৫৮ বর্ষ ৪২ সংখ্যা / ৪ জুন, ২০২১ / ২০ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮
অতিমারীতে সরকার নেই, কিন্তু থাকতে হবে সরকারকেই
বিশ্বম্ভর মণ্ডল
অতিমারী পরিস্থিতিতে মাঝে মাঝেই দেখা যাচ্ছে সরকার নেই, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সরকারকে। অথচ ভালোভাবে বাঁচতে গেলে সরকারকে থাকতে হবে বেঁচে থাকার প্রতিটি মুহূর্তে। যে দেশে বেঁচে থাকার প্রতিটি মুহূর্তে পাওয়া যায় এমন সরকারের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়েছে, তারাই তো দেশের সর্বাধিক সংখ্যক মানুষকে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে পথ দেখাতে পেরেছে। সেইসব দেশে সরকার মানে লোক দেখানো মন ভোলানো ‘মন কি বাত’ না, সরকার মানে ওই দু’জন/চার জন না। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আর বিশেষ বিশেষ সময়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ছাড়া আর কোনো মন্ত্রী, সেনাপতি দেশে আছে বলে তো বোঝার উপায় নেই অধিকাংশ সময়। মাঝে একটা সময় এসেছিল যখন ভোটের আগে আগে দেশপ্রেমের বন্যায় ভাসিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হতো দেশজুড়ে। দেশপ্রেমের বন্যায় ভাসিয়ে ভোট করার পরিকল্পনা ভালো হিট করেছিল। বাজেটের আগে পরে জানা যায় যে, দেশে অর্থমন্ত্রীও আছে। মাসের পর মাস বিদেশে কাটানোর প্রধানমন্ত্রী আছে, যদিও উনি বিদেশে থাকার সময়ে দেশটা চালানোর জন্য ভারপ্রাপ্ত কেউ নেই দেশে। বিদেশ ভ্রমণও চলছে, দেশ শাসনও চলছে। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন দেশের মানুষ ভ্যাকসিনের অভাবে লাখে লাখে অকালে প্রাণ দিচ্ছেন, তাদের কথা না ভেবে আগে বিদেশের চাহিদা মেটালেন কেন উনি। তাও আবার দেশের থেকে কম দামে জেনে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বারে বারে। নানা লেখায়, বক্তৃতায় তাঁরা এর উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছেন দিনের পর দিন। গ্রামে একটা কথা চালু আছে ‘ঘর জ্বালানি পর পোষানি’- কেউ কেউ আকারে ইঙ্গিতে এটাও বলার চেষ্টা করেছেন। দেশ-বিদেশের নানা স্তরের, নানা পেশার মানুষ নানা মাধ্যমে দেশকে না সামলে বিদেশে আগে ভ্যাকসিন পাঠানোয় তাদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। এরা বুঝতে চাননি, আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিটাও কারুর কারুর কাছে কত জরুরি। ওনার দলের প্রচার করা দিনরাত ওনার গুণগান করবে এটা স্বাভাবিক। ওনার ভালোবাসায় আর প্রশ্রয়ে যারা আজ বিশ্বের ধনীদের তালিকায় নাম তুলেছে (নিন্দুকেরা বলে দেশের মানুষের সর্বনাশ করে, ব্যাঙ্কের টাকা মেরে,...) তারা ওনার গুণগান করবে এটাই স্বাভাবিক। নিজের দেশের মানুষকে বঞ্চিত করেও অন্য দেশের কল্যাণে যার এত মাথাব্যথা তার পুরস্কার উনি কী পাবেন উনিই জানেন, কিন্তু অবোধ দেশবাসীর দুর্ভাগ্য ওনার মহত্তম মনের প্রশংসা করার লোক খুঁজে পাওয়া যায় না ওনার দলের বাইরে।
নানা রকমের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে মানুষ নিজেদের রক্ষার কৌশল ঠিক বের করে ফেলবে এনিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দীর্ঘমেয়াদি লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা যাদের ছিল না তাদেরও সেটা অর্জন করা হয়ে যাচ্ছে। কোভিড-১৯ এর প্রথম ওয়েভ, সেটা চলতে চলতে আমফান, এখন কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ওয়েভ, সাথে জুড়ে গেল ‘ইয়াস’। মাথার উপর ছাদ নেই, পেটে নিয়মিত ভাত নেই, ন্যূনতম চিকিৎসার সুযোগ নেই দেশের এক বড়ো অংশের কারুরই। নির্বাচনের পর নির্বাচন আসে, সরকার আসে সরকার যায়। দলে দলে দল বদলায়, কিন্তু অধিকাংশ মানুষের দিন বদলায় না। তাও মানুষ ভুলে যায় তার ঘর নেই, ঘর থাকলেও মাথার ওপরে ছাদ নেই, ছেলেমেয়েকে পড়ানোর পয়সা নেই, দেখার জন্যে সরকার নেই। ঠারেঠোরে দেশের সরকার জানিয়ে দেয় বা বুঝিয়ে দেয় যে, স্বাস্থ্যে, শিক্ষায় সরকার থাকবে না নতুন করে, ব্যাঙ্কে সরকার থাকবে না, রেলে থাকবে না, সরকারের প্রতিষ্ঠানের উন্নতিতে সরকার মাথাব্যথা করতে যাবে না, তিল তিল করে গড়ে তোলা সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো অবহেলা, আর অযত্নে ধুঁকতে ধুঁকতে যেই মুখ থুবড়ে পড়বে, খরিদ্দার রেডি করা আছে। মানুষের মনে ধুলো-মলিন চেহারার সরকারি ব্যাঙ্কের থেকে, সরকারি জীবনবিমার থেকে টাইস্যুট পড়া ঝা-চকচকে বেসরকারি ব্যাঙ্কের, বেসরকারি জীবনবিমার ভাবমূর্তি গড়ে তোলা হয়েছে, হবে দিনের পর দিন সুপরিকল্পিতভাবে। বলা হবে না বেসরকারি ব্যাঙ্কের লালবাতি জ্বালানোর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। সরকারি ব্যাঙ্কের টাকা শোধ করে না বড়ো বড়ো ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের একাংশ আর সরকারের সাফল্যের একনিষ্ঠ প্রচারক সেইসব ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা। সেই গুণাগার দিতে হয় আমাকে আপনাকে। সাধারণ মানুষ হাজার কয়েক টাকা নিয়ে শোধ দিতে দেরি হলে বাড়িতে এসে পোস্টার দিতে দেরি হবে না সরকারের, আবার সেই একই সরকার কেউ কোটি কোটি টাকা মেরে দিলে তাকে দেশ ছেড়ে পালানোর ব্যবস্থাপনাতেও সবার আগে। একই কাজে দু’রকম বিচার। হবেনাই বা কেন। বিচার যে করবে তার তো চোখ বাঁধা, তাকে দেখতেও হয় অন্যের কানে শুনে। দীর্ঘমেয়াদি ভাবনার ছাপ নেই সরকারের কাজে। মিডিয়ায় নেই মানুষের যন্ত্রণার কথা। আছে ভয় দেখানো খবর। বিপন্ন মানুষকে হাত ধরে রাস্তা পার করানোর অভ্যাস ছিল যাদের, তারাও নানা কারণে আজ সাড়ে চার শতাংশ। তবু সেই তারাই পেয়ে গেছে মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে নিজেদের জীবনকে, পরিবারের উদ্বেগকে বাজি রেখে লড়ার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাঠে নেমে আসা ‘রেড ভলেন্টিয়ার’ বা ‘লাল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী’কে। দেরিতে হলেও এদের আগলে রেখে উপযুক্ত সরঞ্জাম দিয়ে, প্রশিক্ষণ দিয়ে পথ দেখানোর প্রস্তুতি শুরু হয়েছে নানা প্রান্তে। আজকের সমাজের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো ‘রেড ভলেন্টিয়ার’রা। কারণ এদের আছে আবেগ, আকুতি, নির্ভীকতা, সমাজের জন্যে কিছু করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা। এদের নেই প্রচারের মোহ, পদের মোহ, ক্ষমতার সাথে থাকার লালসা, দাদা-দিদির চামচাবাজি করার অভ্যাস। এরা বুঝতে শিখেছে বাজারের প্রশ্রয় ততক্ষণ যতক্ষণ তুমি ‘ব্যক্তি পুজোতে’, যতক্ষণ তুমি বাজারের পছন্দের শাসকের সাথে। তবে একটা কথা পরিষ্কার যে অতিমারী থেকে উদ্ভূত মৃত্যু উপত্যকা অতিক্রম করতে সরকারকেই প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা ও মর্যাদা পেলে এই অতিমারীকে সামলাতে সরকারের একটা গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হয়ে উঠতে পারে ‘রেড ভলেন্টিয়ার’রা।