E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৪২ সংখ্যা / ৪ জুন, ২০২১ / ২০ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

চিরনিদ্রায় দিল্লির গৌতম ভট্টাচার্য

অমিতাভ রায়


গৌতম ভট্টাচার্য প্রয়াত। ২৮ মে, ২০২১ দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ দিল্লির এইমস্ হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। ফুসফুসের ক্যান্সার জয় করার পর ফুসফুসেই কোভিড সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় এই বিপর্যয়। এইমস্ হাসপাতালেই তাঁর ক্যান্সারের চিকিৎসা হচ্ছিল। দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসায় সাড়া দিয়ে তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছিলেন। অবসর নেওয়ার পর স্ত্রী অর্পিতা এবং একমাত্র কন্যা মেঘাকে নিয়ে হাওড়ার বালিতে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য যাওয়া পিছিয়ে দিতে হয়। তার আগেই করোনার ভয়ঙ্কর আক্রমণ তাঁকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল সেই অজানা ঠিকানায় যেখানে গেলে আর ফিরে আসা যায় না। কোভিড বিধি মেনে সেদিন সন্ধ্যায় এইমস্-এর নিজস্ব শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।

হাওড়ার বালি এলাকার পাঠকপাড়া থেকে ১৯৮৩ নাগাদ কর্মসূত্রে গৌতমকে দিল্লি চলে আসতে হয়। এরকম তো অনেককেই বাধ্য হয়ে বা কর্তব্যের সুবাদে প্রবাসে জীবন কাটাতে হয়। প্রবাসীদের অনেকেই সময়ের ধারাবাহিকতায় ও পারিপার্শ্বিক কারণে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এখানেই গৌতম অন্যতম ব্যতিক্রম। দিল্লিতে বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসারের কাজে যাঁরা যুক্ত তাঁদের অন্যতম ছিলেন গৌতম ভট্টাচার্য। প্রায় চার দশক ধরে দিল্লির বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে ও সাংস্কৃতিক প্রাঙ্গণে তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি অনস্বীকার্য। শারদোৎসব উপলক্ষে আয়োজিত বইয়ের স্টল হোক বা সফদার হাশমিকে হত্যার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের সামনে চটজলদি আয়োজিত প্রতিবাদী স্মরণসভা, গৌতম সর্বত্রই অন্যতম আয়োজকের ভূমিকা পালন করেছেন। নাট্য উৎসব হোক বা পঁচিশে বৈশাখ উদ্ যাপন, সদাহাস্য মানুষটি ঠিক সময়ে উপস্থিত।

আবার দুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়ে ত্রাণের কাজেও এককথায় ঝুঁকি নিয়েও ঝাঁপিয়ে পড়তে গৌতম ভট্টাচার্যর মধ্যে কোনো দ্বিধা ছিল না। বিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে পূর্ব দিল্লির বস্তিবাসী বাঙালিদের বাংলাদেশি আখ্যা দিয়ে বাস্তুচ্যুত করার চেষ্টা হয়েছিল, তার প্রতিরোধে যে কয়েকজন বাঙালি ঘটনাস্থলে ছুটে গেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম গৌতম ভট্টাচার্য। বামপন্থীদের সর্বভারতীয় কেন্দ্রীয় সমাবেশের প্রতিটিতে তিনি স্বেচ্ছাসেবক। মাঝরাতে হোক অথবা শীতের সকাল, নতুন দিল্লি স্টেশনে তিনি উপস্থিত। বিভিন্ন গণ সংগঠনের 'দিল্লি চলো' অভিযান শুরু হলেই বেড়ে যেত তাঁর কর্মব্যস্ততা। প্রতিনিধিদের থাকার জায়গা থেকে শুরু করে তাঁদের সমাবেশ স্থলে পৌঁছে দেওয়ার কাজে গৌতম ছিলেন একজন অগ্রণী স্বেচ্ছাসেবক।

১৯৫৭-য় দিল্লিতে বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়। খ্যাতনামা বাঙালিরা সংগঠনটির সঙ্গে বরাবরই জড়িত থাকলেও বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন বিশেষ পরিচিতি পায়নি। ১৯৮০-র দশকে বেশ কয়েকজন বাঙালি তরুণ কর্মসূত্রে দিল্লির বাসিন্দা হয়ে বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর প্রাচীন সংগঠনে এলো প্রাণের স্পন্দন। সংস্থার মুখপত্র 'দিগঙ্গন' প্রতি মাসে নিয়মিত প্রকাশ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯৯৯ পর্যন্ত প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে এই সাহিত্য পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছে। একই সঙ্গে শুরু হয় বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশনের নিজস্ব ঠিকানা নির্মাণের কাজ। সেই পরিশ্রম ও উন্মাদনার ফসল 'মুক্তধারা' । নতুন দিল্লির কেন্দ্রস্থলে গোল মার্কেট অঞ্চলে অবস্থিত এই প্রেক্ষাগৃহ এবং সংলগ্ন দপ্তর এখন দিল্লির সংস্কৃতি পরিমণ্ডলে একটি পরিচিত নাম। গৌতম ছিলেন সেই তরুণ দিল্লি প্রবাসীদের অন্যতম।

বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে ১৯৯৮-এ আয়োজিত হয় প্রথম বাংলা বই মেলা। নতুন দিল্লির কেন্দ্রস্থলে বারাখাম্বা রোডের উপর মন্ডি হাউসের পাশে সপ্রু হাউসের প্রাঙ্গণে আয়োজিত এই বই মেলার উদ্বোধন করেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সঙ্গে ছিল কবি সম্মেলন, গল্প পাঠের আসর। কলকাতা থেকে এলেন এক ঝাঁক খ্যাতনামা কবি, গল্পকার। এবং অবশ্যই বাংলা বইয়ের প্রকাশক।

প্রথম বছরের সাফল্যে সকলেই উজ্জীবিত। বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তাদের মধ্যে যাঁদের বাংলা বই মেলা নিয়ে কিঞ্চিৎ আপত্তি ছিল তাঁরাও দ্বিতীয় বারের বাংলা বই মেলা সফল করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ফলাফল - বিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে সপ্রু হাউস প্রাঙ্গণে আয়োজিত দ্বিতীয় বাংলা বই মেলা নিয়ে দিল্লির সাংস্কৃতিক মহলে হইচই পড়ে গেল। কলকাতার দৈনিক সংবাদপত্রগুলি ছাড়াও দিল্লির ইংরেজি, হিন্দি, পাঞ্জাবি, উর্দু দৈনিক সংবাদপত্রগুলি নিয়মিত বাংলা বই মেলা সংক্রান্ত খবর ছাপছে। দূরদর্শন সহ বেসরকারি টিভি চ্যানেলে বিভিন্ন ভাষায় বাংলা বই মেলার খবর প্রচারিত হচ্ছে। উদ্বোধন করছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নবনীতা দেবসেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। কলকাতার সত্তরটি প্রকাশনা সংস্থা মেলায় অংশ নিয়েছিল। মার্চ-এপ্রিলের বসন্তবেলায় অর্থাৎ দিল্লির সেরা আবহাওয়ায় প্রতি সন্ধ্যায় আয়োজিত হয়েছে গল্প পাঠ, কবি সম্মেলন ছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বাংলা বই মেলার দ্বিতীয় বর্ষের অনুষ্ঠানে নাটক নিয়ে হাজির হলেন এখনকার বাংলা নাটমঞ্চের অন্যতম উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। এর আগে তাঁর নাট্যগোষ্ঠী দিল্লিতে নাটক মঞ্চস্থ করার সুযোগ পায়নি। এবং এখনকার প্রতিষ্ঠিত ও অন্যতম জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী ১৯৯৯-এর বাংলা বই মেলার প্রথম দিল্লিতে সঙ্গীত পরিবেশনের সুযোগ পান। এমন এক সারা ফেলে দেওয়া অনুষ্ঠানের আয়োজকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন গৌতম ভট্টাচার্য।

সবমিলিয়ে দিল্লির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে গৌতম ভট্টাচার্য একটি সুপরিচিত নাম। তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ এবং ক্রিয়াকর্মাদি সম্পর্কে সকলেই অভিহিত। কিন্তু তা নিয়ে ব্যক্তি গৌতমের সঙ্গে কারও বিরোধ নেই। বিভিন্ন নাট্যগোষ্ঠীর সঙ্গে সরাসরি জড়িত মানুষটি নিয়মিত সাহিত্যচর্চা করতেন। দেশভাগের ফলে উদ্ভূত সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। দেশভাগে যাঁরা ভুক্তভোগী তাঁদের অভিজ্ঞতা জড়ো করে একটি গুরুত্বপূর্ণ বই সম্পাদনার পরিকল্পনা ছিল। প্রাতিষ্ঠানিক কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর এই বইটি প্রকাশ করার ইচ্ছা ছিল। বেশ কিছু মানুষের অভিজ্ঞতা, অভিমত, বিশ্লেষণ সংগ্ৰহ হয়েছিল। হঠাৎ করেই চিরবিদায় নেওয়ায় আপাতত স্থগিত রইলো এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

মানুষের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ানোর মতো ব্যক্তিত্ব কমে আসা এই সমাজে গৌতম নিঃসন্দেহে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। অসুস্থকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হোক বা দুষ্প্রাপ্য বই জোগাড় করে দেওয়া সবকিছুতেই তিনি এককথায় সাড়া দিতে অভ্যস্ত। কলকাতার সাহিত্য বা সাংস্কৃতিক কর্মীদের সঙ্গেও ছিল তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ। তাঁরা দিল্লি এলেই স্বেচ্ছায় আপ্যায়নের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতেন গৌতম। কলকাতার বাংলা বই প্রকাশনা সংস্থার কর্মীদের সঙ্গেও তাঁর ব্যবহার ছিল অত্যন্ত আন্তরিক।

আক্ষরিক অর্থে গৌতম কোনো নেতা ছিলেন না। বরং বলা যায় তিনি ছিলেন একজন দায়িত্বশীল সৈনিক। স্বার্থকেন্দ্রিক বর্তমান সমাজে যখন 'মানুষ মানুষের জন্য' শব্দবন্ধ মুছে যেতে চলেছে সেই কঠিন ও জটিল সময়ে গৌতম ভট্টাচার্যের মতো একজন নিরহঙ্কারী ও পরোপকারী এবং আদর্শে অবিচল মানুষের আকস্মিক বিদায় বড়োই বেদনাদায়ক।