার্টিকর্মীদের উৎসাহ লক্ষ্য করা গেছে। সম্মেলন মনে করে যে, মতাদর্শগত শিক্ষার ক্ষেত্রে এবং প্রচারের ক্ষেত্রে অনলাইন পদ্ধতি একটি উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা - যার ব্যবহার জারি রাখাটা জরুরি। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, এই মুহূর্তে তেলেঙ্গানা রাজ্যে ২৮০০ সহায়ক গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে ২৫ হাজার সদস্যকে নিয়ে।
প্রতিনিধিদের আলোচনায় উঠে এসেছে আরএসএস এবং হিন্দুত্ব মতাদর্শ রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ার বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে ধারাবাহিক লড়াই সংগ্রাম জারি রাখার বিষয়টি। একইসঙ্গে সাংবিধানিক মূল্যবোধ বজায় রাখা এবং সামাজিক বিভিন্ন আন্দোলন গড়ে তোলা এবং তা প্রসারিত করার লক্ষ্যে আরো বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌছানো এবং তাদের সংগঠিত করে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করা এই মুহূর্তের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ। মনুবাদী দর্শন এবং তার সহায়ক বিভিন্ন কুসংস্কারমূলক প্রচার ও কার্যকলাপ হিন্দুত্ববাদী শক্তি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রাজ্যে ছড়িয়ে দিতে চাইছে। তার বিরুদ্ধে লোকশিল্পের আঙ্গিকে প্রচার আন্দোলন সংগঠিত করে সাফল্য এসেছে। তাই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা এবং কেন্দ্রের বিজেপি’র সিএএ, এনআরসি এবং ৩৭০ ধারা খারিজ সহ সংখ্যালঘু মানুষের অধিকার রক্ষা, দলিত অংশের মানুষের অধিকার রক্ষা ইত্যাদি বিষয় বক্তাদের বক্তব্যে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। এ ছাড়াও বামপন্থী এবং গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ লড়াই ও তার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছেন অনেকেই। কোভিড পরিস্থিতিতে আইসোলেশন সেন্টার সহ সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে হেল্প লাইন চালু করার বিষয়টি রাজ্যের মানুষ সদর্থকভাবে গ্রহণ করেছেন, এই বিশেষ দিকটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে এবং প্রতিনিধিদের আলোচনায়।
সম্মেলনে মোট ৪৫৫ জন প্রতিনিধি যোগ দিয়েছেন। এছাড়াও ৯৫ জন পর্যবেক্ষক এবং ১৫ জন প্রবীণ উপস্থিত ছিলেন। প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন ৮২ জন মহিলা। ৩০২ জন প্রতিনিধির বয়স পঞ্চাশের নিচে। সামাজিকভাবে নিপীড়িত অংশ থেকে ৩৮৬ জন প্রতিনিধি যোগ দিয়েছেন এবং মূল শ্রেণিগুলি থেকে অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণি, খেতমজুর এবং গরিব কৃষকদের মধ্য থেকে ৩১৬ জন প্রতিনিধি সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। তেলেঙ্গানায় সর্বক্ষণের কর্মীর সংখ্যা ৬৫০ জন।
২৫ জানুয়ারি পলিট ব্যুরো সদস্য প্রকাশ কারাত সম্মেলনকে অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন। তিনি পার্টির স্বাধীন শক্তি বৃদ্ধি এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার বিষয়টির ওপর এবং রাজ্য পার্টির সীমাবদ্ধতা ও তা অতিক্রম করার দিকনির্দেশ সম্পর্কে তিনি বিশেষ জোর দিয়েছেন তাঁর বক্তব্যে।
সম্মেলনে পলিট ব্যুরো সদস্য বিভি রাঘভুলু তাঁর বক্তব্যে আন্দোলন-সংগ্রামের বিভিন্ন পরিস্থিতির সুযোগকে ব্যবহার করে রাজ্যে পার্টির প্রসারের বিষয়টি তুলে ধরেন। অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জনগণের সমস্যার ইস্যুগুলিকে চিহ্নিত করে তার ভিত্তিতে আন্দোলন সংগঠিত করার বিষয়টি উল্লেখ করেন।