E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৪২ সংখ্যা / ৪ জুন, ২০২১ / ২০ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

পরিবেশ আলোচনা

যারা পরিবেশের ভক্ষক (সদগুরুর বাস্তুতন্ত্র হত্যা ও মুথাম্মার কাহিনি)

তপন মিশ্র


ঈশা ফাউন্ডেশন।

৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। ২০২১-এর আহ্বান বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধার (Ecosystem Restoration)। এমনই এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুতন্ত্রের ধ্বংসের ঘটনার কথা এই প্রবন্ধে উল্লেখ করব। ঘটনার প্রায় সমস্ত তথ্য সংগৃহীত হয়েছে নিউজলন্ড্রি (Newslaundry) এবং দা ওয়ের (The Wire) এই দুই নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধ থেকে। প্রাকৃতিক নিয়মে সংরক্ষিত বাস্তুতন্ত্রের ধ্বংসে রাষ্ট্রও প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়ে পড়ছে। কখনও ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরিতে মদত দিতে আবার কখনও মুনাফার জন্য এই অবৈধ যোগ স্পষ্ট।

আমাদের রাষ্ট্রের এবং তথাকথিত পরিবেশপ্রেমীদের উদাত্ত আহ্বান হলো পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে সমস্ত নাগরিককে দায়িত্ব পালন করতে হবে। দেশের অধিকাংশ নাগরিক এমন কিছু করেন না যার ফলে পরিবেশের বিশেষ কিছু ক্ষতি হয়। কিন্তু যারা প্রভাবশালী বা প্রভাবশালীদের পৃষ্ঠপোষক, সরকারি মদতপুষ্ট কর্পোরেট তাদের কাছে পরিবেশ রক্ষার কোনো দায়বদ্ধতা নেই। মুনাফা, সাম্প্রদায়িকতার এবং ধর্মান্ধতার বিষ ছড়ানোই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। পরিবেশ রক্ষার নামে কার্বন বাণিজ্যে আন্তর্জাতিক পুঁজির বিনিয়োগ ক্রমবর্ধমান। সন্দেহ নেই যে, এ কারণে পরিবেশ আন্দোলন এবং বিশেষ করে বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধারের আন্দোলন শ্রেণি আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

সদগুরুর অসৎ কাজ

তামিলনাডুর বোলামপট্টি রিজার্ভ ফরেস্ট (সংরক্ষিত অরণ্য)-এর মধ্যে ভেলিয়ামগিরি পাহাড়। পাহাড়টি সম্পূর্ণভাবে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের অংশ এবং কোয়েম্বাটুর বনাঞ্চলের অংশ বিশেষ। এখানেই ১৫০ একর জমির ওপর তৈরি হয়েছে বিলাসবহুল ঈশা ফাউন্ডেশনের কেন্দ্রীয় আশ্রম। ঈশা আশ্রমের কর্তা সদগুরু ওরফে জাগি বাসুদেব। সদগুরু ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে পরিচিত। ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এখানে সদগুরুর এই বিলাসবহুল প্রাসাদ তৈরি হয়। এর মধ্যে রয়েছে কৃত্রিম লেক এবং ৭৭টি বড়ো বড়ো অট্টালিকা। আশ্রম কর্তৃপক্ষের মতে তাঁরা স্থানীয় পঞ্চায়েতের অনুমতি নিয়ে এই আশ্রম তৈরি করেছে, যদিও এমন এক পরিবেশগত সংবেদনশীল অঞ্চলে গ্রাম পঞ্চায়েতের অনুমতি প্রদানের কোনো এক্তিয়ার নেই। এলাকার মানুষের সহানুভূতি পাওয়ার জন্য ‘ঈশা সংস্কৃতি স্কুল’ নামে একটি স্কুলও খুলে ফেলা হয়। এই স্কুলকে সামনে রেখে বিদ্যুৎ বিভাগ আশ্রমকে কম খরচে বিদ্যুৎও সরবরাহ করে।

জায়গাটির আসল নাম ইকারাই বলুভাম্পাট্টি যা ছোট্ট একটি আদিবাসী গ্রাম হিসাবে পরিচিত। বোলামপট্টি রিজার্ভ ফরেস্ট নীলগিরি বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের অংশবিশেষ। পুরো অঞ্চলটি হাতির আবাসস্থল। পুরো আশ্রম চত্বরটি থানিকান্দি-মারুধামালাই হাতির করিডর (সাধারণভাবে বন্য হাতি যে পথ দিয়ে যাতায়াত করে)। সরকারের ১৯৭২ সালের বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন এবং ১৯৮০ সালের অরণ্য সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী বন্যপ্রাণের আবাসস্থল এবং চিহ্নিত যাতায়াতের পথ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুতন্ত্র। সেই বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করা এক শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই জমিতেই আবার পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ায় তামিলনাডুর Hill Area Conservation Authority (HACA)-র অধীনে। তামিলনাডুর ১৯৯০ সালের HACA আইন অনুযায়ী বিশেষ কোনো কারণ এবং অনুমোদন ছাড়া পাহাড়ে যেকোনো ধরনের নির্মাণ কাজ নিষিদ্ধ।

এত কাণ্ড হয়ে যাওয়ার পর ঈশা ফাউন্ডেশন ২০১১ সালে বনবিভাগের কাছে নির্মাণের জন্য অনুমতি চায়। যদিও এটা জানা যে, কোনো রাজ্য সরকারের বনবিভাগের এই ধরনের অনুমতি দেওয়ার কোনো এক্তিয়ার নেই। বনবিভাগের রেঞ্জ আধিকারিক ৮/০২/২০১২ তারিখে ঈশা ফাউন্ডেশনকে চিঠি দিয়ে জানান যে, এই নির্মাণ কাজ অবৈধ এবং এই কাজের জন্য তাদের বা HACA-র কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি। পরবর্তীকালে বনবিভাগের পরিদর্শনের ফলে একথা প্রমাণিত হয় যে, হাতির স্বাভাবিক যাতায়াতের পথ তড়িতাবিষ্ট বেড়া দিয়ে বন্ধ করে দেওয়ার কারণে হাতি অন্য পথ দিয়ে যাতায়াত করছে এবং এর ফলে চাষ জমির অনেক ক্ষতি হচ্ছে। শুধু তাই নয় পাশে বয়ে যাওয়া নোয়াল নদীতে আশ্রমের সমস্ত বর্জ্য ফেলে নদীর জল দূষিত করা হচ্ছে। তামিলনাডুর এক বড়ো শহর কোয়েম্বাটুর নোয়াল নদীর জলের উপর নির্ভরশীল।

১১২ ফুট উঁচু আদিযোগীর মূর্তি।

২০১২ সালের নভেম্বর মাসে তামিলনাডু সরকারের পরিকল্পনা দপ্তর থেকে ঈশা ফাউন্ডেশনকে সমস্ত নির্মাণ কাজ বন্ধ করার চিঠি দেওয়া হয়। ডিসেম্বর মাসে চিঠি আসে সমস্ত অবৈধ পরিকাঠামোকে ভেঙে ফেলার। সরকার এই চিঠি দিয়েই ক্ষান্ত থাকে। কিন্তু ঈশা ফাউন্ডেশন এসবের থোড়াই কেয়ার! সরকারও এই মনোভাবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

একটি বেসরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে ঈশা ফাউন্ডেশন এবং সরকারের বিভিন্ন বিভাগের উদাসীনতার বিরুদ্ধে মাননীয় মাদ্রাজ হাইকোর্টে পর পর ৪টি আবেদন করা হয়। তারা ঈশা আশ্রমের সম্পূর্ণ উচ্ছেদ দাবি করে এবং পাশাপাশি দোষী সরকারি কর্মচারীদের শাস্তির দাবি করে। নিউজলন্ড্রিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পুভুলাগিন নানবার্গাল সংগঠনের পক্ষ থেকে ভেটরই সেলভান বলেনঃ “আদালতে আমরা গিয়েছি কারণ কোয়েম্বাটুরের বনাঞ্চল ও আশেপাশে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর সংঘাত গত ১৫-২০ বছরে বেড়েছে। এর প্রাথমিক কারণ হলো, হাতির আবাসস্থলে অবৈধ নির্মাণ কাজে ইশা ফাউন্ডেশন ব্যাপক পরিমাণে জড়িত। আমরা এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের এবং জীব বৈচিত্র্য রক্ষার জন্য চেষ্টা করছি। এজন্য আমরা ইশার অবৈধ নির্মাণের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। এটি কোনো ব্যক্তিগত কলহ নয়।’’ মাদ্রাজ হাইকোর্টে এই মামলার কোনো সমাধান হয়নি।

ইতিমধ্যে ৪ বছর ধরে এক বিশাল এলাকা জুড়ে ঈশা আশ্রম ১১২ ফুট উঁচু একটি ‘আদিযোগী’- র মূর্তি তৈরি করে। এর বিরুদ্ধে পুভুলাগিন এবং ভেলিয়ামগিরি হিল ট্রাইবাল প্রোটেকশন সোসাইটি জাতীয় পরিবেশ আদালত (National Green Tribunal)-এ আবেদন করে। কিন্তু এই আবেদনের শুনানি হওয়ার আগেই ২০১৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই মূর্তি উদ্বোধন করে দেন। একথা নিশ্চিত যে, উদ্বোধন করার আগে প্রধানমন্ত্রী এটা জানতেন যে, একটি পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল অঞ্চল এবং দেশের অরণ্য ও বন্যপ্রাণ রক্ষা সম্পর্কিত সমস্ত আইনের বিরুদ্ধে তিনি দাঁড়াচ্ছেন। যে দেশে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আইনের বিরুদ্ধে সেই দেশে বাস্তুতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন কী সম্ভব?

দা ওয়ের (The Wire)-এ ২০১৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রকাশিত এই সংক্রান্ত আর একটি খবরের উল্লেখ করছি। খবরে বলা হয় যে, মাদ্রাজ হাইকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ডি হরিপারান্থমন (Justice D. Hariparanthaman) এক সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীকে এই জমির উপর তৈরি মূর্তি উদ্বোধন না করার পরামর্শ দেন। কিন্তু ধর্মের কাহিনি তো সবাই শোনেনা। বামপন্থী দলগুলিও এই কর্মসূচির বিরোধিতা করে এবং কোয়েম্বাটুরে প্রধানমন্ত্রীকে কালো পতাকা দেখায়।

সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির সম্মেলনে মুথাম্মা।

মুথাম্মার কাহিনি

২০১৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর 'দা ওয়ের' আরেকটি খবর ছাপে। খবরটি কোয়েম্বাটুরের বনাঞ্চলের এক আদিবাসী মহিলা মুথাম্মার কাহিনি। সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি-র ১৫তম তামিলনাডুর ধারাম্পুরি রাজ্য সম্মেলনে মুথাম্মা তার আপসহীন লড়াইয়ের জন্য ২৪ সেপ্টেম্বর সন্মানিত হয়। মুথাম্মা ঈশা আশ্রমের বিরুদ্ধে সরাসরি আন্দোলনে যুক্ত। বেশ কয়েক বছর আগে থেকে তাঁর স্বামীর সাথে দৈনিক শ্রমিক হিসাবে তিনি জাগি বাসুদেবের আশ্রমে কাজ শুরু করেন। দৈনিক মজুরি ছিল ২৫০-৩০০ টাকা। এখন অবশ্য সেই কাজ ছেড়ে স্বসহায়ক দলে যুক্ত হয়ে ওখানেই কাজ করেন।

আশ্রমে কাজ ছাড়ার মূলে ছিল আশ্রমের অবৈধ জমি দখলের বিরুদ্ধে মুথাম্মার লড়াই। একদিন মুথাম্মা দেখে যে, আশ্রমের পক্ষ থেকে ওঁদের জঙ্গলে ঢোকার রাস্তাকে কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। মুথাম্মা গ্রামবাসীদের নিয়ে আশ্রমের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করে এবং যাতাযাতের জন্য মাত্র ৩ ফুট রাস্তা ছাড়ার আবেদন করেন। কিন্তু তা মানা হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে মুথাম্মাদের অরণ্যের সঙ্গে যোগের ফলে তাঁরা সেই বাস্তুতন্ত্রে অংশীভূত হয়ে গেছেন। আশ্রমের লোকেরা বনবাসী গ্রামবাসীদের নিয়ে জঙ্গলে বনৌষধি সম্পর্কিত পরম্পরাগত জ্ঞান সংগ্রহ করে কিন্তু তার কোনো মূল্য গ্রামবাসীরা পায়নি। এরপর প্রায় ২০০ জন বনবাসী সংগঠিত হয়ে আদিবাসীদের অরণ্যের অধিকার আন্দোলন শুরু করে। গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি এবং আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তৈরি সংগঠনের অরণ্য বাস্তুতন্ত্র এবং নদী রক্ষার আন্দোলনে এখন মুথাম্মা এক সামনের সারির সৈনিক।

মুথাম্মার লড়াই আসলে বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং এখনও বেঁচে থাকা বাস্তুতন্ত্র রক্ষার লড়াই। এ লড়াই বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে যে সমস্ত মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িয়ে আছে তাদেরও লড়াই। একারণে এই লড়াই শ্রেণির লড়াই। মানুষ সমবেত জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়ার পর এবং উৎপাদন ব্যবস্থা যত উন্নত হয়েছে বাস্তুতন্ত্র ততোটাই ছিন্নভিন্ন হয়েছে। কিন্তু এই দুরবস্থা থেকে প্রকৃতিকে বাঁচাতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আইন তৈরি হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের তৈরি এই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মুনাফা এবং ধর্মীয় আবেগ তৈরিকে সামনে রেখে প্রাকৃতিক সম্পদের লুঠ চলছে। এর সঙ্গে যুক্ত হতে চলেছে বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নামে বাণিজ্যিক বৃক্ষরোপণ। এই অভিনব ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক কার্বন বাণিজ্যের এক অংশ। তৃতীয় বিশ্বের দেশে বাস্তুতন্ত্রের উপর নির্ভরশীল মানুষকে বাস্তুতন্ত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করার এই প্রক্রিয়া আসলে আদিম শোষণের এক নয়া পদ্ধতি। ইন্দোনেশিয়ার বর্ষাবন ধ্বংস করে পাম তেলের উৎপাদন, ব্রাজিলের অরণ্য পুড়িয়ে বাণিজ্যিক গোচারণের জমি তৈরি বা আমাদের দেশে খনিজ সম্পদ লুটের জন্য অরণ্য ধ্বংস করা এসবই এই প্রকৃতি লুঠের অংশবিশেষ। তাই বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধার বা রক্ষা আসলে এক শ্রেণি-লড়াইয়ের অংশবিশেষ।