E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ২৫ সংখ্যা / ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ / ২১ মাঘ, ১৪২৮

কেন নেতাজি মূর্তি এখন স্থাপন করা হচ্ছে?

সুভাষিণী আলি


দিল্লির ইন্ডিয়া গেট একটি সাম্রাজ্যবাদী স্মারক সৌধ যা ব্রিটিশ সরকার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৮) ব্রিটিশ সেনা দলে কর্মরত ভারতীয় সেনারা যাঁরা দেশ থেকে বহুদূরে ফ্লান্ডার্স, গ্যালিপোলি, ইরান সহ অন্যত্র যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন তাদের স্মৃতিতে স্থাপন করেছিল। অন্যান্য ভারতীয় সৈন্য যাঁরা ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে নিহত হয়েছিল তাঁদের নামও ওই স্মৃতি সৌধে খোদিত রয়েছে। পরে, ওই যুদ্ধ স্মারকের কেন্দ্রস্থলে একটি কামানের নিচে রাজা পঞ্চম জর্জের একটি মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়।

স্বাধীনতা লাভের কয়েক বছর পরেই রাজার মূর্তি অনাড়ম্বরভাবে সরিয়ে ফেলা হয় এবং তখন থেকেই বেশ কিছু পরামর্শ আসছিল যে কার মূর্তি ওখানে স্থাপন করা যায় সে সম্পর্কে, যদিও কোনো নতুন মূর্তি ওখানে স্থাপন করা হয়নি।

কয়েকদিন আগে কেন্দ্রীয় সরকার হঠাৎ ঘোষণা করে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মূর্তি ওখানে স্থাপন করা হবে এবং যতদিন না মূর্তি নির্মিত হয়, সেখানে একটি নেতাজি সংক্রান্ত হলোগ্রাম তেইশে জানুয়ারি তার ১২৫তম জন্মদিন থেকে সবাই দেখতে পাবে।

নেতাজি সুভাষের মূর্তি স্থাপনের বিষয়টি অবশ্যই একটি আচমকা নেওয়া সিদ্ধান্ত ছিল। এমনকি এই মূর্তি তৈরি শুরু করার কোনো তোড়জোড়ও আগে থেকে আরম্ভ হয়নি। যখনই বিজেপি সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী নেতাজির স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর বিষয়টি বলেছে তখনই এই ঐতিহ্য সম্পর্কে তাদের মনের বিভ্রান্তি, তাঁর প্রতি তাদের মনোভাব কেমন হবে সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবার অক্ষমতা এবং এই ঐতিহ্যকে সম্মান জানানোর ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত তাঁদের দ্বন্দ্ব সমস্তটাই আপাতভাবে ফুটে উঠেছিল।

তাঁরা যে নেতাজির চিন্তা এবং কর্মের প্রশংসক এটা দেখানোর চাহিদা শুধুমাত্র তাদের সংকীর্ণ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে অনুপ্রাণিত। বিজেপি এবং প্রধানমন্ত্রী নিজেদের নেতাজির প্রকৃত অনুরাগী হিসেবে তুলে ধরতে বেপরোয়া। অন্যদিকে দেশের স্বাধীনতায় নেতাজীর অবদান নেহরু ছোট করার চেষ্টা করছেন এটা তারা প্রমাণ করতে চায়, যদিও প্রকৃত ঘটনা হলো তিনি লালকেল্লা থেকে তার প্রথম ভাষণের অনুষ্ঠানে আন্তরিকভাবে বলেছিলেন, নেতাজির কীভাবে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা উচিত ছিল।

অন্যদিকে বিজেপি এবং প্রধানমন্ত্রী তাদের নেতাজির প্রকৃত অনুরাগী হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে মরিয়া। বাস্তব হলো এদের আরএসএস এবং হিন্দু মহাসভার পূর্বসূরিদের মধ্যে একজনও স্বাধীনতা সংগ্রামী নেই অহঙ্কার করার মতো, তাই মরিয়া হয়ে তাদের এই কাজ করতে হয়েছে। তাদের বেপরোয়াপনা হাস্যকর মাত্রায় পৌঁছেছেঃ ২০২০ সালের ২২ অক্টোবর যখন প্রধানমন্ত্রী লালকেল্লায় আজাদ হিন্দ ফৌজ-এর প্রাদেশিক সরকার স্থাপনের স্মরণ ও উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছিলেন তখন প্রধানমন্ত্রী নেতাজি এবং আইএনএ সৈনিকরা যেমন সামরিক টুপি পরতেন তেমন টুপি পরেছিলেন!

২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারি নেতাজির ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে উদযাপন অনুষ্ঠান আয়োজন করার জন্য একটি কমিটি তৈরি করে তিনি যে নেতাজির একজন প্রকৃত অনুগামী তা প্রমাণ করতে আরও একবার চেষ্টা করেছিলেন মোদি। যে উদযাপন পর্ব শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালের ২৩ জানুয়ারি। ওই কমিটি মধ্যবর্তী সময়ে একটিও সভা করেনি এবং অবশ্যই কোনো উদযাপনও হয়নি। এটা আশ্চর্যজনক নয় যখন যে কেউই উপলব্ধি করতে পারবে যে নেতাজির জীবন, তাঁর ভাবনা এবং কর্মের সঙ্গে যুক্ত এমন কিছুই নেই যা মোদি এবং তার পার্টি উদযাপন করতে পারে।

যখন এই কমিটি ঘোষিত হয়েছিল তখন অনেকেই মনে করেছিলেন যে, বিজেপি এবং মোদি মনে করছে এই দেখনদারি তাদের আসন্ন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে জিততে সাহায্য করবে। যখন তারা নির্বাচনে লজ্জাজনক পরাজয়ের মুখোমুখি হলো তখন ওই কমিটি এবং উদযাপন দু’টোই ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হলো। যে কোনো ক্ষেত্রেই যখনই বিজেপি এবং তাদের প্রধানমন্ত্রী নেতাজি সুভাষের ঐতিহ্য আত্মসাৎ করে এগোনোর চেষ্টা করেছে তখনই প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছে, তখনই আপাতভাবে সেটা প্রতীয়মান হয়েছে।

তাদের সাম্প্রতিকতম চেষ্টা হলো পঞ্চম জর্জের মূর্তি যেখানে ছিল সেখানেই নেতাজির মূর্তি স্থাপনের ঘোষণা।

এটা এমন একটা সময়ে যখন তারা দেশে তাদের নীতি সমূহের বিরুদ্ধে বাড়তে থাকা বিরোধিতার মুখোমুখি হচ্ছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন এমন কোনো ব্যক্তির মূর্তি স্থাপন খুবই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু এই মূর্তি স্থাপনের পিছনে বিজেপি’র প্রকৃত উদ্দেশ্য আরও একবার প্রকাশ হয়ে পড়েছে। বি‍‌জেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী সুভাষচন্দ্রের মহান উত্তরাধিকারকে নিজের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশে ব্যবহার করছেন। তবে তাদের এই অপচেষ্টা ব্যর্থ হবে। এই মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হলেও বিজেপি এবং তার রাজনৈতিক অনুসারীরা জাতীয় আন্দোলনে তাদের বিরোধী ভূমিকাকে আড়াল করে রাখতে পারবে না। বিজেপি এবং তার অনুসারীরা তাদের জাতীয় আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন তাই নয়, তারা ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি সুভাষচন্দ্রের যে গভীর বিশ্বাস এবং প্রতিশ্রুতি ছিল তারও বিরোধিতা করেছিলেন। সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় গোঁড়ামির প্রতি তাঁর গভীর বিদ্বেষ ছিল যা বিজেপি’র কাছে গভীর অভিশাপ স্বরূপ।

মূর্তি কোনোভাবেই বিজেপি ও মোদিকে দেশপ্রেমের সার্টিফিকেট দেবে না, যা তারা মরিয়া হয়ে চাইছে। তাদের দ্বারা এটির নির্মাণ এই সত্যটিকে মুছে ফেলবে না যে, নেতাজি যখন সিঙ্গাপুরে আইএনএ’র নেতৃত্ব গ্রহণ করছিলেন, যখন তিনি এবং সাহসী আইএনএ সৈন্যরা ব্রিটিশদের পরাক্রমের সাথে লড়াই করার সময় 'রানী ঝাঁসি রেজিমেন্ট' গঠনের জন্য প্রবাসী ভারতীয় মহিলাদের নিয়োগ করছিলেন তখন তাদের নিজস্ব নায়ক, সাভারকর ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর জন্য সৈন্য নিয়োগ করছিলেন। তিনি ব্রিটিশ প্রভুদের রক্ষা করার জন্য সুভাষ এবং আইএনএ-এর মহিলা এবং পুরুষ সেনানীদের বিশ্বাসঘাতক বলে হত্যা করার জন্য তাদের আহ্বান জানিয়েছিলেন।

এই মূর্তি বিজেপি এবং মোদিকে এই বাস্তবকে গোপন করতে সাহায্য করবে না যে নেতাজি খুব জোরের সঙ্গে বিশ্বাস করতেন যে, ভারতের ঐক্য এবং প্রগতির জন্য একান্তই ‌আবশ্যক ধর্মনিরপেক্ষতা। তারা এই বিষয়টি কীভাবে বোঝাপড়া করবে যে, বাস্তব হচ্ছে আইএনএ’র অফিসারদের অনেকেই মুসলিম ছিলেন এবং সুভাষ চন্দ্র তাদের উপর অটুট বিশ্বাস এবং আস্থা রাখতেন এবং তাঁরা তার পরিবর্তে ভারতের স্বাধীনতার জন্য জীবন বলিদান দিতে তাদের ইচ্ছা দেখিয়েছিলেন। এরা কীভাবে এটা অস্বীকার করবে যে, এই ঐক্য যা সুভাষ তৈরি করেছিলেন তা গোটা দেশের সামনে প্রতিভাত হয়েছিল যখন আইএনএ’র তিন আধিকারিক একজন হিন্দু, একজন মুসলিম এবং একজন শিখকে ব্রিটিশরা জেলবন্দি করেছিল এবং ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাদের বিচার করেছিল?

মাথায় আইএনএ টুপি পড়লেই তা মোদিকে একজন আইএনএ সেনায় রূপান্তরিত করবে না। নেতাজি মূর্তি স্থাপন করলেই তা তাকে ভারতের জাতীয় আন্দোলনের যে ঐতিহ্য তার উত্তরাধিকারী করে তুলবে না এটাও সত্যি। তিনি স্ট্যাচু নির্মাণ করতেই পারেন কিন্তু তার নিচে আইএনএ’র স্লোগান ইত্তেমাদ (বিশ্বাস) ইত্তিহাদ (একতা) কুরবানী (ত্যাগ) খোদাই করার কোনো যোগ্যতা তাঁর নেই।