E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৪২ সংখ্যা / ৪ জুন, ২০২১ / ২০ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

যে সংগ্রাম স্বর্গে ঝড় তুলেছিল

সোমনাথ ভট্টাচার্য


১৮৭১, ১৮ মার্চ থেকে ২৮ মে। প্রতিষ্ঠিত হলো পৃথিবীর প্রথম প্রলেতারীয় রাষ্ট্র। প্যারি কমিউন। মার্কস বললেন, ওরা স্বর্গে ঝড় তুলেছিল।

ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯) এবং নভেম্বর বিপ্লবের (১৯১৭) মধ্যবর্তী সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংগ্রাম ছিল প্যারি কমিউন। মাত্র ৭২ দিন স্থায়ী হয়েছিল। প্যারিসের শ্রমিকশ্রেণি প্যারি নগরীকে দখল করে নতুন সরকার পরিচালনা শুরু করে দেয়। কিন্তু ৭২ দিন পর শাসকের ভয়ঙ্কর আক্রমণে পতন হয় প্যারি কমিউনের। হাজার হাজার কমিউনার্ডদের রক্তে লাল হয়ে যায় প্যারিসের প্রতিটি রাস্তা। যত্রতত্র পড়ে থাকে কমিউনার্ডদের লাশ।

আজ থেকে দেড়শ’ বছর আগে ১৮৭১-র ২৮মে পতন হয় প্যারি কমিউনের। কিন্তু এ হল সেই ব্যাতিক্রমী সংগ্রাম যা পরাজিত হয়েও বিজয়ী। যেমন স্পার্টাকাসের বিদ্রোহ। দু’ হাজার বছরেরও বেশি আগে বিদ্রোহ করে দাস প্রভুদের হাতে খুন হন স্পার্টাকাস। কিন্তু আজ এত বছর পরেও স্পার্টাকাস আমাদের হৃদয়ে অমর। প্যারি কমিউনও ছিল এমন এক ঘটনা যা পরাজিত হয়েও অপরাজিত। যার শিক্ষাগুলি অপরাজেয়। ভবিষ্যতের সংগ্রামে সার্চ লাইটের মত। যুগ যুগ ধরে আলো দেখিয়েছে। কোন্ পথে গন্তব্য আর কোন্ পথ পরিত্যাজ্য তা শিখিয়ে দিয়েছে। শাসকের বুকে কাঁপন তুলে বুঝিয়ে দিয়েছিলঃ
“পিনাকেতে লাগে টঙ্কার
বসুন্ধরার পঞ্জরতলে, কম্পন জাগে শঙ্কার।”


কমিউন কেন অনন্য

পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম শোষিত জনগণ, শ্রমজীবী মানুষ সংক্ষিপ্ত পরিসরে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করল প্যারি কমিউনের হাত ধরে।

১৮৪৮-র ২১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় মার্কস-এঙ্গেলস রচিত কমিউনিস্ট ইস্তাহার। শোষণহীন সমাজ গড়ার ব্লুপ্রিন্ট। সেই দলিলের প্রথম বাস্তবায়ন প্যারি কমিউন। শ্রমিকশ্রেণির ক্ষমতা দখল। মার্কস- এঙ্গেলসের নেতৃত্বে ১৮৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সংগঠন International Working Men’s Association। যা পরবর্তী পৃথিবীতে প্রথম আন্তর্জাতিক বলে পরিচিত হয়েছে। এই আন্তর্জাতিকের মানস সন্তান প্যারি কমিউন।

শৌর্য-বীর্যের লড়াইয়ের এক অত্যুজ্জ্বল অধ্যায়। দেশ-কাল-জাতি-সীমার ঊর্ধ্বে। শ্রেণির বিরুদ্ধে শ্রেণির লড়াই। শোষণমুক্ত সমাজের পয়লা নজির। মার্কসের কথায়ঃ এই কমিউন হল মূলত শ্রমিকশ্রেণির সরকার। এটা হল আত্মসাৎকারী শ্রেণির বিরুদ্ধে উৎপাদকের শ্রেণি সংগ্রামের পরিণতি।

লেনিন বললেন, কমিউন-এর আদর্শ হলো সমাজ বিপ্লবের আদর্শ। মেহনতি মানুষের সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির আদর্শ। এটা হলো সমগ্র পৃথিবীর সর্বহারাদের আদর্শ এবং এই অর্থে এ হলো অমর।

সেদিন বিচারকের চোখে চোখ রেখে, অকুতভয় দৃপ্তকণ্ঠে কমিউনের মহীয়সী নেত্রী লুইজ মিশেল ঘোষণা করেছিলেন, কমিউনার্ডদের হত্যা করে কমিউনকে ধ্বংস করা যায়না। তিনি বলেন, আমরা মৃত্যুকে ভয় করি না। আমাদের মৃত্যুদণ্ড দাও। তাও আমরা আবারও ফিরে আসবো। আমরা বিপ্লব।

এই উচ্চারণের মধ্য দিয়ে আমরা বুঝতে পারি বিপ্লবের মৃত্যু নেই, বিপ্লবীদের মৃত্যু নেই, তারা অমর। যুগে যুগে, কালে কালে, দেশে দেশে যখনই শাসকের অত্যাচারে দুর্বিষহ হয় মানুষের জীবন তখনই তাদের মুক্তির সংকল্পে বিপ্লবীর জন্ম হয়। দেখা দেয় বিপ্লব।

কমিউনার্ডদের লড়াই দেখে বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পী রেনোয়া যেন বলে ওঠেনঃ ওরা পাগল! বদ্ধ পাগল! কিন্তু কী মহৎ ওদের পাগলামি। ওরা যে মর্ত্যের মাটিতে স্বর্গ রচনা করতে চেয়েছিল!

ফরাসি ঔপন্যাসিক এমিল জোলা কমিউন-এর মধ্যে দেখেছিলেন মনুষ্যত্বের পরম অভিষেক।

কমিউনের প্রেক্ষাপট

ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকেই ইয়োরোপের রাজনীতিতে ফ্রান্সের গুরুত্ব অপরিসীম। ফ্রান্স তার চিন্তা দিয়ে গোটা ইয়োরোপকে ভাবাতে পারত। যে কারণে মেটারনিক বলতেন, If France is sneezing, rest of Europe catches cold.

আর বলার অপেক্ষা রাখেনা ফরাসি বিপ্লবের শিক্ষা মার্কসবাদের অন্যতম উপাদান। তাই মার্কস-এঙ্গেলস বিপ্লবী ফ্রান্সের লড়াই আন্দোলন সম্পর্কে সব সময় বাড়তি মনোনিবেশ করতেন। ১৮৩০ এর জুলাই বিপ্লব, ১৮৪৮-র ফেব্রুয়ারি বিপ্লব কিংবা ১৮৭০-র ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধ, মার্কস-এঙ্গেলস গভীর মনোযোগ সহকারে এগুলিকে লক্ষ্য করেছেন।

১৮৭০ সাল। ফ্রান্সের সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন। ১৮৫২ থেকে ১৮ বছর তার অত্যাচার-নিপীড়নের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত ফ্রান্সের জনগণ। মানুষ মুক্তির পথ খুঁজছে। যার বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটল ১৮৬৯ এ ফ্রান্সের সাধারণ নির্বাচনে। অনেক ছলচাতুরি, কলাকৌশলের পরেও সরকার পক্ষ পেল ৫৫ লক্ষ ভোট আর শত সহস্র হুমকি, চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে রাজতন্ত্রের বিপক্ষে পড়ল ৩০ লক্ষ ভোট। প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম জোরদার হতে লাগল।

এই সময়ে নেপোলিয়ন এক কপট কূটনীতির আশ্রয় নিলেন। তিনি প্রাশিয়ার (জার্মানির অংশ) বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। দিনটা ১৯ জুলাই ১৮৭০। ভাবলেন সামরিক বিজয় দিয়ে তিনি তার হারানো গৌরবকে ফিরিয়ে আনবেন। যুদ্ধজয়ের উন্মত্ততায় তছনছ করে দেবেন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সমস্ত প্রচেষ্টা। ধ্বংস করবেন শ্রমিক ঐক্য।

এদিকে প্রাশিয়ার কর্ণধার বিসমার্কও বুঝেছিলেন জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হলে ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধ অনিবার্য। কারণ জার্মানির দক্ষিণাংশ ছিল নেপোলিয়ানের অনুগামী। কুশলী বিসমার্ক বুঝেছিলেন নেপোলিয়ন প্রাশিয়া আক্রমণ করলে জার্মান জাতীয়তাবোধ ও দেশাত্মবোধের আওয়াজ তুলে সমস্ত জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করা যাবে। আর দক্ষিণ জার্মানিকেও বোঝানো যাবে ফ্রান্স তাদের দেশ দখল করতে চায়। এর মধ্য দিয়ে ফ্রান্সের আনুগত্য থেকে তাদের টেনে আনা যাবে। বিসমার্কের এই চালেই পয়লা সেপ্টেম্বর ১৮৭০ সেডানের যুদ্ধে পরাজিত হন নেপোলিয়ান। ৪ঠা সেপ্টেম্বর প্যারিসে ঘোষিত হয় প্রজাতন্ত্র। বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হলো National Defence Government বা জাতীয় প্রতিরক্ষা সরকার।

একদিকে যখন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে তখনই উচ্চাকাঙ্ক্ষী চক্রের পান্ডারা মিলিত হলো Hôtel de Ville-তে। তাদের নেতা ঘোষিত হলো তিয়ের (Thiers) আর জেনারেল হলেন ত্রশু (Trochu)।

এই তিয়েরের নেতৃত্বেই কালক্রমে “জাতীয় প্রতিরক্ষার সরকার” পরিণত হয়েছিল “জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতার সরকার”এ।

ফ্রান্সের প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে মার্কসের মন্তব্যটি অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। তিনি বললেন, ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্রের আবির্ভাবকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। কিন্তু সেইসঙ্গে আমাদের মনে কিছু সংশয়ও আছে। আমরা খুশি হব আমাদের আশঙ্কা ভুল প্রমাণ হলে। আমাদের ভাবনার কারণ এই প্রজাতন্ত্র রাজসিংহাসনের মূলোৎপাটন করেনি তার শূণ্যস্থানে গিয়ে বসেছে মাত্র।

এই প্রজাতন্ত্র সম্পর্কে মার্কসের মূল্যায়ন ছিল ষোলআনা খাঁটি। সত্যি সত্যিই দেখা গেল এই প্রজাতন্ত্র প্রজাদের স্বার্থে আদৌ কোনও মনোযোগ দিতে পারেনি।

Vive la Commune!

এই সময় ফ্রান্সের একের পর এক শহরকে দখল করছে প্রাশিয়া। তখন প্যারিসের শ্রমিকশ্রেণি সিদ্ধান্ত নেয় তাদের সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দেবে প্রাশিয় সেনাদের। রক্ষা করবে নিজেদের পিতৃভূমিকে। রক্ষা করবে প্যারিসকে। এই সংকল্পে শুরু হয় লড়াই। তারা ফিরিয়ে দেয় জার্মান সেনাদের। এই লড়াই লড়তে লড়তে আসে ১৮৭১-র ১৮ ই মার্চ। সেদিন সকাল হতে না হতেই প্যারিসের শ্রমিক শ্রেণি Vive la Commune! অর্থাৎ ‘কমিউন দীর্ঘজীবী হোক’ এই স্লোগানে মুখরিত করে প্যারিসের আকাশ বাতাস। শাসকের পুলিশ আর বুর্জোয়াদের সৈনিকদের পিছু হটতে বাধ্য করে অভ্যুত্থানকারী জনগণ। নেতৃত্বে প্যারিসের শ্রমিকশ্রেণি। যাদের কেন্দ্রীয় কমিটির নাম National Guard বা জাতীয়রক্ষী বাহিনী। এরা দখল নেয় প্যারি নগরীর। তাড়া খাওয়া শাসকেরা পালিয়ে যায় ভার্সেইয়ে। শ্রমজীবী মানুষের এই অভ্যুত্থানের দশ দিন পর ২৮ শে মার্চ ঘোষিত হয় প্যারি কমিউন। পৃথিবীর প্রথম প্রলেতারীয় রাষ্ট্র।

নতুন সমাজ, নতুন ব্যবস্থা

এ এক নতুন ধরনের ব্যবস্থা। মূলত শ্রমজীবী জনগণের দ্বারা পরিচালিত। শ্রমিকশ্রেণি তথা জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ এক সরকার। যে সরকার শ্রমিকের কথা বলল। যে সরকার মানুষের রুটি-রুজির কথা বলল। যে সরকার কর্মচারীদের বেতনের বৈষম্য দূর করল। যে সরকার নারীর শিক্ষা আর অধিকারের কথা বলল। যে সরকার রাষ্ট্রপরিচালনায় ধর্মীয় আগলকে মুক্ত করে দিল। মুক্ত করল বিজ্ঞানকে। নিষিদ্ধ হল জুয়া। কমে গেল অপরাধ।

কমিউনের মতাদর্শ

১৮ মার্চ অভ্যুত্থানের প্রথম দিকে প্যারিসের শ্রমিকরা প্রভাবিত ছিল ব্ল্যাঙ্কি ও প্রুঁধোর দ্বারা। কিন্তু যত দিন এগিয়েছে তারা যেন তাদের ভাবনার কথাগুলো খুঁজে পাচ্ছিল মার্কস-এঙ্গেলসের বক্তব্যের মধ্যে। সেই ভাবনার প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় কমিউনের কর্মসূচিতে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই সংগ্রামের শ্রমজীবী মানুষদের অধিকাংশই ছিলেন অসংগঠিত শ্রমিক। আর এই সংগ্রামে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছেন মহিলা শ্রমিকরা। পূর্বোক্ত লুইজ মিশেলের ন্যায় অসংখ্য মিশেল ঘুম কেড়ে নিয়েছিল শাসকশ্রেণির। এমনকি বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়েও তারা শাসকদের পোষা বন্দুকধারী দানবদের জানিয়ে দিয়েছেঃ হাঁটু গেড়ে বসব না।

অবশেষে ব্যর্থ

এত কিছুর পরেও ব্যর্থ হলো প্যারি কমিউন।

১৮৭১-র ২৮মে জার্মান ও ফরাসি সেনা, যারা এতদিন পরস্পরের প্রতি সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল তারা সম্মিলিতভাবে এক হয়ে আক্রমণ করল কমিউনকে। কমিউনার্ডদের রক্তে হোলি খেলা হলো। হাজারে হাজারে কমিউনার্ডদের প্রাণের বিনিময়ে পতন হল প্যারি কমিউনের।

একথা ঠিক প্যারিসের শ্রমিকদের মার্কস বারবার সতর্ক করেছিলেন উপযুক্ত সময় আসেনি বলে। কিন্তু শ্রমিকশ্রেণি যখন ঝাঁপিয়ে পড়েছে মার্কস-এঙ্গেলস তখন সর্বতোভাবে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কমিউনের পতনের পর বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেওয়া কমিউনার্ডদের সাহায্যের জন্য মার্কস- এঙ্গেলস নতুন অভিযানে নেমে ছিলেন। আর বুকের মধ্যে যন্ত্রণাকে চেপে রেখে এর ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। কমিউনিস্ট ইস্তাহারের ১৮৭২ সালের জার্মান সংস্করণের ভূমিকায় আজও তা জ্বলজ্বল করছে। তারা বললেন, কমিউন শিক্ষা দিল শ্রমিকশ্রেণির শুধু রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলেই চলবে না। তাকে রক্ষা করে তাদের শ্রেণির স্বার্থে ব্যবহারের দক্ষতা অর্জন করতে হবে। অর্থাৎ প্যারি কমিউন আমাদের শেখালোঃ লড়াই করে পেয়েছি যা লড়াই করে রাখব তা।

ব্যর্থতার কারণ

কমিউন ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর অনুপস্থিতি। বরং শাসকেরা কৃষকদের ব্যবহার করেছিল শ্রমিকদের বিরুদ্ধে।

ছিল না আদর্শে বলীয়ান বিপ্লবী পার্টি। প্যারি কমিউন আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে সমগ্র পৃথিবীকে শিখিয়ে গেল বিপ্লবী পার্টি ছাড়া বিপ্লবী সংগ্রাম সফল হতে পারে না।

আর একটা বড়ো কারণ বিপ্লবীদের ঔদার্য।

কমিউনার্ডদের তাড়া খেয়ে বেইমান তিয়েররা যখন ভার্সেইয়ে পালিয়ে গেল তখন তারা পালাতে দিয়েছে।

তিয়েররা যখন ভার্সেইকে বুর্জোয়াদের রাজধানী বানালো তখনও তারা কিছু বলেনি।

ব্যাঙ্ককে তারা অধিগ্রহণ করেনি। ফলে এই ব্যাঙ্কের টাকা নিয়ে, সৈন্য সামন্ত জড়ো করে, প্রাশিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারা কমিউনকে আক্রমণ করে।

ফ্রান্সের শাসকও বোঝে লাল ঝান্ডা তাদের শত্রু আর প্রাশিয়ার শাসকও বোঝে লাল ঝান্ডা তাদের শত্রু। তাই শ্রেণি স্বার্থে নিজেদের বিবাদ দূরে সরিয়ে রেখে শ্রমিকশ্রেণিকে আক্রমণ করতে তাদের দু’বার ভাবতে হয়নি।

অবশ্য মার্কস এটাও লক্ষ্য করেছিলেন, যখন সরকারি ফ্রান্স ও সরকারি জার্মানি ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত ঠিক তখনই ফ্রান্স ও জার্মানির শ্রমিকরা একে অপরকে শান্তি ও শুভেচ্ছার বাণী পাঠাচ্ছে।

কমিউনের শিক্ষা

কেন এই পরাজিত বিপ্লবকে আজও স্মরণ করছি আমরা?

লেনিন আমাদের দুটি কথা শিখিয়ে দিলেন -
এক) কমিউন ইয়োরোপীয় প্রলেতারিয়েতকে শিখিয়েছে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্তব্যগুলি যথাযথভাবে উপস্থিত করতে।
দুই) প্যারিসে কামানের বজ্রনির্ঘোষ প্রলেতারিয়েতের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অংশগুলিকেও গভীর নিদ্রা থেকে জাগিয়ে তুলেছিল।

আর একই সঙ্গে বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক প্রচারকে বাড়াতে উদ্দীপনা যুগিয়েছিল।

নভেম্বর বিপ্লবের প্রতিটি পদক্ষেপে প্যারি কমিউনের শিক্ষা লেনিনকে আলো দেখিয়েছে। কমিউন ভীষণভাবে লেনিনকে প্রভাবিত করেছিল। তিনি প্রতি পদে চেষ্টা করেছেন কমিউনের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিতে। তাই বিপ্লবের কাজে প্রথমেই টেনে এনেছেন শ্রমিকশ্রেণির সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু কৃষক সমাজকে। গড়ে তুলেছেন মতাদর্শে শাণিত, ইস্পাতসম মজবুত বিপ্লবী পার্টি। সতর্ক থেকেছেন শাসকের শ্রেণিচরিত্র সম্পর্কে। সজাগ দৃষ্টি রেখেছেন ছদ্মবেশে থাকা বিপ্লবের শত্রুদের প্রতি।

সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাষ্ট্র যখন ৭২ দিন অতিক্রম করলো তখন লেনিন বললেন, এটাই হলো এক ঐতিহাসিক ঘটনা। আমরা এখন ‘কমিউন প্লাস ওয়ান’ যুগে পদার্পণ করেছি। অর্থাৎ প্যারি কমিউন হলো বিপ্লবী আন্দোলনের একটা প্যারামিটার।

প্যারি কমিউন আমাদের পথ দেখায়। অন্ধকার রাস্তায় সার্চ লাইটের মতো আলো ফেলে। আর শিক্ষা দেয় পরাজয় শেষ কথা বলে না। পরাজয়ের মধ্যেই ঘুমিয়ে থাকে আগামী বিজয়ের সম্ভাবনার মহিরুহ।