E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ২৫ সংখ্যা / ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ / ২১ মাঘ, ১৪২৮

কৃষক বাঁচাও - দেশ বাঁচাও

সুপ্রতীপ রায়


গত বছরের ১৯ নভেম্বর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। ওইদিন বেতার ভাষণের মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদি তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করেছিলেন। নিঃসন্দেহে দীর্ঘ আন্দোলনের জয় এটি। নরেন্দ্র মোদি ভেবেছিলেন, মানুষ মেনে নেবেন এই আইনগুলি। বিজেপি এটা ভেবেছিল উজ্জ্বলা, পিএম কিষান প্রভৃতির মাধ্যমে কৃষকের মন পাওয়া গিয়েছে, অতএব তারা তিন কৃষি আইন মেনে নেবেন। তা কৃষকরা মানেননি। আপাতত তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহৃত হয়েছে ঠিক, কিন্তু বিপদ রয়ে গেছে। ভারতেরই কৃষি ও কৃষকের যে বিপুল সমস্যা তা সমাধানের পথ কি? দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনই একমাত্র পথ।

কৃষি আইন প্রত্যাহারের ঘোষণায় মোদির আন্তরিকতা ছিল না

তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের ঘোষণায় মোদির কোনো আন্তরিকতা ছিল না। বেতারে প্রত্যাহারের ঘোষণা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আজ দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়ে আমি আন্তরিক ও নির্মল হৃদয়ে বলতে চাই, হয়তো আমাদের প্রচেষ্টায় কিছু ঘাটতি ছিল, যার কারণে আমরা কিছু কৃষককে সত্যটা প্রদীপের আলোর মতো ব্যাখ্যা করতে পারিনি।’’ অর্থাৎ প্রত্যাহারের ঘোষণায় কৃষির তিনটি আইন যে খারাপ তা প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করেননি।

প্রধানমন্ত্রী যখন প্রত্যাহারের ঘোষণা করতে গিয়ে বলেন, ‘‘...স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকীতে সবাইকে নিয়ে চলতেই সরকার কৃষকদের এক ছোটো অংশের বিরোধিতাকেও মেনে নিল...’’। তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না আসলে প্রত্যাহৃত তিন কৃষি আইনের পক্ষেই কেন্দ্রীয় সরকার। মোদি সরকার দাবি করছে - আইনগুলি খুব ভালো হওয়া সত্ত্বেও সরকার প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হলো, তার অন্যতম কারণ সুপ্রিম কোর্ট স্থগিতাদেশ দিয়েছে। চরম মিথ্যাচার। কারণ সুপ্রিম কোর্ট ২০২১-এর জানুয়ারি মাসেই স্থগিতাদেশ দিয়েছিল। তখনই কেন সরকার আইনগুলি প্রত্যাহার করেনি?

তিন কৃষি আইনের মাধ্যমে বড়ো দুর্যোগ নামিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছিল

কোভিড মহামারী আসলে কর্পোরেটদের পৌষমাস, আমজনতার সর্বনাশ। কৃষির তিনটি আইনের মাধ্যমে মোদি সরকার ভারতের কৃষি ব্যবস্থাকে বৃহৎ কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল। কৃষিতে আদানি আম্বানি-রাজ্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে কৃষকের স্বাধীনতা হরণ করে কোম্পানির দাসে পরিণত করতে চেয়েছিল বিজেপি।

ভারতের কৃষকরা এই আইনের বিরোধিতার মধ্য দিয়ে ভারতীয় কৃষিক্ষেত্রের চেহারা পাল্টে দেওয়ার চেষ্টাকে রুখে দিয়েছেন। সরকার কৃষকদের কর্পোরেটদের করুণার পাত্র করে তুলে সব দায় থেকে অব্যাহতি নিতে চেয়েছিল। মোদি-শাহ জুটি আসলে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে দুর্বল করে কৃষি আইনে রাজ্য সরকারগুলিকে কৃষকদের সুরক্ষা দেওয়ার পথে বাধা হতে পারে এমন ব্যবস্থা করতে চেয়েছিল। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার কৃষকদের জমি থেকে উৎখাত করে তাঁদেরকে বৃহৎ প্রাইভেট কোম্পানিগুলির ক্রীড়নকে পরিণত করতে ‍চেয়েছিল। বিজেপি সরকার কৃষিকে বৃহৎ ব্যবসায় রূপান্তরিত করার মরিয়া প্রচেষ্টায় লিপ্ত।

কৃষির তিনটি আইন লাগু হলে আদানি-আম্বানির মুনাফার পাহাড় আরও উঁচু হতো, খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে আমরা সম্পূর্ণ আদানি নির্ভর হয়ে পড়তাম। খাদ্য নিরাপত্তা সম্পূর্ণ বিপন্ন হয়ে পড়ত। আসলে কৃষির তিনটি আইনের মাধ্যমে কৃষি তথা গ্রামীণ ক্ষেত্রে দুর্যোগ নামিয়ে আনতে চেয়েছিল বিজেপি সরকার।

আসলে জয়ী হয়েছে আন্দোলন

আসলে তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারে সরকারকে বাধ্য করেছেন কৃষক সহ দেশপ্রেমিক মানুষ। মোদি স্বইচ্ছায় এই আইন বাতিল করেননি। চলতি কৃষক আন্দোলন কর্পোরেট আগ্রাসনকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। কৃষির তিনটি আইন প্রত্যাহার আসলে সরকারের নতি স্বীকার - মহানুভবতা নয়। এই আন্দোলন দেখিয়েছে সাহসিকতা, সৃজনশীলতা, দৃঢ়তা আর উদ্ভাবনী ক্ষমতা কাকে বলে।

মোদি আইন প্রত্যাহারের আগে বারংবার বলেছিলেন, ‘কৃষি আইনগু‍‌লো ক্ষতিকারক নয়।’ আন্দোলনকারীদের উপহাস করে বলেছিলেন, ‘আন্দোলনজীবী’, ‘পরজীবী’, ‘ঝামেলা ও অশান্তি’ সৃষ্টিকারী। নয়া শ্রমকোড, প্রত্যাহৃত তিন কৃষি আইন, পরিবেশ সুরক্ষা কোডগুলির লঘুকরণ একই সুতোয় গাঁথা। যার মূল লক্ষ্য কর্পোরেট স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

কৃষক আন্দোলন কর্পোরেট রাজের বিরুদ্ধে

কৃষির তিনটি আইন প্রত্যাহারের মধ্যদিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে কর্পোরেট স্বার্থ। বর্তমান সময়ে কৃষকদের কাছে বিপজ্জনক শক্তি কর্পোরেট মালিক। ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভের পর ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি যেমন গোটা ভারতবর্ষকে দখল করেছিল তেমনি বর্তমান সময়ে কর্পোরেটরা আমাদের দেশের সব সম্পদ দখল করতে চায়। আর কর্পোরেটদের ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ মোদি-মমতা। বর্তমান কেন্দ্র ও আমাদের রাজ্যের শাসকদল কর্পোরেট পূজারি। প্রতিরোধ আন্দোলনের উজ্জ্বল নজির সৃষ্টি করেছে কৃষকসহ দেশপ্রেমিক মানুষ। আগামীদিনে সংযুক্ত কিষান মোর্চা আরও দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন গড়ে তুলবে।

প্রত্যাহৃত কৃষি আইনগুলি অন্যরূপে আনা হতে পারে

মোদি সরকার প্রত্যাহৃত কৃষি আইনগুলি অন্য নামে, বাঁকা পথে আনতে পারে। কারণ এই সরকারের দায়বদ্ধতা কর্পেরেটদের কাছে। মুক্ত বাজার অর্থনীতি গত তিন দশক ধরে চালু হলেও মোদির নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলেই কর্পোরেটমুখী নীতি বেশি বেশি করে গৃহীত হয়েছে। ২০১৪-র পর থেকে দেশের সরকার যেভাবে সরকারি মালিকাধীন সংস্থাগুলোর বি‍‌রোধিতা করছে ‍‌ইতিপূর্বে তা দেখা যায়নি।

কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষা করতে নতুন নতুন আইন আনা হয়েছে। দ্রুততার সঙ্গে আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে অর্ডিন্যান্স জারি করার প্রবণতা বেড়েছে। ২০১৪-র পর ৭৬টি অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়েছে। ক্ষমতায় এসেই ভূমি অর্ডিন্যান্স জারি করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আইনি রূপান্তর করতে পারেনি। কেন্দ্রীয় সরকার এবিষয়ে অন্য পথে হেঁটেছিল। কি ছিল সেই অন্য পথ? কেন্দ্রীয় সরকারের ইঙ্গিতে বিজেপি পরিচালিত রাজ্যগুলি সংশোধনী বিল গ্রহণ করে এবং রাষ্ট্রপতি সেগুলি অনুমোদন করেন। যার ফলে সরকারকে আর কৃষকদের সম্মতি গ্রহণ করতে হবে না এবং ক্ষতিপূরণের সর্বোচ্চ পরিমাণ প্রদানের বাধ্যবাধকতা থাকবে না। প্রত্যাহৃত কৃষি আইনগুলির ক্ষেত্রেও এই ধরনের কৌশল কর্পোরেটপ্রেমী সরকার গ্রহণ করতে পারে।

২০১১-তে মোদির বক্তব্য ও প্রত্যাহৃত সাম্প্রতিক তিন কৃষি আইন

২০১০ সালে দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন সিং। ২০১০ সালে ইউপিএ সরকার বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে তিনটি কৃষি বিষয়ক কমিটি গঠন করেছিল। এই কমিটিগুলির মধ্যে Working Group on Consumer Affairs-এর চেয়ারম্যান ছিলেন নরেন্দ্র মোদি (তখন তিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী)।

মোদি কমিটির সুপারিশে যে বিষয়গুলি উল্লেখ করা হয়েছিল সেগুলি -
১) কৃষিতে ব্যাপক উদারীকরণ;
২) এপিএমসি-কে লঘু করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির কাছে বাজার উন্মুক্ত করে দেওয়া;
৩) চুক্তি চাষ;
৪) ফাটকা বাজারে উৎসাহ দেওয়া ইত্যাদি।

নির্মলা সীতারামন খোলাখুলিই বলেছেন, ‘‘গুজরাটের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই অধুনা কৃষি বাজার সংস্কারের পদক্ষেপগুলি নেওয়া হচ্ছে।’’ ফলে তিনটি কৃষি আইন এনে গোটা কৃষি ক্ষেত্রকে পুরোপুরি কর্পোরেটদের হাতে সঁপে দেওয়ার যে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চেয়েছিল বর্তমান বিজেপি সরকার তার পিছনে নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল। বর্তমান বিজেপি সরকারের নীতি - মিনিমাম গভর্নমেন্ট, ম্যাক্সিমাম গভর্নন্যান্স। যার ফলে বাজার অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে, পরিচালনা করবে। সরকার কর্পোরেটদের করে খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে।

মোদির ঘোষণার বাস্তবায়ন কোথায়?

আমাদের দেশে কৃষি ও কৃষকের সমস্যা উত্তরোত্তর বাড়ছে। নয়া উদারবাদী অর্থনীতি সঙ্কট বাড়াচ্ছে। খুব যুক্তিসঙ্গতভাবেই গত বছরের ২১ নভেম্বর সংযুক্ত কিষান মোর্চা প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল - তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের ঘোষণা স্বাগত কিন্তু বেশ কয়েকটি মৌলিক দাবির সমাধান হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে যে ছয় দফা দাবি পেশ করা হয়েছিল সেগুলি বাস্তবায়নের উদ্যোগ কোথায়? সমস্ত কৃষিজাত পণ্যের জন্য বিধি প্রণয়নের মধ্যদিয়ে এমএসপি নিশ্চিত করা বা কৃষি সং‍‌শ্লিষ্ট বিষয়ে কমিটি গঠন ও তার কাজের অগ্রগতি কোথায়? আসলে কৃষকদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে চলেছেন মোদি। কৃষি ও কৃষকের সমস্যা নিয়ে আবার ব্যাপক দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন গড়ে উঠতে চলেছে। জমি, ঋণ, এমএসপি প্রভৃতি বিষয়ে হিসাব বুঝে নিতে চায় ভারতের কৃষক।

দেনার দায়ে জর্জরিত কৃষকের কী হবে?

দেশে কৃষক আত্মহত্যার পরিমাণ বাড়ছে, পশ্চিমবাংলাও তার বাইরে নয়। কিন্তু কেন? কৃষি ঋণ পরিশোধ করতে না পারার কারণেই কৃষক আত্মহত্যার মিছিল দীর্ঘায়িত হচ্ছে। কিন্তু কৃষক ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছেন কেন? আবার ঋণ পরিশোধও কেন করতে পারছেন না?

আসলে কৃষক ঋণ নিয়ে কৃষিজ উপকরণ কিনে ফসল উৎপাদন করেন। কিন্তু উৎপাদিত ফসল বাজারে যে দামে বিক্রি হয় তা দিয়ে সুদ সহ ঋণের টাকা ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। চাষের খরচ ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। নয়া উদারবাদী ব্যবস্থায় চাষের খরচ বেড়ে গেছে। সার, কীটনাশক ও বীজের দাম বহুগুণ বেড়ে গেছে। এগুলো বিক্রি করার জন্য বহুজাতিক সংস্থাগুলিকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বীজের উপর বহুজাতিকদের আধিপত্য বেড়ে গেছে। সার, কীটনাশক, বীজ ও সেচের খরচ আগের তুলনায় বহুগুণ বেড়েছে।

একদিকে কৃষিক্ষেত্রে বহুজাতিকদের ‍‌শোষণ বিপুল পরিমাণে বেড়েছে। অন্যদিকে বিভিন্ন কৃষিজ উপকরণের উপর ভরতুকি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর এসবই করা হয়েছে দেশি-বিদেশি বড়ো পুঁজির অনুকূলে। চাষের খরচ জোগাড় করতে চাষি বাধ্য হয় ঋণ করতে। যদিও মাঝারি ও প্রান্তিক চাষিরা কার্যত প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পান না। নিরুপায় কৃষক মহাজনী ঋণের শিকার হন। ঋণের সুদ ও আসল মেটানো হয়ে পড়ে অসম্ভব।

সাধারণ ক্রেতারা যে দামে ফসল বা খাদ্যদ্রব্য কেনেন সে দাম বা অনুপাত কৃষকরা পান না। কারণ, দালাল ও ফড়েরা কৃষকদের লাভের অংশ আত্মসাৎ করে নেয়। সরকারই স্বীকার করেছে, উপভোক্তা যে দাম দেয় তার মাত্র ৩০ শতাংশ কৃষকের কাছে যায়। বাকিটা ভোগ করে ফড়ে আর মজুতদাররা।

মাইক্রোফিনান্সের ফাঁদ

কৃষকের এই আর্থিক দুর্দশার সুযোগ নিচ্ছে মাইক্রোফিনান্স সংস্থাগুলি। পশ্চিমবাংলায় গত কয়েক বছরে মাইক্রোফিনান্স সংস্থাগুলির দৌরাত্ম্য বেড়েছে। বিভিন্ন মাইক্রোফিনান্স সংস্থাগুলোর এজেন্টদের নির্যাতন বেড়ে চলেছে। এই সংস্থাগুলি গরিব মানুষকে গোপন করে পুরাতন ধার পরিশোধ দেখিয়ে নতুন করে ঋণ অনুমোদন করে নতুন করে কিস্তি ‍‌শোধ করার জন্য চাপ দেয়।

মাইক্রোফিনান্স কোম্পানিগুলি বিপুল পরিমাণ মুনাফার লোভে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে এক একজন ব্যক্তিকে একাধিক ঋণ দিয়ে ঋণের জালে জড়িয়ে দিচ্ছে। যদিও ২০১৪ সালের মাইক্রোফিনান্স বিষয়ক আইনে বলা আছে, কোনো ব্যক্তি যদি ঋণ নেন সেই ঋণের কমপক্ষে ৭০ শতাংশ পরিশোধ না করলে তাকে পুনরায় ঋণ দেওয়া যাবে না। এছাড়া ‍‌একজনকে একসাথে ১.২৫ লক্ষ টাকার ঋণ দেওয়া যাবে না। এই আইন ভাঙা হচ্ছে। সরকার নীরব।

মাইক্রোফিনান্স সংস্থার কাছ থেকে একবার ধার নিলে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়তে হয়। সেই জাল কেটে বেড়িয়ে আসা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। কিন্তু সব জানার পরেও কৃষিজীবী মানুষ বেসরকারি মাইক্রোফিনান্স সংস্থার কাছ থেকে ধার নিচ্ছে কেন? কারণ - ১) সমবায় সংস্থাগুলি কৃষকদের বাঁচানোর জন্য দায়িত্ব পালন করছে না; ২) রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পেতে গেলে যেসব কাগজপত্র চাওয়া হয় সেগুলি জোগাড় করতে কৃষক হিমসিম খান। আর আছে ব্যাঙ্কের নিয়মকানুনের বাড়াবাড়ি, তাতে কৃষক আর ব্যাঙ্কের দরজায় যান না; ৩) মাইক্রোফিনান্স সংস্থাগুলি ঋণ দেয়। ফলে চড়া সুদের বিনিময়েই বিপদের সময় চাষি মাইক্রোফিনান্সের কাছে ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। ক্ষুদ্র ঋণের ৭০ শতাংশ এখন মাইক্রোফিনান্স সংস্থাগুলিই দিয়ে থাকে।

এ প্রসঙ্গে আর একটি তথ্য গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের রাজ্যে গরিব চাষি, কৃষি মজুরদের জন্য সরকারি ঋণ অপ্রতুল। নাবার্ডের দেওয়া তথ্য অনুসারে ২০২০-২১ আর্থিক বর্ষে গ্রামীণ বাংলায় ঋণের চাহিদা ছিল ১ লক্ষ ৯১ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা। গত পাঁচ বছরে পশ্চিমবাংলায় ঋণের চাহিদা পাঁচগুণ বেড়েছে। যদিও চাহিদা ও ঋণের অনুপাতে সর্বভারতীয় গড় ৪৬ শতাংশ, সেখানে পশ্চিমবাংলায় মাত্র তা ১৯ শতাংশ।

মোদি সরকার ও মমতা সরকার কৃষকদের জন্য অনেক চমক লাগানো প্রকল্পের কথা ঘোষণা করলেও মাইক্রোফিনান্সের জাল থেকে কৃষকদের বার করে আনার কোনো ঘোষণা করেনি।

কথা নয় - কার্যকর করো স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ

বাংলার কৃষক, ভারতের কৃষক মোদি-মমতার ভাষণ শুনতে চান না। তাঁরা চান ‘ঋণ ও বিমা’ প্রশ্নে স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশের বাস্তবায়ন। প্রান্তিক ও মাঝারি কৃষক পরিবারগুলোর সঠিক সময়ে প্রতিষ্ঠানিক ঋণ পাওয়া বিরাট সমস্যা। এক্ষেত্রে স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশগুলি হলো -
১) প্রকৃত দরিদ্র মানুষ যাতে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পেতে পারেন তার জন্য ব্যবস্থা করা;
২) শস্য ঋণে সুদের হার ৪ শতাংশে কমিয়ে আনা;
৩) শস্যহানি ঘটলে ঋণ শোধের সময়সীমা বাড়ানো ও প্রয়োজনে ঋণ মকুব করা;
৪) প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় কৃষকদের সাহায্য করার জন্য তহবিল গঠন করা;
৫) নারী কৃষকদের কিষান ক্রেডিট কার্ড সরবরাহ করা;
৬) শস্যবিমাকে গোটা দেশের জন্য এবং সব ফসলের জন্য সম্প্রসারিত করা;
৭) গরিব কৃষকদের জীবনধারণের মান উন্নত করার জন্য আর্থিক সাহায্য সহ নানাবিধ ব্যবস্থা নেওয়া।

কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। তাই বকেয়া সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনের পথেই দেশের কৃষকরা থাকবেন এমন ঈঙ্গিতই মিলছে।