৫৯ বর্ষ ২৯ সংখ্যা / ৪ মার্চ, ২০২২ / ১৯ ফাল্গুন, ১৪২৮
ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে আনিস খান খুনের ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত
চক্রান্তে জড়িত পুলিশ প্রশাসন
আনিস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ২৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় বামফ্রন্টের মিছিল।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ আনিস খান খুনের ঘটনা রাজ্যের পুলিশ প্রশাসন দ্বারা পরিকল্পিত, বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। এমনটাই মনে করছেন রাজ্যের মানুষ। এই চক্রান্তে জড়িত প্রশাসনের উঁচুতলা - ঘটনা পরম্পরার প্রেক্ষিতে মত ওয়াকিবহাল মহলের। আর প্রশাসনের এই নেতিবাচক ভূমিকার যাবতীয় চিহ্ন মুছতে বেআইনি পদক্ষেপ করতেও পিছপা হচ্ছে না পুলিশমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির দপ্তর। কিন্তু রাজ্যের সাধারণ মানুষ সজাগ থেকে বানচাল করে দিচ্ছেন পুলিশের এই অপচেষ্টা। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যের বামফ্রন্ট নেতৃত্ব আনিস খানের বাড়িতে সন্তান হারানো পিতা সালেম খানের সঙ্গে দেখা করে জানিয়েছেন, ন্যায় বিচারের দাবিতে তার পরিবারের লড়াইয়ের পাশেই রয়েছেন তাঁরা। অন্যদিকে রাজ্যজুড়ে চলা বিক্ষোভ আন্দোলনের মাঝেই প্রমাণ লোপ করতে তৎপর পুলিশ ২৬ তারিখ ভোরবেলায় পারিবারিক সম্মতি ছাড়াই কবর থেকে দেহ তুলে নিতে গেলে গ্রামবাসীরা তা রুখে দেয়। প্রতিরোধের মুখে পিছু হঠে পুলিশ।
পুলিশি অপচেষ্টার আরও প্রমাণ পাওয়া যায় ২৮ ফেব্রুয়ারি। ওই দিন দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্তের জন্য আনিস খানের দেহ কবর থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় এসএসকেএম হাসপাতালে। সেখানেও আইন ভঙ্গের অভিযোগ উঠেছে। কারণ ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তরফে এক নির্দেশে জানানো হয়েছিল, দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্তের ক্ষেত্রে তিন সদস্যের বোর্ড গঠন করতে হবে। যেখানে ওই সদস্যরা তিনটি ভিন্ন মেডিকেল কলেজের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হবেন। কিন্তু জানা গেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নির্দেশ অমান্য করেই আনিসের দ্বিতীয় ময়না তদন্তে ওই দলে একই হাসপাতালের (এসএসকেএম) তিন জন সদস্য ছিলেন। সরকারের এই কাণ্ড কারখানার প্রেক্ষিতে আনিস খানের দাদা সাবির খান আবারও বলেছেন, প্রতি পদক্ষেপে স্পষ্ট নিরপেক্ষ তদন্ত করতে পারবে না সিট। আমরা তাই এখনও সিবিআই তদন্তই চাইছি।
২৫ ফেব্রুয়ারি বিমান বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্টের প্রতিনিধিদল আমতায় সারদা গ্রামের দক্ষিণ খান পাড়ায় বিকেলে যান আনিসের শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সান্তনা দিতে এবং তাদের পাশে থাকার বার্তা দিতে। সালেম খান’কে বিমান বসু বলেন, আনিস আর ফিরবে না এটা ঠিক। কিন্তু আজ হাজার হাজার আনিস রাস্তায় নেমেছে। সর্বশক্তি দিয়ে ন্যায় বিচারের জন্য লড়ছে। এই লড়াইতে আমরা আছি আপনার পাশে।
পাড়ার ছেলে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আনিস খুনের ঘটনা এবং তারপর সরকারের মতিগতিতে ক্ষুব্ধ গ্রামের মানুষ বামফ্রন্ট নেতৃবৃন্দকে বলেন, এই খুনের ন্যায়বিচার চান তারা। আনিসের বাবা নেতৃবৃন্দকে বলেন আমিও এই লড়াইতে আছি। যতক্ষণ না প্রকৃত দোষীরা শাস্তি পাবে আমি লড়ে যাব। আপনারাও থাকুন সঙ্গে। ওরা চাইলেও আমরা বিক্রি হবো না।
পরে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু সাংবাদিকদের বলেন, একজন ছাত্রকে খুন করা হলো মানে দেশের ভবিষ্যতের সম্পদকে হত্যা করা হলো। সেই কাজ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় শাসকদলের চক্রান্তের পরিণতিতে ঘটলো। গোটা ঘটনা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে দেখতে হবে। এটা সরকার ও শাসকদলের চক্রান্ত কিনা তা খুঁজে বার করতে হবে।
সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র আনিসের পরিবারের সদস্যদের বলেন, আমরা সবাই আছি। আমরা কলকাতার রাস্তায় প্রতিবাদে থাকবো। দোষীদের শাস্তির দাবিতে লড়াই চালিয়ে যাব।
বামফ্রন্টের প্রতিনিধি দলে বিমান বসু, সূর্য মিশ্র ছাড়াও ছিলেন সিপিআই(এম) নেতা রবীন দেব, দীপক দাশগুপ্ত, সিপিআই’র রাজ্য সম্পাদক স্বপন ব্যানার্জি, আরএসপি’র সাধারণ সম্পাদক মনোজ ভট্টাচার্য, ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা হাফিজ আলম সইরানি, আরসিপিআই নেতা মিহির বাইন প্রমুখ।
২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র’র নেতৃত্বে আনিস খানের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গ্রামে আসে আক্রান্ত আমরা’র প্রতিনিধি দল। নিহত বরুণ বিশ্বাসের দিদি প্রমিলা রায় বিশ্বাস, বালিতে নিহত তপন দত্তের স্ত্রী প্রতিমা দত্ত, নিহত মিতা দাস মণ্ডলের দাদা খোকন দাস প্রমুখ এই প্রতিনিধি দলে ছিলেন। তাঁরাও আনিস খানের পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন।
এদিকে আদালতের নির্দেশ মেনে আগেই ২৮ ফেব্রুয়ারি আনিস খানের দেহ কবর থেকে তুলে দ্বিতীয়বার ময়না তদন্ত করার ব্যাপারে সায় দিয়েছিল আনিসের পরিবার। কিন্তু ২৬ ফেব্রুয়ারি ভোররাতে মমতা ব্যানার্জির পুলিশ প্রশাসন দেহ কবর থেকে তুলে আনতে পৌঁছে যায় আমতার দক্ষিণ খান পাড়া গ্রামে। পুলিশ বিশাল বাহিনী নিয়ে এলেও ভোররাতে ঐক্যবদ্ধ গ্রামবাসী ওই সশস্ত্র বাহিনীর সামনে রুখে দাঁড়িয়ে পড়ে। তাদের বক্তব্য, ভোররাতে চোরের মতো পুলিশ ঢুকলো কেন গ্রামে? পুলিশ কি লাশ পাচার করতে এসেছে?
তখন গ্রামবাসীদের লড়াকু প্রতিরোধের মুখে পিছিয়ে যায় পুলিশ বাহিনী। পুলিশের এই আস্বাভাবিক দ্রুততার প্রেক্ষিতে গ্রামের মানুষের মুখে মুখে আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে যে, পুলিশ তদন্ত ধামাচাপা দিতে চায়। কারণ আনিস খানের বাবা লিখিতভাবে সিটের আধিকারিকদের জানিয়েছিলেন, তিনি অসুস্থ। সোমবার নাগাদ একটু সুস্থ হলে পুলিশকে তিনি কবর থেকে দেহ তোলার কাজে সাহায্য করবেন।
পুলিশ সেই লিখিত বক্তব্য গ্রহণ করেছিল। তবে বাধার মুখে নিজেদের দোষ ঢাকতে পুলিশের বক্তব্য, ময়নাতদন্তের জন্য আদালতের নির্দেশকে বাধা দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে এই জোর-জবরদস্তির জন্য গ্রামের মানুষের বক্তব্য, তাঁরা এই পুলিশের তদন্তে ভরসা রাখতে পারছেন না।
এই খুনের ঘটনায় অন্যান্য নানা অসঙ্গতির প্রেক্ষিতে বারবার সামনে আসছে শাসক অনুগত গ্রামীণ পুলিশ সুপারের নাম।আমতার পুলিশ সুপার সৌম্য রায় ঘটনার পরেই বলেছিলেন, সেদিন রাতে আনিস খানের বাড়িতে পুলিশ যায়নি। তারপর আনিসের বিরুদ্ধে কী কী ‘অভিযোগ’ আছে তাও তুলে ধরেছিলেন। মামলা থাকলেও গভীর রাতে তথাকথিত অভিযুক্ত ছাত্রের বাড়িতে গিয়ে তাকে মারধর করা এবং পরিবারের সদস্যদের বন্দুকের নলের সামনে দাঁড় করিয়ে হুমকি দেওয়া যায় কিনা প্রশ্ন উঠছে তা নিয়ে।
আরও প্রশ্ন উঠেছে ১৯ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় টিএমসি বিধায়ক সুকান্ত পালের ভূমিকা নিয়েও। কারণ তৃণমূলের এই জমানায় পাশের গ্রামে পুলিশি অ্যাকশন হচ্ছে তা ঘাসফুলের বিধায়ককে না জানিয়ে, এটা মানছেন না আনিসের গ্রামের কেউই। মমতার এই বিধায়কের ঘনিষ্ঠ সিভিক ভল্যান্টিয়ার তৃণমূল কর্মী প্রীতম ভট্টাচার্য গ্রেফতার হবার পরেই অবশ্য সাংবাদিকদের সামনে বলেছেন আমাদের বলির পাঁঠা করা হচ্ছে। ওসির অর্ডার ক্যারি করেছিলাম আমরা। আর অন্য অভিযুক্ত হোমগার্ড কাশীনাথ বেরার স্ত্রীর বক্তব্য তার স্বামীকে ফাঁসানো হচ্ছে। কারণ নিজের ইচ্ছেয় তো কেউ ডিউটি করে না। তাই আনিসের পাশের গ্রামে থাকা তৃণমূল বিধায়ক এবং পঞ্চায়েত প্রধানও সন্দেহের তালিকায় রয়েছে। মানুষ দাবি করছেন বিধায়ক, এসপি, আমতা থানার ওসি, কুশবেড়িয়ার পঞ্চায়েত প্রধান, এঁরা সবাই যুক্ত খুনের চক্রান্তে। এদের সবাইকে গ্রেফতার করা হোক। আর খুঁজে বার করা হোক এদের মাথা কে।