E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৪২ সংখ্যা / ৪ জুন, ২০২১ / ২০ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

স্মরণ

কমরেড মৈথিলী শিবরামন

মালিনী ভট্টাচার্য


কমরেড মৈথিলী শিবরামন দীর্ঘ কয়েক বছর রোগভোগের পরে গত ৩০ মে চেন্নাইতে কোভিডজনিত জটিলতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। ১৯৮১ সালে সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির গোড়াপত্তনের সময় থেকে তামিলনাডুতে এবং জাতীয় স্তরে এই আন্দোলনের সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রীদের তিনি ছিলেন একজন। আন্দোলনে হাতে-খড়ি অবশ্য আরো আগেই। সাংবাদিকতায় উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে ১৯৬০-এর দশকের শেষে যখন তিনি আমেরিকায় রাষ্ট্রসংঘের দপ্তরে কাজ করছিলেন সেসময়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং কালো মানুষের অধিকারপ্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনগুলি তাঁকে প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করে এবং বামপন্থী মতাদর্শের দিকে আকৃষ্ট করে। দেশে ফিরে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন শ্রমিক আন্দোলনে। বিশেষত নারী-শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের কাজে যুক্ত করতে তামিলনাডুতে সি আই টি ইউ-র এক প্রথম সারির সংগঠক হিসাবেই তাঁর রাজনৈতিক কর্মীর জীবন শুরু।

উল্লেখ্য, তামিলনাডুর নারী-আন্দোলনে জানকী আম্মল ও ‘পাপা’ উমানাথের মতো প্রথম প্রজন্মের নেত্রীরা উঠে এসেছিলেন শ্রমজীবী বর্গের মধ্য থেকেই। মৈথিলীর পারিবারিক পরিপার্শ্ব অন্যরকম হলেও পূর্বসূরীদের ধারা ধরে নিজের কর্মীজীবনের গোড়া থেকেই তাঁর অভিমুখ ছিল শ্রমজীবী আন্দোলনে নারীর অধিকারের প্রশ্নের সঙ্গে নারী-আন্দোলনে শ্রমজীবী মেয়েদের প্রসঙ্গটির সেতুবন্ধনের দিকে। তামিলনাডুর জনবাদী নারীসংগঠনে ‘পাপা’ উমানাথের শিক্ষানবিশ হিসাবে কাজ শুরু করেন মৈথিলী; সারাভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি তৈরি হবার পরে তামিলনাডুতে এবং জাতীয় স্তরে তার অন্যতম মূল সংগঠক হয়ে ওঠেন তাঁর স্বচ্ছ বাস্তব দৃষ্টি, নিরলস মনন এবং সকলস্তরের কর্মীর প্রতি তাঁর সহজ ও সংবেদনশীল ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। পরে মহিলা সমিতির সর্বভারতীয় সহ-সভানেত্রীও নির্বাচিত হন। অসুস্থতার কারণে কাজের মধ্যে থাকা যখন আর সম্ভব হলো না, তখনও থেকেছেন আমাদের পরামর্শদাতাদের (patron) অন্যতম হয়ে।

উচ্চশিক্ষা নিয়ে মৈথিলীর কোনো অভিমান ছিল না; বরং উচ্চশিক্ষাও তাঁর জীবনে হয়ে উঠেছিল নিপীড়িত মানুষের সপক্ষে রাজনৈতিক সংগ্রামের হাতিয়ার। ইংরেজি এবং তামিল দুই ভাষাতেই সমান দক্ষতায় তিনি সব্যসাচীর মতো লেখনীকে ব্যবহার করেন যাদের কথা কেউ বলে না তাদের কথাকে বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিতে। আন্তর্জাতিক মঞ্চ বা রাস্তার ধারে বস্তির মধ্যে কথ্য ভাষার জমায়েত এই দুই মেরুতে ছিল তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ। কী করে মননক্ষমতাকে রাজনৈতিক লড়াইয়ে ব্যবহার করতে হয় তার সেরা পরিচয় তিনি দেন থাঞ্জাভুর জেলার কিলভেনমানিতে আন্দোলনরত দলিত খেতমজুরদের পুড়িয়ে মারার ঘটনা বা নব্বইয়ের দশকে ধর্মপুরী জেলার ভাচিথিতে আদিবাসী মেয়েদের ওপর পুলিশ এবং সরকারি আধিকারিকদের নৃশংস অত্যাচারের পরে তাঁর প্রতিক্রিয়াতে। একদিকে লাগাতার অত্যাচারিতের পাশে দাঁড়িয়ে সাহস জুগিয়েছেন; অন্যদিকে সাংবাদিকের খোলাদৃষ্টিতে সত্যের অনুসন্ধান করে তা নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন তামিলনাডু এবং জাতীয়স্তরের সংবাদমাধ্যমে। থামেননি যতদিন সুবিচার আদায় করা না গেছে। রাষ্ট্রের উৎপীড়ন, মেয়েদের এবং শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের লড়াই, পণপ্রথা, গার্হস্থ্য হিংসা, কন্যাভ্রূণমোচনের অন্যায় - এই প্রতিটি বিষয় নিয়ে একদিকে যেমন সংগঠনকে আন্দোলনে উদবুদ্ধ করেছেন, অন্যদিকে তা নিয়ে অজস্র লেখার মধ্য দিয়ে মতামত সংগঠিত করার সংগ্রাম চালিয়েছেন। তাঁর এরকম ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা কিছু লেখা নিয়ে একটি সংকলনগ্রন্থ Haunted by Fire: Essays on Caste, Class, Exploitation and Emancipation।

আমার সঙ্গে মৈথিলীর ভালো করে পরিচয় হয় সম্ভবত ১৯৯২ সালে, যখন আমাকে চেন্নাইতে প্রথম জানকী আম্মল স্মারক বক্তৃতা দেবার জন্য সে আমন্ত্রণ জানায়। নয়াউদারবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার প্রেক্ষাপটে আমার বক্তৃতার বিষয় ছিল Women in Dark Times। মৈথিলীর সঙ্গে আলোচনা করেই বক্তব্য তৈরি করেছিলাম। বক্তৃতাস্থলে মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলাম তামিলনাডুর জ্ঞানীগুণীসমাজে মৈথিলীর সম্মান ও জনপ্রিয়তা কতখানি। শ্রমজীবী আন্দোলনের লড়াকু নেত্রী এই ভূমিকাতে সমান স্বচ্ছন্দই ছিল। তখন দু'দিন ছিলাম তার স্পার ট্যাংক রোডের ফ্ল্যাটে, যে ফ্ল্যাটটি তামিলনাডুর মহিলা সমিতির স্থায়ী আড্ডাস্থল ছিল, অনেক রাজনৈতিক ক্লাস নেওয়া হতো যে ফ্ল্যাটে এবং মহিলা সমিতির অনেক কর্মী যে পরিসর থেকে তৈরি হয়েছিল।

মৈথিলীর মেয়ে কল্পনা মায়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছে, ছোটো থেকেই সে জানত মা অন্য মায়েদের থেকে একটু আলাদা; এমনকী তাঁর বলা গল্পগুলিও ছিল অন্যরকম যার মধ্যে ‘হোঁৎকা জোতদারে’র কথা প্রায়ই থাকত। সেসময়ে মোটেই সে পছন্দ করত না দিদিমার কাছে তাকে রেখে মায়ের এখানে-ওখানে উধাও হওয়া আর সারাক্ষণ বাড়িতে লোকের আনাগোনার ফলে মায়ের নজর তার থেকে অন্যদিকে চলে যাওয়া। আমি যখন মৈথিলী এবং কমরেড করুণাকরণের সঙ্গে থেকেছি তখন কল্পনা বড়ো হয়ে গেছে। কিন্তু আমাকে আকর্ষণ করেছে এই পরিবারের মতাদর্শের সঙ্গে তাদের প্রাত্যহিক জীবনযাপনের সঙ্গতি, নিছক রক্তের বন্ধন ছাড়াও যে মতাদর্শের বন্ধন পরিবারটিকে নিবিড় করে বেঁধে রেখেছে। পরবর্তী সময়ে যে যত্ন ও ভালবাসা দিয়ে ব্যাধিক্লিষ্ট মৈথিলীকে তার পরিবার ঘিরে রেখেছিল তাতে পারিবারিক দায়িত্ববোধই নয়, ফুটেছে সহযোদ্ধাদের সহমর্মিতা।

মৈথিলী সুস্থ থাকতে তাঁর সঙ্গে আরেকবার কিছু সময় কাটানোর সুযোগ হয় নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে। মহিলা সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং হচ্ছিল বোলপুরে। সে আমাকে বলে রেখেছিল, তার দিদিমার ডায়েরির ভিত্তিতে তাঁর যে জীবনকথা রচনা করার সে চেষ্টা করছেন, রবীন্দ্রভবনে তার কিছু রসদ খোঁজার জন্য বাড়তি দু'দিন তার থাকার ইচ্ছে ; আমি যদি তাকে সেখানে নিয়ে যাই। সেই আশ্চর্য মহিলাটির কথা তার কাছে তখনই শুনি। প্রায় শৈশবেই বিবাহিত সুব্বুলক্ষ্মী বহু প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে গিয়ে জাতীয় আন্দোলনে যোগ দেন এবং কন্যা পংকজমকে (মৈথিলীর মা) লেখাপড়া শেখানো তাঁর জীবনের ব্রত হয়ে ওঠে। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের কাছে মেয়েকে পড়ানোর ইচ্ছা যখন পারিবারিক বাধায় ব্যর্থ হয়, তখন তাঁর মন ভেঙে যায়। বন্ধু কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় ‘শামা’ (আলো) নামে যে পত্রিকাটি চালাতেন তাতে তাঁর কিছু লেখা ছিল। রবীন্দ্রভবনে পত্রিকাটির কিছু সংখ্যা পাওয়া যেতে পারে একথা জেনেই যে শান্তিনিকেতনে দিদিমার আসা হয়নি সেখানে মৈথিলীর আগমন। সুখের বিষয়, অসুস্থ হয়ে পড়ার আগেই মৈথিলীর এই বইটি প্রকাশিত হয় Fragments of a Life এই নামে। আজ যখন সে নেই তখন তাঁর অফুরান প্রাণশক্তি, তাঁর চিন্তার সতেজ উদারতা স্মরণ করে মনে হয় তাঁর কাছ থেকে আমাদের আরো অনেক কিছু পাবার ছিল। গর্বিত বোধ করি যে এই ব্যতিক্রমী নেত্রী, এই ব্যতিক্রমী বুদ্ধিজীবী তাঁর জীবনের সেরা সময়টা জুড়ে ছিল আমাদের সংগঠনের একজন কর্ণধার।