৫৮ বর্ষ ৪২ সংখ্যা / ৪ জুন, ২০২১ / ২০ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮
সেন্ট্রাল ভিস্তা, পরিবেশ বিসর্জনের বিনিময়ে মোদীজির স্বপ্নপূরণ প্রকল্প
কৌশিক মুখোপাধ্যায়
"এ বিশ্ব, তার ভূমি ও জল আমাদের পূর্বপুরুষদের উত্তরাধিকার হতে লব্ধ কোনো সম্পদ নয়, বরং আমাদের সন্তানদের কাছ থেকে তা ঋণপ্রাপ্ত। সে কারণেই অন্ততপক্ষে যে রূপে আমরা তা পেয়েছি সেভাবেই তাদের তা ফিরিয়ে দিতে হবে।" - জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর এ আহ্বান সবেমাত্র মহা আড়ম্বরে অতিক্রম করে আসা তাঁর সার্ধশতবর্ষে কী মূল্য আছে? স্বাধীন ভারতের ৭৫ বছর আসন্ন। দেশের শাসকের তাই বর্তমানে একমেব অদ্বিতীয়ম, অন্যতম প্রধান কর্তব্য, যে করেই হোক স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানের উদ্যাপন যেন এক নজিরবিহীন ঐতিহাসিক তকমায় ভূষিত হয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, অযোগ্য, স্বৈরাচারী শাসকেরা ঠিক এভাবেই নিজেদের অন্যায়-অনাচার আর অযোগ্যতাকে আড়াল করতে এমন জনমোহিনী পথের আশ্রয় নেন। ঠিক যেমনভাবে সেলুলয়েডের হীরক রাজা তার বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানের নামে কৃষক-শ্রমিক-শিক্ষক সহ সাধারণ মানুষের জীবন-যন্ত্রণা, তাদের অনাচারের ছবিকে আড়ালে রাখতে নিজের সুবিশাল মূর্তির উন্মোচনে মেতেছিলেন! রাজধানী দিল্লির বুকে জনগণের করের প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে (যা শেষ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে ২০ হাজার কোটি টাকায়) যেনতেন প্রকারেণ, সব আপত্তিকে উড়িয়ে সেন্ট্রাল ভিস্তা নামের প্রকল্পটি যেভাবে সম্পূর্ণ করার তোড়জোড় শুরু হয়েছে তা যেন পুনরায় ১৯৭৬ সালে সত্যজিৎ রায় সৃষ্ট হীরক রাজাকেই স্মরণে আনতে বাধ্য করে। এরই পাশাপাশি শাসকের এ তাড়নায় বাড়তি উৎসাহ তাদের রাজনৈতিক অন্তরাত্মা ও আদর্শগত চেতনা। যা তাদের প্ররোচিত করে - দিল্লির বুকে যা যা স্মারক বর্তমান তার প্রায় সব কটিই এ দেশের মুসলিম শাসকদের (সুলতানী যুগ থেকে মুঘল যুগ) সৃষ্টি, সুতরাং এমন কিছু নিদর্শন তৈরি করতেই হবে যা ‘হিন্দু মহা সম্রাট’ মোদীজিকে অমরত্ব লাভে সাহায্য করতে সক্ষম হয়।
জনসংখ্যায় বিশ্বের দ্বিতীয় হয়েও আমাদের দেশ গোটা বিশ্বের স্বাস্থ্য খাতে সবথেকে কম খরচে চতুর্থ স্থানে। যে দেশ স্বাস্থ্য খাতে এখনও জিডিপি-র ১.৫% ব্যয় করতে অপারগ (বাস্তবে হিসাবের মারপ্যাঁচ বাদ দিলে তা মাত্র ০.৩৪%-এরও কম), যে দেশে শিক্ষাখাতে ব্যয় এখনও জিডিপি-র ৩.১% (পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো বাদ দিন, অনেক গরিব দেশও এক্ষেত্রে আমাদের থেকে বহু এগিয়ে, ভারত এক্ষেত্রে ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৪৪ নম্বরে), সে দেশেই যখন কোটি কোটি টাকা সরকারি অর্থ খরচ করে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মূর্তি স্থান হতে বুলেট ট্রেন বা সেন্ট্রাল ভিস্তার মতো এমন অনাবশ্যক, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প অগ্রাধিকার পায় তখন প্রশ্ন উঠবে বৈকি! কোভিড-১৯-কে কেন্দ্র করে দেশ জুড়ে চলা ভয়ঙ্কর এ সামাজিক সঙ্কটকালে শুধুমাত্র অক্সিজেনের অভাবে, ন্যূনতম প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে প্রতি মুহূর্তে এত মানুষের অসহায় মৃত্যু প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। আর এমন বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও দেশের শাসকরা যখন যে করেই হোক এমন প্রকল্পকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যকেই পাখির চোখ মনে করে এগিয়ে যেতে চায়, যে কোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকের কাছেই তা চরম ধৃষ্টতার উদাহরণরূপেই গৃহীত হতে বাধ্য।
এই প্রকল্পের আশু প্রয়োজনীয়তা বা আবশ্যিকতার প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনার জন্য নয় বরং যেভাবে এই প্রকল্প রূপায়ণের জন্য পরিবেশ আইন, পরিবেশের দীর্ঘকালীন সুরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে কার্যত ধূলিসাৎ করা হয়েছে সেই নজিরবিহীন পদক্ষেপসমূহ নিয়ে আলোচনার সাপেক্ষেই এ নিবন্ধ। নানা ক্ষেত্রের ওজর-আপত্তি উড়িয়ে সুপ্রিমকোর্টও যে দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে এই প্রকল্পে ছাড়পত্র ঘোষণা করেছে তাতে পরিবেশ রক্ষার প্রশ্নে সামগ্রিক চেতনা ও রাজধানী দিল্লির আগামী পরিবেশ সুরক্ষার প্রশ্নও যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হয়নি বলেই অভিযোগ। শুধুমাত্র কাগুজে আইনগত অবস্থান থেকে সেন্ট্রাল পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্ট দ্বারা ঘোষিত দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্ধারিত বিবিধ পদক্ষেপের তালিকার ভিত্তিতে যে রায় ঘোষিত হয়েছে তা এ দেশের পরিবেশ আইনের মৌলিক আদর্শগত ভাবনাকেও যেমন চ্যালেঞ্জ করেছে একইসাথে আগামীদিনে পরিবেশের সাপেক্ষে সুসংহত উন্নয়নের আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক মহলের স্বীকৃত ভাবনাকেও লঘু করেছে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত ‘পরিবেশ সাফল্য সূচক’ বা ‘এনভায়রনমেন্ট পারফরমেন্স ইনডেক্স’ অনুসারে ভারতের স্থান ছিল মোট ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৭৭ নম্বরে। পরিবেশের মৌলিক বৈশিষ্ট্য, যেমন - জনস্বাস্থ্য, বনাঞ্চল, আবহাওয়া, বায়ুর মান, কৃষি, জীববৈচিত্র্য, বাসস্থান, দূষিত গ্রিন হাউস গ্যাসের মাত্রা, জ্বালানির (ফসিল ফুয়েল) ব্যবহার ইত্যাদি মোট ২৪টি সূচকের মানদণ্ডে ভারতের প্রাকৃতিক পরিবেশ বর্তমানে এক ভয়ঙ্কর ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে। প্রাকৃতিক ও আর্থ-সামাজিকভাবেএমন এক সমস্যাসঙ্কুল, ভয়ানক পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও, পরিবেশের ধ্বংসলীলা সাধন করে খোদ দেশের রাজধানীতে সেন্ট্রাল ভিস্তার মতো প্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত বলে দিচ্ছে এ দেশের শাসকরা প্রকৃত অর্থে পরিবেশগত এমন ভঙ্গুর অবস্থানকে ন্যূনতম স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাটুকুও উপলব্ধি করেন না। সমগ্র বিশ্বের সামনেও আজ দৃষ্টান্ত, এমন ভয়ানক সঙ্কটকালে ভারত সরকারের অগ্রাধিকার কী হতে পারে।
২০১৯ সালে এ প্রকল্পের ঘোষণাই হয়েছিল ন্যূনতম গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে মান্যতা না দিয়ে। প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পটি বিস্তৃত রাষ্ট্রপতি ভবন হতে ইন্ডিয়া গেট পর্যন্ত (যা প্রকৃত অর্থে যমুনা নদীর চর অবধি বিস্তার লাভ করবে) যা রূপায়ণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সেন্ট্রাল পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্ট (সিপিডব্লিউডি)-কে। এই প্রকল্পের অধীনের রয়েছে ৬৪,৫০০ বর্গফুটের সম্পূর্ণ নতুন সংসদ ভবন, যেখানে বসার ব্যবস্থা থাকবে ১২৪৪জন সাংসদের। দিল্লির রাজপথ ধরে সংসদ ভবনকে কেন্দ্র করেই থাকবে জনসাধারণের জন্য খোলা জায়গা, ব্রিজ হতে শুরু করে নানা কাঠামো। এছাড়াও থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের ১০টি নতুন অফিস বিল্ডিং, প্রধানমন্ত্রী ও উপ-রাষ্ট্রপতির জন্য পুরো নতুন বাসভবন সহ যমুনা নদীর তীরে নিউ ইন্ডিয়া গার্ডেনের নানা দৃষ্টিনন্দন কাঠামো। এমন বিশালবপু এই প্রকল্পটি কৌশলগতভাবে পরিবেশ আইনে উল্লেখিত পরিবেশগত অভিঘাত মূল্যায়নের (এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট-ইআইএ) নিরিখে পর্যালোচনার হস্তক্ষেপ থেকে দূরে রাখতে সমগ্র প্রকল্পটাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করা হয়েছে যাতে প্রতিটি প্রকল্পের অধীনে এলাকা কমিয়ে দেখানো যায়। আইনের প্রতিবন্ধকতাকে ব্যবহার করে কিভাবে দেশের সরকার দেশেরই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখাতে পারে তারই এক কু-দৃষ্টান্ত তৈরি করা হলো এভাবে। যার ফলে শুধুমাত্র সাধারণ কেন্দ্রীয় সচিবালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের জন্য চিহ্নিত এলাকাই ইআইএ-র আওতায় এলো। আর সে কারণেই দিল্লির রাজপথ ঘিরে সমস্ত খোঁড়াখুঁড়ি, ব্যারিকেড, বিল্ডিং, ব্রিজ যা এই সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্পের অর্ন্তভুক্ত তা পরিবেশগত অভিঘাত মূল্যায়নের বাইরে চলে গিয়ে সাধারণ পরিবেশ সুরক্ষার প্রশ্নে ছাড়পত্র অর্জনে সক্ষম হলো। একইসাথে পরিবেশের ছাড়পত্র পেয়ে গেল একক প্রকল্প রূপে নতুন সংসদ ভবন এবং তাকে কেন্দ্র করে সংগঠিত মেট্রো রেল প্রকল্পও।
এমন একটা সময়ে প্রকল্পকে পরিবেশগত অভিঘাত মূল্যায়ন এড়িয়ে শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী বা শাসকদলের মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে বা আশু প্রয়োজনভিত্তিক কর্মসূচির অঙ্গ রূপে অতি গুরুত্ব সহকারে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এ প্রকল্প সমাপ্ত করার দিক নির্দেশিত হচ্ছে তখন পরিবেশের প্রশ্নে আমাদের দেশের রাজধানী কোন্ অবস্থায় আসীন তাও একটু দেখে নেওয়া যাক। দিল্লির বায়ুদূষণ সম্পর্কে আমরা সকলেই কমবেশি ওয়াকিবহাল। শীতকালে দিল্লিতে স্বাভাবিক জনজীবন কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা সহ দিল্লির সরকারকে সে সময়ে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয় শুধুমাত্র মাত্রাতিরিক্ত বায়দূষণের প্রকোপ হতে নাগরিকদের সুরক্ষার স্বার্থে। সরকারি বিভিন্ন রিপোর্টেই উল্লেখিত, বিগত কয়েক বছরে বায়ুর গুণগত মানের নিরিখে দিল্লির দূষণ সর্বকালীন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে এবং পৃথিবীর সবথেকে দূষিত রাজধানী শহর রূপে তা চিহ্নিত হয়েছে। শেষ পাঁচ বছরে বাতাসে পিএম-২ কণার মাত্রার গড় মান ছুঁয়েছে ১১৫ মাইক্রোগ্রাম/কিউবিক মিটার, যার জাতীয় গড় মান ৪০ মাইক্রোগ্রাম/কিউবিক মিটার আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিরিখে তার নির্ধারিত মান থাকার দরকার ১০ মাইক্রোগ্রাম/কিউবিক মিটার। অর্থাৎ বায়ুদূষণের নিরিখে বর্তমানে দিল্লির অবস্থা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানের ভিত্তিতে প্রায় ১০ গুণ তলানীতে। আর ঠিক এমন অবস্থায় এই সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্পের অধীনে এক্সপার্ট এপ্রেসাল কমিটির গত ১৩ এপ্রিলের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, এই প্রকল্প রূপায়ণের জন্য দিল্লির ৩২৩০টি গাছ অন্যত্র সরিয়ে লাগানো হবে এবং মাত্র ১৪১২টি গাছ যে স্থানে আছে সেখানেই থাকবে। যদিও এ সংক্রান্ত কোনো খবর দিল্লির বন দপ্তরের কাছে নেই। ইতিমধ্যেই বিশিষ্ট জীব-বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, শতাধিক বছরেরও পুরনো, অতি প্রাচীন জামুন, নিম সহ এই কয়েক হাজার গাছ এভাবে পুনঃরোপণের সিদ্ধান্ত একেবারেই সঠিক নয় এবং এভাবে শুধুমাত্র প্রাথমিক ধাক্কা (শক্) সামলাতে না পেরেই নিশ্চিতভাবে বহু গাছ মারা যাবে। অর্থাৎ একদিকে যখন বায়ুদূষণের ধাক্কায় দিল্লির আবাল বৃদ্ধ-বনিতাদের জীবনে ঘনিয়ে এসেছে ভয়ঙ্কর নানা প্রভাব সে সময়ে সেন্ট্রাল ভিস্তা নামের এ প্রকল্পকে ঘিরে রাজধানী জুড়ে এত বড়ো বড়ো, প্রাচীন গাছ ধ্বংসের এমন আয়োজনের কী কোনো বাস্তবতা থাকতে পারে? ন্যূনতম লজ্জাবোধ থাকলে কোনো সভ্য দেশের শাসক এমন কাজে অগ্রসর হয়? বিশেষত, আজ যখন করোনা মহামারীর সাথে বিশুদ্ধ বায়ুর সরাসরি সম্পর্ক চিকিৎসকরা বারে বারে চিহ্নিত করছেন তখন কোনো দেশের সরকার এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত গ্রহণে উৎসাহী হয়? একদিকে যখন বৃক্ষ নিধন যজ্ঞের এমন সংগঠিত পরিকল্পনা তারই পাশাপাশি এই প্রকল্পের কারণে দিল্লির অতি দ্রুত হারে কমে আসা ভূ-গর্ভস্থ জলাধারকে আরও সঙ্কটময় করে তোলার আশঙ্কাও ইতিমধ্যেই চিহ্নিত। রাজধানী জুড়ে ভয়ঙ্কর জল সঙ্কটের ছবি আমরা গত কয়েক বছরে অনেক সময়েই প্রত্যক্ষ করেছি। সমগ্র বিশ্বের ২০টি জলাভাব যুক্ত শহরের তালিকায় দিল্লির স্থান আজ দ্বিতীয়। সেন্ট্রাল গ্রাউন্ড ওয়াটার বোর্ড, ২০১৮ সালের রিপোর্টেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল যে, দিল্লির ভূগর্ভস্থ জল ২০২০ সালের মধ্যেই ভয়ানক সঙ্কটের মুখোমুখি হতে চলেছে। সব মিলিয়ে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে শাসকের বিকৃত মানসিক আকাঙ্ক্ষাকে চরিতার্থ করতে সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্পের নামে এই বিপুল নষ্টামি দেশের রাজধানীর বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ পরিবেশের পক্ষে যে এক ভয়ানক বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত তৈরি করতে চলেছে তা ইতিমধ্যেই চিহ্নিত।
জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর যে আহ্বান দিয়ে এই নিবন্ধের সূচনা করেছিলাম, ১৯৭৮ সালে ব্রান্টল্যান্ড কমিশনের রিপোর্টেও পরিবেশ ও উন্নয়নের প্রশ্নে সে বার্তাকেই প্রাধান্য দিয়ে বলা হয়েছিল - “সুসংহত বিকাশ হলো সেটাই যা বর্তমান প্রজন্মের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ততদূরই অগ্রসরমান হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদাকে ন্যূনতম ক্ষতিগ্রস্ত করে।’’ সুসংহত বিকাশের প্রশ্নে আজ একইসাথে এটাও বলা হচ্ছে যে, তা কেবলমাত্র মানবসমাজের আশু চাহিদাকেই সুরক্ষিত করবে না, পাশাপাশি সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, দারিদ্র্য দূরীকরণ, খাদ্যের নিরাপত্তার অভাব দূর করা সহ অন্যান্য পরিবেশের অন্তর্নিহিত বিভিন্ন শক্তির ভারসাম্য ও সুরক্ষার প্রশ্নেও সচেতন থাকবে। যেকোনো দেশের ক্ষেত্রেই পরিবেশ সংক্রান্ত আইনের প্রশ্নে যে মৌলিক বিষয়গুলো আজ অতি গুরুত্ব সহকারে স্বীকৃত তা হলো - প্রাকৃতিক সম্পদ সীমিত, তা দ্রুততার সাথে নিঃশেষিত হয়ে চলেছে। পরিবেশও আজ আপন শোধন ক্ষমতার সাথে আধুনিক জীবনযাত্রার সামঞ্জস্য পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে, ফলে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে মাত্রাতিরিক্ত দূষণ। সেকারণেই পরিবেশের সুরক্ষার প্রশ্নে এমন এক চূড়ান্ত স্পর্শকাতর সময়ে দাঁড়িয়ে যেকোনো প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহারের প্রশ্নে অতি অবশ্যই মানবসমাজের সামগ্রিকতার স্বার্থে তার প্রয়োজনীয়তাকে বিচার করা আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ বর্তমান সময়ের নিরিখে প্রকৃতির ভারসাম্যের প্রশ্নে আজকের প্রতিটি পদক্ষেপই আগামীর জন্য হয়ে উঠতে পারে ভয়ঙ্কর রকমের বিপর্যয়কর। দুঃখের হলেও সত্য আমার-আপনার আজকের রাষ্ট্র এমন বিচারের দায়িত্বকে তো গ্রহণ করতেই চায় না বরং আপন রাজনৈতিক স্বার্থকে চরিতার্থ করার তাড়নায় ন্যূনতম নীতি, নৈতিকতাকে বিসর্জন দিতেও এতটুকু কুণ্ঠিত হয় না।